নিউ ইয়ার রেসোলিউশন 2024 – New Year Resolutions

Bongconnection Original Published
17 Min Read

নিউ ইয়ার রেসোলিউশন 2024

ঘড়ির কাঁটাটা এগারটা বেজে ঊনষাটের ঘরে ঢুকতেই চারদিক থেকে শাঁখ, কাঁসর, ঘণ্টা
বেজে উঠল। কান ঝালাপালা করে ফটাস ফটাস করে বাজি পুড়তে লাগল। আর ঠিক তখুনি
বলাইবাবু বলা নেই কওয়া নেই ভীষণ এক ব্রত নিয়ে ফেললেন মনে মনে। তারপর মোবাইলটা
চার্জে বসিয়ে টুপ করে মশারীর ভেতর ঢুকে মিটি মিটি হাসতে লাগলেন। কাকপক্ষীতেও
টের পেল না তাঁর এই কঠিন সংকল্পের কথা।
মল্লিকা ঘুমের ঘোরেই খুটখুট আওয়াজটা শুনতে পেয়েছিলেন। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে
যেই না ধুপধাপে পরিণত হল, ধড়মড় করে উঠে বসলেন তিনি। ঘুম চোখেও স্পষ্ট শুনলেন
দেয়ালের ওপাশ থেকে কারা যেন শাবল নিয়ে খুঁড়তে লেগেছে। বাইরেটা অন্ধকার
ঘুটঘুটটি। দুদিন আগেই বিয়ে বাড়ি যাবেন বলে ব্যাঙ্কের লকার থেকে যে গয়নাগুলি
আনিয়েছিলেন, সেগুলিতো এঘরের আলমারিতেই রাখা! পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে কেমন
যেন দিশেহারা হয়ে পড়লেন মল্লিকা। প্রাণের মায়া ত্যাগ করে হাউমাউ করে চেঁচিয়ে
উঠলেন – “ওরে বাবারে! ডাকাতে মেরে ফেল্লেরে!”
ডাকাতদের উৎসাহ যেন আরো বেড়ে গেল! ঠকাঠক শাবল পড়তে লাগল। অবিশ্যি মল্লিকার
আর্তস্বর ব্যর্থ হলনা তাই বলে! পাশের ঘর থেকে ছেলে মলয় চোখ ডলতে ডলতে ছুটে এলো
– “কি হয়েছে? চেঁচালে কেন হঠাৎ?”
ডুকরে উঠলেন মল্লিকা – “ঘরে ডাকাত পড়েছে! শিগগির পুলিশে খবর দে বাবু!”
মলয় আলোর সুইচটা ফটাস করে টিপে দিল। ডাকাত তখনও চেয়ারের ওপর লাফিয়ে চলেছে। এক
থাবড়া মেরে সেটাকে চুপ করিয়ে ভোঁসভোঁস করে ঘুমোতে থাকা জন্মদাতাকেও জোরসে এক
ঠ্যালা মারল মলয়।নিউ ইয়ার রেসোলিউশন 2024 - New Year Resolutions
Loading...
বলাইবাবুর স্বপ্ন আজ সার্থক। রক্তে চিনি নেই, প্রেসার একেবারে নর্মাল, হাঁটুতে
সেই অল্পবয়সের জোর। বুক উঁচু করে অমল ডাক্তারের চেম্বারে হাজির হন মাঝে মাঝে।
ডাক্তারবাবু তাঁকে দেখেই সসম্মানে উঠে দাঁড়ান – “আসুন আসুন! আপনি এলে রুগীরা
মনে খুব জোর পায়! ওদের একটু উপদেশ টুপোদেশ দিয়ে যাবেন প্লিজ।”

বলাইবাবু গলাটা একটু ঝেড়ে নেন। তারপর আস্তে আস্তে শুরু করেন গত একবছর ধরে নিজের
কঠিন সাধনার কথা, সংযমের কথা। আশ্চর্য সেই কাহিনী অবাক চোখে শোনে তাঁকে ঘিরে
ধরা রুগীরা। মেদহীন ছিপছিপে বলাইবাবুর ঠোঁটে এক ছটাক মাপা হাসি। কে বলবে এর
মধ্যেই তিনি হাফ সেঞ্চুরি করে ফেলেছেন। বয়স যেন এক লাফে কুড়িটা বছর নেমে গেছে।
দুটি সুন্দরী মেয়ের সাথে দিব্যি বাগানে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। একটির নাম রম্ভা আর
একটির নাম উর্বশী। দুটোই যেন ডানাকাটা পরী। কিছুতেই বলাইবাবুর পিছু ছাড়েনা
তারা। একজনের হাতে লাল আঙুরের থোকা আর একজনের হাতে একটি সোনালী রঙের রেকাবি।
বলাইবাবু থোকা থেকে একটি করে আঙুর মুখে পুরছিলেন আর বিচিগুলি রেকাবিটায়
ফেলছিলেন। মেয়েদুটো মাঝে মাঝেই খিল খিল করে হাসছিল। হঠাৎ কিসের যেন গোলমাল ভেসে
এলো। বলাইবাবু দেখলেন মল্লিকার মতো দেখতে এক মহিলা তাঁর দিকেই ছুটে আসছে। চোখ
দুটো জবা ফুলের মতো লাল। প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে তিনি রম্ভার হাতটাই খপ করে চেপে
ধরলেন। অমনি মল্লিকার পেছন থেকে একটা ষাঁড় তেড়ে এসে শিং দিয়ে তাঁকে গেঁথে নিয়ে
শূন্যে তুলে ধরল। বলাইবাবু যত বাবারে মারে করে চেঁচান নির্দয় ষাঁড়টা তত তাঁকে
বনবন করে ঘোরায়। তারপর ধরাম করে হঠাৎ মাটিতে আছড়ে ফেলেই দিল। বলাইবাবু “আঃ” করে
উঠলেন।

Also read,
 
মল্লিকার সাথে ষাঁড়টাও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকেই চেয়ে আছে। যেন বলাইবাবু
একটু ট্যাঁ-ফুঁ করলেই ষাঁড়টা তাঁকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দেবে একেবারে। মল্লিকার
মুখেই প্রথম কলি ধরল – “বলি মাথাটা কি একবারেই গ্যাছে?”
একটি লাইনেই বলাইবাবু নিজের টাইমলাইনে ফিরে গেলেন। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলেন
– “কি হয়েছে রাত থাকতে উঠে পড়েছ কেন?”
মল্লিকা ভেংচি কেটে উঠলেন – “রাত থাকতে উঠে পড়েছ কেন! তোমার ওই বিটকেল ফোনের
আওয়াজে ঘুমোনোর জো আছে?”
মনে মনে একটু লজ্জিত হলেন বলাইবাবু। এহ অ্যালার্মটা শুনতেই পাননি । বরাবরই তার
ঘুম বটের আঠার মত পুরু। তাই বলে স্ত্রী-পুত্রের চোখরাঙানিতে দমে যাবেন সেই
শর্মাই নন তিনি! খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে মোবাইলটা হাতে নিতে গেলেন – “এখন থেকে
রোজই অ্যালার্ম দিয়ে শোব। অসুবিধে হলে ছেলের ঘরে ঘুমোবে।“
কিন্তু বরফের মতো ঠাণ্ডা মেঝেতে পা রাখতেই শেষের কথাগুলি আর বেরোতে পেল না।
গলাতেই বুজে গেল কেমন। এমন কাঁপুনি ধরল যে আবার বিছানায় ফিরে যাবেন কিনা ভাবলেন
একবার বলাইবাবু। কভি নেহি! প্রাণ যায়ে পর প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গেগা নেহি! প্রবল
উত্তেজনায় হিন্দি আউরালেন মনে মনে। তারপর বিছানা থেকে নিজের কম্বলখানা টেনে
নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।

New Year resolution 2024

Loading...
লতিকা অন্য দিনের মতোই ঝাঁটা হাতে ছাদে উঠে এসেছিল। সবেই খরাং খরাং করে কবার
ঝাঁটা বুলিয়েছে, চোখ গিয়ে পড়ল লাশটার ওপর। ছাদের ঠিক মধ্যিখানটায় পড়ে আছে
লাশটা। আগাগোড়া কম্বল দিয়ে মোড়ানো। ভয়ে-আতঙ্কে পা দুটো কেমন মাটির সাথে আটকে
গেল বেচারার। সম্বিৎ ফিরতেই ঝাঁটাটা মাটিতে আছড়ে ফেলে চোঁচোঁ দৌড় মারল।
নটা বাজতে চলল, কর্তা এখনও বেপাত্তা, মল্লিকা রান্নাঘরে তাই নিজের মনে গজগজ
করছিলেন। লতিকা হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। একটু দম নিয়ে ঘড়ঘড়ে
গলায় ফিসফিস করে উঠলো – “বউদি গো কারা এসে লাশ ফেলে রেখে গেছে তোমাদের ছাদে!”
কথাটা মল্লিকার কানে ওঠার আগেই কম্বল গায়ে লাশও ছাদ থেকে নেমে এলেন হাই তুলতে
তুলতে – “কই গো এক কাপ চা দাও দেখি!”
লতিকা বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। লাশ না ভুত তাই নিয়ে দ্বন্ধে। মল্লিকা দুহাত
কোমরে তুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন – “তুমি ছাদে কি করছিলে? ঘুমোচ্ছিলে?”
অহেতুক জেরায় বিরক্ত হলেন বলাইবাবু। কিন্তু কোন মুখেই বা বলেন কম্বলগায়ে ছাদ
অবধি তো পৌঁছে গিয়েছিলেন কিন্তু হাতপাগুলো আর সাহস করে বের করতে পারেননি
কম্বলের তলা থেকে। ভেবেছিলেন শবাসন দিয়েই শুরুটা করবেন। তারপর কি যে হল একেবারে
শবসাধনায় চলে গেলেন! এই একটু আগে লতিকার ঝাঁটার আওয়াজে নাকি রোদের তেজে সাধনা
ভেঙেছে। ওহ! গলাটা চায়ের তেষ্টায় একেবারে শুকিয়ে গেছে! রাগতস্বরে বললেন – “কে
বললে? না জেনে কথা বল কেন? চা দেবে নাকি শুধু মুখেই বাজার চলে যাব?“
“এতো বেলায় কি বাজার আনবে শুনি! বাবুকে পাঠিয়ে দিয়েছি বাজারে।”
বলাইবাবু মনে মনে খুশিই হলেন তাতে। বাজারে গেলেই মনটা খাই খাই করে ওঠে তাঁর। কই
মাছের মতো খলবল করতে থাকেন এ-দোকানে সে-দোকানে। ভালই হল। মাছ মাংস খাওয়াই
ছাড়লেন যখন বাজারের দিকটায় যত কম মাড়ানো যায়! তারচেয়ে বল্টুর দোকানেই যাওয়া যাক
বরং। ভাবলেন তিনি।
সকাল বেলাটায় বলাইবাবু ছাড়াও তাঁর বয়সী আরো কয়েকজন জোটেন বল্টুর দোকানে। চায়ের
সাথে টা বলতে রাজা-উজিরদের পিণ্ডি চটকানো। আজ অনেকেরই ছুটি বলে এখনও আড্ডা
চলছে। বলাইবাবু এসেই কাগজটা টেনে নিয়ে বেঞ্চে বসে গেলেন।
পরিতোষবাবু একটু অবাক গলায় শুধোলেন – “কি হে আজ এসেই চায়ের তাড়া দিলে না যে?
নিউ ইয়ার বলে বউ বাড়িতে ছাড় দিয়েছে নাকি?”
বলাইবাবু কাগজ থেকে চোখ সরালেন না – “নাহ! আজ থেকে দিনে একবার চা।“
“ই যে বিড়াল বলে মাছ খাবো না!” – পাশ থেকে ফুট কাটলেন মতি মাস্টার,। বলাইবাবুরই
প্রতিবেশী, হাড় বজ্জাত লোক একটা। বলাইবাবু দুচোখে দেখতে পারেননা তাঁকে।
দর্পভরে জবাব দিলেন তিনিও – “শুধু মাছ কেন, মাংস এমনকি “ – গলাটা খাটো করলেন –
“ওসবও ছোঁব না।”
“সব্বোনাশ! তা এমন মতিভ্রম হল যে?”  – কারো সাথেপাঁচে না থাকা পাঁচুবাবুরও
শিউরে উঠেছেন শুনে।
বলাইবাবু গম্ভীর – “নিউ ইয়ার রেসোলিউশন।”
খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠলেন মতি মাস্টার – “কিসের রেসোলিউশন? ওসবে কিস্যু
হয়না মশাই। আমি নিজে কতবার ভেবেছি হ্যান করেগা ত্যান করেগা, দুদিনেই যে কে
সেই!”
বলাইবাবু এবার কঠিন চাহনি দিলেন – “বাঘের সাথে ছাগ এক করে ফেলো না। আমি একবার
যা ভাবি সেটা করেই ছাড়ি।“
মতি মাস্টার খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতেই থাকলেন।
Also read,
সাদা ধবধবে ভাতের ঠিক ওপরেই মুচমুচে করে ভাজা ডিম আর একটা ভাজা শুকনো লঙ্কা
স্তুপ করে রাখা। পাশেই কাঁচের প্লেটে কাঁচা সোনার মতো মিহি করে বাটা সর্ষের
ঝিলের ওপর ভেসে ওঠা এক টুকরো ইলিশ ভাপা। রেশমের মতো উজ্জ্বল ত্বক। এতো নরম আর
তুলতুলে যে আঙুল ছোঁয়ালেই গলে পড়বে। মাছের গায়ে লেগে থাকা অমৃতটুকু দিয়েই পুরো
থালা শেষ করে ফেলতে পারেন বলাইবাবু। হাত গুটিয়ে তীব্র চোখে খানিকক্ষণ তাকিয়ে
রইলেন থালার দিকে। তারপর জলদগম্ভীর স্বরে বললেন – “এগুলি সরিয়ে নাও। শুধু ডাল
আর একটু ভাজা দাও।”
মল্লিকা ভাত দিচ্ছিলেন ছেলেকে, তাড়াতাড়ি এসে বলাইবাবুর কপালে হাত রাখলেন –
“হ্যাঁগো তোমার শরীর ঠিক আছে তো? সকাল থেকেই কেমন অদ্ভুতধারা ব্যাভার দেখছি!”
সব শালা শত্তুর! বলাইবাবু অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন – “শরীর ঠিকই আছে। নিউ ইয়ার
রেসোলিউশন নিয়েছি এই এক বছর মাছ-মাংস কিছু খাবো না।“
মল্লিকা চোখ কপালে তুলে কিছু বলতে গেলেন, পাশ থেকে ছেলে বলে উঠল – “বাবা খাবেনা
তো আমাকে দিয়ে দাও। ইলিশ মাছ ঠিক এক পিসে মন ভরে না।“
বলাইবাবু অগ্নিদৃষ্টি হানলেন ছেলের দিকে। অকৃতজ্ঞ, অকালকুষ্মাণ্ড একটা! ঘরে বসে
বাপের অন্ন ধ্বংস করলে এক পিসে মন ভরবে কেন!
“ভাজা খা তাহলে। তোর আর তোর বাবার দুপিস তুলে রেখেছিলাম কালকের জন্য।“ –
মল্লিকা স্বামীর ভাগের ডিমটাও ছেলের পাতে চালান করে দিলেন।
“না না ভাপাটাই দাও। যা ফাটিয়ে রেঁধেছো না! বাবা সর্ষেটা কোথা থেকে এনেছিলে
ব্যাপক ঝাঁজ কিন্তু! চোখে জল এসে যাচ্ছে পুরো!”
চোখে জল বলাইবাবুরও এসে গেছে। জবাব না দিয়ে ডাল দিয়ে ভাত মাখিয়ে মুখে নিয়ে
নাড়তে চাড়তে লাগলেন। চোখ ঝাপসা।
বলাইবাবুর মেজাজটা খিচড়েই ছিল, সপ্তমে চড়ল দরজা খুলতেই মতি মাস্টারকে দেখে।
চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন – “কি ব্যাপার? এখানে কি মনে করে?”
মতি মাস্টার পাশ কাটিয়ে স্যাট করে ঢুকে গেলেন ভেতরে – “হে হে! বিকেলে মলয়ের
সাথে দেখা হয়ে গেল রাস্তায়। বার বার করে বলে দিল আসতে। বড়ো ভালো ছেলে আপনার।”
মাস্টারের গলা পেয়ে মল্লিকা হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলেন – “এসে গেছেন? আমার
হয়েই গেছে লুচি কটা শুধু ভাজব।”
মতি মাস্টার সুড়ুত করে জল টানলেন একটু – “লুচি! অতি উত্তম! তা বউদি চা টা হবে
নাকি একটু?”
“কেন হবে না! বসুন আমি এখুনি নিয়ে আসছি।“
বলাইবাবু স্ত্রীর পিছু নিলেন – “বাড়িতে কি মচ্ছব হচ্ছে নাকি? মাস্টারকে কেন
ডাকা হয়েছে?”
“বাবু বাজার করে ফিরছিল, রাস্তায় দেখা। খাসির মাংস শুনে মাস্টারমশাই দুঃখ করছিল
নাকি। ওসব ওনার বারণ কিনা! বাবুই তাই বলল রাতে এখানে খেতে।“
বলাইবাবু টগবগ করে ফুটতে লাগলেন – “আমি কি লটারি পেয়েছি? সকালে ইলিশ রাতে খাসি!
বলি টাকা কি নবাবপুত্তুর দেবে না ওর বাপ?”
“বাপই দেবে।“ – মল্লিকার নির্বিকার জবাব – “বচ্ছরকার দিন ছেলেটা বাড়িতে আছে!
প্রতিবার তো বাড়িই থাকেনা!”
“তবে আর কি আমার চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে দিয়েছে!” – নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠলেন
তিনি।  তারপর লাফাতে লাফাতে আবার বসার ঘরে এলেন।
মতি মাস্টার নোংরা ধুলোভর্তি পাদুটো চেয়ারের ওপর তুলে আয়েস করে একটা বিড়ি
ধরিয়েছেন। বলাইবাবু গলা খাঁকারি দিলেন। মাস্টার নির্বিকার হয়ে বিড়ি টানতে
লাগলেন শুধু। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে মাথাটা একটু এগিয়ে নিয়ে এলেন – “খেয়েই
বুঝলেনতো আবার পরিতোষদার ওখানে যেতে হবে। রাতে মজলিশ হবে।“
বলাইবাবু বলাই বাহুল্য আবার অবাক হলেন – “কিসের মজলিশ।?”
“ছেলে বিলেত থেকে একটা দামী বোতল এনে দিয়েছে নাকি গেল বার, সেটা এখনও পড়ে আছে।
বউও বাড়ি নেই। সবাই গিয়ে ওটার সদ্ব্যবহার করা হবে আজ।“
“অ! তা আমাকে তো বলল না কেউ?”
“বলবে কেন? আমিই বারণ করে দিলাম তো। আপনি কিসব নিউ ইয়ার রেসোলিউশন নিয়েছেন।
গিয়ে শেষে মন উচাটন হোক আর কি!” – খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগলেন মাস্টার।
“ঢের ঢের খচ্চর লোক দেখেছি কিন্তু তোমার মতো বিটলে বামুন আর একটা দেখি নি।” –
চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন বলাইবাবু।
মতি মাস্টারের পরিতুষ্ট মুখ – “তা মশাই মাস্টার বলে কথা! অন্যের ভালমন্দটাও
দেখতে হয় বইকি!”
এক ঝুড়ি ফুলকো লুচি এনে মল্লিকা টেবিলের ওপর রাখলেন। পাশেই বড়ো জামবাটিতে খাসির
মাংস কষিয়ে রাঁধা। ভুরভুর করে গন্ধ ছেড়েছে। একে দুপুর থেকে আধপেটা খেয়ে আছেন,
তার ওপর মাংসের গন্ধে বলাইবাবুর পেটের ভেতর থেকে কেমন গুড়গুড় আওয়াজ বেরোতে
লাগলো। হাত বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি লুচির ঝুড়িটা নিতে গেলেন, তার আগেই ছোঁ মেরে মতি
মাস্টার কেড়ে নিলেন ঝুড়িটা – “আহা হা আপনি কেন কষ্ট করেন, আমরাই নিয়ে নেব
ক্ষণ।“
মল্লিকা দুটো রুটি এনে তাঁর প্লেটে রাখলেন – “একটু বোসো, বেগুনটা আরেকটু ভাজা
হলেই দিচ্ছি।“
“বউদি আমাকেও একটা বেগুন ভাজা দেবেন। আহ! এমন লুচি আমার ঠাকুমা বানাতেন। পেটটা
ঠিক ময়রার মতো ফুলে থাকতো। এরম করে ভুঁড়ি ফাসিয়ে দিতাম আমি।“ – মাস্টার আঙুল
দিয়ে খোঁচা দিলেন একটা লুচির পেটে – “আর তার সোয়াদ সে কি বলব! মুখে দিলেই
মিলিয়ে যেত একেবারে।“ – স্মৃতির স্মরনিতে ডুব দিতে দিতেই লুচিটা টপ করে মুখে
পুরে দিলেন তিনি।
মলয়ের অবশ্য এতো কথা বলার সময় নেই। ইতিমধ্যেই তিনটে লুচি মেরে দিয়েছে সে।
আর বলাইবাবু খাঁচায় পোরা বাঘের মতো ফুঁসতে লাগলেন।
মাস্টারতো দূর, ছেলে এমনকি বউ পর্যন্ত একটা লুচি সাধলনা তাঁকে। তিনি শুধু দেখতে
লাগলেন চোখের সামনে এক ঝুড়ি লুচি কিভাবে নিমেষে উধাও হয়ে গেল দুই বক রাক্ষসের
উদরে। হাড়গুলি একের পর এক জমতে লাগল পাতে। মল্লিকা আরেক ঝুড়ি লুচি এনে রাখলেন
টেবিলে। মুখে পরিতৃপ্তির হাসি।
“উফ একটু মিষ্টি হলে আরো জমে যেত!” – মতি মাস্টারের খেতে পেলে শুতে চাওয়া মুখ।
গা ঘিনঘিন করে উঠলো বলাইবাবুর। কোনোরকমে নিজের শুকনো রুটিটা গলাধঃকরণ করেই উঠে
দাঁড়ালেন তিনি। যেতে যেতে মল্লিকার সলজ্জ জবাব কানে এল – “মিষ্টিতো নেই তবে
নলেন গুড়ের পায়েস করেছি। দাঁড়ান নিয়ে আসছি।“
“কি আনন্দ কি আনন্দ!” – মল্লিকার বিচক্ষণতায় মতি মাস্টার আপ্লুত। বলাইবাবু
দাঁড়ালেন না।
বলাইবাবু মোবাইলটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজছিলেন অ্যালার্ম দেবেন বলে। তারপরই খেয়াল
হল সকালে ওটা হাতে করে ছাদে উঠেছিলেন কিন্তু ঘুম থেকে উঠে মোবাইলের কথা বেমালুম
ভুলে গিয়ে খালি হাতেই নেমে এসেছিলেন। এই ঠাণ্ডায় আবার ছাদে যেতে হবে ভেবেই
বিরক্তিতে ভুরু কুঁচকে উঠেছে তাঁর। ঠিক যা ভেবেছিলেন! ছাদের এক কোণে পড়ে আছে
ফোনটা।
“আমার সাধ না মিটিল আশা না পুরিলো সকলই ফুরায়ে যায় মা!”
বলাইবাবু নামতেই যাচ্ছিলেন, গানটা শুনে থমকে দাঁড়ালেন। ছাদের রেলিং দিয়ে গলাটা
একটু বাড়ালেন। মতি মাস্টার। হেঁড়ে গলায় গাইতে গাইতে নিজের বাড়ির গেট খুলে
ঢুকছেন। অল্প অল্প দুলছেন। সাধ যে ভালই মিটেছে বোঝা যাচ্ছে। শকুনের চোখ
মাস্টারের। ঠিক দেখতে পেয়েছেন তাঁকে। তরল গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন – “কি বলাইদা
রাতের বেলায় ফ্রি হ্যান্ড করছো নাকি ছাদে?”
“রাস্কেল একটা!” – জবাব না দিয়েই হনহন করে নেমে এলেন নিচে।
“তুমিতো আবার কাকভোরে উঠবে! আমি বাবা আমার ঘুম নষ্ট করতে পারব না সাতসকালে।“ –
বালিশ নিয়ে ছেলের ঘরে চলে গেলেন মল্লিকা।
বলাইবাবু অ্যালার্ম দিতে টেপাটেপি করছিলেন ফোনটা। হঠাৎ সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল
ফোনটার ওপর। সজোরে এক আছাড় মারলেন ফোনটাকে মাটিতে। “নিকুচি করে রেসোলিউশনের!” –
দাঁত কিড়মিড় করে উঠলেন তিনি।
দূরে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠল। বলাইবাবু স্পষ্ট শুনলেন – “আগেই জানতাম ওসব
রেসোলিউশন ফেসোলিউশন আপনার দ্বারা হবে না! খ্যাঁক খ্যাঁক!”
আরো পড়ুন,

Share This Article