(১)
অর্কর মাথায় আসছে না, মেয়েটি কি তাকে দেখার জন্যই ব্যালকনিতে বসে থাকে! আজ চারদিন হয়ে গেল অর্ক যখনই ব্যালকনিতে এসেছে, তখনই সে দেখেছে মেয়েটি তাদের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে বসে আছে। চোখাচোখি হলেই মেয়েটি অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসে। মেয়েটি কি অর্ককে চেনে? অর্কর চেনা চেনা লাগলেও, কিছুতেই মনে করতে পারছে না, সে মেয়েটিকে কোথায় দেখেছে। আজ যেন অর্কর মনে হচ্ছে, সেও মেয়েটিকে দেখার জন্যই বার বার ব্যালকনিতে চলে আসছে। প্রথম দিন সে সিগারেট খেতে ব্যালকনিতে এসেছিল। মা জানলেও, মায়ের সামনে অর্ক সিগারেট খায়না। তাই ব্যালকনিতে সিগারেট খেতে এসেছিল। পুরোনো বাড়িতে সে ছাদে যেত সিগারেট খেতে।
চার দিন আগে, যেদিন অর্ক মাকে নিয়ে এই ফ্ল্যাটে এসেছিল, সেদিন দুপুরেই প্রথম খেয়েদেয়ে ব্যালকনিতে সিগারেট খেতে এসেছিল। সিগারেট ধরিয়ে সামনের ফ্ল্যাট বিল্ডিংটার দিকে তাকাতেই অর্কর ঠিক রাস্তার ওপর তাদের সামনের বিল্ডিংটার পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে চোখ চলে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ অর্কদের ফ্ল্যাটটাও পাঁচ তলায়। চোখ পড়তেই সে দেখে একটি মেয়ে নীল শাড়ি পরে, ব্যালকনির রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে। অর্কর প্রথম নজরেই নীল শাড়ি পড়া, খুব ফর্সা আর কোমর পর্যন্ত ছাপিয়ে পড়া চুলের এই মেয়েটিকে খুব চেনা চেনা লাগছিল। তাই অর্ক একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে চেনার চেষ্টা করছিল। মেয়েটি হটাৎ অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল। নিজের অজান্তেই অর্ক প্রত্যুত্তরে হাসলেও, অর্কর কেমন লজ্জা লাগলো। সে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে সিগারেট টানতে লাগল। তার মাথায় তখন ঘুরছে কি কি কাজ বাকি রয়ে গেল।
অর্কদের পাঁচ পুরুষের পৈতৃক বাড়ি ছিল চন্দন নগরে। পাঁচ পুরুষ ধরেই চলে এসেছে যৌথ পরিবার। সেই যৌথ পরিবার ভেঙ্গে গেল বছর দেড়েক আগে, অর্কর বাবা মারা যেতে। অর্কর বাবারা ছিলেন তিন ভাই। অর্কর বাবা ছিলেন সব চেয়ে ছোট। তার দুই জ্যাঠা আগেই মারা গিয়েছিলেন। অর্কর বাবা মারা যেতে দুই জ্যাঠার ছেলেরা সিদ্ধান্ত নিল তাদের সেই পৈতৃক বাড়ি প্রমোটারকে দিয়ে দেবে। হলোও তাই। প্রমোটার সেই পাঁচ পুরুষের বাড়ি ভেঙ্গে পনের তলা ফ্ল্যাট বানানোর উদ্যোগ নিতে শুরু করলো। অর্ক আর অর্কর মায়ের ভাগে একটা করে ফ্ল্যাট আর সঙ্গে দশ লাখ করে টাকা। বছর খানেক আগে বাড়ি ভাঙ্গা শুরুর আগে অর্ক আর অর্কর মা চন্দন নগর ছেড়ে কলকাতায় চলে এসেছিল বাড়ি ভাড়া নিয়ে। চন্দন নগর থেকে অর্কর কলকাতায় অফিসে যাতায়াতে অসুবিধা হচ্ছিল। তাই কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে থাকতে এসেই অর্ক খুঁজে বেড়াচ্ছিল একটা ছোটর ওপর ভালো ফ্ল্যাট। ভেবেই রেখেছে তার আর তার মেয়ের প্রাপ্য ফ্ল্যাট আপাতত ভাড়া দিয়ে রেখে দেবে। শেষে গত মাসে রুবি হসপিটালের কাছেই এই ফ্ল্যাটের সন্ধান পায়।
চারদিন আগে এই ফ্ল্যাটে গৃহ প্রবেশ করলেও, কেনা কাটা অনেক বাকি। তাই অর্ক অফিস থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়েছে। রোজই বিকেলে মাকে নিয়ে বেরোচ্ছে। কখনো ফার্নিচারের দোকানে, কখনো পর্দার দোকানে, কখনও আবার রান্নার বাসন-কোষণের দোকানে।
অর্ক মনে মনে ভাবছিল এখনো টিভির কানেকশন বাকি। রান্নার গ্যাস ট্রান্সফার করাতে হবে, আসে পাশের কোনো ব্যাঙ্কে মার নামে একটা একাউন্ট খোলাতে হবে, যাতে মা নিজে গিয়ে ফ্যামিলি পেনশন তুলতে পারে। এই সব কাজের কথার মধ্যেও মাথায় ফিরে এলো সেই মেয়েটি। নিজের অজান্তেই তার চোখ চলে গেল সামনের ব্যালকনিতে। মেয়েটি তখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হটাৎ অর্কর মনে হলো, সেও তো কালকে থেকে অনেকবার ব্যালকনিতে এসেছে। সেও কি মেয়েটিকে দেখার জন্যই ব্যালকনিতে আসছে! তার অবচেতন মন কি তাকে ব্যালকনিতে টেনে আনছে? এই সব ভাবতে ভাবতে অর্ক আবার একবার তাকালো মেয়েটির দিকে। মেয়েটির সেই হাসি। অর্কও হেসে ভেতরে চলে গেল।
রাত দশটা বাজে। অর্ক খেয়ে দেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়ে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়েছে। অর্কর ছুটি শেষ। কাল থেকে তাকে অফিস যেতে হবে। ঘরের কেনা কাটা বা প্রয়োজনীয় সব কাজ হয়ে গেছে। গত সাত দিন অর্ক ফেসবুক খুলে দেখে নি। দেখেনি মানে দেখার সময় হয় নি। গত সাত দিনে অর্ক কোনো নতুন গল্পও পোস্ট করতে পারে নি। আজ অর্কর ইচ্ছে হলো একটু ফেসবুকটা খুলে দেখার। অর্ক শুধু ফেসবুকেই গল্প লেখে না। তার লেখা গল্প প্রায় ছোট বড় সব পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে। গত বছর বই মেলায় তার প্রথম গল্প সংকলনও বেরিয়েছে। বইটা বই মেলায় হট কেক ছিল। ফেস বুকেও তার জনপ্রিয়তা আকাশ ছোঁয়া।
অর্ক ফেসবুক খুলতেই দেখলো অসংখ্য নোটিফিকেশন আর ইনবক্সেও বেশ কিছু মেসেজ। অর্ক ইনবক্সের ম্যাসেজের জবাব সাধারণত দেয় না। সে বার বার নিজের ওয়ালে বন্ধুদের অনুরোধ করেছে যে তারা যেন অর্কর ইনবক্সে মেসেজ না দেয়। তাও মেসেজ আসে। অর্ক পড়েও দেখে না। তাই উত্তর দেওয়ার প্রশ্নও থাকে না।
কিন্তু আজ ফেসবুক খুলতেই ইনবক্সে দেখলো কেউ একজন, যে তার বন্ধু নয়, সে কিছু বলতে চায়। ফেসবুক অর্ককে সেকথা বলছে। অর্ক মনে মনে ভাবল এ আবার কে? অবশ্য এরকম অভিজ্ঞতা অর্কর আগেও হয়েছে। কোনো গ্রূপের কোন পাঠক বা পাঠিকা অনুরোধ করেছে অমুক গল্পের শেষ অংশটা অমুক গ্রূপে আর একবার দেওয়ার জন্য। সে খুঁজে পাচ্ছে না। অর্ক সেক্ষেত্রে পাঠকের অনুরোধ রাখে। সেরকম কোনো পাঠক ভেবেই অর্ক ফেসবুকের কথা মতো একসেপ্ট করল। মুহূর্তে চমকে উঠল অর্ক। এত সামনের ফ্ল্যাটের মেয়েটি। লিখেছে, ‘স্যার! আমি সুলেখা বাগচী। আপনার গল্প আমি নিয়মিত “গল্পের খোঁজে” গ্রূপে পড়ি। আপনি কি ছায়ানট বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে এসেছেন?’ অর্ক এবার বুঝলো সামনের ফ্ল্যাটের মেয়েটির তার দিকে তাকিয়ে থাকা আর চোখাচোখি হলেই হাসার কারণ। অর্ক লিখে ফেলল,’ হ্যাঁ। তবে আমার স্যার সম্মোধনটাতে একটু এলার্জি আছে। আমার নামটাই যথেষ্ট।’ এই কথা লিখে দিয়ে অর্ক ফেসবুকের নোটিফিকেশন গুলো একটা একটা করে খুলে দেখতে লাগল।
মিনিট পাঁচেক পরেই আবার অর্কর ল্যাপটপের স্ক্রিনে সুলেখার ফটো। অর্ক বুঝলো মেয়েটি অন লাইনে এসেছে। সেই সুলেখা লিখল,’ আপনার সাথে পরিচয় করতে চাই। আপনি অনুমতি দিলে আমি আপনার ফ্ল্যাটে কাল আসতে চাই। কখন আসবো বলুন?’ অর্ক একটু চিন্তা করল। তারপর কি ভেবে লিখে ফেলল,’ কাল সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার পর।’ সুলেখা মুহূর্তে থ্যাঙ্ক ইউ লিখলো। অর্ক থামস আপ দিয়ে আবার নোটিফিকেশন খুলে খুলে পড়তে লাগল।
অর্ক ছটা বাজতেই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। মনে মনে একটু টেনশন ছিল। সে নিজে জানে সে একটু লাজুক প্রকৃতির। ফেসবুকে সে যে কোনো পাঠক বা পাঠিকার প্রশ্নের উত্তর খুব সহজেই দেয়। কিন্তু তার ছোট বেলা থেকে মেয়েদের সাথে কথা বলার অভ্যেস নেই বললেই চলে। শুধু একটু আধটু জ্যাটতুতো দিদি, বোনদের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা আছে। ব্যাস, ওইটুকুই।
মনে মনে ভেবেছিল একটু তাড়াতাড়ি ফিরে মাকে একটু বলে দেবে। না হলে, মা হয়তো ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু অর্ক ফেঁসে গেল জ্যামে। বাস আর এগোয়না। ফলে অর্কর বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেল। লিফট দিয়ে উঠে দরজায় কলিং বেল বাজাতে গিয়ে চোখে পড়ল একটা লেডিজ চটি। অর্ক বুঝল সুলেখা এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। মনে মনে ভাবছিল, মা আগেকার দিনের মানুষ, কি ভাবছে কে জানে!
অর্ক এই সব যখন ভাবছে, মা এসে দরজা খুলে হেসে বলল,’সামনের ফ্ল্যাটের সুলেখা এসেছে। সে নাকি তোর গল্পের ভক্ত। তোর সাথে আলাপ করতে এসেছে।’ মায়ের কথা শুনতে শুনতে অর্ক ড্রইং রুমে ঢুকল। অর্ককে দেখে সুলেখা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল,’ নিশ্চই জ্যামে ফেঁসে গিয়েছিলেন?’ অর্ক সুলেখার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ব্যালকনি থেকে সুলেখাকে সুন্দরী মনে হতো, কিন্তু তিন ফুট দূর থেকে সুলেখাকে দেখে অর্ক বুঝলো, সে যতটা ভেবেছিল, সুলেখা তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দরী। অর্কর খেয়াল হলো, সে হা করে সুলেখার দিকে তাকিয়ে আছে। তাই লজ্জায় মাথা নামিয়ে বলল,’ হ্যাঁ, জ্যামে ফেঁসেই দেরি হলো। বসো, বসো।’ সুলেখা বলল,’ হ্যাঁ, আমি বসছি। তবে আপনি যান আগে একটু ফ্রেশ হয়ে আসুন। তারপর আপনার সাথে একটু আড্ডা দেব।’ এই আড্ডা দেব কথাটা শুনে মনে মনে অর্কর হাসি পেল। যেন কত দিনের বন্ধুত্ব! অর্কর মা বললেন,’ হ্যাঁ, বাবু! তুই যা, একটু হাত মুখ ধুয়ে নে। আমি চায়ের জল বসাচ্ছি। তুই আসবি আসবি ভেবে বেচারীকে আমি এখন পর্যন্ত জল ছাড়া কিছুই দিইনি।’ মায়ের কথা শুনে অর্ক ল্যাপটপের ব্যাগটা নিজের ঘরের টেবিলে রেখে সোজা বাথরুমে চলে গেল।
অর্ক ফ্রেশ হয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যখন ড্রইং রুমের সোফায় ফিরে এলো, ততক্ষণে অর্কর মা, সেন্টার টেবিলে চা আর একটা প্লেটে কিছু নিমকি রেখে রান্না ঘরে চলে গেছে।
অর্ক সোফায় বসে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে সুলেখার দিকে তাকিয়ে বলল,’ নিন, চা খান।’ সুলেখাও চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল,’ফেসবুকের প্রোফাইল থেকে আপনার সম্পর্কে খুব বেশি জানতে পারি নি। তবে এতক্ষন কাকিমার মুখে আপনার অনেক কথাই শুনলাম। আপনার ছোট বেলার কথা, আপনার পড়াশোনা, লেখালেখি সব কিছু। এবার আমার পরিচয় দিই। আমি খুব সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতোই। বাংলা নিয়ে পড়াশোনা করেছি। গতবছরই এম এ পাস করেছি। এখন বসে আছি। বাবা আগামী বছর রিটায়ার করবেন। তাই বাবা, মা উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে বিদায় করার জন্য।’ সুলেখা শব্দ করে হেসে উঠল। তারপর সে আবার বলল,’ একটাই হবি, বই পড়া। বলতে পারেন বইয়ের পোকা। নিন এবার এটাতে আপনার অটোগ্রাফটা দিন। যার জন্য আপনার কাছে আসা।’ অর্ক এতক্ষণ খেয়ালই করেনি সুলেখার কোলের ওপর তার প্রথম গল্প সংকলন,” টক মিষ্টি ঝাল” বইটা রাখা ছিল। সুলেখা বইটা এগিয়ে দিল অর্কর দিকে। অর্ক কাপটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে, সেন্টার টেবিলের নীচ থেকে একটা পেন বার করে বইয়ের প্রথম পাতায় লিখলো, “সুলেখা কে”। তার নীচে সই করে সুলেখার দিকে এগিয়ে দিল।
সেদিন আর বেশি কথাবার্তা হলো না। হঠাৎই সুলেখার মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। সুলেখা মোবাইল ফোনটা কানে নিয়ে বলল,’ কি বলছো, নটা বেজে গেছে? হ্যাঁ মা! আমি এক্ষুনি আসছি।’ সুলেখা ফোনটা কেটে দিয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে বলল,’ আজ বাড়ি যাই। আজ আর আড্ডাটা ঠিক মতো হলো না। আবার অন্য একদিন আসবো।’ এই কথা বলে সে উঠে পড়ল। অর্কর মা রান্না ঘরে ছিল। সে সেখানে গিয়ে বলল,’ কাকিমা! আসছি।’ অর্কর মা বললেন,’ তুমি মাঝে মধ্যে চলে আসবে। তোমার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগবে।’ সুলেখা বলল,’ হ্যাঁ, নিশ্চই আসবো, কাকিমা।’ এই কথা বলে সুলেখা ড্রইং রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অর্কও এগিয়ে গেল দরজার দিকে। সুলেখা লিফটে ঢোকার মুখে, ঘাড় ঘুরিয়ে অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল। অর্কও হাসল।
(২)
অর্ক রাত্রে খেয়ে দেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে সিগারেট খেয়ে এসে নিজের ঘরের টেবিলে বসল। প্রায় আট ন দিন আগে একটা গল্প প্রায় শেষ করে এনেছিল। কিন্তু শেষটা আর লেখা হয়নি। সেই গল্পটা শেষ করবে ভেবে টেবিলের ওপর থেকে কাগজ আর পেন টেনে নিল। গল্পটা আর একবার প্রথম থেকে পড়তে শুরু করল। পড়া শেষ হতে ভাবতে লাগলো গল্পের শেষটা কি ভাবে লিখবে। কয়েক মুহূর্ত পর সে বুঝল, তার মাথা কাজ করছে না। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সুলেখার হাসি মুখটা। সেই কাজল পড়া টানা টানা চোখটা। সেই হাসি মুখের গালের টোলটা। অর্ক ভেবে পাচ্ছে না। তার এরকম আজ কেন হচ্ছে! রাস্তা-ঘাটে এমনকি তার অফিসেও অনেক মেয়েকেই তো সে রোজ দেখছে। তাদের অনেকেই বেশ সুন্দরী। তাহলে তার সুলেখাকে সামনা সামনি দেখার পর থেকে কেন এরকম হচ্ছে? মনে মনে ভাবল তাহলে কি সে সুলেখার প্রেমে পড়ে গেল!
ছোট বেলা থেকে গল্প-উপন্যাসে অনেক প্রেমের অনুভূতির বর্ণনা পড়েছে। সেই পড়ার অভিজ্ঞতা থেকেই, সেও তার নিজের গল্পে ওই ধরণের বর্ণনার সাথে নিজের কিছু কল্পনা জুড়ে দিয়ে প্রেমের অনুভূতির বর্ণনা দিয়েছে। কিন্তু আজ তার মনে যেটা হচ্ছে, সেটা যেন একটু অন্যরকম। সেই অনুভূতির বর্ণনা সে আজ পর্যন্ত কোনো গল্প-উপন্যাসে পড়ে নি। সে নিজেই তার অনুভূতিটাকে যেন বুঝতে পারছে না। এতদিন সে অনেক গল্প লিখেছে। কিন্তু কবিতা লেখে নি। লেখেনি মানে, সে লেখার চেষ্টা করলেও, লিখতে পারে নি। বহুবার লেখার চেষ্টা করেছে। লিখেছেও কখনও কখনও তিন চার লাইন। কিন্তু সেই কবিতার প্রথম তিন চার লাইন পড়ে নিজেই হেসে উঠেছে। মনে মনে ভেবেছে, ধ্যূত! এটা আবার কবিতা হলো না কি! ভাবতে ভাবতে কাগজটা ছিড়ে ফেলে দিয়েছে।
কিন্তু আজ তার এ কি হলো! আজ তার মাথায় এতো কবিতা এসে ভিড় করছে কেন? না, তার প্রিয় কবি জীবনানন্দ বা জয় গোস্বামীর কবিতা নয়। যা মনে আসছে মানে যে শব্দ বা লাইন গুলো মাথায় আসছে, অর্ক বুঝতে পারছে সেগুলো তার মস্তিষ্কের ভেতরে থাকা গ্রে ম্যাটারটাই সৃষ্টি করছে। তাহলে কি সেই পুরোনো কথাটাই সত্যি? “প্রেমে পড়লে অনেকেই কবিতা লেখে।” আজ তো অর্কর সেরকমই অবস্থা।
অর্ক যেন আর নিজের মধ্যে নেই। তার চোখের সামনে ভাসছে সুলেখার সেই দীঘল কালো চোখ। যে চোখে মায়াবী নেশার হাতছানি। সে যন্ত্র চালিতের মতো ফেসবুক খুলে মেসেঞ্জারে সুলেখাকে মেসেজ করল-
” তোমার দীঘল কালো মায়াবী চোখের নেশায়,
মনের ভেতর ইচ্ছে পাখি ডানা ঝাপটায়।
রাতের ঘুম নোঙ্গর ফেলেছে তোমার জ্যোৎস্নায়,
লোনা জলের ভালোবাসায় মাতিয়ে দিও আমায়।”
অর্ক তার লেখা সেন্ট করে চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইল। তার বুকের মধ্যে তখন সাগরের উত্তাল ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে।
ও ভাবে অর্ক কতক্ষন বসে ছিল, তা তার খেয়াল ছিল না। বুকের হৃদ স্পন্দনের গতি একটু কমতে সে চোখ মেলে কম্পিউটারের দিকে তাকালো। তাকিয়েই চমকে উঠল। আবার বুকের মধ্যে সেই ঢেউ আছড়ে পড়ছে। না এবার সেই ঢেউ আছড়ে পড়তে তার বুকে লাগছে না। মনে হচ্ছে তার কত কালের বুকের ভেতরের কষ্টটার ওপর কেউ যেন মলম লাগিয়ে দিচ্ছে। বুকের মধ্যের সেই ভালোলাগা আবেশটা যেন তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্ক পড়ছে সুলেখার উত্তর-
“ইচ্ছে পাখি ডানা মেলে উড়ুক আকাশের বুকে,
সে আকাশ আজ সারা দিচ্ছে ইচ্ছে পাখির ডাকে।”
অর্ক আর থাকতে পারল না। সে লিখে ফেলল-
“বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তোমার অপেক্ষায় থাকবো ধর্মতলার অম্বর রেস্ট্রুরেন্টে।”
মুহূর্তে রিপ্লাই এলো-
“আসছি ঠিক সময়ে।”
অর্ক ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত বারোটা বাজে। সে কম্পিউটার বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। সে শুধু এপাশ ওপাশ করে চলেছে ঘুমোনোর জন্য। না তার ঘুম আসছে না। অর্ক উঠে পড়ল আবার। মুখে জল দিল, একটু জল খেল। আবার দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দুটো বাজে। তারপর দরজা খুলে বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো। সিগারেটে একটা টান দিয়ে সামনের ফ্ল্যাটের দিকে তাকালো। দেখে সুলেখাদের ফ্ল্যাটের একটা ঘরে তখনও লাইট জ্বলছে। অর্ক বুঝতে পারলো, সুলেখাও ঘুমোতে পারছে না। সিগারেট খাওয়া শেষ হতে, সে ফিরে এলো নিজের বিছানায়। মাথায় তখন ঘুরছে, কাল কি হবে? সে, কি কি কথা সুলেখাকে বলবে। ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে অর্ক ঘুমিয়ে পড়ল।
সকাল আটটা। অর্ক ডাইনিং টেবিলে বসে জল খাবার খাচ্ছে। টেবিলের অপর পাশে অর্কর মা বসে আছে। হঠাৎই অর্কর মা বললেন,’এই সুলেখা মেয়েটিকে তোর কেমন মনে হলো?’ অর্ক মায়ের কথায় বিষম খেয়ে উঠল। একটু জল খেয়ে, বা হাত দিয়ে মাথায় চাপ্পর মেরে নিজেকে সামলে নিয়ে অর্ক বলল,’ কেন বলোতো?’ অর্কর মা বললেন,’ কালকে মেয়েটির সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো। শুধু দেখতে শুনতেই ভালো যে তা নয়, মেয়েটির স্বভাবটাও খুব ভালো মনে হলো। একটু খোঁজ নিয়ে দ্যাখ না মেয়েটি সম্পর্কে।’ অর্ক আবার বিষম খেতে খেতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’ কি খোঁজ নেব?’ অর্কর মা বললেন,’ বুঝিস না কেন? আজকালকার মেয়ে, তার ওপর দেখতে শুনতে ভালো। কোনো ছেলের সাথে আবার প্রেম টেম নেই তো?’ অর্ক এবার পরিষ্কার বুঝলো, মা কোন দিকে এগোচ্ছে। বুঝে খুব খুশি হলো। কিন্তু সেই খুশি মনের মধ্যে চেপে রেখেই বলল,’ শুনলে না, কাল কি বলল। ওর বাবার আর একবছর চাকরি আছে। তাই ওর বাবা, মা ওর বিয়ের চেষ্টা করছে। তাই মনে হয় না, ওর সাথে কোনো ছেলের প্রেম আছে। কিন্তু তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন?’ অর্কর মা বললেন,’আমি ভাবছিলাম, মেয়েটিকে তোর পছন্দ হলে..’ অর্কর মায়ের কথা আর শেষ হলো না। তার আগেই অর্ক মাথা নামিয়ে বলে ফেলল,’ আমার আবার পছন্দ-অপছন্দের কি আছে? তোমার যদি পছন্দ হয়ে থাকে, ওর বাবা, মায়ের সাথে কথা বলে দেখো।’ অর্কর জল খাবার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সে জল খেয়ে বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল হাত ধুতে।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটা বাজে। অর্ক বসে আছে অম্বর রেস্ট্রুরেন্টে। বার বার ঘড়ির দিকে দেখছে। সে অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় অম্বরে পৌঁছে, একটা টেবিলে বসে আছে। ছটা বাজতেই তার টেনশন সুরে হয়ে গিয়েছিল। সে মেসেঞ্জারে মেসেজ দিয়েছে দুবার। কিন্তু রিপ্লাই তো দূর, সুলেখা তার মেসেজ দুটো খুলেই দেখছে না। খুব আফসোস হচ্ছে অর্কর। সে কেন সুলেখার মোবাইল নম্বরটা নিয়ে রাখে নি। তাহলে এত দুশ্চিন্তা হতো না। সাতটা বাজতেই অর্ক উঠে পড়ল। মনে মনে ভাবছিল, সুলেখা হয়তো তার সাথে মজা করেছে। নিজেকে অর্কর খুব বোকা বোকা লাগছিল। এই সব ভাবতে ভাবতে সে বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল।
রুবি হসপিটাল স্টপেজে বাস থেকে নেমে অর্ক হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। ফ্ল্যাটের গলিতে ঢুকেই দেখে তাদের ফ্ল্যাটের নীচে বেশ কিছু মানুষের জটলা। অর্ক দূর থেকে দেখল তার মাও নিচের দিকে তাকিয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক ধীরে ধীরে সেই জটলার কাছে এসে দাঁড়ালো। সে এই পাড়ায় নতুন। খুব বেশি কাউকেই চেনে না। তার চোখে পড়ল তার পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোকও সেই জটলার মধ্যে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক এগিয়ে গেল সেই ভদ্রলোকের দিকে। তাকে সে জিজ্ঞেস করল,’ দাদা! কি হয়েছে?’ ভদ্রলোক অর্কদের উলটো দিকের বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলা ফ্ল্যাটের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল,’ ওই ফ্ল্যাটের একটি মেয়ের আজ রুবি হসপিটালের সামনে এক্সিডেন্ট হয়েছে। মেয়েটির মা, বাবাকে একটু আগেই পাড়ার ছেলেরা রুবি হসপিটালে নিয়ে গেছে।’ শুনেই অর্কর শরীরটা কাঁপতে লাগলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সে তাড়াতাড়ি নিজেদের বিল্ডিংয়ের ফ্ল্যাটের দিকে এগোলো। পাঁচ তলায় গিয়ে মায়ের হাতে টিফিন আর ল্যাপটপের ব্যাগটা দিয়ে সে বলল,’ মা! তুমি তো শুনেছো নিশ্চই, সুলেখার এক্সিডেন্ট হয়েছে। আমি একবার দেখে আসছি।’ অর্ক এই কথা বলে নীচে নেমে এলো। প্রায় দৌড়তে দৌড়তে রুবি হসপিটালে পৌছালো।
অর্ক যখন রুবি হসপিটালে পৌছালো, তখন সুলেখা অপারেশন থিয়েটারে। অপারেশন থিয়েটারে বাইরেই দাঁড়িয়ে আছেন সুলেখার বাবা, মা আর সুলেখাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক, ভদ্র মহিলা। অর্ক, সুলেখার বাবা, মাকে ব্যালকনি থেকে বেশ কয়েকবার দেখলেও, পরিচয় নেই। তাই অর্ক একটু দূরে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।
পাড়ার অনেকেই আসছে, যাচ্ছে। সুলেখার বাবা, মার সাথে কথা বলছে, তাদের সান্তনা দিচ্ছে। সেই পাড়ার লোকেদের সাথে, সুলেখার বাবা, মার সাথে কথা বার্তা থেকে অর্ক বুঝতে পারল, বিকেল চারটে নাগাদ সুলেখা রুবি হসপিটালের মোড় থেকে একটা ধর্মতলার বাসে উঠতে যাচ্ছিল। হটাৎ পেছন থেকে একটা ট্যাক্সি এসে সুলেখাকে ধাক্কা মারে। সুলেখা রাস্তায় পড়ে যায়। এরপর পেছন থেকে আর একটা ট্যাক্সি এসে পড়ে। ট্যাক্সিটা সুলেখাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও, ট্যাক্সির একটা চাকা সুলেখার বা পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়।
তখন রাত বারোটা বাজে। অপারেশন থিয়েটারে থেকে সুলেখাকে নিয়ে যাচ্ছে স্ট্রেচারে করে। অর্ক পেছন পেছন এগিয়ে গেল। একটা কেবিনের বেড়ে তাকে শুইয়ে দেওয়া হলো। তখন ব্লাড দেওয়া চলছে। অর্ক সেই কেবিনের বাইরেই দাঁড়িয়েছিল। হটাৎ সুলেখাদের পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গেলেন। ডাক্তার বললেন,’ বা পা টা একদম থেঁতলে গেছে। হাড় টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ফলে উপায় ছিল না। হাঁটুর নিচের অংশটা কেটে বাদ দিতে হলো।’ অর্ক নিজের মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
সন্ধ্যে সাড়ে ছটা। অর্ক এই মাত্র সুলেখাকে তাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এলো। সুলেখা হসপিটাল থেকে ছুটি পেল ঠিক দুমাস পর। সুলেখাকে জয়পুরী লেগ লাগাতে হয়েছে। এই দু মাস অর্ক রোজ অফিস ফেরত সুলেখাকে দেখতে যেত। প্রায় ঘন্টা খানেক সুলেখার বেডের পাশে চুপ করে বসে থাকতো। সুলেখার বাবা, মায়ের সাথেও পরিচয় হয়ে গেছে। আজ অর্কই সুলেখাকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করে নিয়ে এসেছে।
অর্কর মা সুলেখাকে এক দিনের জন্যও দেখতে যায়নি। প্রায়ই তিনি অর্ককে বলতেন,’ রোজ রোজ হসপিটালে গিয়ে দেখার কি আছে? এক্সিডেন্টের দিন ঠিক ছিল। শত হলেও প্রতিবেশীর মেয়ে।’ অর্ক কোনোদিন মায়ের কথার জবাব দেয় নি।
সুলেখা বাড়িতে আসার পরও অর্ক নিয়ম করে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে সুলেখাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঘুরে আসতো। একদিন অর্কর মা অর্ককে রাত্রে খেতে দিতে দিতে বলল,’তুই এবার সুলেখাদের ফ্ল্যাটে যাওয়া বন্ধ করে দে। আসে পাশের ফ্ল্যাটের লোকেরা ব্যাপারটা নিয়ে আজকাল খুব হাসাহাসি করছে।’ অর্ক মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ হাসতে দাও। আমি সুলেখাকে বিয়ে করে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে এলে এই সব হাসাহাসি বন্ধ হয়ে যাবে।’ অর্কর মা, তার হাতে ধরা তরকারির বাটিটা ডাইনিং টেবিলে রেখে বলল,’ কি বলছিস তুই? তুই সুলেখাকে বিয়ে করতে চাস?’ অর্ক বলল,’ হ্যাঁ, মা। মেয়েটা কি খারাপ? একদিন তো তুমিই সুলেখার সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়ে ছিলে। আজ হঠাৎ কি হলো?’ অর্কর মা একটু রেগে গিয়ে বললেন,’ হ্যাঁ, তখন বলেছিলাম। কিন্তু তখন আর এখনের মধ্যে অনেক ফারাক। একটা পা নেই। জেনে শুনে কোন সুস্থ সবল ছেলে একজন প্রতিবন্ধী মেয়েকে কি বিয়ে করে? তার ওপর..’ অর্ক তার মার কথা শেষ করার আগেই বলল,’ মা! যদি আমার সুলেখার মতো অবস্থা হতো? তাহলে কি আমাকেও কেউ বিয়ে করত না? না তুমি আমার বিয়ে দিতে চাইতে না?’ অর্কর কথা শুনে অর্কর মা কেঁদে অর্ককে জড়িয়ে ধরে বলল,’ এরকম বলিস না রে। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ঠিক আছে। আমি আজই সুলেখার মায়ের সাথে কথা বলবো।’
….শেষ…