উত্তর কোলকাতার বর্ধিষ্ণু গুহঠাকুরতা পরিবারে আজ শত আনন্দের মাঝেও বিষাদের সুর।সকাল থেকেই বিসমিল্লাহর সানাই জানান দিচ্ছে কন্যাবিদায়ের সময় উপস্থিত হবে আর কিছুক্ষণের মধ্যে।প্রখ্যাত ব্যবসায়ী মিস্টার বিজন গুহঠাকুরতা আর মিসেস বিনীতা গুহঠাকুরতার একমাত্র মেয়ে মানালি আজ বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।প্রতিটা মেয়ের মা বাবার জীবনে এই দিনটায় একটা আনন্দ মাখা বিষাদ গ্রাস করে।এতদিন ধরে সমস্ত স্নেহ ভালবাসা দিয়ে যাকে তিলে তিলে বড় করা হয় সে এক নিমেষে অন্য কারোর বাড়ির বউ হয়ে যায় সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে এটাই সমাজের বিধিনিয়ম।মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে হলেও গুহঠাকুরতা দম্পতিও তাই ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছেন নিজেদের মুখের হাসিটা ধরে রাখার যাতে ওনাদের মনখারাপ করতে দেখে মানালি না ভেঙে পড়ে।
এমনিতে মানালির স্বামী দীপ্ত সুপুরুষ এবং যথাযোগ্য ভাবেই সুপ্রতিষ্ঠিত ওর কর্মজীবনে।বলা যেতে পারে গুহঠাকুরতা পরিবারের পাল্টিঘর সুযোগ্য পাত্র নিজে এবং তার পরিবারের লোকজন।তবুও যা হয় আর কি!নতুন পরিবেশে সব ঠিকঠাক থাকবে কিনা এই ভেবেই ওনাদের দুশ্চিন্তার মেঘ কাটতেই চায়না।
যাইহোক সারাদিন এটা ওটা নিয়নকানুনের পর বিকেলে শ্বশুরবাড়ি রওনা হবার আগে গুহঠাকুরতা পরিবারের কুলপুরোহিত রামকিঙ্করবাবু মানালির হাতে তুলে দেন কিছু চাল তারপর বলেন,”মামণি এবার বাপের বাড়ি ছাড়বার আগে কনকাঞ্জলি দেবার সময় উপস্থিত।তুমি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে মুঠো ভরে তিনবার তোমার মায়ের আঁচলে চালগুলো দাও আর মুখে বলো মা তোমার ঋণ আমি শোধ করলাম। মনে রেখ কথাটা বলে আর একদম পিছনদিকে তাকাবেনা।”
এতক্ষণ চুপচাপ থাকলেও এবার সবাইকে অবাক মানালি বলে,”ক্ষমা করবেন পুরোহিত দাদু,আমার অপরাধ নেবেন না।ছোটো থেকে শুনে আসছি শাস্ত্রে বলে মা বাবার ঋণ কোনোদিন শোধ করা যায়না।তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে সে নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটবে কেন একটু বলবেন?এতদিন ধরে পড়াশুনো শিখিয়ে আদর ভালোবাসা দিয়ে যারা বড় করলো তারা কি বিয়ের শেষে এক নিমেষে পর হয়ে যায়?তবে এ কেমন শাস্ত্র?আর আমি আমার বাপের বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছি এটা আপনাকে কে বললো? আমি আরেকটা নতুন মা বাবার কাছে যাচ্ছি।আজ থেকে আমার দুটো বাড়ি।যখন যেখানে ইচ্ছা থাকব।”উপস্থিত সকলে তখন চুপ।আপাত দৃষ্টিতে শান্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা মানালির দিকে তাকিয়ে তখন সব বিস্ময়ে হতবাক।বলে কি মেয়েটা এতবড় সত্যি কথাগুলো নির্দ্বিধায় বলে দিল।
তবে অবাক হবার বোধয় আরো কিছু বাকি ছিল।এগিয়ে এসে নিজের স্ত্রীর হাতটা ধরে দীপ্ত বলে,”একদম ঠিক কথা বলেছ তুমি।নিয়মরীতি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য এক হওয়া উচিত।একজন পুরুষ তো বিয়ের আগে বাড়িতে কখনোই বলে আসেনা যে তোমাদের ঋণ শোধ করে বিয়ে করতে যাচ্ছি তাহলে একজন নারী কেন বলবে যে সব ছেড়ে দিয়ে চললাম? এইসব প্রথা তো বহুকাল ধরে চলে আসা একপ্রকার সামাজিক অসুখ।এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস কজনের বা আছে?শোনো মানালি তোমার মনের এই স্বাধীন মনোভাব যেন সবসময় থাকে কোনোদিন পাল্টে যেওনা আর তোমাকে আমি পাল্টাতেও দেবনা।বিয়ের পর একযাত্রায় পৃথক ফল কেন হবে নারী আর পুরুষের জন্য?রাস্তা যখন দুজনের তখন শুধু মন্ত্রপাঠ করে নয় দুজনেই জীবনের রাস্তায় সমানভাবে পথ হাঁটবো।।”মৃদু হেসে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে মানালি।দীপ্ত এগিয়ে বিজনবাবু আর বিনীতাদেবীর পা ছুঁয়ে দীপ্ত বলে,”এখন যাই আমরা,কোনো মনখারাপ কান্নাকাটি নয়।আর সব যেভাবে শিখিয়েছি মনে থাকে যেন।আমরা ও বাড়ি পৌঁছে স্কাইপে কল করে দেব।ওখানে আমরা কি কি করছি সেটা যেমন তোমরা দেখতে পাবে তেমন আমরাও যেন দেখতে পাই তোমরা নিজেদের খেয়াল রাখছ।”
জামাই মেয়ের কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন গুহঠাকুরতা দম্পতি অস্ফুটে বলেন ভেবেছিলাম বিয়েতে আমাদের মেয়ের দুটো হাত তুলে দেব তোমার হাতে।কিন্তু আজ ঐ দুটো হাতের বদলে আরো দুটি হাত নতুন করে যোগ হল আমাদের জীবনে। এভাবেই নতুন করে নতুন ভাবনায় পথ চলব আমরা নতুন প্রাণশক্তি দিয়ে।”গাড়িতে ওঠে ওরা দুটিতে জুটিতে,মেড ফর ইচ আদার কাপল বোধয় একেই বলে।কে বলে কন্যাবিদায়ের ক্ষণে মা বাবার চোখে জল থাকা বাধ্যতামূলক?কিছু বিদায় তো স্মৃতিসুধাতেও ভরা থাকে নতুন করে ফিরে আসবে বলে।।