ক্রিকেটে চিরস্থায়ী বলে আসলে কিছু হয়না । গত বছরের ১৯ শে নভেম্বর যে দলটা আমদেবাদের মাঠে ভারতের স্বপ্নকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলো । হাতছাড়া হয়েছিলো ভারতের ওডিআই বিশ্বকাপ । সেই দলটাই চলতি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার এইট থেকেই আউট হয়ে গেলো ।
গতকাল ভারতের বিশ্বজয়ের ম্যাচটা শুধুমাত্র একটি ম্যাচ হিসেবে গণ্য করলে হয়তো ভুল করা হবে । এই জয় শুধুমাত্র একটি ম্যাচ জয় নয়, এই জয়ের নেপথ্যে অনেক জীবন জয়ের গল্প লুকিয়ে আছে ।
গতকালের বিশ্বকাপ জয় যেন ক্রিকেটের ইতিহাসে এক রূপকথার মতোই বহু শতাব্দী ধরে থেকে যাবে ।
T20 World Cup Final 2024
হার্দিক পাণ্ডিয়া তার নামটা শুনলেই কিছুদিন আগে মানুষ ক্ষেপে যেতো । গুজরাত থেকে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স দলের অধিনায়ক হয়ে তিনি যেন ভারতের প্রতিটি ক্রিকেট প্রেমীর অঘোষিত শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন । ভাগ্য দেবীর কি নিষ্ঠুর পরিহাস দেখুন ! ঠিক সেই সময়টায় তিনি হয়তো তার জীবনের সবথেকে বাজে খেলাটা খেলেছেন । মাঠে নামলেই হাজার হাজার দর্শক তার নামে ব্যাঙ্গ করেছে । সোশ্যাল মিডিয়ায় তার নামে কত কটূক্তি, ট্রোল, মিম হয়েছে ।
এত যন্ত্রণার মাঝেও তার হাসিমুখ টা ছিলো কিন্তু অমলিন । কিন্তু বিশ্বকাপ শুরু হতেই তিনি জ্বলে উঠেছেন । গতকাল তার নেওয়া তিনটি উইকেট বিশেষত ক্লাসেন আর শেষ ওভারে মিলারের উইকেট টা আসলে কোন কিছু দিয়েই হয়তো পরিমাপ করা যাবে না । ২০১১ র বিশ্বকাপে যুবরাজ সিং যে রোলটা নিয়েছিলেন, কালকের এই বিশ্বজয়ের মঞ্চে সেই স্থানটা কিন্তু হার্দিক নিজে নিয়েছিলেন । গতকাল ম্যাচ শেষে তার কান্নাটা দেখে সত্যিই চোখে জল এসেছিলো ।
বিরাট কোহলি ভারতীয় ক্রিকেট কে কি দেয়নি ? কত যুদ্ধের যোদ্ধা তিনি । অথচ বিশ্বকাপের মঞ্চে তার রান না আসাতে তাকে অনেকেই ফাইনাল ম্যাচ থেকে ড্রপ করতে বলেছিলেন । কিন্তু দেখুন, ফাইনাল ম্যাচে তিনি রাজার মতো ব্যাট করে ম্যাচ জেতালেন । ম্যাচ শেষে তার উচ্ছ্বাস দেখে সত্যিই আবেগপ্রবণ হয়েছে কোটি কোটি মানুষ । তার মতো ক্রিকেটের বহু যুগ পর পর তৈরি হয় । সেটা আমাদের মেনে নিতেই হবে ।
রাহুল দ্রাবিড়, ভারতীয় ক্রিকেটার ওয়াল বলা হয় তাকে । বহু বছর দেশের হয়ে খেলেছেন কিন্তু বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদটা থেকে বঞ্চিত ছিলেন । কোচ হয়ে শেষ ম্যাচে তিনি সেই বিশ্বকাপটা পেলেন । তাকে কোনদিন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখিনি । বড়ই শান্ত স্বভাবের মানুষটাকে কাল পাগলের মতো চিৎকার করে উচ্ছ্বাস করতে দেখেছি।
সবশেষে, আরেক জনের কথা না বললেই নয় । তিনি যশপ্রিত বুমরাহ । তিনি যে আসলে ভারতের কত ম্যাচের জয়ের কান্ডারী তা হিসেব করে শেষ করা যাবেনা । ৩০ বলে ৩০ রান, হাতে ৬ ইউকেট দক্ষিণ আফ্রিকার । মাঠে বিশ্বসেরা দুই বাট্যার খেলেছেন ।
সেই ম্যাচে ১৭ তম ওভারে মাত্র দুই রান দিলেন সঙ্গে নিলেন একটি উইকেট । সেখান থেকেই খেলা পাল্টে গিয়েছিল। ভারতের ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন বোলার কোনদিন ছিলোনা। চিরকাল আমরা একটি ব্যাটিং নির্ভর দল হিসেবে গণ্য হয়েছি । অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্থানের কাছে যে ধরনের ফাস্ট বোলার ছিলো, ভারত তা কোনদিন পায়নি ।
কিন্তু বুমরাহ যেন সেই হিসেবটা পাল্টে দিয়েছেন ।
শান্ত, লাজুক স্বভাবের বুমরাহ বল হাতে যে কতটা ভয়ঙ্কর গত ম্যাচে তার সাক্ষী ছিলো গোটা বিশ্ব ।
গত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চোটের জন্য খেলতে পারেননি । গোটা দের বছর মাঠের বাইরে ছিলেন । কিন্তু বুম বুম মাঠে নামা মানেই বিপক্ষ ব্যাটারদের ত্রাস। তার গল্পটাও কি জীবন জয়ের গল্প নয় !
T20 World Cup Final
ভারতের মতো দেশে ক্রিকেট শুধু একটি খেলা নয়, ক্রিকেট এক আবেগ । ১৩ বছর পর ভারত বিশ্বকাপ জয়ের গল্প যেন ঠিক তাই রূপকথার মতোই ।
বারবার ফাইনালে উঠেও আমরা কাপ নিতে পারিনি ।
গতকাল মাঝরাতে ভারতের জয়ের পর ১৪০ কোটি মানুষের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে । একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাদতে দেখেছি অনেককেই । কি বলবেন এই আবেগকে ? আসলে শব্দে বলার মতো কিছু নেই ।
বিশ্বকাপ জয়ের রাতেই টি টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন বিরাট কোহলি ও রোহিত শর্মা ।
ভাবতেই অবাক লাগে যে, টি টোয়েন্টি তে এই দুজন মানুষকে আমরা আর খেলতে দেখবোনা ! বিরাট, বিরাট বলে আর চিৎকার করবো না । রোহিতের লম্বা ছক্কা দেখার জন্য তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বাড়ি ফিরবো না, হিটম্যান হিটম্যান বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবো না । গতকাল ম্যাচ জয়ের পর রাজার মতোই কিং কোহলি বিদায় নিলেন । বিদায় নিলেন সর্বকালের সেরা ব্যাটার । হয়তো বিদায় জানানোর জন্য এর চেয়ে বড় মঞ্চ আর কিছু হতে পারেনা ।
কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেট তার সবথেকে উজ্জ্বল তারকাকে চিরকালের মতো মিস করবে । ক্রিকেটের এত জনপ্রিয়তার নেপথ্যে এই মানুষটার কম অবদান নেই । এরপরেও হয়তো অনেক তরুণ প্রতিভা ভারতীয় ক্রিকেটে আসবে কিন্তু বিরাট কোহলির অভাব কোনদিন পূর্ণ হবেনা ।
শচিন টেন্ডুলকার অবসরের সময় বলেছিলেন বিরাট বা রোহিত হবেন পরবর্তী ক্রিকেট সুপারস্টার । কিন্তু রোহিত, বিরাট অবসরের সময় ভারতীয় ক্রিকেটে সুপারস্টার হওয়ার মতো আসলে তেমন কেউ নেই ।
সবশেষে, ধন্যবাদ বিরাট, রোহিতকে । কত নির্ঘুম রাত তাদের খেলা দেখে কাটিয়েছি । কত আনন্দ, কান্না আর উচ্ছ্বাসের সাক্ষী থেকেছি । এমন সুন্দর মুহূর্তকে আমাদের দেওয়ার জন্য হৃদয়ের গহীন থেকে ভালোবাসা । সকল ভারতীয়দের বিশ্বজয়ের শুভেচ্ছা
। আর হ্যাঁ, জীবনের সবথেকে কঠিন লড়াইটা লড়ার আগে এই ম্যাচটা একবার দেখবেন কথা দিচ্ছি….আপনার লড়াই বিশ্বজয়ের মতোই সফল হবে ।