Valentine’s day
আলাপ করিয়ে দি আমাদের আজকের গল্পের নায়ক শ্রীমান ঋতবান মুখার্জি ওরফে টোপর আর নায়িকা শ্রীমতী তিস্তা রায় ওরফে টিকলির সঙ্গে। টোপরের বাবা শ্রীযুক্ত অনিমেষ মুখার্জি স্বনামধন্য চার্টার্ড একাউন্টটেন্ড ও টিকলির বাবা সৃজিত রায় শহরের নাম করা উকিল। ছোট বেলা থেকে মাতৃহীন মেয়েকে পরম যত্নে বড় করেছেন।
Valentine’s Day Love Story In Bengali
সেই কোন ইজের পরা বয়সের বন্ধু টোপর আর টিকলি। বন্ধুত্বের সূত্রপাত সল্টলেকের নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। টিকলি পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী, ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল, দারুণ আঁকে, ভালো আবৃত্তি করে। টোপর খেলা ধুলা আর গানে যতটা পারদর্শী, পড়াশোনায় ততটা নয়, স্কুলের সমস্ত গানের অনুষ্ঠান এবং অন্যান্য স্কুলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় প্রধান আকর্ষণ সে। পড়াশোনায় তার একমাত্র সহায় প্রাণের বন্ধু টিকলি। বাড়ি ফেরার পথে গাড়িতে এবং শনিবার/রবিবার টোপরের বাড়ি গিয়ে সব বোঝায়, ফেলে রাখা প্রজেক্ট গুলো করতে ওকে সাহায্য করে। গুরুত্বপূর্ণ অংশ গুলো পেন্সিল দিয়ে আন্ডারলাইন করে দিয়ে আসে।মা মরা মিষ্টি মেয়েটিকে টোপরের মা ঊর্মিলা ভীষণ ভালোবাসে। টোপর ঘুষ দেয় নিজেদের গাছের সদ্য ফোটা গোলাপ, মায়ের হাতের রান্না করা টিফিন, আচার। তার লেখা ও সুর করা গানের প্রথম শ্রোতা টিকলি।
এগিয়ে যায় দিন ও বছর। স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষার ফলাফল আজ, টোপর খুব চিন্তিত। দেখা যায় তিস্তা রায় স্কুল টপার। প্রাপ্ত নম্বর সাতানব্বই শতাংশ আর ঋতবান মুখার্জি পেয়েছে সত্তর শতাংশ। আনন্দে কেঁদে ফেলে টোপর। টিকলির হাত ধরে বলে “তুই না থাকলে আমি জাস্ট ফেল করতাম রে। তোর সাহায্য কোনো দিন ভুলতে পারবো না।” টিকলি বলে “আর আমি তো তোর সঙ্গে থাকব না, আমার ইচ্ছে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভালো কোনো কলেজে ভর্তি হব,তুই কি করবি, ভাবলি কিছু?” টোপর বলে, “গান ছাড়া আমি বাঁচব না রে, গান টা রেখেই যা করার করবো। ভাবছি হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ব, কিন্তু বাবা রাজি হলে হয়।”
ভ্যালেন্টাইন্স ডে প্রেমের গল্প
অনিমেষ মুখার্জি কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না ছেলের সিদ্ধান্তে। “কি? আমার ছেলে হয়ে তুমি হোটেলে চাকরি করবে আর গান গেয়ে বেড়াবে? ক’টাকা রোজগারে ভবিষ্যৎ বানাবে?” কিন্তু ছেলের একগুঁয়েমির কাছে হার মানলেন, টোপর NSHM এ হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হয়। টিকলি ভর্তি হয় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে। পড়ার পাশাপাশি টোপর বিভিন্ন শো করতে থাকে, ছোট বেলা থেকে গান শেখা রেওয়াজি গলা সকলের মুগ্ধতা বাড়ায় ।
একসময় গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে যাদবপুরে মাস্টার্সে ভর্তি হয় টিকলি আর টোপর গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেও কোনো হোটেলে চাকরি নেয় না পাছে তার গানের চর্চায় বাধা পড়ে। সে শহরের একটি নামকরা গানের স্কুলে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। যদিও পারিশ্রমিক খুব বেশি নয়, তবে মাস গেলে একটা বাঁধা রোজগার, এই যা সুবিধা। শো, টিউশনি, গান তৈরী, রিহার্সাল, এর মধ্যে নতুন ব্যান্ড তৈরী হল, ‘রিদম’। সব চলছে তবে, শান্তি নেই, বাবা ভালো করে কথা বলেন না, তার কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন না। ছেলেও কম জেদি না, তার সিদ্ধান্ত বাবার থেকে একটা পয়সাও নেবে না। তাহলে ছোট বেলা থেকে দেখা স্বপ্ন গুলো সত্যি হবে তো? একটা মৌলিক গানের অ্যালবাম বার করবে আর নিজের মিউজিক একাডেমী হবে, বাচ্চাদের গান, গিটার, কি বোর্ড, মাউথ অর্গান, ড্রামস, উকুলেলে পিয়ানো, সব শেখাবে, দু’চোখ ভরে স্বপ্ন দেখে।
টিকলি বি.এড টাও করে নেয় এরপরে, শহরের একটি নামকরা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা সে, টোপরের সমস্ত অনুষ্ঠানের হিসাব রাখা, কি পরবে টোপর ও তার দলের সবাই, রিহার্সাল এ সাহায্য করা , এসব ও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাবা পাত্রের সন্ধান করায় মেয়ের সাফ জানিয়ে দেয় “টোপর ছাড়া আর কেউ আমার জীবনে আসতে পারে না। তুমি অহেতুক চেষ্টা কোরো না।” বাবা রেগে গিয়ে মেয়েকে বলেন “ও কি তোর যোগ্য মামণি? আমি বাবা হয়ে জলে ফেলব তোকে?” টিকলি বলে “বাবা, যদি শুধু শিক্ষা আর রোজগারের মানদন্ডে যোগ্যতা বিচার করতে চাও, তাহলে আমি বলব ও যা যা পারে সকলে কি সেগুলো পারে ? আমিও তো আমার সব কিছু নিয়ে ওর সাথেই থাকব। তুমি দেখো আমরা ঠিক সুখী হব।“
টোপর যে কখন তিস্তার গভীর স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে, নিজেও জানে না।আজ টিকলি ছাড়া সে অসহায়। কিন্তু “বাবা বিয়ের চেষ্টা করছে ,তুই কিছু ভাবছিস?” বলাতে টোপর খুব বিষণ্ণ হয়ে পড়ে, বলে “তোকে ছাড়া আমি অচল টিকলি, কিন্তু রোজগারটা আরো একটু না বাড়াতে পারলে খাওয়াবো কি? একটা আধুনিক গানের মৌলিক অ্যালবাম বার করার ইচ্ছা আর নিজের মিউজিক একাডেমী তৈরীর ইচ্ছা সেই কবে থেকে। কারো সঙ্গে তেমন যোগাযোগ করতেও পারছি না,অত টাকাও এই মুহূর্তে আমি জমাতে পারিনি রে।” টিকলি আর কথা বাড়ায় না সেদিনের মত।
ভ্যালেন্টাইন্স ডে গল্প
বাড়ী ফেরার পথে একবার সুমন জ্যেঠুর বাড়ি যায় টিকলি। আগে অনেক বার টোপরের গানের ভিডিও জ্যেঠুকে শুনিয়েছে সে। জ্যেঠু নিজে একজন মিউজিক কম্পোজার হওয়ায় ‘সা রে গা মা’, ’আশা অডিও’, ‘সাগরিকা’ ইত্যাদি অনেক কোম্পানির সাথেই কাজ করে থাকেন। জ্যেঠু সব শুনে বললেন “একটা অ্যালবামে যদি আটটা গান থাকে, তবে সমস্ত রকম খরচ মিলিয়ে প্রায় দু’লাখ মত লাগবে, তারপরও কোনো সেলিব্রিটি শিল্পী কে দিয়ে, ভালো হল ভাড়া নিয়ে, প্রেসকে ডেকে অ্যালবাম রিলিজ করতে হলে আরও পঞ্চাশ/ষাট ধরে রাখ, বেশিও লাগতে পারে।” টিকলি বলে “জ্যেঠু টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তুমি কথা বলে আমায় জানাও, আর যদি ওর গালের ভিডিও গুলো দেখে ওরা অডিশন এ ডাকে, তাহলে ১৪ই ফেব্রুয়ারি দিনটা ফেলার চেষ্টা কোরো। আমি তাহলে ছুটি নেব, ওর সাথে যাব।” অত টাকা লাগবে শুনে টোপর বলে “অত টাকা তো জমে নি রে, তাহলে আর হলো না রে।” টিকলি ওকে আশ্বস্ত করে বলে “আমি তো আছি তোর পাশে, চিন্তা করিস না।”
চাকরিটা পাওয়ার পর থেকেই একটু একটু করে কৃপণের মতো টাকা জমিয়েছে টিকলি। মনে মনে হিসাব করে, লাখ খানেক মতো তোলা যাবে, আর মায়ের আশীর্বাদী হার , যেটা বিয়েতে পড়বে ঠিক করে ছিল সেটা আপাতত বিক্রি করলে দেড় মতো পেয়ে যাবে। এদিকে নিজের স্কুলে টোপরের একটা বায়োডাটা আগেই জমা দিয়ে রেখেছিল টিকলি, কারণ শুনেছিল, আগামী দু/তিন দিনের মধ্যেই সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি বের হবে। ইতিহাসের শিক্ষিকা সুজাতাদির মুকুন্দপুরে সাড়ে চার কাঠা জমি কেনা আছে। একদিন টিকলি কে দেখাতে নিয়ে গিয়ে ছিলেন।এখন একমাত্র ছেলে কানাডা চলে যাওয়ায় সুজাতা দি জমিটা বিক্রি করে দেবেন ঠিক করেছেন। টিকলি ঠিক করেছে ওনাকে বলে রাখবে, এখনই বিক্রি না করতে, একটু সময় পেলে ও আর টোপর টাকা জমিয়ে কিনে নেবে। ওখানে ধীরে সুস্থে টোপর মিউজিক একাডেমী করতে পারবে।
স্কুল ফেরত রাস্তায় সুমন জ্যেঠুর ফোন “টোপর কে নিয়ে সকাল এগারোটায় চলে আয়, আমি রেডি থাকব। ‘সা রে গা মা’ থেকে ওকে অডিশন এ ডেকেছে। তুই বলেছিস বলে অনেক অনুরোধ করে ১৪ই ফেব্রুয়ারী দিন ফেলিয়েছি।” জ্যেঠু ফোন রাখতেই টোপরের উত্তেজিত গলা “তোর স্কুল থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারী ‘ডেমনস্ট্রেশন’ ক্লাসের জন্য ডেকেছে আমাকে।”
আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারী,
“ভ্যালেনটাইন’স ডে”। আজ সকালে টোপর কে নিয়ে টিকলি প্রথমে যাবে কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে, তারপর মামণি মানে টোপরের মা আর জ্যেঠুকে নিয়ে সোজা ‘সা রে গা মা’র অফিসে। ক্যাবে বসা টিকলির পরনের লাল জামদানিটা অনেক খুঁজে টোপর কিনেছে। পকেট থেকে সেই ছোট বেলার মত টুকটুকে লাল গোলাপ টিকলির আজ প্রথম করা খোঁপায় গুঁজে ওর ঘাড়ে পরম আবেশে চুমু খেয়ে বলে “জন্ম জন্মান্তর ধরে তুই শুধু আমার থাকিস টিকলি।”
টিকলি বলে “ইস্, তোর জন্য তো কিছু আনা হল না।” টোপর একহাতে ওকে জড়িয়ে বলে “তুই আমার জীবনের সবথেকে বড় উপহার, তোকে পেয়েছি, আর আমি কিছুই চাই না সোনা।”
আরো পড়ুন,
প্রাপ্তমনস্কদের গল্প (ভালোবাসি হয়নি বলা)