বিশেষ নিবেদন
ভিড় বাসে লোকটা, কনস্ট্যান্ট মেয়েটাকে — মলেস্ট করছে। আমার চোখের সামনে। দেখতে পাচ্ছি কিন্তু কিছু বলতে পারছি না। প্রচন্ড ভিড়। ফলে বাঁদিক, ডানদিক করার উপায় নেই। তাই, অফিস-টাইমে এমন সুযোগ, কিছু অমানুষ নষ্ট করে না। নিজের সর্বস্ব কিছু, মেয়েটির শরীরের ওপর চাপিয়ে — আমোদিত হচ্ছে।
ভিক্টিমের বয়স, কুড়ি-বাইশের মধ্যে । প্রতিবাদের সাহস বা ভাষা এখনও, মনে এলেও — মুখে আসেনি। অথবা এই বয়সেই চূড়ান্ত বাস্তববাদী। বুঝে গেছে, চূড়ান্ত ভিড় বাসে প্রতিবাদ করে লাভ নেই। অজুহাত প্রস্তত আছে।
” ভিড়ে, সরবো কোথায়… !”
” অসুবিধে হলে, ট্যাক্সিতে যান..”
” এটা কি, নিজের বাড়ি পেয়েছেন ..! “
” অসুবিধে হয়, তো ভিড় বাসে ওঠেন কেন ! “
— এই জাতীয় একগুচ্ছ অজুহাত আর টুকরো টুকরো করে ব্যাঙ্গ, শুধু নিগ্রহকারী নয় বরং সারা বাস থেকেই, তীরের ফলার মতন ধেয়ে আসবে।
তাই হয়ত — কিশোরী চুপ। দাঁতে দাঁত চিপে সহ্য করছে, হেনস্থার সবটুকু; হয়ত, চোখ ফেটে জল আসছে ; হয়ত, একটা ভীষণ রাগ — গলার কাছে দলা পাকিয়ে উঠে আসছে ; হয়ত, এক লাফে বাস থেকে নেমে পড়তে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু পালিয়েই বা আর কতদূর যাওয়া যায়… !
বাড়ি থেকে তো আবার সেই, বেরোতেই হবে ! দিন গুজরানের জন্য। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। নিজেকে আরও উন্নত করার জন্য।
শরীর লোলুপ, রাক্ষসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য — মেয়েটি ক্রমশ পিছিয়ে আসছে।
কিন্তু কতদূর !
দেওয়াল তো সর্বত্রই বিদ্যমান ! কোনও না কোনো সময় তো — পিঠ ঠেকেই যাবে। তখন !
পিছোতে পিছোতে, কিশোরী — আমার বুকে ধাক্কা মারল। দুজন পুরুষের মাঝে মেয়েটি এখন একা। মুখটা ঘুরিয়ে, দু-চোখে এক সমুদ্র বিপন্নতা নিয়ে আমাকে বলল ,
— আপনি, একটু আমার সামনে আসবেন, প্লিজ !
আমি মুখটা, মেয়েটির কানের কাছে নিয়ে গিয়ে, ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলাম ,
” আপনার, তাতে কী লাভ হবে… ! “
মেয়েটি এবার আড়ষ্টতা কাটিয়ে, লজ্জাটুকু সঙ্কোচন করে আরও মৃদু স্বরে আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে বলল,
— লোকটা, আমার সাথে অসভ্যতা করছে…
” আমি জানি। দেখেছি। কিন্তু আপনি কিছু বলছেন না কেন ..!” জানতে চাইলাম।
— লাভ নেই। এই লোকটা, রোজ এরকম অসভ্যতা করে। ভিড়ের সুযোগ নিয়ে। কিছু বললে আবার উল্টে আমাদেরকে দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করে…
” পুরো জার্নিটাতেই, কি এরকমই ভিড় থাকে… ! “
— নাহ। পরের স্টপেই হয়ত ফাঁকা হয়ে যাবে কিন্তু ও সরবে না । দেখবেন। কতদিন বলেছি । কিন্তু ও অসভ্যতামি করবে-ই । আমার মতন আরও যাঁরা রেগুলার প্যাসেঞ্জার আছেন, তারা সবাই — একে চেনে….
আমি বললাম , ” দ্যাখো, আমিও দুটো স্টপ পরেই নেমে যাব কিন্তু তখনও ও তোমাকে এভাবেই মলেস্ট করবে। তাই না ! তবে এভাবে, আর কতদিন পিছতে থাকবে ! মুখে ব’লে যখন কিছু হবে না, তখন হাতে করো !”
সহযাত্রীনি, অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে লাগল ..
ফিসফিসিয়ে বললাম, ” তোমার দেশ, যখন শত্রুকে নির্মূল করতে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করছে। বুড়ো যুদ্ধ বিমান নিয়ে, যখন অভিনন্দন শত্রু দেশের আকাশে — এফ সিক্সটিন পেড়ে ফেলছে, তখন তোমরা এই ব্যাটাকে নামিয়ে ফেলতে পারছ না ! “
— কী ভাবে করব !
মেয়েটি এবার, একগুচ্ছ সাহস নিয়ে আমার দিকে ফিরে তাকাল। নিগ্রহকারী তখন ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে, নিজের পিঠ, মেয়েটির শরীরে, লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এমন একটা ভাব — যেন কিছুই বোঝে না, কিছুই জানে না।
পরের স্টপে ভিড় হাল্কা হওয়ার পরেও, যখন লোকটা সরে দাঁড়াল না, বুঝলাম আমার সহযাত্রীনির অভিযোগ সঠিক।
বেশ, তাহলে টার্গেট লক করা যাক।
” আগে, দুবার সতর্ক করো…” । শত্রু-কে, আঘাত করার আগে দুবার সতর্ক করা উচিত।
কিন্তু বিধি বাম। তিনি, তখনও বিকৃত কামনায় বিভোর। মেয়েটির অনুরোধে — পাত্তা দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই, বোধ করল না।
অগত্যা, অ্যাকশন।
বললাম, ” কান-চাপাটি দিতে পার ! “
– হ্যাঁ। আঙ্কেল।
মৃদু উত্তর এল।
বললাম, ” দাও। বাঁ কানের নিচে। “
মেয়েটি, বাঁ কানের নিচে একটি পুরুষালি চাপাটি কষিয়ে দিল। যেন — এতদিনের ক্রোধ, ব্রম্ভাস্ত্র হয়ে আছড়ে পড়ল। লোকটা, বীরত্ব দেখানোর জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই , মেয়েটি আবার একটা থাপ্পড় মারল। দু-পাশ থেকে হঠাৎ-ই আরও দুজন মহিলা, কমপ্লিমেন্টারি আরও দুটো — বিয়াল্লিশ সিক্কার থাপ্পড় মারল…
ঘটনার বিহ্বলতায় — নিগ্রহকারীর তখন ছন্নছাড়া দশা।
পরের স্টপে, যখন গন্তব্যস্থলে নেমে পড়লাম — বুঝলাম বাস জুড়েই সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে।
শত্রু — কি শুধু বিপক্ষের মাটিতেই আছে !
দেশের মাটিতেও আছে। লড়াই সর্বত্র জরুরি। এত জবরদস্ত নারী দিবস, সম্ভবত আগে কখনও সেলিব্রেট করে নি । কেউ।
শুধু একটাই আক্ষেপ রয়ে গেল।
আমাকে, আঙ্কেল বলল …!!! 🤔🤔🤔
নাহ, এবার আর চুলে — রং না করলেই নয় … 🤔
——-
আমাদের অন্যান্য গল্প,