বিবাহ বিভ্রাট
বিবাহ বিভ্রাট :~ সুপ্রিয় ভট্টাচার্য্য
বৃহস্পতিবার অফিস করে বাড়িতে ফিরে ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম মা এসে বললেন ব্যাগ গোছাচ্ছিস কোথায় যাবি ? ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মাকে বললাম, তোমরা তো বিয়ে বাড়ি যাচ্ছ আমি একা একা থেকে কী করব তাই কাল ছুটি সে কারণে শুক্র, শনি, রবি এই তিন দিনের জন্য রাঁচিতে বন্ধু অনিন্দ্যর ওখানে যাচ্ছি সাড়ে নটায় ট্রেন, রবিবার রাত্রে ফিরবো।
Bangla Golpo
মা বললেন তাহলে অনিন্দ্যর ওখানে না গিয়ে আমাদের সাথে চল না। বললাম না তোমরা যাও আমার ওই বিয়েবাড়ী গিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে না। মা বললেন যাব তো পুরুলিয়ায় তোর বাবার বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে, মনে হয়না তোর খারাপ লাগবে। বললাম তোমরা তো বিয়ে বাড়ির নানা কাজে ব্যস্ত থাকবে আমার একা একা বোরিং ফিল করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। মা বললেন তুই চল না বিয়ে বাড়ির কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবি। বললাম পুরুলিয়ার লোকের সাথে বাবার বন্ধুত্বটা হলো কি করে ! সেখানে কি বাবা কখনো ছিলেন ? মা বললেন, তোর বাবা বিয়ের আগে প্রথম চাকরিতে জয়েন করে পুরুলিয়ায় চার’বছর ছিলেন। সেখানেই আলাপ হয় দীপকবাবুর সাথে, সেই আলাপ থেকেই বন্ধুত্ব যেটা ফোনের মাধ্যমে আজও আছে। দীপকবাবু তো প্রায়ই ফোন করেন, যদিও বা এক দু’দিন উনি ফোন না করেন তখন উল্টে তোর বাবা ফোন করে খবর নেয় তার শরীর ঠিক আছে কিনা। বললাম এটা আগে বললে তো ওদিকে একবার ঘুরে আসতে পারতাম কিন্তু এখন ওই বিয়ে বাড়ির..
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই মা বললেন, আগে কখনো পুরুলিয়া যাবি বলেছিস ? ছুটি পেলে সবসময়তো দীঘা মন্দারমনি নয়তো নর্থ বেঙ্গলের দিকে যাস, তোর বাবা বলেন বৈশাখের পুরুলিয়া খুব সুন্দর। সেখানে পাহাড় জঙ্গল সব আছে আর সব থেকে বড় কথা ওখানকার মানুষগুলো খুব সুন্দর।
আগে যখন ওদিকটায় তোর যাওয়া হয়নি এখন আমরা যাচ্ছি যখন তুইও আমাদের সাথে চল, দেখিস ভাল লাগবে !
ক্যামেরাটা ব্যাগের মধ্যে গুছিয়ে রাখতে রাখতে ভেবে নিলাম, রাঁচিতে অনিন্দ্য আছে যখন পরেও যাওয়া যাবে এখন বরং বাবা মার সাথে পুরুলিয়াটা ঘুরে আসা যাক।
ঠিক আছে চলো যাই, তোমাদের সাথে এই সুযোগে গেলে পুরুলিয়াটাও আমার ঘোরা হয়ে যাবে বলে ব্যাগের চেনটা আটকিয়ে মাকে বললাম, আমি একবার সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে দেখি রাঁচির টিকিটটা ক্যানসেল করতে পারি কিনা তারপর অনিন্দ্যকে বলে দেবো এবার আর যেতে পারলাম না পরেরবার যাবো।
আমি অরূপ, স্টুডেন্ট ছিলাম যখন বাবার থেকে টাকা ম্যানেজ করে বছরে একবার বন্ধুদের সাথে বকখালি দীঘা পুরী অথবা দার্জিলিং ছাড়া অন্য কোন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এখন চাকরি করি তিন চার দিনের ছুটি অথবা পুজোর ছুটি
পেলেই এ দিক সে দিক ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি নয়তো গ্রুপের সাথে ট্রেকিংয়ে যাই। হবি বলতে, গান শোনা, ছবি তোলা আর হেডলি চেজ ইয়ান ফ্লেমিংয়ের থ্রিলার বই পড়া।
ওয়ান সাইড প্রেমেও একবার পড়েছিলাম কিন্তু টেকেনি, এখন সে আমার ভালো বন্ধু !
থার্ড ইয়ারে যখন পড়তাম ঈশিকা নামের একটি মেয়ের সাথে মাস ছয়েক ঘোরাঘুরি মেলামেশা করে যখন প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি সে বলে বসল, তার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ছেলে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে প্রপোজ করে ধাক্কা খেয়ে সেদিন সেই মুহূর্তে খারাপ লেগেছিল বলে তাকে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, তুমি প্রথমেই এটা বলতে পারতে ! উত্তরে সে একটু হেসে বলেছিল, আমিতো বন্ধু ভেবেছিলাম অন্য কিছু ভাবি নি তো !!
বললাম এই ছয় মাস ধরে বন্ধুর মত ভেবে এলে কই একদিনও বলনি তো তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে ?
ঈশিকা সেই একই ভঙ্গিতে বলল, সেরকম প্রসঙ্গ ওঠেনি তাই বলিনি। মনে মনে ভাবলাম সেটাও ঠিক এরকম কথাবার্তা এর আগে তো কখনো হয়নি।
বললাম ঠিকই তো, anyhow congratulations তাহলে আজ থেকে আমরা বন্ধু হলাম।
পরের বছর অস্ট্রেলিয়ার ছেলের সাথে ঈশিকার বিয়েটা হয়নি কারণ, বিয়ের কুড়ি দিন আগে ঈশিকার বাবা বিদেশ মন্ত্রক মারফত জানতে পারেন ছেলে সিটিজেনশিপ পাওয়ার জন্য একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলাকে অলরেডি বিয়ে করে রেখেছে।
বিয়ের আয়োজনটা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল বলে তড়িঘড়ি করে ঈশিকার বাবা তার ব্যবসাদার বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। ফলস্বরূপ দেড় বছরের মাথায় ঈশিকার ডিভোর্স হয়ে যায়।
মাঝেমধ্যে সময় পেলে ঈশিকার বাড়িতে গিয়ে দেখা করি কথাবার্তা বলি, বুঝতে অসুবিধা হয় না, মানসিকভাবে ঈশিকা খুব একটা ভালো নেই।
চাকরি পাওয়ার খবরটা যেদিন ঈশিকাকে দিয়েছিলাম সেদিন ঈশিকা বলেছিল, আজ তুই আমার বাড়িতে আয় তোকে খাওয়াবো।
গিয়েছিলাম অনেক কিছু খাইয়ে ছিল হাসতে হাসতে ঈশিকা এটাও বলেছিল, সেদিন তোর প্রস্তাবটা একসেপ্ট করলে ভালোই হতো ! তাহলে আজ আমাকে এত কিছুর সম্মুখীন হতে হতো না !!
ঈশিকার অনলাইনে আনানো তন্দুরি খেতে খেতে আমি বলেছিলাম ভাগ্যিস করিস নি, তাহলে এত ভাল একটা বন্ধু আমি পেতাম না। আমার কথায় সেদিন ঈশিকা সামান্য একটু হেসেছিল ঠিকই কিন্তু বুঝতে অসুবিধা হয়নি সেই হাসিটা কান্নার থেকেও অনেক বেশি ছিল।
Bangla Golpo Online Reading
সাইবার ক্যাফেতে যাব বলে মোটরসাইকেলটা যখন বার করছি বাবা বললেন, ভেবেছিলাম কাল সকাল সকাল বেরিয়ে একেবারে টিকিট কেটে নেব কিন্তু তুই যখন তোর টিকিট ক্যানসেল করতে যাচ্ছিস তাহলে লালমোটি এক্সপ্রেসের তিনটে চেয়ার কারের টিকিট কেটে নিস।
ঠিক আছে বলে গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে মনে মনে ভাবতে ভাবলাম, পুরুলিয়া সম্বন্ধে অনেক শুনেছি, কৃষ্ণচূড়া শাল শিমুল অযোধ্যা পাহাড় আর মহুয়ায় ভরা জায়গাটা অনেক সুন্দর। তাই এই বৈশাখ মাসে প্রকৃতির টানে রাঁচিতে অনিন্দ্যর ওখানে না গিয়ে মায়ের কথাতেই রাজি হয়ে গেলাম।
২:৩৫ মিনিটে পুরুলিয়া স্টেশনে নেমে দীপকবাবুর বাড়িতে এসে যখন পৌছালাম তখন তিনটে বেজে গেছে, গাছপালায় ঘেরা বেশ বড় বাড়ি সামনে শান বাঁধানো পুকুর কিন্তু পুকুরে জল খুব বেশি নেই। পুকুরের চারধারে বেশ বড় বড় গাছ, পরিবেশটা কেমন যেন একটা শান্ত স্নিগ্ধ ছায়ায় ঘেরা, ভালোলাগার পক্ষে যথেষ্ট।
আমাদের দেখে দীপকবাবু এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন কতদিন পর দেখলাম, রাস্তায় কোন অসুবিধা হয়নি তো ? বাবা হাসতে হাসতে বললেন, অনেক বছর পর এসেছি তার উপর সবকিছু পাল্টে গেছে বলে একটু গুলিয়ে ফেলেছিলাম কিন্তু তোমার নাম বলাতে গাড়িওয়ালা সোজা তোমার বাড়িতে নিয়ে এলো, আমাদের কোন অসুবিধা হয়নি বলে আমার দিকে তাকিয়ে বাবা বললেন, তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, আমার ছেলে অরূপ, আর ইনি আমার মিসেস। মিসেসের সঙ্গে তোমার ফোনের মাধ্যমে আগেই আলাপ হয়েছে কিন্তু সামনাসামনি কখনো দেখা হয়নি। দীপকবাবু মায়ের দিকে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন বৌদি, আমার মেয়েটার মা নেই, আপনাকেই সব সামলাতে হবে, ওই জন্যেই বন্ধুকে বারবার বলেছিলাম বিয়ের দুটো দিন আগে আসতে ! আপনারা এসে গেছেন আমি নিশ্চিন্ত, আসুন ভিতরে আসুন। দীপকবাবু মানুষটাকে দেখে আমার যেন কেমন একটা হল, পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলাম। উনি আমাকে হাত ধরে তুলে বললেন বেঁচে থাকো বাবা, আজকালকার দিনে কেউ আর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে না, তোমাকে দেখে ভালো লাগলো, তুমি যেন কিসে একটা চাকরি পেয়েছে ? বললাম ফুড এন্ড সাপ্লাইতে, দীপকবাবু হেসে বললেন, খুব ভালো।
Bangla Golpo Story
খাওয়া-দাওয়া সেরে আমার ডিএসএলআর ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। একে রোদের তাপ বেশি তার উপর রাস্তা ঘাট চিনি না তাই বাইরে কোথাও না গিয়ে পুকুরের উল্টোদিকে গাছগাছালিতে ভরা বাগানটায় গিয়ে ঢুকলাম এই আশায় কোন অচেনা পাখির দেখা যদি পাই। পাখির দেখা না পেলেও পরীর দেখা পেলাম ! দেখলাম, মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়া একটা মোটা গাছের ডালে কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বন্ধ করে মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। এখানে এইভাবে একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে একটু অবাক না হয়ে পারিনি, বেশ কয়েক সেকেন্ড মেয়েটিকে ভালো করে দেখে দ্বিধা কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম আলাপ করতে। কাছে যেতেই মেয়েটি তার প্রজাপতির মতো চোখ দুটো মেলে আমাকে দেখে হেডফোনটা কান থেকে সরিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল, এতটা রাস্তা জার্নি করে এসেছেন একটু রেস্ট নিলে পারতেন তো ? বললাম, আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পারলাম না ! মেয়েটি একটু হেসে আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে বলল, ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়েছেন ছবি তোলার শখ আছে নিশ্চয়ই !! বললাম হ্যা। মেয়েটি বলল তাহলে এখানে কি ছবি তুলবেন, সাত কিলোমিটার দূরে তো জঙ্গল সেখানে আপনি খুব ভালো ভালো ছবি তুলতে পারবেন। বললাম জায়গাটা তো চিনিনা, তবে একটা টোটো বা অটো রিজার্ভ পাওয়া গেলে ভালো হতো, দেখি রাস্তার দিকে এগিয়ে যাই যদি পাওয়া যায়। মেয়েটি বলল আপনি কি এখন যাবেন নাকি ? বললাম হ্যা, সময় নষ্ট করে কি হবে তার থেকে বরং ঘুরে আসি। মেয়েটি বলল, টোটো অটো কোথাও পাবেন না, যদিও বা পান আপনি যখন পৌঁছাবেন তখন প্রায় সন্ধে নামবে। তার থেকে কাল সকালে যদি যান তাহলে আলোছায়া আর রোদ্দুরের মধ্যে, জঙ্গলের অন্যরকম চেহারা দেখতে পাবেন। মেয়েটির কথা শুনে মনে হল সে ঠিকই বলছে, বললাম, সকালে টোটো অটো পাবো তো ? এবার মেয়েটি বললো চলুন বাড়ির দিকে যাই বলে কয়েক পা এগিয়ে সে বলল, কাল সকাল ছটার মধ্যে তৈরি হয়ে থাকবেন, আমার স্কুটিতে আপনাকে জঙ্গলে নিয়ে যাব। আপনারা যার বিয়েতে এসেছেন আমি সেই অদিতি।
আধঘন্টা আগে যাকে জীবনে প্রথম দেখলাম তার বিয়ের কথাটা শুনে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কেন জানি মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেল…
“গল্পটি দুটি পর্বের,
শেষ পর্ব শুক্রবার”
আরো পড়ুন,