জানো ওঁর খুব সকাল সকাল অফিস বলে,আমায় ওঁর আগেই উঠে পড়তে হয় আজকাল ঘুম থেকে..যতটা সকালে মা উঠতো বাবা,আর আমি আর তুমি, “আমাদের তো এখন মাঝ রাত্রি..”বলে ভোর ছটাটাকেও ঘুমে দশ গোল দিয়ে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতাম দুজনে…! গ্যাস জ্বালিয়ে চা বসাই একদিকে, আর একদিকে ওঁর জন্যে ভাত..আগের দিন রাতে শোবার আগে, মনে করে ডাল করে ফ্রিজে রেখে দিতে হয়..যদি ভুলে যাই..।আমাদের এই ফ্লাটের ছয় তলা বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে আমি ভোর বেলা দূরের রাস্তাটা দেখতে পাই, আর রাস্তা দেখতে পেলেই আমার বড্ড তোমাদের কথা মনে পরে…। মনে হয়, আমায় চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিক কেউ ওই রাস্তায়..আমি আমাদের বাড়িটায় , থুড়ি “বাপের বাড়িটায়” ঠিক পৌঁছে যাবো..। তারপর আমার যে ঘরটা ছিলো,তাতে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে ঘুমাবো, বেলা করে উঠবো..তুমি মা দুজনেই একবার করে ডেকে যাবে আর আমি ততোবার পাশ ফিরে চাদর টেনে…!! জানো বাবা, আমি কতোদিন একটু ভাল করে রাতে ঘুমাইনি..? ভোরের আগেই ভোর হয়ে যায় মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে… তুমি বুঝি এখনো দেরী করেই ওঠো ? মাকে বলো , খুব সকালেও এখন আমাদের মাঝ রাত্রি..?
সারাদিনের রান্না কাজ সব শেষ করে যখন নিজের ঘরে যাই দুপুর হয়ে যায়, ওঁকে ফোন করি , খেয়েছো টুকু জিজ্ঞেস করার উত্তর দিতে দিতেই বলে অফিসে অনেক কাজ..পরে কথা হবে ফিরে…আমি ফোন রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়াই, দেখি ফ্ল্যাটের নীচে ছোটো ছোটো বাচ্ছা গুলো পিঠে ব্যাগ নিয়ে স্কুল থেকে ফিরছে এক এক করে..কেউ বা স্কুল বাসে কেউবা মায়ের হাত ধরে, হাতে চিপসের প্যাকেট গলায় আই কার্ড, স্কুলের সাদা জামা..আমার হিংসে হয় বড্ড..আমি চোখ ঘুরিয়ে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবি, এইতো সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে তুমি আমায় শেখাচ্ছিলে , এই বছরটা খুব ভাল করে পড়তে হবে, মাধ্যমিক জীবনের সবচেয়ে বড় প্রথম পরীক্ষা…
কেনো বলেছিলে অমন ? সবচেয়ে বড় পরীক্ষা তো সেদিন ছিলো , যেদিন মায়ের আঁচলে চাল ছুঁড়ে ঋণ মেটাতে বলেছিলো পাশের বাড়ির ফুল পিসি..
স্কুলে পড়তে যেদিন গানে প্রথম হয়েছিলাম, তোমার মনে আছে ? স্কুলের বড়দি মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “অনেক দূর যাবি..” আমি অনেকটা দূরেই এসছি বাবা, যতটা দূরে এলে তোমাদের রোজ একবারের জন্যে হলেও চোখের দেখাও দেখা যায় না..আজকাল সন্ধ্যের দিকে একা একাই মনের ভুলে গেয়ে ফেলি দু চার লাইন, আমার শাশুড়ি মা হেসে বলেন , ভালই তো হচ্ছে…করো..তারপর মনে করিয়ে দেন রাতের রুটি , ওঁর জামার আয়রন সবটাই বাকী..আমি মনে পরতেই লজ্জা পেয়ে যাই, ময়দা মাখতে মাখতে ভাবি, মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে গান থাকে , কবিতা থাকে , নাচও থাকে। তবে তা সংসারের রোজনামচার তালে, লয়ে । আলাদা করে তাতে কান পেতে শুনে মুগ্ধ হওয়ার ভাগ্য ,খুব কম মেয়েই জীবনে নিয়ে আসে…
দুপুর বেলা আলমারী খুলে বিয়ের শাড়ি গুলোয় হাত রাখি, গয়না গুলো বাক্স খুলে খুলে দেখে আবার আগের মতোন পুরে রাখি, মনে পরে এই একটা গয়নার জন্যে তোমায় দিন রাত অক্লান্ত চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরতে কাজ থেকে…মনে পরে তোমার প্রতিটা শখ , মায়ের আল্হাদ গুলো নিমিষে ম্যাজিকের মতোন ভ্যানিশ হয়ে যেতে..মনে পরে প্রতিটা অভাবের মুখে আরও অসংখ্য অভাবের গল্প লুকিয়ে , তোমায় আমায় বোঝাতে , “এইটুকু দিতেই হয় মা…” !
জানো, কোনোদিন বলিনি তোমাদের, যখন ছোট্ট একটা কাজ পেয়েছি কলেজ পাশ করে, বিয়ের কথা বার্তা যখন একটু একটু করে জলের মতোন গড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের তিনজনের একতলার বাড়িটায়..তখন প্রায় দিন অফিস করে বাড়ি ফেরার সময় পৃথিবীর তোমার বয়সী সমস্ত পুরুষকেই আমার বাবা বলে মনে হতো, কেউ রিকশাতে কিংবা ঝালমুড়ি দিয়ে দু টাকা বেশি নিলেও আমি একটুও রেগে যেতাম না..দিয়ে দিতাম..শুধু মনে হতো তাঁদের তুমি..।তুমিও তো এমন আমায় খুশী করবার জন্যে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বাড়ি ফিরছো রোজ..শুধু মনে হতো তাঁর বাড়িতেও আমার মতোন বোধহয় একটা মেয়ে আছে বাবা, যাঁর বাবার ইচ্ছে অনেক, কিন্তু সামর্থ বাঁধা…!
আমি ভালই আছি জানো..
পাখা , কম দামী রঙের দেওয়াল, সাদা মেঝে,মায়ের আঁচল তোমার গায়ের গন্ধ সবটাই ছেড়ে আমি ভাল আছি বাবা…শুধু কখনো কখনো ঘুমের ভেতর আমি দেখতে পাই, তুমি আমার প্রিয় গরম গরম জিলিপি এনে ডাকছো আমায়…আর মা বিছানার পাশে এসে বলছে আর কতো ঘুমাবি?? দেখ তোর বাবা তোর জন্যে কী এনেছে…” আমি চমকে উঠে বসি, দু গাল মুছি, জল খাই…
মনে হয় , আমি এখনও স্কুলে আছি…কড়া একটা ক্লাস চলছে..আমার একটুও ভাল্লাগছে না..তবুও আমি ভান করছি, মন দিয়ে পড়ার..অথচ আমি ছুটির অপেক্ষা করছি, তুমি নিতে আসবে..গেটের বাইরে , ভীড়ের মধ্যে আমি ঠিক চিনে নেবো তোমায়..তারপর ছুটটটট….
আমার ছুটি কখন হবে বাবা ? বাড়ি নিয়ে যাবেনা আমায়… ? তাড়াতাড়ি এসো না…আর কতক্ষণ আমি দাঁড়িয়ে থাকবো…এসো না..প্লীজ এসো…প্লীজ…
ভালো লাগলে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না …
ভালো থাকুক প্রতিটি বাবার রাজকন্যা তার রাজকুমারের এর সাথে …. মুহুর্তেরা হোক অনেক রঙিন । শুভকামনা রইলো ❤️