দ্বিতীয় পর্ব
লিখেছেন – ছবি ব্যানার্জী
তিতাস বিয়ের পর বাবাকে বলল———বাবা এখন তো দাদু ঠামি নেই। এত বড় ফ্ল্যাটে তুমি কি করে একলা থাকবে?তুমি আমাদের সংগে থাকবে চলো বাবা। ———মা সন্তান বড় হয়ে গেলে তাকে তো একদিন ছাড়তেই হয়। আর আমি একলা কোথায় ?তুই আমি একই শহরে তো থাকছি। তাছাড়া জগন্নাথ থাকতে আমার চিন্তা কি?সে ব্যাটা তো বিয়ে থা করে সংসারী হতেই চাইলো না। আমাকে নিয়ে ভাবিস না। আমার মন খারাপ করলে ঠিক চলে যাব।
দেড় বছরের মাথায় তিতাসের ফুটফুটে একটা ছেলে হল। তীর্থ নাতিকে দেখত এসে বলল——অরুন তিতাস তোমরা এবার বাবা মা হলে। তোমাদের দায়িত্ব কর্তব্য অনেক বেড়ে গেল। তিতাস হেসে বলল———বাবা আমি ঠিক তোমার মতো যত্ন করে আমাদের ছেলেকে মানুষ করব। তুমি তোমার নাতির নাম দাও। ———শিলিগুড়িতে ওর দাদু ঠামি জেঠু জেঠি আছেন,তোমরা আছো। সবাই মিলেই আমরা নাম ঠিক করব। অরুন বলল———বাবা আপনার আর আমার বাবার নাম মিলিয়ে ওর নাম হোক রূপঙ্কর। আমার বাবার নাম শুভঙ্কর। দুই দাদুর নামের সংগে বেশ রাজজোটক হবে। আমরা ওকে রূপাই বলে ডাকবো।
রূপাইএর সাতমাস বয়সে একদিন তীর্থ মেয়ের কাছে এসে বললেন———মা আমি পাঁচবছরের জন্য বেনারস ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ আমি হাতছাড়া করতে চাইনা। জগন্নাথ ছাড়া আমি অচল। তাই জগন্নাথকে সংগে নিয়ে যাচ্ছি। ফ্ল্যাট তালাবন্ধ করে যাব। মাঝে মাঝে আসব। তিতাস বলল———তোমার এখন বিশ্রামের সময়। অনেক তো খাটলে বাবা। আমাকে একটু সন্তানের কর্তব্য করতে দাও। আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবে?আর তোমার নিজের তো টাকারও তেমন প্রয়োজন নেই। না বাবা আমি কিছুতেই তোমাকে যেতে দেবনা। তীর্থ বলল———মা রে শুধু কি টাকার প্রয়োজনে যাচ্ছি?———জানি বাবা তুমি আজও মাকে ভুলতে পারোনি।
তীর্থ মনে মনে ভাবল———সত্যিই কি তাই?মা বলতেন———একটা সময় তিতাস বড় হয়ে গেলে তুই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বি বাবা। সে তো পুরো যৌবনটাই নিঃসঙ্গ মরুভূমির মতোই কাটালো। তিতাস মাত্র দুবছরে সুতপা চলে গিয়েছিল। সে তো ইচ্ছা করলেই বিয়ে করতে পারতো। বহু মেয়ের হাতছানিকে সে উপেক্ষা করেছে। শুধুই কি সুতপার জন্য?সুতপাকে তো সে সব দিয়েছিল। অর্থ সম্মান স্বাধীনতা আর ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিল। তার নিজের চেহারা এই বয়সেও সুদর্শন। কোন অভাবে সুতপা তাকে ছেড়ে গেল?কোনো কোনো মেয়ে কি অপ্রাপ্তি নিয়েই জন্মায়?তার ভালোবাসা কি একতরফা ছিল?এতগুলো প্রশ্ণের জবাব খুঁজতে তার গোটা জীবনটা চলে গেল। অবচেতন মনে কি সে সুতপার প্রতীক্ষায় ছিল?মেয়েকে আজও সে সত্যিটা বলে উঠতে পারেনি। মেয়ের বিয়ের পর আজ
সে সত্যিই নিঃস্ব হয়ে গেল। কাজ ছাড়া সে বাঁচতে পারবেনা। তিতাস সুখি হোক।
তিতাসও বুঝেছিল বাবা কাজের মধ্যে থেকেই মাকে ভুলতে চায়। বাবা বোধ হয় আজও মাকে খুঁজে বেড়ায়। তাই সে আর বাধা দেয়নি। তীর্থ জগন্নাথকে সংগে করে বেনারস চলে গেল। তিতাস কাজে যোগ দেওয়ার আগে একটা সব সময়ের জন্য একটা মধ্য বয়সী বিশ্বস্ত মহিলা খুঁজছিল। শুধুমাত্র আয়ার কাছে রূপাইকে রেখে সে শান্তি পাচ্ছিল না।
একদিন অরুনকে বলল———এভাবে চলবেনা অরুন। তুমি খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দাও। মাসে খাওয়া থাকা ছাড়া দশহাজার টাকা বেতনের বিনিময়ে নির্ঝঁঝাট মধ্য বয়সী মহিলা চাই,যে বাচ্চার দেখভাল করতে পারবে। অরুন বলল———দিনসময় খারাপ। আমরা তো নামী আয়াসেন্টার থেকে আয়া রেখেছি। খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে যাকে রাখবে তাকে বিশ্বাস করব কিভাবে?———আমরা ভোটার আইকার্ড ,আনুসঙ্গিক কাগজপত্র দেখে তবে রাখব। দরকারে একবেলার একটা আয়াও থাকবে।
কাজে যোগ দেওয়ার ছমাস পর তীর্থ একবার কয়েকদিনের জন্য মেয়ের কাছে এসেছিল। তখন টালমাটাল পায়ে রূপাই কেবল হাঁটতে শিখেছে। আধোআধো গলায় একটু আধটু কথা বলতেও শিখেছে। তিতাস বলল———বাবা আমরা খবরের কাগজে একটা সবসময় থাকার জন্য মহিলা চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছি। তীর্থ বলল———তুই বরং জগন্নাথকে এখানে রাখ। কোনো অপরিচিতা মহিলাকে না রাখাই ভালো। ———না বাবা একেই তো তুমি কতদুরে আছো ,জগন্নাথ দাদা ছাড়া তোমাকে দেখবে কে?ভেবোনা সবরকম পরিচয়পত্র দেখে তবেই কাজে লাগাবো।
বিজ্ঞাপণে ঠিকানা দেওয়া ছিল। ইচ্ছা করেই কনট্যাক্ট নম্বর দেওয়া হয়নি। ফোনে বারবার বিরক্ত হতে হয়। বিজ্ঞপণে বেশ সাড়া পড়ল। প্রায় কেউ না কেউ আসছে। মধ্যবয়সী উল্লেখ করা সত্বেও অল্পবয়সী মেয়েরাই বেশী আসছে। কারো বড় নেলপালিশ রঞ্জিত বড় বড় নখ,কারো বিসদৃশ খাটো পোষাক কারো বা চোখেমুখে কথা। তিতাস ইন্টারভিউ করে সবকটা বাতিল করছে। অরুন হেসে বলল———তিতাস যেমন চলছে তেমনই চলুক। আমি নিশ্চিত বলতে পারি তোমার কাউকে পছন্দ হবেনা। ———আমি বলছি ধৈর্য্য ধরলে উপযুক্ত কাউকে নিশ্চয়ই পাবো।
ঠিক এক সপ্তাহ পর এক মধ্যবয়সী অভিজাত চেহারার মহিলা এলেন তিতাসদের ফ্ল্যাটে। চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে ইনি একসময় যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন। পরণে দামী হাল্কা রঙের তাঁতের শাড়ি,সিঁথিটা ফাঁকা। গায়ে কোনো সামান্য গয়নাও নেই। একে দেখে মোটেও কোনো পেশাদারি আয়ার মতো বা কাজের মাসীর মতো দেখাচ্ছে না। তিতাস বলল———বলুন কি দরকার ?আমার স্বামী ফ্ল্যাটে পেসেন্ট দ্যাখেন না।ভদ্রমহিলা বললেন ———আমি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপণ দেখে কাজের জন্য এসেছি। ———কিন্তু আপনি কি পারবেন?একটা বাচ্চার পুরোপুরি দায়িত্ব নেওয়া অনেক পরিশ্রমের কাজ। ———আমি পারবো ম্যাডাম। না পারলে রাখবেন না। তিতাস গলা তুলে অরুনকে ডাকল। বলল———ইনি কাজ করতে চাইছেন। অরুন বলল———আপনি থাকেন কোথায়?———আমি উত্তর কলকাতায় অনেক ভাড়াটের সংগে একটা ঘর নিয়ে থাকি। ———ঠিক আছে আগামী কাল আপনার সব পরিচয়পত্র সংগে নিয়ে আসবেন।