“কিরে রোজী কী ব্যাপার তোর তিন দিন ধরে ধান্দা তে আসছিস না কেন ?”
কথা টা বেশ রাগের সুরেই বললো সোনাগাছি পতিতাপল্লীর সুন্দরী রানি ৷
“কেন বলেছি তো শরীর ভালো না তাই যাইনি ” রোজী বললো ৷
“বাব্বা যে শরীর বিক্রি করে খাস সেটা কেই খারাপ করে ফেললি ; যাইহোক তোকে যেটা বলতে এসেছি খাঁচা তে একটা নতুন ময়না এসেছে হেব্বি তেঁটিয়া মাল তোকে মাসি একটু সামলে নিতে বলেছে , তোর ডিমান্ড তো সব থেকে বেশী এখানে দেখ সামলাতে পারিস কিনা; একটু পর ওকে তোর রূম এ পাঠাচ্ছি” ,এই বলে রানী বেরিয়ে গেলো রোজীর রূম থেকে , রোজীর গায়ে হাতে খুব ব্যাথা তাই শুয়ে রইল ৷ কিছুক্ষণ পর একটা সুরেলা আওয়াজ ওর কানে এসে পৌঁছাল , বিছানা ছেড়ে উঠে দেখল একটা পনের ষোলো বছরের মেয়ে দরজার সামনে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে ৷ রোজী
ভ্রু কুচকে ওকে কাছে ডাকলো মেয়ে টাকে ;মেয়ে টা ভয়ে ভয়ে কাছে এল রোজীর ৷” এই মেয়ে তোর নাম কী ?”
মেয়ে টা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল কিরে চুপ করে রইলি? বোবা নাকি? এই শোন আমার আমার এত সময় নেই বাজে বকার ; এই রোজী কে এখানে সবাই সমঝে চলে বুঝ্লি ৷ কিরে তুই কী কানেও শুনতে ও পাসনা …..”আমি মিঠু ৷” আসতে আসতে উত্তর দিল মিঠু ৷ রোজী একটু ব্যাঁকা হাসি হেসে বললো ” মিঠু , এইসব নাম দিয়ে এখানে ধান্দা করা যাবে না তুই এখন ঘরে যা কাল থেকে তোর ট্রেনিং শুরু হবে এই রোজী তোকে একদম তোকে সেকেন্ড রোজী বানিয়ে দেবে ৷ মিঠু তখন ও ওখানে দাঁড়িয়ে রইল , রোজী কিছু টা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল “কিরে এখনো যাসনি?” মিঠু একটু গলা টা ঝেরে নিয়ে বললো ” দিদি তোমার গায়ে হাতে ব্যাথা একটু পা টিপে দেবো হাত পা গুলো ?” রোজী অবাক হয়ে গেলো মিঠুর কথা শুনে; বিগত পনের বছর ধরে ধান্দা করছে কেউ ওর শরীর খারাপ হয়েছে নাকী কোনোদিন ও জিজ্ঞেস করেনি৷ রোজী এবার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ” তুই কী করে জানলি আমার শরীর খারাপ ?” মিঠু বললো ” সবাই বলছিল তোমার নাকী শরীর খারাপ তাই ; দাও না দিদি আমি তোমার হাত পা টিপে দিচ্ছি “এই বোলে মিঠু রোজীর পা টিপ্ তে শুরু করে দিলো ৷ রোজীর বেশ আরাম হচ্ছিল আরাম খেতে খেতে ও মিঠু কে জিজ্ঞেস করল ; ” এই ধান্দা তে এলি কেন তুই , এই বয়স টা তো লেখাপড়া করার বয়স ৷” মিঠু মুচকি হেসে বললো “করবো তো দিদি লেখাপড়া দিয়ে অনেক বড় হব ; আমার বাবা বলেছে এখানে আমাকে কাজ দেওয়া হবে আসলে লেখা পড়া করার তো অনেক খরচা তাই এখানে কাজ করলে আমি অনেক টাকা পাবো ওই টাকা দিয়ে আমি বই কিনবো পড়াশুনা করতে পারব ৷ রোজী ওর কথা শুনে হোহো করে হেসে ফেললো ” তুই এখানে কাজ করবি ? বলি কী কাজ হয় তুই জানিস ? মোটা টাকা তুই পাবি যদি কাস্টমার কে খুশি করতে পারিস তবে বুঝ্লি৷” মিঠু কিছু না বুঝে এক গাল হাসি হেসে দিলো ৷ মেয়ে টার চোখে মুখে অদ্ভুত মায়া আর হাসি ঠিক নিস্পাপ শিশুর মতো এক মুহূর্তে রোজী কে ওর অতীতের কথা মনে করিয়ে দিলো ; রোজীর অাসল নাম ছিল পদ্মা ও এরকম হাসি খুশি নিস্পাপ মনের একটা মেয়ে , সবাই ওকে খুব ভালোবাসতো , কিন্তু ওর বাবা মারা যাবার পর ওর মা আবার বিয়ে করে আর ওর সত্ বাবা কলকাতা তে কাজ দেবার নাম করে পতিতাপল্লীতে বিক্রি করে দিয়ে চলে যায় , অনেকবার পালানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি , দিনের পর দিন কষ্ট সহ্য করে আজ হয়ে উঠেছে হাই ডিমান্ডিং রোজী, নিজের ভাগ্যের পরিহাস এর কথা ভেবে হেসে ফেললো রোজী ; মিঠুর দিকে তাকিয়ে বললো ” যা এবার ঘরে যা “; মিঠু কিছু না বলে হেসে চলে গেলো ৷ পরের দিন সকালে রোজী ঘুম ভেঙ্গে যেতে দেখল মিঠু এক ভাঁড় চা নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে আছে ও উঠে পড়ল ধরমর করে ” কিরে এত সকাল সকাল চা নিয়ে কী করছিস ; মিঠু সেই শিশু সুলভ হাসি হেসে বললো “দিদি চা খাও শরীর ঠিক হয়ে যাবে “
রোজী আবার হেসে ফেললো ” তুই আমার জন্য চা নিয়ে এসেছিস , কিন্তু আমি তো চা খাই না , ওই দেখ্ছিস রঙিন বোতল ওটা খাই যা ওটা নিয়ে আয় ওসব চা টা হাটা “৷ মিঠু চা টা রেখে কিছু না বুঝেই বোতোল টা এগিয়ে দিয়ে চলে গেলো ৷ কিছুক্ষণ পরে রেডী হয়ে বাইরে এসে দেখল এক হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে গেছে মিঠুর ঘরে; রানি মোহিনী সবাই৷ রোজী ভীড় ঠেলে ঘরে ঢুকলো মিঠুর ঘরে দিয়ে ধমক দিয়ে বললো ” কী হয়েছে টা কী ? তোরা সবাই চিল্লমিল্লি কেন করছিস ?” মোহিনী বললো ” এই চিরিয়া টা বলে কিনা ধান্দা করবেনা , তোর বাপ কে অনেক টাকা দিয়েছি বুঝ্লি, এখানে এসে কোনো মেয়ে তো সতী হয়ে ফিরে যেতে পারেনা ৷ ” রোজী আবার ও ধমক দিলো ” চুপ কর মোহিনী রোজীর সামনে এত কথার সাহস কারো নেই তোর খুব সাহস হয়েছে তাই না ” ; রোজীর কথা শুনে মোহিনী চুপ করে গেলো ৷মিঠু ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে ; মিঠুর চোখে জল দেখে মুহূর্তে হুহু করে উঠ্লো রোজীর পাথর হয়ে যাওয়া মন তবু ও রোজী ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতে গেলো রোজী কাছে যেতে মিঠু ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো ৷রোজী নিজেকে শক্ত করে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিলো আর বললো ” ওসব ন্যাকা কান্না কেঁদে রোজী কে ভোলানো যাবেনা , তোর বাপ কে যেন টাকা গুলো দিয়েছি ওটা উসুল করেই ছাড়বো ; ;আজ রাতে ওকে রেডী করে রাখিস ওই যে বাবু টা এক সপ্তাহ আগে এসেছিল ; ওর বাংলো তে নিয়ে যাব ; ওই মালদার বাবু কে ফোন লাগা , বল ওর জন্যে তোফা নিয়ে যাচ্ছি আজ রাতে টাকা রেডী রাখ্তে বল ৷” এই বলে রোজী ঝড়ের গতিতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো ৷ রাত ৮.৩০ নাগাদ রোজী মিঠু কে নিয়ে বেরল , অটো ধরে অটো ওয়ালা কে ধর্মতলা নিয়ে যেতে বললো ৷ মিঠু চুপ করে বসে রইল ওর সর্বনাশের অপেক্ষায় ৷ অটো এসে দাঁড়ালো ধর্মতলা তে ওরা নামল রোজী ভাড়া মিটিয়ে দিলো ৷ মিঠু তখন ও চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল ৷রোজী ওর হাত টা ধরে বললো “খিদে পেয়েছে বোন?” রোজীর কথা শুনে মিঠু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে ৷রোজী এরপর মিঠুর হাতে একটা ব্যাগ তুলে দিয়ে বললো ” এই ব্যাগ এ কুড়ি হাজার টাকা আছে , আর আমার কিছু গয়না ; তুই এখান থেকে বাস এ করে শ্যামবাজার চলে যা ওখানে আমার পিসি থাকে ; তুই ওর কাছে চলে যা , ওখানে গিয়ে বলবি পদ্ম দিদি পাঠিয়েছে আর যদি আমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে বলবি আমি পরে দেখা করে আসব ; কিন্তু আমার কাজের কথা বলিস না পিসি জানে আমি মুম্বাই এ বিশাল চাকরী করি তুই বোন দয়া করে বলিস না “৷ মিঠু রোজীর কথা শুনে কেঁদে ফেললো ,কাঁদতে কাঁদতে বললো ” দিদি তুমি এত ভালো ; তুমি পিসির কাছে কেন ফিরে যাচ্ছনা ?” চুপ করে রইল রোজী তারপর বললো ” পিসি আমাকে খুব ভালোবাসতো , আমি ছোটো বেলাতে বাবার সাথে আসতাম ; কিন্তু বাবা মারা যাবার পর যখন এই ধান্দা তে চলে এলাম পিসির কাছে ফেরার অনেক চেষ্টা করি তবে যেতে পারিনি; পদ্মা থেকে রোজী হবার পরে পিসির সাথে যোগাযোগ করেছি তবে বলিনি আমি এই কাজ করি ; পিসি লোকের বাড়িতে কাজ করতো আগে এখন আমি প্রত্যেক মাসে টাকা পাঠাই ; বাড়ি ভাড়া বাকী সব খরচ; আমি নয় আরো বেশী টাকা পাঠাবো ; তুই যা ওখানে কিন্তু বলিস না কিচ্ছু পিসি কে ৷ ” কথা বলতে বলতে বাস এসে গেলো রোজী মিঠু কে বাস এ তুলে দিয়ে সব বুঝিয়ে দিলো ; মাথা তে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ” বোন কলকাতা তে অনেক আলো থাকলে ও আমাদের জীবন টা পুরো অন্ধকারে ঢাকা ৷ “
“কিন্তু তুমি মোহিনী দিদিদের কী বলবে ওরা যদি কিছু জিজ্ঞেস করে ” মিঠু বললো
রোজী একটা ব্যাঁকা হাসি হেসে বললো ” আমি রোজী আমার কথাই ওখানে শেষ কথা , ওদের আমার মুখের উপর কথা বলার সাহস নেই তুই সাবধান এ যাস পিসি যদি জিজ্ঞেস করে বলবি তুই পিসি কে দেখ|শোনা করতে গেছিস; তুই ওখানে ভালো থাকবি ; পড়াশুনা করবি তোকে স্কুলে আমি ভরতি করে দেবো পিসি কে বুঝিয়ে ঠিকাছে ;যা বোন আজ তুই মুক্ত ৷” রোজীর কথা শেষ হতে না হতেই মিঠু কেঁদে ফেললো , রোজী ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললো ” আর কাঁদিস না বোন , আমি আছি তো, আমি দুনিয়ার সামনে বেশ্যা হলেও আমি
মেয়ে মা এর জাত আর মা হয়ে কী করে আরেক টা মেয়ের সর্বনাশ করি ; ভালো থাক বোন ভালো থাক ৷ “
পনের মিনিট এর মধ্যে বাস ছেড়ে দিলো ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইল দুজোন দুজনার দিকে ……..ক্রমশ ঝাপসা হতে থাকল রোজীর মুখ ৷
শুধু মিঠুর বুকে বাজ্তে থাকল ওই কথা টা ” আমি বেশ্যা হলেও আমি মেয়ে ” আমি বেশ্যা হলেও আমি মেয়ে ” আমি বেশ্যা হলেও আমি মেয়ে ৷”