বসন্ত উৎসব 2024 – Basanta Utsav

Bongconnection Original Published
6 Min Read

বসন্ত উৎসব 

       – নীলাঞ্জনা (রীনা দাস)
রুপুদের বাড়িটা বিরাট। অনেকটা জায়গা জুড়ে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বিরাট দরজা। দরজায় নেপালী দারোয়ান। তাদের গাড়িটা রুপুকে নিয়ে সেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে ইস্কুলে দিয়ে আসে। আবার ছুটির পর তাকে নিয়ে ফিরে এসে সোজা দাঁড়ায় গাড়িবারান্দার তলায়।
আজ দোল। প্রতিবার তারা দোলে শান্তিনিকেতন যায়। এবারে বাপির জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায়, ট্যুর বাতিল। তার বদলে বাড়িতেই আয়োজন করা হয়েছে বসন্ত উৎসবের। সামনের বাগানে সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজান টেবিলে থালা ভর্তি করে রাখা নামী কোম্পানীর রঙ বেরঙের সুগন্ধী আবীর। একতলার হলঘরে ছোট্ট স্টেজ। লাল নীল ভেলভেটের চেয়ার পাতা হয়েছে সারিসারি। সকাল একটু গড়াতেই আমন্ত্রিতরা আসতে শুরু করলেন। সকলেই
প্রায় সাদা ধপধপে পাজামা পাঞ্জাবী, চূড়িদার কিম্বা শাড়ী পরে এসেছেন। তারপর শুরু হল বসন্ত উৎসব। সাজিয়ে রাখা আবীর দু আঙ্গুলে তুলে একে অন্যকে টিপ পরিয়ে দিলেন বা গালে একটু আলতো করে আঙ্গুল ছোঁয়ালেন। অনেকের আবার নিজেদের রঙ ছাড়া কিছুতে বিশ্বাস নেই। তাঁরা আগে থেকেই নামীদামী বিশুদ্ধ হারবাল রঙ ইঞ্চি স্কেল মেপে দু গালে লাগিয়ে এসেছেন। কাঁচা হলুদ বেঁটে হলুদ, গোলাপের পাপড়ি পিষে গোলাপী, আরো কি কি সব। তাই নিয়ে খুব খানিকটা আলোচনা হল। এদিকে রোদও চড়ে গেছে। কেউ আর বাইরে থাকতে চাইছিলেন না। এবার আসল উৎসব শুরু হল হলঘরে। জোরালো এসির ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় কবিতা, গান, নাচ, হাততালি। বেয়ারারা ঠাণ্ডা পানীয়ের গ্লাস ভরা ট্রে নিয়ে অতিথিদের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দারুণ জমে উঠেছে বসন্ত উৎসব।

বাঙালির বসন্ত উৎসব

Loading...
এই হৈচৈ এর মধ্যে রুপুর দিকে কারো খেয়াল ছিল না। সে চুপিচুপি উঠে এল ছাদে। উত্তর পশ্চিম কোনাটা বাড়ির পেছন দিক। আলসের ধারে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, পাঁচিলের ওপারের বস্তিতে একপাল ছেলেমেয়ে হৈহৈ করে দোল খেলছে।  শুকনো পাতা, কাগজ, কাঠিকুঠি যোগাড় করে শীতবুড়ির ঘর করেছিল, ন্যাড়া বেঁধেছিল। গতকাল সন্ধে বেলা সে গুলো জ্বালিয়ে হৈহৈ করে ন্যাড়াপোড়া হচ্ছিল। ছাদে উঠে
ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল রুপুর। কিন্তু মায়ের কড়া হুকুমে সব হোম ওয়ার্ক শেষ করতে হয়েছিল আন্টির কাছে বসে। ছেলেমেয়ে গুলো সেই ন্যাড়াপোড়ার ছাই জল দিয়ে মেখে এ ওর মুখে মাখাচ্ছিল। পুঁচকে বাচ্ছারা ছোট ছোট পিচকিরি ভরে লাল, সবুজ, বেগুনী রঙ নিয়ে তাড়া করছিল এ ওকে আর পিচিক পিচিক করে রঙ দিচ্ছিল। যদিও তাদের শরীরের একতিলও বাকি ছিল না রঙ মাখতে। কেউ কেউ ছোট ছোট শিশি থেকে রূপোলী রঙ নিয়ে
ছাই মাখা কালো মুখেই মাখিয়ে দিচ্ছিল। যা রূপ খুলেছে না সবকটার। একেবারে ভুতের ছানা। হঠাৎ একজনকে সাত আট জন মিলে চেপে ধরে রঙ মাখাতে গিয়ে, হুড়মুড় করে পড়ে গেল সবাই মিলে এ ওর ঘাড়ে। আর থাকতে পারল না রুপু। খিলখিল করে হেসে ফেলে হাততালি দিয়ে উঠল। আর ছেলেমেয়ে গুলো তাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল।

বসন্ত উৎসব প্রবন্ধ

:- দোল খেলবি আমাদের সঙ্গে? আয় না। আয়।
:- কি সুন্দর সাদা ফুটফুটে জামা তোর। মুখে একটুও রঙ নেই। আয় তোকে রঙ মাখিয়ে ভুত
করে দিই।
বলল একটা মেয়ে।
:- কি করে যাব? দরজায় বাহাদুর কাকা বসে আছে। আটকে দেবে।
বলল রুপু।
:- পাঁচিল ডিঙ্গিয়ে আয়।
:- অত উঁচু পাঁচিল। কি করে ডিঙ্গোব?
:- যাআআ! তবে আর কি করে দোল খেলবি।
হঠাৎ একটা ছেলে, পকেট থেকে কি একটা বের করে সপাটে ছুঁড়ে মারে রুপুর দিকে।
দারুণ টিপ। থপাস্ করে রঙ বেলুনটা আছড়ে পড়ে রুপুর মাথায়। গাঢ় বাঁদুরে রঙ মাথা
ভিজিয়ে নেমে আসে। লেগেছিল ভালই। কিন্তু এত চমকে গেছিল রুপু, যে ব্যথা ভাল বুঝতে
পারে নি। বেলুন ছোঁড়া ছেলেটাকে কাঁধে তুলে, ছ্যাড়ারারা ডিকচা লিচা, ডিকচা
লিচা, করে নাচছিল বাকি গুলো। রুপুর কি হল কে জানে, গড়ানো রঙ হাত বুলিয়ে মাখাতে
থাকে গালে মুখে। ছেলেমেয়ে গুলো আনন্দে হেসে ওঠে।

বসন্ত উৎসব নিয়ে লেখা

:- এইবার ঠিক হয়েছে।
বলে ওরা চলে যাচ্ছিল। রুপু চেঁচায়,
:- এই তোরা যাস না। একটু দাঁড়া। আমি এক্ষুনি আসছি।
বলে এক ছুটে নেমে আসে নিজের ঘরে। একটা পিচবোর্ডের বাক্স যোগাড় করে, সকালে
উপহার পাওয়া অনেক চকলেট, মিষ্টির বাক্স আর শেষে একটা আবীরের প্যাকেট ভরে,
সেলোটেপ দিয়ে বন্ধ করে সেটাকে। তারপর সেটাকে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে আসে
ছাদে। ছেলেমেয়ে গুলো ছিল তখনো। অনেকটা দূর। রুপুকি পারবে এতটা দূরত্ব অতিক্রম
করতে। পৌঁছে দিতে পারবে তার উপহার ওদের কাছে?
ইস্কুলের স্পোর্টসের শটপুট ছোঁড়ার কায়দায়, একটু পিছিয়ে এসে, দুহাতে বাক্সটাকে
ধরে ছুটে যায় রুপু আলসের দিকে। তারপর সজোরে ছোঁড়ে। অনেক গুলো রঙীন হাত শূন্যে
লুফে নেয় সেটাকে। পেরেছে, রুপু পেরেছে।
তারপরে যা শুরু হয়, সে আর বলবার নয়। বাক্স ছিঁড়ে কাড়াকাড়ি করে চকলেট, মিষ্টি
বের করে আনে ওরা। ফয়েল ছিঁড়ে কামড় বসায় চকলেটে। এ ওকে খাইয়ে দেয়। একটা মেয়ে
দাঁত দিয়ে আবীরের প্যাকেট ছিঁড়ে একমুঠো বের করে নিজের গালে মাখে। চোখ বুঁজে
সুগন্ধটাকে টেনে নেয় বুকের ভেতরে। এবার সবাই সেই আবীর মাখামাখি করতে থাকে।
দেখতে দেখতে রুপু পৌঁছে যায় এমন একটা দেশে, যেখানে কোন পাঁচিল নেই, দরজা নেই,
দরজায় পাহারা নেই। আছে শুধু খোলা আকাশ। দূরে কাউকে একটা দেখতে পেয়ে, ছেলেমেয়ে
গুলো রুপুকে হাত নেড়ে, রে রে করে তেড়ে যায় সেদিকে। গলির মোড়ে হারিয়ে যায়। আর
মনে মনে রুপুও ছুটে যায় তাদের সঙ্গে, সেই দূরের কাউকে রঙ মাখাতে। রঙ মেখে যে
একদিন খুব কাছের হয়ে উঠবে তার।

Share This Article