তৃতীয় পর্ব
পরদিন ভদ্রমহিলা একটা বড় ট্রলিব্যাগ নিয়ে তিতাসদের ফ্ল্যাটে এলেন। হাতের ছোটো ব্যাগটা খুলে ভোটার আইকার্ড আর পোষ্টঅফিসের একটা পাশবই বের করে বললেন———এই দুটোই আমার পরিচয়পত্র ম্যাডাম। তিতাস ও অরুন একটু দুর থেকে দেখে বলল——ঠিক আছে মাসিমা ও দুটো যত্ন করে আপনার কাছে রেখে দিন। আর আমাদের স্যার ম্যাডাম বলবেন না। আপনি আমাদের গুরুজন স্থানীয়া। আমাদের ভালোবেসে এখানে নিজের মতো থাকুন। পাশের ঘরে আপনি থাকবেন। আজ থেকে রূপাইএর দায়িত্ব আপনার।
তীর্থ চাকরীতে যোগ দেওয়ার ছমাস পর মেয়ের কাছে কয়েকদিন ঘুরে গিয়েছিল। রূপাই তখন টলমল পায়ে সবে হাঁটতে শিখেছে। আধোআধো গলায় কিছু কথা বলতেও শিখেছে। তারপর দীর্ঘ দুবছর সে কলকাতা আসেনি। মেয়ের সংগে প্রায় প্রতিদিনই তার কথা হয়। যাচ্ছি যাব করে দুটো বছর কখন যেন গড়িয়ে গেল।
তিতাস একদিন ফোনে বাবাকে বলল———বাবা তুমি কি আমাদের ভুলে গেলে?এবার বুঝলাম মেয়ে তোমার কাছে বোঝা ছিল। দু দুটো বছর আমাদের না দেখে কি করে আছো বলোতো?তীর্থ বলল———পাগলী মাটা আমার বড্ড রেগে গ্যাছে। আচ্ছা কথা দিচ্ছি এবার তোর কাছে একমাস থাকব। আর ঠিক দশদিন পরেই যাব। ঐ ভদ্রমহিলার কাছে রূপাই কেমন আছে রে?———বাবা ভদ্রমহিলা এই দুবছরে এখন পরিবারের একজন হয়ে গ্যাছেন। রূপাই তো দিদি বলতে পাগল। এখন সে প্রায় বায়না ধরে দিদির কাছে ঘুমাবে বলে। মাঝে মাঝে ওকে ছেড়ে দিই। তুমি কিন্ত এবার চাকরীটা ছেড়ে দাও বাবা। এরপর রূপাই তোমাকে আর চিনতে পারবেনা। ওকে নিয়ে তোমার দিব্যি সময় কেটে যাবে। ———আচ্ছা ঠিক আছে মা। আর একটা বছর থেকেই চলে যাব।
ঠিক দশদিন পর একমাস থাকার প্রস্তুতি নিয়ে তীর্থ জগন্নাথকে সংগে করে মেয়ের কাছে এল। তিতাস বাবাকে জড়িয়ে ধরল। তীর্থ বলল———তুই এখনও আমার সেই ছোট্ট তিতাসই আছিস। কিন্তু এবার সব আদর এবার রূপাই খাবে। তুই এবার মা হয়ে গেছিস । কই দাদুভাইকে ডাক। তার সংগে তো আমার নতুন করে পরিচয় করতে হবে। তিতাস গলা তুলে ডাকল——মাসিমা রূপাইকে একবার আনুন। ভদ্রমহিলা অপরিচিত ভদ্রলোককে দেখে মাথায় ঘোমটা টেনে রূপাইকে কোলে করে আনল। তীর্থর নজর পড়ল। ভদ্রমহিলার হাতে। অনামিকায় হীরের আংটিটা ঝলসে উঠল। তীর্থ চমকিয়ে উঠে বলল———উনি কে?———বাবা ইনি আমাদের মাসিমা। রূপাইএর দিদি। আর মাসিমা ইনি আমার বাবা। বাবাকে দেখে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ভদ্রমহিলা একটু ঘাড় ঝুঁকিয়ে নিঃশব্দে ঘরে চলে গেলেন।
তিতাস বলল———বাবা তুমি চা জলখাবার খেয়ে রূপাইকে নিয়ে খেলা কর। আমরা দুজনেই কাজে বেরোবো। দুপুরে তাড়াতাড়ি ফিরে একসংগে খাব।
ওরা কাজে বেরিয়ে গেলে তীর্থ বলল——চল জগন্নাথ একবার ফ্ল্যাট থেকে ঘুরে আসি। ফ্ল্যাটটা একটু পরিস্কার করতে হবে। ———দাদাবাবু দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে গেলে হতনা?———দুপুরের আগেই ফিরে আসব।
ফ্ল্যাট দুঘন্টার মধ্যে জগন্নাথ পরিস্কার ঝকঝকে করে তুলল। তীর্থ বলল——তুই একটু বাজার থেকে চাল আলু আর ডিম নিয়ে আয়। এখানেই সেদ্ধভাত রান্না কর। আমার আরো ঘন্টা তিনেক কাগজপত্রের কাজ আছে। আমি তিতাসকে ফোন করে দিচ্ছি। বেলা পড়লে ওখানে যাব।
ঘরে এসে তীর্থ মেয়েকে দীর্ঘ একটা চিঠি লিখল। জগন্নাথকে বলল———তুই খাওয়া দাওয়ার পর এই খামটা তোর তিতাস মামণির হাতে দিয়ে আয়। বেনারস থেকে একটা আর্জেন্ট ফোন এসেছে। আজ রাতের ট্রেনে আমরা বেনারস যাব। সপ্তাহখানেক পরে ফিরে আসব। ———দাদাবাবু আপনার ব্যাগ?——ফেরার সময় ব্যাগদুটো নিয়ে আসিস।
জগন্নাথ খামটা তিতাসের হাতে দিল। তিতাস অবাক হয়ে বলল———বাবা কোথায়?——মামণি ঐ খামে সব লেখা আছে। তিতাস খামটা খুলে চিঠিটা পড়তে লাগলো। চিঠিতে লেখা।
মা তিতাস———আজ যে ভদ্রমহিলাকে তোর ওখানে দেখলাম উনি তোর গর্ভধারিণী মা। ছোটোবেলা থেকে জেনেছিলিস তোর মা হারিয়ে গ্যাছে। এতদিন পর্যন্ত আমিই তোকে একথা বলেছিলাম। আজ আর সেটা গোপন রইলনা। তোর দুবছর বয়সে সুতপা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছিল। তোর শিশুমন কখনো কখনো এর জন্য আমাকে অপরাধী ভাবত। অনেক প্রশ্ণ ও কৌতুহল ছিল তোর মনে। হয়তো তার ডিভোর্সের পিছনে আমিই দায়ী ছিলাম। সুতপাকে মায়ের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে বাকী জীবন কাছে রেখে দিস। মায়ের দোষগুণ সন্তানকে বিচার করতে নেই। জগতে মায়ের বিকল্প কেউ হতে পারেনা।
ফুলশয্যার রাতে সুতপাকে আমি একটা হীরের আংটি দিয়েছিলাম। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে অনেক কষ্ট করেও সে আংটিটা খুলতে পারেনি। ঐ আংটিটা দেখেই তাকে চিনেছি। মা ও সন্তানের সম্পর্ক কোনো অবস্থাতেই ভাঙেনা। কিন্ত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ভাঙে। সে তোর এখনো মা কিন্ত আমার কাছে সে পরস্ত্রী। আমি আজ রাতের ট্রেনে বেনারস চলে যাব। বাকী জীবন ওখানেই থাকব। তুই ইচ্ছা করলে আমার সংগে দেখা করতে পারবি। তুই ছাড়া আমারও তো কেউ নেই। তাই আমি কখনো নিরুদ্দেশ হতে চাইনা। তোর মায়ের মুখোমুখি হতেও চাইনা। আশীর্বাদ করছি মাকে নিয়ে সুখে
থাক। ওর এরকম অবস্থা কেন হল সেটা একবার জানিস।
ইতি তোর বাবা।
চিঠিটা পড়ে তিতাসের চোখ থেকে ঝরঝর করে জল ঝরতে লাগলো। অরুন ব্যাকুল হয়ে বলল———কি হয়েছে তিতাস?বাবার শরীর ভালো আছে তো?তিতাস অরুনের হাতে চিঠিটা এগিয়ে দিল। অরুন চিঠি পড়ে বলল——এটা ভদ্রমহিলাকে পড়তে দাও।
ভদ্রমহিলা চিঠিটা পড়ে বলল——কিন্ত আমি তো সুতপা নই। আমি সুমেধা সরকার। দরকারে আমার আই কার্ড আর একবার দেখতে পারো মা ———আপনার হাতে হীরের আংটিটা তবে কার?———এটা সুতপা সেনের। ও আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। ———আর কি জানেন সুতপা সেনের সম্পর্কে?————প্রথম দিকে তেমন কিছুই জানতাম না। ও আমাদের পাশের সিংগল রুম ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকত। আমরাও ভাড়াতেই থাকতাম। সুতপা কোনো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে চাকরী করত। আস্তে আস্তে আমাদের বন্ধুত্ব গভীর হল। ও খুব বিষণ্ণ হয়ে থাকত। আমি নিঃসন্তান ছিলাম। আমার স্বামী একটা ছোটো কোম্পানির চাকরী করত। ওর কে আছে জিজ্ঞেস করলে বলত———একদিন আমার সব ছিল। এখন আমি একা।
এভাবেই চলছিল। আটবছর আগে আমার স্বামীর ক্যানসার ধরা পড়ে। কোম্পানি থেকে থোক কিছু টাকা দিয়েছিল। সেই টাকায় স্বামীর চিকিৎসা শুরু করি। ব্যয়সাধ্য চিকিৎসা। সঞ্চিত টাকা যখন তলানিতে তখন সুতপা সাহায্যের হাত বাড়ালো।সে তার নিজের সব গয়না বিক্রী করে আমাকে মোটা অংকের টাকা দিয়েছিল। আমি টাকাটা ধার হিসাবেই নিয়েছিলাম। বলেছিলাম———সুতপা তোমার ঋণ আমি কোনোদিন ভুলবনা। এই টাকা একদিন গতরে খেটেও আমি শোধ করে দেব।
আমার স্বামীর চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় সে একদিন এসে বলল———সুমেধা আমি এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দেব। আমি একটা বড় এনজিওতে কাজ পেয়েছি। আমি বললাম————ঠিকানাটা দাও। ———তোমাকে একটা দায়িত্ব দেব নেবে? ———বলো কি দায়িত্ব———এই হীরের আংটিটা তীর্থঙ্কর সেনকে দিয়ে আসবে। বলবে সুতপা এটা ফেরত দেবে বলেছিল। তাহলেই সে বুঝবে। একটা ফোন নাম্বারও দিয়েছিল। আমি বলেছিলাম———উনি তোমার কে? ———পরিচিত,এর বেশী জানতে চেওনা। ———না সুতপা উনার পরিচয় তোমার পরিচয় না বললে এ দায়িত্ব আমি নিতে পারবোনা।
সুতপা তখনই তার সব কথা আমাকে বলে। সে বলেছিল———সুমেধা সংসারে যেমন তোমার মতো মেয়ে আছে যে স্বামীর জন্য জীবন বাজি রাখতে পারে তেমন আমার মতো মেয়েও আছে যে লোভ লালসার মোহে অন্ধ হয়ে দেবতুল্য স্বামী সন্তানকে নিজের আত্মসুখের জন্য ছেড়ে আসতে দুবার ভাবেনা। আমি মাত্র কয়েকমাসের পরিচয়ে একটা ধনী ছেলের স্তাবকতায় আর কোটিকোটি টাকার প্রলোভনে নির্দোষ স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে ঘর ছেড়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম সে বিবাহিত। সে দ্বৈত সম্পর্ক রেখে আমাকে রক্ষিতা রাখতে চায়। সস্তা স্তাবকতা আর নাটুকে সংলাপ কখনো ভালোবাসার গভীরতা হয়না।আমার মোহ ভাঙল যখন, তখন আর ফিরে আসার রাস্তা আমার বন্ধ। আমার স্বামী উদার চরিত্রের মানুষ ছিল। হয়তো মাথা নীচু করে তার কাছে গেলে সে আমাকে গ্রহণ করত। কিন্তু কিছু আত্মসম্মান আমার বোধহয় তখনো অবশিষ্ঠ ছিল। তাই ফিরে যেতে পারিনি।
মাত্র দুমাসেই তার স্বরূপ আমি বুঝেছিলাম। তারপর আমি একাই প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি। তার দেওয়া আংটিটা ভেবেছিলাম পবিত্রতার প্রতিমুর্তি হয়ে আজীবন আমি আঙুলে রেখে দেব। কিন্ত ওটা ওকে আমি ফিরিয়ে দেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। তাই তোমাকে এই দায়িত্ব দিচ্ছি। ———যদি উনার সংগে যোগাযোগ না করতে পারি?———তাহলে ওটা আমি একদিন ফিরিয়ে নেব কথা দিলাম।
আমার শ্বশুরবাড়ির কিছু সম্পত্তির টাকা সৌভাগ্যবশত আমার হাতে হঠাৎই এসে যায়। সেই টাকা দিয়ে আমি সুতপার ঋণ শোধ করি। সুতপা চলে গেল কোনো ঠিকানা না দিয়েই। তারপর আমার স্বামী মাত্র তিনমাস বেঁচে ছিলেন। আমি ঐ ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে একটা ঘর নিয়ে থাকতে শুরু করেছিলাম। সুতপা এই ফিরে আসেনি। আমিও আংটিটা তাকে ফেরত দিতে পারিনি। এটা সত্যিই আমার কাছে একটা বিরাট দায়। সেই সময় এই বিজ্ঞাপনণটা আমার চোখে পড়ে। ভালোই হল মা। এই আংটিটা নিয়ে তুমি আমার ভারমুক্ত কর।
তিতাস মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব কথা শুনল। বলল———মাসিমা ক্ষমা করবেন। আপনি এখানেই থাকবেন। আমি বাবাকে এখনই একটা ফোন করি। তিতাস বাবাকে ফোনে ধরল। ———বাবা উনি সুতপা সেন নন। তীর্থ অবাক হয়ে বলল———তাহলে ঐ আংটি?———ওটা সুতপা সেনেরই। ————ছিঃ মা । মাকে মা বলেই ডাকতে হয়। তিতাস বলল———বাবা ছোটো থেকে তো তাই বলতাম। ভাগ্যিস হীরের আংটিটা তোমার চোখে পড়েছিল। নাহলে সারাজীবন সত্যিটা তুমি গোপনই রাখতে। তুমি আমাকে ক্ষমা করো বাবা। ছোটোবেলায় যা বলেছি স্বাভাবিক কৌতুহল থেকে বলেছি। তোমাকে আমি কখনই দায়ী করিনি। ভালোই হয়েছে বাবা। উনার আত্মসম্মান আছে জেনে একটু হলেও উনাকে শ্র দ্ধা করছি। আমি তোমাকে আনতে যাচ্ছি বাবা। আর আমি তোমাকে কোথাও যেতে দেবনা।