বড়দের গল্প | নিষিদ্ধ ঘর সংসার (পর্ব ২) | Boroder Golpo

Samaresh Halder
20 Min Read

নিষিদ্ধ ঘর সংসার (পর্ব ২, শেষ)

আন্তর্জাতিক সময় অনুসারে নতুন একটি তারিখের শুরু হবে ৩ ঘন্টা পরে। এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাস নিয়ে স্বামীর হাত ধরে ভিতরে ঢুকে গেলো শর্মিলা।

আগের পর্ব পড়ুন

সেদিকে তাকিয়ে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো সুনীলের। মনে হচ্ছিলো কে যেন খুবলে খুবলে খাচ্ছে কলিজাটিকে। তারপরও হাসিমুখে তার সবকিছু মেনে নিতে হলো।

বড়দের গল্প

কিছুক্ষণ মিথ্যে অভিনয় করে আনমনা হয়ে সুনীল ভাবছিলো, “শর্মিলাকে মিথ্যে অভিনয় করে যেতে হবে। রাতে একজনের শরীরের ছোঁয়া পেয়ে অভিনয় করতে হবে সুখী হওয়ার, যেখানে কেউ জানবেওনা প্রতিটা ছোঁয়াই অনিচ্ছায়, প্রতিটি ছোঁয়াই ধর্ষণ। আর আমি দূর থেকে শুনে যাবো, কিছু করতে পারছিনা, পারবোওনা। নিজের মতো করে ভীড়ে মিশে গিয়ে সবকিছু আপনমনে করতে থাকবো।”

ভাবতে ভাবতে সুনীল পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখলো কাঁচ দিয়ে ঘেরা ঘরের বাহির দাঁড়িয়ে অঝোরে কাঁদছে শর্মিলার মা ও বাবা। আর শর্মিলা কান্না চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। সম্ভবত, শেষবারের মতো শর্মিলা বাবা-মায়ের সাথে দেখা করার জন্যে ফিরে আসতে গিয়েছিলো, ঠিক তখনই সুনীল শুনতে পেলো শর্মিলার স্বামীর মুখে “স্টুপিড বাঙালিস, অ্যান্ড দেয়ার ফাকিং ইমোশনস”। কথাটি বলা মাত্র হেঁচকা টানে সামনের দিকে টেনে নিয়ে গেলো শর্মিলার তথাকথিত স্বামী। দৃশ্যটা এতোই দৃষ্টিকটু ছিলো যে, দেখে সুনীলের মনে হয়েছিলো বাংলা সিনেমার কোন বাবা তার মেয়ের গরীব ঘরের ছেলের সাথে প্রেমের কাহিনী শুনে মেয়েকে বললো “তুই চৌধুরী বংশের মেয়ে হয়ে চাকরের সাথে প্রেম করিস; তারপর মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে যেয়ে ঘরে বন্দী করে দিলো।

বড়দের রোমান্টিক গল্প

Loading...

সেই দৃশ্যটি দেখে শর্মিলার বাবা-মায়ের বুঝতে বাকী রইলোনা, কোথায় আত্নীয়তা করা হয়েছে। বার্ধক্যের সূচনার দিকে এগিয়ে যাওয়া দু’জন মানুষ তখন তাদের কৃতকর্মের জন্য খুব বেশি অনুতপ্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু, এখন আর তাদের কিছু করার নেই। তাদের অসহায় অবস্থা দেখে সুনীল এগিয়ে গেলো। দু’তিনটে সান্ত্বনা বাক্য বলে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করলো।

শর্মিলার মা-বাবা চুপ করে বসে রইলো এয়ারপোর্টের ভিজিটিং রুমে। আর সুনীল বেরিয়ে আসলো পার্কিং এর দিকে। ঘড়ির কাটায় সময় এখন বরাবর ১২ টা। অান্তর্জাতিক তারিখ অনুসারে নতুন একটি দিনের শুরু হলো। ঠিক তখনই সুনীলের মোবাইলে মেসেজ আসলো। দুঃখবোধের কারণে সুনীলের কোন হুস ছিলোনা। তাই, মেসেজ চেক করা হয়নি।

সুনীল প্যাকেট থেকে বের করে একটি সিগারেট ধরালো। ঠিক তখনই মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো লন্ডনগামী বিমানটি। সাথে উড়িয়ে নিলো শর্মিলাকে। চোখের কোণ থেকে বেরিয়ে আসা জল ভিজিয়ে দিলো সুনীলের ঠোঁটে থাকা সিগারেটের ফিল্টারটিকে। সুনীল সেই সিগারেটটিকে ছুড়ে ফেলে দিলো। হাত দিয়ে মুছে গোপন করার চেষ্টা করলো চোখের জলগুলিকে। তারপর, সময় দেখার জন্য মোবাইল বের করলো। মোবাইলের স্ক্রিণে ভেসে উঠলো শর্মিলার মেসেজ।

“শুভ জন্মদিন সুনীল। তোমার কয়েক বছরের জন্য নতুন জন্ম হলো আজ থেকে। সেই জন্মে আমি স্বশরীরে উপস্থিত থাকবোনা। এই স্বশরীরে অনুপস্থিতির সময়গুলোতে নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নাও, আমিও গুছিয়ে নিই আমাকে। তারপর, আমরা আমাদের ছোট্ট সংসার গড়ে তুলবো। সেই সংসার যেখানে থাকবেনা কোন অভিনয়, থাকবেনা কোন নিয়মের মাঝে আটকে থেকে মনের বিরুদ্ধে পথচলা।

ভালো থেকো সুনীল। নিজের মতো করে জীবন কাটাও। যা মনে আসে করো। তারপর, আমি আসলে ফিরে এসো। সকল প্রকার বাঁধন থেকে আপাতত কয়েক বছরের জন্য মুক্ত তুমি।”

মেসেজটির দিকে তাকিয়ে চোখ থেকে বাঁধভাঙা জল বেরিয়ে এলো। সুনীল ভেজা চোখে লিখলো, “ভালো থেকে ভালো রেখো আমায়। মুক্ততা শেষে পাখি ধরা দিবে তোমারই খাঁচায়। ভালো রেখো নিজেকে আগত সেই দিনগুলির কথা ভেবে।”
মেসেজটি লিখে পাঠালেও ডেলিভার হলোনা। হয়তো, আর কোনদিনই ডেলিভার হবেনা সেই মেসেজটি।


সম্পর্কে অধিকারবোধটা যেমন প্রয়োজনীয়, তেমনই প্রয়োজন সেটাকে নিয়ন্ত্রন করা। নিয়ন্ত্রনহীন অধিকারবোধ যেমন প্রিয় মানুষটির একসাথে থাকার অভিপ্রায় কে নষ্ট করে দেয়, তাকে বারবার অস্তিত্বহীন বলে অনুভব করায়; ঠিক তেমনি অধিকারবোধ না থাকলে প্রিয় মানুষটি নিজেকে অপর মানুষটির জীবনে মূল্যহীন বলে মনে করে। তাই, সম্পর্কে অধিকারবোধটা নিয়ন্ত্রনের মধ্যে রাখতে হয়, যেন তা খুব বেশিও না হয় আবার কমও যেনো না হয়।

কিন্তু এই নিয়ন্ত্রন কিছুদিন পাওয়ার পর যখন ছেড়ে দিতে হয়, তখন কেমন লাগে? যদি একজন চায় অপরজন ছেড়ে দিক, তাহলে এক কথা। কিন্তু, যখন দু’জনেই চায়না, তারপরও ছাড়তে হয়- তখন?

এইরকম এক পরিস্থিতির শিকার সুনীল। প্রিয় মানুষটির উপর অন্য কারো অধিকার, প্রিয় মানুষটির জোর করে তা মেনে নিতে হচ্ছে, পাশাপাশি সে’ও কিছু করতে পারছেনা! জীবনে এরকম অসহায় অবস্থায় আর কখনো পড়েনি সুনীল।

শরীরের গল্প

তার উপর দারিদ্রতার আঘাতে জর্জরিত। প্রকৌশলীবিদ্যা শেষ করার বদলে সাহিত্যের জগতে আগমন। ফলাফল, নিজের পরিবারের নিশ্চিত জীবন থেকে বিতারিত। প্রতিদিনের থাকা খাওয়ার খরচ চালানোটাই দায় হয়ে পড়লো।

অনেক ধরাধরি করে একটি অনলাইন পোর্টালে লেখালেখির কাজ, আর টিউশন। নিজের পড়ালেখার খরচ আর জীবন চলানো যায় মতো অবস্থা।

সবমিলিয়ে জীবন পুরো অগোছালো হয়ে উঠেছিলো সুনীলের। তারউপর শর্মিলার কেন খোঁজ নেই কিছুদিন ধরে। অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি সুনীল। সবমিলিয়ে বিষাদ রাগিনী বাজছিলো সুনীলের চারপাশে।

যোগাযোগহীনতার হাহাকার আর জীবন যুদ্ধ করতে করতে কেটে গেলো একটি বছর। তারপর, একদিন সুনীল হাতে পেলো শর্মিলার চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিলোঃ

ভালোবাসার সুনীল,
লন্ডনে আসার পর আমার জীবন অনেকটাই বদলে গেছে। বাবা-মায়ের আদুরে সন্তান থেকে পরিণত হয়েছি ঘরের ঝিঁ তে। ঘরের প্রায় সবকাজই আমাকে করতে হয়। সেটা তাও মেনে নিলাম। কিন্তু, আমার প্রতিটি পদে পদে দোষ। সব কাজ করে দেওয়ার পরও গ্লাস কেনো এগিয়ে দিইনি, খাবার কেনো তুলে দিইনি- এগুলো নিয়ে বিচার গিয়েছে আমার পরিবারের কাছে। আমি জানি, মা-বাবা খুব কষ্ট পেয়েছে আমার অবস্থা জেনে। কিন্তু, জানো আমার না কিচ্ছু করার নেই।

এই উন্নত দেশে এসেও আমার নিজের কোন মোবাইল নেই। কেন নেই জানো? আমি যদি অন্য কারো সাথে যোগাযোগ করি, অন্য কারো প্রেমে পড়ে যাই যদি- তাই। এজন্য তোমার সাথেও আমার যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

পড়ালেখাটাও শুরু হয়নি। তবে, অনেক বুঝিয়ে শুরু করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি। বাকীটা সময়ের উপর ছেড়ে দেওয়া যাক।

আর, যেই ভদ্রলোককে স্বামী হিসেবে জেনে এসেছি তিনি দেশে বিয়ে করে রেখেছিলেন। তার একটি সন্তানও আছে। কিন্তু, তার পারিবারিক সম্মানের সাথে সমতায় আসেনি বলে তাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে নারাজ। পাশাপাশি প্রচুর মদ্যপানের অভ্যেস আছে তার। মদ্যপানের পাশাপাশি নারী আসক্তি নেহাৎ কম নয়।

যাই হোক, আমাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আর, চিঠিতে আমাদের আলাপ হবে।

তুমি নিজেকে ভালো রেখো। আর, তোমার বর্তমান পরিস্থিতি জানিয়ে পত্র লিখতে ভুলে যেয়োনা।

ইতি,
শর্মিলা।

চিঠিটি বেশ কয়েকবার পড়লো সুনীল। চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে চিঠিটিকে ভিজিয়ে দিলো। সেদিকে খেয়াল হতেই চিঠির উপরের জল মুছে খামে ভরে রেখে দিলো বা’পাশের বুক পকেটে।

আরো পড়ুন,

প্রাপ্তমনস্কদের গল্প

হঠাৎ বুক পকেটে থাকা চিঠির কথা মনে হতেই সুনীলের মনে হলো, বা’পাশের বুক পকেট থেকে হয়তো চিঠিটা স্থানান্তরিত হবে অন্যকোন স্থানে, কিন্তু বুকের বা’পাশের হৃদয়ে যে স্থানটি জুড়ে আছে শর্মিলা- তা কেউ কখনো স্থানান্তরিত করতে পারবেনা।


বস্তির মেয়ে নিয়ে এসেছি আমাদের বংশে। এতো পুরো বংশের মান ডুবাবে। আজ থেকে তোর ঘরের বাহিরে যাওয়া নিষেধ রাক্ষুসি।

শ্বাশুড়ীর মুখ থেকে কথাগুলো শুনে মুখ হাত দিয়ে ঢেকে ফেললো শর্মিলা। চোখের বাঁধ ভেঙে জল বেরিয়ে আসতে চাইছে, কোনমতে সেটাকে সে আটকানোর চেষ্টা করছে। বারবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কোনমতেই তার কাঁদলে চলবেনা, তাকে শক্ত হতে হবে।

শ্বাশুড়ীর গালাগাল বাড়তে বাড়তে যখন আর কানে নেওয়া যাচ্ছিলোনা, তখন শর্মিলা ঢুকে গেলো তার রুমে। রুমে এসে কাঁদতে লাগলো। শতচেষ্টা করেও সে সেই কান্নাকে থামাতে পারছিলোনা।

বারবার তার মনে হচ্ছিলো, কি ছিলো আমার অপরাধ? পড়ালেখার পাশাপাশি একটি চাকুরী করতে চেয়েছি- তাতেই এই অপরাধ?

এভাবে উঠতে বসতে কথা শুনতে শুনতে শর্মিলা মানসিকভাবে এতোটাই ভেঙে পড়েছিলো যে আত্নহননকেই বেছে নিলো মুক্তির উপায় হিসেবে।

তারপর, সিদ্ধান্তের যেদিন চূড়ান্তরূপ দিতে যাচ্ছিলো সেদিনই হাতে পেলো একটি চিঠি। বুকের ভেতরে লুকিয়ে রেখে গভীর এক আনন্দ কৌতুহল নিয়ে সে ঢুকে গেলো নিজের রুমে। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে এক পাঁ দু পাঁ করে খাটের দিকে এগিয়ে গেলো। তারপর, চিঠিটি বের করে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলো। এরপর, চিঠিটি পড়া শুরু করলো।

প্রিয়,
আশা করি ভালো আছো, আমিও ভালো আছি – এসব মিথ্যে কথার জঞ্জাল দিয়ে মিথ্যে স্বান্তনা নিতেও চাইনা, দিতেও চাইনা। আমি তোমাকে ছেড়ে ভালো নেই। জানি, তুমিও ভালো নেই।

জীবন চলছে। টুকটাক কাজ করে জীবন চলে যাচ্ছে। বাকীটা সময়ও এভাবে কেটে যাবে। তুমিও সব সামলে নিও। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যেয়ো।

জানো সেদিন একটা লেখা পড়েছিলাম। লেখাটা এতোটাই মনে গেঁথে গেলো যে এই চিঠিটা লেখার আগে কবিতা লিখতে বসলাম সেখানে চলে এলো। হয়তো, কিছু লেখার শক্তিটাই এরকম হয়।

যাই হোক, কবিতাটি-

কাছে আসার জন্য তোমায় দূরে ঠেলে দিলাম,
তুমি দূরে গিয়ে কাছে এসো আবার,
ঠিক ততটা কাছে, যতটা কাছে এলে
আর কাছে আসা যায়না।

তবে, এতোটা দূরে সরে যেয়োনা যেন-
সে দূরত্ব থেকে আর ফিরে আসা যায়না,
ভুলে যাওয়া যায়….

কবিতা পড়ে অনুভূতিটি সাদা কাগজে লিপিবদ্ধ করে খামে মুড়ে পাঠিয়ে দিও পৃথিবীর পশ্চিম থেকে পূর্ব প্রান্তে। ভালোবাসি। নিজেকে ভালো রেখে ভালো রেখো আমায়।

ইতি,
সুনীল।

চিঠিটা বুকে গুঁজে টেবিলের ড্রয়ারের ভেতরে রাখা ঔষধগুলি বের করলো শর্মিলা। তারপর, জানালা দিয়ে ফেলে দিলো বাহিরে।

পৃথিবীর পূর্বপ্রান্তে বুকের ভেতর অসীম ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষায় আছে কেউ একজন। সেই একজনের কাছে ফেরার জন্যে হলেও শর্মিলাকে বেঁচে থাকতে হবে।

Boroder Golpo


বেশ্যার সাথে সংসার করা যায়, তবু তোমার সাথে নয়।

কথাটি বলে সজোরে চড় বসিয়ে দিলো শর্মিলার স্বামী। পেছনে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখে খুব আনন্দ হলো শর্মিলার শ্বাশুড়ীর। এরপর, যা ইচ্ছে তাই বলে শর্মিলাকে প্রচুর মার খাওয়ালো স্বামীর হাতে।

প্রথমে মার খেয়ে চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে পড়েছিলো। তারপর, পুরোটা সময় সে নিঃস্তব্ধ হয়েছিলো। বাবা-মা’র হাতে যে কখনো মার খায়নি, এখন তাকে বিনা অপরাধে মার খেতে হচ্ছে। অপমান আর অসহায়ত্বের কাছে হার মেনে নিতে কষ্ট হলেও, তার কিছু করার ছিলোনা। তার মার খাওয়ার কারণ, সে কেনো বাসায় দেরী করে ফিরেছিলো? বাসার সবাই জানে রাস্তাঘাটে একটু দেরী হতে পারে। বেশি না তার সবমিলিয়ে ৫ মিনিট দেরী হয়েছিলো। আর, এই ৫ মিনিট কেনো দেরী হলো, তাতেই মার খেতে হলো।

মার খেতে খেতে একসময় বেহুশ হয়ে গেলো। এরপর যখন তার হুশ ফিরলো তখন সে আবছা আবছা শুনতে পাচ্ছিলো তার স্বামী আর শ্বাশুড়ীর কথোপকথন। সবকিছু স্পষ্টভাবে না শুনলেও শ্বাশুড়ীর কিছু কথা শর্মিলার কানে স্পষ্টভাবে এসেছিলো, “বউকে মাঝে মাঝে মেরে লাইনে আনতে হয়। মার না খেলে মাথার উপর উঠে যায়।”

কথাগুলো শুনে শর্মিলার নিজের উপরই হাসি আসছিলো। এই মহিলাটিকে একসময় দেবতা মনে করতো সে! এজন্যই হয়তো বলে দূরত্ব থেকে মানুষের সাথে মিশতে হয়, দূরত্ব ভেঙে কাছে আসলে মানুষের মুখোশটি খসে পড়ে। আর, তখনই সূচনা হয় সম্পর্কের অবনতির।

রাতে শর্মিলা তার অপমানবোধটাকে দাঁতে দাঁত চেপে আটকে রেখে স্বাভাবিক ব্যবহার করলো। কোনমতে রাতটা পার হয়ে গেলে পরের দিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করলো। অনেকেই শর্মিলার চোখ মুখ ফোলা দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলো। শর্মিলা কাওকেই কিছু বললোনা। শুধু বললো, ব্যাথা পেয়েছি। এরপর, ফেরার পথে উকিলের সাথে দেখা করে এলো। তারপর, বাসায় ফিরে যেন কিছু হয়নি এমন একটি ভাব করে সবার সাথে মিশে যেতে লাগলো।

জীবনে অনেকসময় পরিস্থিতির সাথে আপোশ করে মানিয়ে নিতে হয়। সেটা যতই নীতিবিরোধা হোক না কেনো। নীতিবাগিশ হয়ে সব সময় একরোখা হয়ে থাকলে নিজের কাছে স্বচ্ছ থাকা যায়, কিন্তু পরিস্থিতির সাথে সামাল দেওয়া যায়না।

শর্মিলা চাইলেই তার স্থান থেকে প্রতিবাদ করতে পারে, কিন্তু শর্মিলার অর্থনৈতিক মুক্তি পুরোপুরি নেই, নেই স্থায়ী বসবাসের অধিকার। স্থায়ী বসবাসের অধিকার যাদের হাতে, তাদের চটিয়ে দিয়ে আর যাই হোক থাকার ব্যবস্থা হবেনা। পাশাপাশি, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে দেশে ফিরে গেলে বাবার পরিবারও তাকে সাদরে গ্রহণ করবেনা। প্রতিটি পদে পদে তাদের হেয় হতে হবে। সেদিক বিবেচনায় পিতৃলয়ে ফিরে কুরুক্ষেত্র সৃষ্টির কোন অর্থ হয়না। আর, সুনীল? বাংলাদেশের মতো দেশে সুনীলের সাথে গিয়ে বসবাস সম্ভব নয়। তার উপর সুনীল নিজেই নিজের খরচ খুব কষ্টে জোগাড় করছে।

তবে হ্যাঁ, পৃথিবীতে কেউ যদি তাকে সানন্দে নিবাস দেয় তবে সেটা সুনীল। যতই কষ্ট হোক সে হাসিমুখে মেনে নিবে। কিন্তু, ভেঙে যাবে তার সাজানো স্বপ্ন। একসাথে থাকাটাও স্বপ্ন, কিন্তু সেটা নির্দিষ্ট একটি সময়ের পর। এখনও সেই সময়টি আসেনি। এই সময়ে একসাথে থাকলে সবকিছু থাকলেও আর যাই হোক ভালো লাগাটা থাকবেনা, তার স্থলে স্থান করে নিবে দায়বদ্ধতা। আর দায়বদ্ধতার সম্পর্কে কে না জানে মন বেশি দিন টিকে থাকেনা, তাতে বিরক্তি চলে আসে।

সুতরাং, সুনীলের কাছে যাওয়াটাও সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। তাহলে, বাকী রইলো একটি পথ। সঙ সেজে টিকে থাকা। নৈতিকতা ছেড়ে মুখোশ পরিধান করে বেঁচে থাকা। তারপর, লক্ষ্যে পৌছে গেলো মুখোশটি ঝেড়ে ফেলা। ঠিক যেমন পথিকের করে।

পথিকের কাজ নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছানো। সেই গন্তব্যে পথিক শর্টকার্টে যাবে না ছকেবাঁধা পথে যাবে এটা কারোরই বিবেচ্য নয়। শর্টকার্টে যেয়ে কেউ গন্তব্যে পৌছুলে তাকে নিয়ে সবাই গর্ব করবে। পাশাপাশি আর একজন ছকেবাঁধা পথে হেঁটে পৌছুতে না পারলে কেউ তাকে মনেও রাখার প্রয়োজনও বোধ করবেনা, যদিও সবচেয়ে বেশি কষ্ট সে করেছিলো।

সুতরাং, শর্মিলাকে তার লক্ষ্যে পৌছুতে হবে। কিভাবে, কি করে পৌছুবে সেটা নৈতিকতা দিয়ে বিচার করে তার কোন লাভ নেই।


এটা কি বউ না কালসাপ, কথাটি বলে শর্মিলার চুলের মুঠি ধরে হেচকা টান দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো শর্মিলার শ্বাশুড়ী। তারপর, ছেলে ও মা মিলে প্রচুর মার দিলো শর্মিলাকে। মারের পরিমান এতোটাই হয়ে গিয়েছিলো যে শর্মিলা প্রায় আধমরা হয়ে গিয়েছিলো।

পরিস্থিতি বুঝতে পেরে তিনটি বছর ধরে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা শ্বশুর অবশেষে এগিয়ে এলেন। শর্মিলাকে ভর্তি করলেন নার্সিং হোমে। তারপর, সেখান থেকে সুস্থতা অর্জন, শর্মিলার জবানবন্দী এবং সর্বশেষ বিবাহ বিচ্ছেদ। সম্ভবত, স্থায়ী বসবাসের জন্য আর যেটুকু অপেক্ষা করতে হলো সেটাও আর করা লাগলোনা। শর্মিলার পক্ষে আদালত থেকে রায় গিয়ে শর্মিলার স্বামী ও শ্বাশুড়ী দু’জনকেই কারাগারে যেতে হলো। পাশাপাশি, শর্মিলা পেয়ে গেলো তার নাগরিকত্ব।

স্থায়ী বসবাসের ঝামেলা মিটে যাওয়ার পাশাপাশি শর্মিলার অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটেছিলো কাজের সুবাদে। এবার শুধুই অপেক্ষা। একসাথে থাকার। সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে সুনীলকে চিঠি লিখবে ভেবেছিলো সে। কিন্তু তার আগেই শর্মিলার শ্বশুর শর্মিলার হাতে দিয়ে গেলো সুনীলের চিঠি।

প্রিয়,
চিঠি হাতে পাওয়ার আর ঠিক ২ দিন পরই আমার ফ্লাইট। আমি পাড়ি জমাচ্ছি তোমার নতুন শহরের বুকে।

অবাক হচ্ছো? ভাবছো, ঠাট্টা করছি, তাইনা?
না, আমি ঠাট্টা করছিনা। সত্যিই আসছি। বিশ্বাস করানোর জন্য টিকেটের কপি যোগ করে দিলাম!

ক্যারিয়ার গোছাতে বলেছিলে, আমি গুছিয়েছি। যেই পড়ালেখা মাঝপথে ছেড়ে দিয়েছিলাম, সেটাই আবার শুরু করেছিলাম মাঝ থেকে। পাশাপাশি, আমার কাজকর্ম চলছিলো খুব ভালো করে। তাই বলে ভেবোনা সাহিত্যের জগত থেকে বিদায় নিয়ে নিয়েছি। নিজ সম্পর্কে উচ্চবাক্য কিছু করবোনা, শুধু এটুকু বলতে পারি- এখন আমি চাইলে কোন কাজ না করে শুধু প্রতি বইমেলায় একটি বই বের করে সারাবছর ভালোভাবে চলতে পারি।

উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য সম্পূর্ণ বিনা খরচে পড়তে আসছি তোমারই শহরে।

আর, নয় অপেক্ষা এই আমাদেরই মিলনের….

ইতি,
সুনীল।

চিঠিটা যেদিন হাতে পাওয়ার কথা তারও দুদিন পরে হাতে পেয়েছিলো শর্মিলা। টিকেটের কপিতে চোখ বোলাতেই দেখলো আর বেশি সময় নেই। সুনীলকে রিসিভ করতে হলে এখনই তাকে বের হতে হবে।

তারপর, সুনীলের দেখা ও মিলন। অতঃপর, স্বপ্নপূরণ…

পরকীয়া সম্পর্কে খুব বেশি গালাগাল দেওয়া হয় আমাদের দেশে। বলা হয়, এটি প্রতারণা। এটুকু বলেই সবাই সেই সম্পর্ককে খারাপ রায় দিয়ে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু, একবারও কি ভেবে দেখা হয়েছে, পরকীয়া সম্পর্ক কেন গড়ে উঠে? কেন তৈরি হয় এত জটিলতা?

সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হলে ভালোবাসার থেকে দায়বদ্ধতা বেশি থাকে। তার অর্থ এই নয় যে, দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কে যাওয়া যাবেনা। একটা সম্পর্কে পর্যাপ্ত সম্মান, অধিকার থাকলে কেউই সেখান থেকে আসার কথা ভাবেনা।

আবার, কিছু সম্পর্কে মনের মিল থাকেনা। শুরুতে সবার দেখাদেখি উচ্ছাসিত হলেও একটি সময় ঠিকই মোহ ভেঙে যায়। এই যে, মোহভঙ্গ সেটা থেকে সাথের মানুষটির প্রতি অনীহা তৈরি হয়। আর, কে না জানে ইচ্ছে না থাকলে কিছুই হয়না। এখন, এই সম্পর্কে ইচ্ছে নাই, কিন্তু পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে তাকে জোর করে থাকতে হবে, কারণ সে অসহায়। তখন, তারপক্ষে পরকীয়াতে জড়িয়ে পড়া খুবই স্বাভাবিক। কেননা, অনীহা চলে আসা কোন জিনিস করতে গিয়ে মানুষ যখন তার মনের মতো কোন কিছু পায়; তখন দেখানোপনার জন্য ঐ কাজের পাশাপাশি লুকিয়ে ভালো লাগার কাজটি করে যায়।

তাই, পরকীয়াকে গালি দেবার পূর্বে ভাবুন পরকীয়া কেন হয়। আর যেন পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তুলতে কেউ বাধ্য না হয় সেরকম পরিস্থিতি গড়ে তুলুন। আপনার সাথের মানুষটিও একজন মানুষ। আপনি যেমন ভাবেন আপনার মনের দিক বিবেচনায় তাকে আটকে রাখার কথা; ঠিক তেমনি আপনারও মনে রাখা উচিত তারও থাকা না থাকার ইচ্ছে আছে। যে থাকতে চায়না, তাকে জোর করে আটকে রেখে বিপত্তি টেনে আনেন কেনো? সমাজের ভয়ে? লোকে কি বলবে তা ভেবে? তাহলে, জেনে রাখুন, সম্পর্ক ভেঙে গেলে যা বলবে, সম্পর্ক টিকে থাকলেও লোকে একটা কথা কম বলবেনা।

আর, মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। তাই, যে যা করতে ভালোবাসে তাকে তা করতে দিন। তার কাজকর্ম ভালো না লাগলে তাকে ছেড়ে দিন। আটকে থেকে বিপত্তি বাড়ানোর কোন অর্থ হয়না।

এবং সর্বশেষ, অর্থনৈতিক মুক্তি। উভয়পক্ষের অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা এই সমাজকেই করতে হবে, যাতে কেউ আটকে না থেকে বাধ্য হয়ে অন্য সম্পর্ককে লুকিয়ে চালিয়ে যায়।

অর্থনৈতিক মুক্তি ও আটকে রাখার প্রবণতা না থাকলে অর্ধেকের বেশি পরকীয়া সম্পর্ক থাকবেনা। তাই, যেকোন কিছুকে অপবাদ দেওয়ার আগে গভীরে গিয়ে কারণ খুঁজুন, তারপর সেটাকে দূর করুন। অযথা বিচার করে পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করবেন না। এতে সমাধান তো হবেই না বরং আরো বাড়বে। মনে রাখা উচিত, জোর করে কখনো কিছু চাপিয়ে মানুষকে দমানো যায়না। যতই কঠিন পরিস্থিতি হোক না কেনো মানুষ মুক্তির পথকে খুঁজে নিবে।

——————-সমাপ্ত——————-

গল্পটি কেমন লাগলো নিচের কমেন্ট সেকশনে লিখে জানান। ভালো লাগলে প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

আরো পড়ুন,

ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প

প্রতিশোধের শারীরিক সম্পর্ক রোমান্টিক গল্প

(সবার আগে সব খবর, সব আপডেট পেতে ফলো করুন আমাদের Google News এবং Whats App Channel)

Share This Article