ঠাকুরমার ঝুলি রাক্ষসের গল্প নীলকমল
ছোটবেলায় অনেকেই ঠাকুরমার ঝুলি গল্প পড়তে ভালোবাসতেন । এখন তো সেইসব গল্পের বই
খুঁজে পাওয়া ই মুশকিল । Internet এর এই বাড়বাড়ন্তর যুগে অনেকেই সেইসব গল্প সার্চ করেন। তাই আপনার জন্য রইলো ঠাকুরমার ঝুলির গল্প ‘নীলকমল আর লালকমল’।
খুঁজে পাওয়া ই মুশকিল । Internet এর এই বাড়বাড়ন্তর যুগে অনেকেই সেইসব গল্প সার্চ করেন। তাই আপনার জন্য রইলো ঠাকুরমার ঝুলির গল্প ‘নীলকমল আর লালকমল’।
ঠাকুরমার ঝুলি নীলকমল লালকমল এর গল্প
এক রাজার দুই রাণী; তাহার এক রাণী রাক্ষসী!
কিন্তু, এ কথা কেহই জানে না।
দুই রাণীর দুই ছেলে;-লক্ষ্মী মানুষ-রাণীর
ছেলে কুসুম, আর রাক্ষসী-রাণীর ছেলে অজিত।
অজিত কুসুম দুই ভাই গলাগলি।
রাক্ষসী-রাণীর মনে কাল, রাক্ষসী-রাণীর
জিভে লাল। রাক্ষসী কি তাহা দেখিতে পারে?-
কবে সতীনের ছেলের কচি কচি হাড়-
মাংসে ঝোল অম্বল বাঁধিয়া খাইবে;-তা পেটের
দুষ্ট ছেলে সতীন-পুতের সাথ ছাড়ে না।
রাগে রাক্ষসীর দাঁতে-দাঁতে কড় কড় পাঁচ পরাণ
সর্ সর্।-
যো না পাইয়া রাক্ষসী ছুতা-নাতা খোঁজে,
চোখের দৃষ্টি দিয়া সতীনের রক্ত শোষে।
দিন দন্ড
যাইতে না যাইতে লক্ষ্মীরাণী শয্যা নিলেন।
তখন ঘোমটার আড়ে জিভ্ লক্লক্
আনাচে কানাচে উঁকি।
দুই দিনের দিন লক্ষ্মীরাণীর কাল হইল। রাজ্য
শোকে ভাসিল। কেহ কিচ্ছু বুঝিল না।
অজিতকে “সর্ সর্” কুসুমকে “মর্ মর্’,-
রাক্ষসী সতীন-পুতকে তিন ছত্রিশ গালি দেয়,
আপন পুতকে ঠোনা মারিয়া খেদায়!
দাদাকে নিয়া গিয়া অজিত নিরালায় চোখের জল
মুছায়-”দাদা, আর থাক্ আর আমরা মার
কাছে যাব না। রাক্ষসী-মা’র কাছে আর কেহই
যায় না! লোহার প্রাণ অজিত সব সয়; সোনার
প্রাণ কুসুম ভাঙ্গিয়া পড়ে। দিনে দিনে কুসুম
শুকাইতে লাগিল।
ঠাকুরমার ঝুলি রাক্ষসের গল্প
২
রাণী দেখিল,
কি! আপন পেটের পুত্র,
সে-ই হইল শত্রু!-
রাণীর মনের আগুণ জ্বলিয়া উঠিল।
এক রাত্রে রাজার হাতীশালে হাতী মরিল,
ঘোড়াশালে ঘোড়া মরিল, গোহালে গরু মরিল;-
রাজা ফাঁপরে পড়িলেন।
পর রাত্রে ঘরে “কাঁই মাঁই!!”
চমকিয়া রাজা তলোয়ার নিয়া উঠিলেন।-সোনার
খাটে অজিত-কুসুম ঘুমায়; এক মস্ত রাক্ষস
কুসুমকে ধরিয়া আনিল। রাক্ষসের হাতে কুসুম
কাঠির পুতুল! ছুটিয়া আসিয়া মাথার চুল
ছিঁড়িয়া রাজার গায়ে মারিল,-হাত নড়ে না,
পা নড়ে না, রাজা বোকা হইয়া গেলেন।
রাজার চোখের সামনে রাক্ষস
কুসুমকে খাইতে লাগিল। রাজা চোখের
জলে ভাসিয়া গেলেন, মুছিতে পারিলেন না।
রাজার শরীর থরথর কাঁপে, রাজা বসিতে পারিলেন
না। রাণী খিল্খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল।
অজিতের ঘুম ভাঙ্গিল;-
রাত যেন নিশে
মন যেন বিষে,
দাদা কাছে নাই কেন?
অজিত ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দেখে, ঘর ছম্ছম্
করিতেছে, রাণীর হাতে বালা-কাঁকণ ঝম্ঝম্
করিতেছে,-দাদাকে রাক্ষসে খাইতেছে! গায়ের
রোমে কাঁটা, চোখের পলক ভাঁটা, অজিত
ছুটিয়া গিয়া রাক্ষসের মাথায় এক চড় মারিল।
রাস “আঁই আঁই’ করিয়া ঘুরিয়া পড়িয়া এক
সোনার ডেলা উগরিয়া পলাইয়া গেল!
রাণী দেখিল, পৃথিবী উল্টিয়াছে-পেটের
ছেলে শত্রু হইয়াছে! রাণী মনের আগুনে জ্ঞান-
দিশা হারাইয়া আপনার ছেলেকে মুড়মুড়
করিয়া চিবাইয়া খাইল! রাণীর গলা দিয়া এক
লোহার ডেলা গড়াইয়া পড়িল।
রাণীর পা উছল, রাণীর চোখ উখর, সোনার
ডেলা লোহার ডেলা নিয়া রাণী ছাদে উঠিল।
ছাদে রাক্ষসের হাট। একদিকে বলে-
হুঁম্ হুঁম্ থাম্ -আঁরো খাঁবো।
আর এক দিকে বলে,-
গুম্ গুম্ গাঁম্-দেঁশে যাঁবো।
রাণী বলিল-
“গব্ গব্ গুম্ থম্ থম্ খাঃ!
আমি হেঁথা থাকি, তোঁরা দেশে যায়ঃ!”
রাজপুরীর চূড়া ভাঙ্গিয়া পড়িল, রাজার বুক
কাঁপিয়া উঠিল;-গাছ-পাথর মুচ্ড়িয়া, নদীর জল
উছ্লিয়া রাক্ষসের ঝাঁক দেশে ছুটিল।
ঘরে গিয়া রাণীর গা জ্বলে, পা জ্বলে;
রাণী সোয়াস্তি পায় না। বাহিরে গিয়া রাণীর
মন ছন্ছন্, বুক কন্কন্; রাত আর পোহায় না।
না পারিয়া রাণী আরাম-কাঠি জিরাম-
কাঠিটি বাহির করিয়া পোড়াইয়া ফেলিল। তাহার
পর, মায়া-মেঘে উঠিয়া, নদীর ধারে এক বাঁশ-বনের
তলে সোনার ডেলা, লোহার
ডেলা পুঁতিয়া রাখিয়া, রাক্ষসী-রাণী, নিশ্চিত
হইয়া ফিরিয়া আসিল।
বাঁশের আগে যে কাক ডাকিল, ঝোপের
আড়ে যে শিয়াল কাঁদিল,
রাণী তাহা শুনিতে পাইল না।
ঠাকুরমার ঝুলি বাংলা
৩
পরদিন রাজ্যে হুলুস্থুল। ঘরে ঘরে মানুষের হাড়,
পথে পথে হাড়ের জাঙ্গাল! রাক্ষসে দেশ
ছাইয়া গিয়াছে, আর রক্ষা নাই। যখন
সকলে শুনিল, রাজপুত্রদেরও খাইয়াছে, তখন
জীবন্ত মানুষ দলে-দলে রাজ্য
ছাড়িয়া পলাইয়া গেল।
রাজা বোকা হইয়া রহিলেন; রাজার রাজত্ব
রাক্ষসে ছাইয়া গেল।
আরো পড়ুন,
৪
নদীর ধারে বাঁশের বন হাওয়ায় খেলে,
বাতাসে দোলে। এক কৃষাণ সেই বনের বাঁশ
কাটিল। বাঁশ চিবিয়া দেখে, দুই বাঁশের মধ্যে বড়
বড় গোল দুই ডিম। সাপের ডিম, না কিসের
ডিম। কৃষাণ ডিম ফেলিয়া দিল।
অমনি, ডিম ভাঙ্গিয়া, লাল নীল ডিম
হইতে লাল নীল রাজপুত্র বাহির হইয়া,-মুকুট
মাথে খোলা তরোয়াল হাতে জোড়া রাজপুত্র
শন্ শন্ করিয়া রাজ্য ছাড়িয়া চলিয়া গেল!
ডরে কৃষাণ মূর্ছা গেল।
যখন উঠিল, কৃষাণ দেখে, লাল ডিমের খোলস
সোনার আর নীল ডিমের খোলস
লোহা হইয়া পড়িয়া আছে! তখন
লোহা দিয়া কৃষাণ কাস্তে গড়াইল;
সোনা দিয়া ছেলের বউর পঁইচে, বাজু
বানাইয়া দিল।
চলিয়া চলিয়া, জোড়া রাজপুত্র এক রাজার
রাজ্যে আসিলেন। সে রাজ্যে বড় খোক্কসের
ভয়। রাজা রোজ মন্ত্রী রাখেন,
খোক্কসেরা সে মন্ত্রী খাইয়া যায় আর এক ঘর
প্রজা খায়। রাজা নিয়ম করিয়াছেন, যে কোন
জোড়া রাজপুত্র খোক্কস মারিতে পারিবে,
জোড়া পরীর মত জোড়া রাজকন্যা আর তাঁহার
রাজত্ব তাহারাই পাইবে। কত জোড়া রাজপুত্র
আসিয়া খোক্কসের পেটে গেল। কেহই খোক্কস
মারিতে পারে না; রাজকন্যাও পায় নাই, রাজ্যও
পায় নাই।
লালকমল নীলকমল জোড়া রাজপুত্র রাজার
কাছে গিয়া বলিলেন,-”আমরা খোক্কস
মারিতে আসিয়াছি!”
রাজার মনে একবার আশা নিরাশা;
শেষে বলিলেন,-”আচ্ছা।”
নীলকমল লালকমল এক কুঠুরিতে গিয়া, তরোয়াল
খুলিয়া বসিয়া রহিলেন।
৫
রাত্রি ক’দন্ড হইল, কেহ আসিল না।
রাত্রি আর ক’দন্ড গেল, কেহ আসিল না।
রাত্রি একপ্রহর হইল, তবু কেহ আসিল না।
শেষে, রাত্রি দুপুর হইল; কেহ আর আসে না। দুই
ভাইয়ের বড় ঘম পাইল। নীল
লালকে বলিলেন,-”দাদা! আমি ঘুমাই,
পরে আমাকে জাগাইয়া তুমি ঘুমাইও।” বলিয়া,
বলিলেন,-”খোক্কসে যদি নাম
জিজ্ঞাসা করে তো, আমার নাম আগে বলিও,
তোমার নাম যেন আগে বলিও না।” লালকমল
তরোয়ালে ভর দিয়া সজাগ হইয়া বসিলেন।
খোক্কসেরা আসিয়াই,-আলোতে ভাল
দেখিতে পায় না কি-না?-
বলিল,-”আলোঁ নিঁবোঁ।”
লালকমল বলিলেন,-”না!”
সকলের বড় খোক্কস রাগে গঁর গঁর,-বলিল-”বঁটে!
ঘরে কেঁ জাঁগেঁ?” যত
খোক্কসে কিচিমিচি,-”কেঁ জাঁগেঁ, কেঁ জাঁগেঁ?”
লালকমল উত্তর করিলেন-
“নীলকমল জাগে, লালকমল জাগে
আর জাগে তরোয়াল,
দপ্দপ্ করে ঘিয়ের দীপ জাগে-
কার এসেছে কাল?”
নীলকমলের নাম শুনিয়া খোক্কসেরা ভয়ে তিন
হাত পিছাইয়া গেল! নীলকমল আর
জন্মে রাক্ষসী-রাণীর পেটে হইয়াছিল, তাই তাঁর
শরীরে কি-না রাক্ষসের রক্ত!
খোক্কসেরা তাহা জানিত।
সকলে বলিল,-”আচ্ছা নীলকমল কি-
না পরীক্ষা কর।”
রাক্ষস-খোক্কসেরা নানা রকম
ছলনা চাতুরী করে’ সকলের বড় খোক্কসেটা সেই
সব আরম্ভ করিল। বলিল,-তোঁদের নঁখেঁর
ডাঁগাঁ দেঁখিঁ?”
লাল, নীলের মুকুটটা তরোয়ালের
খোঁচা দিয়া বাহির করিয়া দিলেন।
সেটা হাতে করিয়া খোক্কসেরা বলাবলি করিতে লাগিল-
বাঁপ্ রেঁ! ঐ যাঁর নঁখের ডঁগাঁ এঁমঁন,
না জাঁনি সেঁ কিঁ রেঁ!
তখন আবার বলিল,-দেঁখি তোঁদেঁর থুঁ থুঁ কেঁমঁন।”
লালকমল তরোয়াল প্রদীপের ঘি গরম
করিয়া ছিটাইয়া দিলেন। খোক্কসদের লোম
পুড়িয়া গন্ধে ঘর ভরিল; খোক্কসেরা আবার
আসিয়া বলিল,-”তোঁদেঁর জিঁভঁ দেঁখিবঁ।”
লাল, নীলের তরোয়ালখানা দুয়ারের ফাঁক
দিয়া বাড়াইয়া দিলেন। বড় খোক্কস দুই
হাতে তরোয়াল ধরিয়া, আর সকল
খোক্কসকে বলিল,-”এঁইবাঁর জিঁভ্
টানিয়া ছিঁড়িবঁ,
তোঁরাঁ আঁমাঁকে ধঁরিঁয়াঁ জোঁরেঁ টাঁন্-ন্-ন্।”
সকলে মিলিয়া খুব জোরে টানিল, আর তর্তর্
ধার নেঙ্গা তরোয়ালে বড় খোক্কসের দুই হাত
কাটিয়া কালো রক্তের বান ছুটিল!
চেচাঁইয়া মেচাইয়া সকল খোক্কস ডিঙ্গাইয়া বড়
খোক্কস পলাইয়া গেল!
অনেকক্ষণ পরে বড় খোক্কস আবার
কোথা হইতে ছুটিয়া আসিয়া বলিল,-”কেঁ জাঁগেঁ,
কে জাঁগেঁ?”
কতক্ষণ খোক্কস আসে নাই, লালকমলের ঘুম
পাইতেছিল; লালকমল ভুলে বলিয়া ফেলিলেন,-
“লালকমল জাগে, আর-”
মুখের কথা মুখে,-দুয়ার কবাট ভাঙ্গিয়া সকল
খোক্কস লালকমলের উপর আসিয়া পড়িল।
ঘিয়ের দীপ উল্টিয়া গেল, লালের মাথার মুকুট
পড়িয়া গেল;
লাল ডাকিলেন-”ভাই!”
নীলকমল জাগিয়া দেখেন,-খোক্কস!
গা মোড়ামুড়ি দিয়া নীল বলিলেন,-
“আরামকাকাঠি জিরামকাঠি, কে জাগিস্ রে?
দ্যাখ তো দুয়ারে মোর ঘুম ভাঙ্গে কে!”
নীলকমলের সাড়ায় আ-খোক্কস ছা-খোক্কস
সকল খোক্কস আধমরা হইয়া গেল। নীলকমল
উঠিয়া ঘিয়ের দীপ জ্বালিয়া দিয়া সব খোক্কস
কাটিয়া ফেলিলেন। সকলের বড়
খোক্কসটা নীলকমলের হাতে পড়িয়া, যেন,
গিরগিটির ছা!
খোক্কস মারিয়া হাত মুখ ধুইয়া দুই
ভাইয়ে নিশ্চিতে ঘুমাইতে লাগিলেন।
পরদিন রাজা গিয়া দেখিলেন, দুই রাজপুত্র
রক্তজবার ফুল-গলাগলি হইয়া ঘুমাইতেছেন;
চারিদিকে মরা খোক্কসরে গাদা।
দেখিয়া রাজা ধন্যধন্য করিলেন। রাজার রাজত্ব
ও জোড়া রাজ-কন্যা দুই ভাইয়ের হইল।
Thakurmar Jhuli Golpo Bengali
সেই যে রাক্ষসী-রাণী? রাজার
পুরীতে থানা দিয়া বসিয়াছে তো? আই-রাক্ষস
কাই-রাক্ষস তাঁর দুই দূত দিয়া খোক্কসের
মরণ-কথার খবর দিল। শুনিয়া রাসী-
রাণী হাঁড়িমুখ ভারি করিয়া বুকে তিন চাপড়
মারিয়া বলিল,-”আই রে! কাই রে!
আমি তো আর নাই রে!-
-ছাই পেটের বিষ-বড়ি
সাত জন্ম পরাণের অরি-
ঝাড়ে বংশে উচ্ছন্ন দিয়া আয়!”
অমনি আই কাই, দুই সিপাইর
মূর্তি ধরিয়া নীলকমল লালকমল রাজসভায়
গিয়া বলিল,-”বুকে খিল পিটে খিল, রাক্ষসের
মাথায় তেল না হইলে তো আমাদের রাজার
ব্যারাম সারে না।”
লালকমল নীলকমল কহিলেন,-”আচ্ছা, তেল
আনিয়া দিব।”
নূতন তরোয়ালে ধার দিয়া, দুই ভাই রাক্ষসের
দেশের উদ্দেশে চলিলেন।
যাইতে যাইতে, দুই ভাই এক বনের
মধ্যে গিয়া উপস্থিত হইলেন। খুব বড় এক
অশ্বত্থ গাছ হায়রাগ হইয়া দুই
ভাইয়ে অশ্বত্থের তলায় বসিলেন।
সেই অশ্বত্থ গাছে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী পীর বাসা।
বেঙ্গমী বেঙ্গমাকে বলিতেছে,-
“আহ, এমন দয়াল কাঁরা, দুই ফোঁটা রক্ত
দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়!”
শুনিয়া, লাল নীল বলিলেন,-”গাছের
উপরে কে কথা কয়?-রক্ত আমরা দিতে পারি।”
বেঙ্গমী “আহ্ আহা” করিল।
বেঙ্গম নিচে নামিয়া আসিল।
দুই ভাই আঙ্গুল চিবিয়া রক্ত দিলেন।
রক্ত নিয়া বেঙ্গম বাসায় গেল; একটু
পরে সাঁ সোঁ করিয়া দুই বেঙ্গম
বাচ্চা নামিয়া আসিয়া বলিল,-”কে তোমরা রাজপুত্র
আমাদের চোখ ফুটাইয়াছ? আমরা তোমাদের
কি কা করিব বল।”
নীল লাল বলিলেন,-”আহা, তোমরা বেঁচে থাক :
এখন আমাদের কোনই কাজ নাই।”
বেঙ্গম-বাচ্চারা বলিল,-”আচ্ছা, তা তোমরা,
যাইবে কোথায় চল,
আমরা পিঠে করিয়া রাখিয়া আসি।”
দেখিতে দেখিতে ডাঙ্গা জাঙ্গাল, নদ নদী,
পাহাড়-পর্বত, মেঘ, আকাশ, চন্দ্র, সূর্য সকল
ছাড়াইয়া, দুই রাজপুত্র পিঠে বাচ্চারা হু হু
করিয়া শূন্যে উড়িল।
৭
শূন্যে শূন্যে সাত দিন সাত রাত্রি উড়িয়া আট
দিনের দিন বাচ্চারা এক পাহাড়ের উপর নামিল।
পাহাড়ের নিচে ময়দান, ময়দান ছাড়াইলেই
রাক্ষসের দেশ। নীলকমল গোটাকতর কলাই
কুড়াইয়া লালকমলের
কোঁচড়ে দিয়া বলিলেন,-”লোহার কলাই
চিবাইতে বলিলে এই কলাই চিবাইও!”
নীল লাল আবার চলিতে লাগিলেন।
দুই ভাই ময়দান পার হইয়া আসিয়াছেন-,আর-,
“হাঁউ মাঁউ! কাউঁ!
এনিষ্যির গঁন্ধ পাঁউ!!
ধঁরে ধঁরে খাঁউ!!!”
-করিতে করিতে পালে পালে ‘অযুতে-
নিযুতে রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসিতে লাগিল।
নীলকমল চেঁচাইয়া বলিলেন,-”আয়ী মা! আয়ী মা!
আমরাই আসিয়াছি- তোমার নীলকমল,
কোলে করিয়া নিয়া যাও!”
“বঁটে বঁটে, থাঁম্ থাঁম্ !”
বলিয়া রাসদিগকে থামাইয় এ-ই লম্বা লম্বা হাত
পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে, ঝাঁকার জট
কাঁপাইতে কাঁপাইতে, হাঁপাইয়া ‘জটবিজটি’
আয়ীবুড়ি আসিয়া নীলকমলকে কোলে নিয়া-”আমার
নীল! আমরা নাঁতু!’ বলিয়া আদর করিতে লাগিল।
আয়ীর গায়ের গন্ধে নীলুর নাড়ি উলটিয়া আসে।
লালকে দেখিয়া আয়ীবুড়ি বলিল,-”ওঁ’ তোঁর
সঁঙ্গে কেঁ র্যাঁ?”
নীলু বলিলেন,- “ও আমার ভাই লো আয়ীমা,
ভাই!”
বুড়ি বলিল,-
“তাঁ কেঁন মঁনিষ্যি মঁনিষ্যি গন্ধ পাঁই?
আঁমার নাঁতু হঁয় তো চিবিয়ে খাঁক্
নোঁহার কঁলাই।”
-বলিয়া বুড়ি ‘হোঁৎ’ করিয়া নাকে ভিতর
হইতে পাঁচ গন্ডা লোহার কলাই বাহির
করিয়া লাল-নাতুকে খাইতে দিল।
লাল তো আগেই জানেন;-চুপে চুপে লোহার
কলাই কোঁচড়ে পুরিয়া, কোঁচড়ের সত্যিকার
কলাই কটর্ কটর্ করিয়া চিবাইলেন! বুড়ি দেখিল,
সত্যি তো, লাল টুক্টুক্ নাতুই তো। বুড়ি তখন
গদ্গদ্,-দুই নাতু কোলে নিয়া বুলায়, ঢুলায়, কয়-
“আঁইয়া মাঁইয়া নাঁতুর
লাঁলু নীলু কাঁতুর্
নাঁতুর বাঁলাই দূরে যাঁ!”
-কিন্তু লালকমলের শরীরে মনুষ্যের গন্ধ!-
কোটর চোক অস্গস্ জিভ বার বার খস্-খস্,
আয়ীর মুখের সাত কলস লাল্ গলিল! তা নাতু?
তা’ কি খাওয়া যায়? বুড়ি কুয়োমুখে লাড় টুকু
খাইতে খাইতে খাইল না। শেষে নাতু
নিয়া আয়ী বাড়ি গেল!
আরো পড়ুন,
৮
-সে কি পুরী!- রাজ্যজোড়ে। সেই ‘অছ্নি অভিন্’
পুরী রাক্ষসে কিল্বিল্। যত
রাক্ষসে পৃথিবী ছাঁকিয়া জীবজন্তু
মারিয়া আনিয়া পুরী ভরিয়া ফেলিয়াছ। লাল নীল,
রাক্ষসের কাঁধে চড়িয়া বেড়ান আর দেখেন,-গাদায়
গাদায় মরা, গাদায় গাদায় জরা! পচায়, গলায়
পুরী গদ্ গদ্ থক্ থক্ -গন্ধে বালো ভূত পালায়,
দেব দৈত্য ডরায়! দেখিয়া লাল বলিলেন,-”ভাই,
পৃথিবী তো উজাড় হইল।”
নীল চুপ করিয়া রহিলেন,-”নাঃ পৃথিবী আর
থাকে না!’ তখন, নিশি রাত্রে, যত নিশাচর
রাক্ষস, সাত সমুদ্রের ঐ পারে যত রাজ-রাজ্য
উজাড় দিতে গিয়াছে; এক কাচ্চা-বাচ্চাও
পুরীতে নাই; নীলকমল উঠিয়া,
লালকমলকে নিয়া পুরীর দক্ষিণ কূয়োর
পাড়ে গেলেন। গিয়া, নীল বলিলেন,-”দাদা, আমার
কাপড়-চোপড় ধর।”
কাপড় দিয়া, নাল, কূয়োয় নামিয়া এক খড়গ আর
এক সোনার কৌটা তুলিলেন। কৌটা খুলিতেই
জীয়নকাঠি মরণকাঠি দুই ভীমরুল ভীমরুলী বাহির
হইল।
জীয়নকাঠি মরণকাঠি-ভীররুল ভীমরুলীর,
গায়ে বাতাস লাগিতেই, মাথা কন্-কন্ বুক চন্-চন্,
রাক্ষসের মাথায় টনক্ পড়িল; বোকা রাজার
দেশে রাক্ষসী-রাণী ঘুমের চোখে ঢুলিয়া পড়িল।
মাথার টনক্ বুকে চমক্; দীঘল দীঘল
পায়ে রাক্ষসেরা নদী পবর্ত এড়ায়,
ধাইয়া ধাইয়া আসে! দেখিয়া নীলকমল
জীয়নকাঠির পা ছিঁড়িয়া দিলেন। যত রাক্ষসের
দুই পা খসিয়া পড়িল।
দুই হাতে ভর, তবু রাক্ষস ছুটিয়া ছুটিয়া আসে-
নীলকমল জীয়নকাঠির আর চার
পা ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। যত রাক্ষসের হাত
খসিয়া পড়িল
হাত নাই পা নাই, তবু রাক্ষস,-
“হাঁউ মাঁউ কাঁউ!
সাঁত শঁত্তুর খাঁউ!!-”
-বলিয়া পড়াইয়া গড়াইয়া ছোটে। খড়গের
ধারে ধরিয়া নীলকমল জীয়নকাঠির
মাথা কাটিলেন। আর যত রাক্ষসের
মাথা ছুটিয়া পড়িল। আয়ীবুড়ির মাথাটা,-
ছিটকাইয়া পড়িয়া নীল লালকে ধরে-ধরে গিলে-
গিলে।
তখন রাক্ষস-পুরী খাঁ খাঁ;-আর কে থাকে?
নীলকমল লালকমল আয়ীবুড়ির মাথা নূতন
কাপড়ে জড়াইয়া, মরণকাঠি ভীমরুলের সোনার
কৌটা নিয়া, “বেঙ্গম, বেঙ্গম!”- বলিয়া ডাক
দিলেন।
৯
তিন মাস তের রাত্রির পর দুই ভাইয়ের
পা দেশে পড়িল। দেশের সকলে জয় জয়
করিয়া উঠিল!
নীলকমল লালকমল বলিলেন,-”সিপাইরা কৈ?
ওষুধ নাও!”
সিপাইরা কি আছে? আই আর কাই তো রাক্ষস
ছিল! তারা সেইদিন-ই মরিয়াছে। নীলকমল
লালকমল আপন সিপাই বুকে খিল পিঠে খিল
রাজার দেশে রাসের মাথা পাঠাইয়া দিলেন।
“ও-মা!!”-মাথা দেখিয়াই রাণী-নিজ মূর্তি ধারণ
করিল-
“করম্ খাম্ গরম খাম্
মুড়মুড়িয়ে হাড্ডি খাম্!
হম্ ধম্ ধম্ চিতার আগুন
তবে বুকের জ্বালা যাম্!!
বলিয়া রাক্ষসী-রাণী বিকট
মূর্তি ধরিয়া ছুটিতে ছুটিতে নীলকমল
লালকমলের রাজ্যে গিয়া উপস্থিত হইল।
বাহির দুয়ারে,-”খাম্! খাম্!!”
লাল বলিলেন,-”থাম্ থাম্।” লালকমল
মরণকাঠি ভীমরুল আনিয়া-কৌটা খুলিলেন।
গা ফুলিয়া ঢোল,
চোখের দৃষ্টি ঘোল,
মরণকাঠি দেখিয়া, রাক্ষসী, মরিয়া পড়িয়া গেল!
সকলে আসিয়া দেখে,-এটা আবার কি!
খোক্কসের ঠাকুর’মা না কি? আমাদের
রাজ্যে বুঝি নিমন্ত্রণ খাইতে আসিয়াছেন?
সকলে “হো-হো-হো!!” করিয়া উঠিল।
জল্লাদেরা আসিয়া মরা রাক্ষসিটাকে ফেলিয়া দিল।
Thakurmar Jhuli Golpo Bangla
১০
রাণী মরিল, আর বোকা রাজার রোগ
সারিয়া গেল! ভাল
হইয়া রাজা রাজ্যে রাজ্যে ঢোল দিলেন।
প্রজারা আসিয়া বলিল,-”হায়! আমাদের সোনার
রাজপুত্র অজিত কুসুম কৈ?”
রাজা নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন,-”হায়! অজিত
কুসুম কৈ?”
এমন সময় রাজপুরীর ঢাক ঢোলের শব্দ।
রাজা বলিলেন,-”দেখ তো, কি।”
গলাগলি দুই রাজপুত্র আসিয়া রাজার
গায়ে প্রণাম করিল।
রাজা বলিলেন,-”তোরা কি আমার অজিত
কুসুম?”
প্রজারা সকলে বলিল,-”ইহারাই আমাদের অজিত
কুসুম!”
তখন দুই রাজ্য এক হইল; নীলকমল লালকমল
ইলাবতী লীলাবতীকে লইয়া, দুই রাজা সুখে কাল
কাটাইতে লাগিলেন।
আরো পড়ুন,