প্রথম পর্ব
✍️ ছবি ব্যানার্জি
দীর্ঘ সাত বছরের বিবাহিত জীবন ছেড়ে সুতপা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ সে তার সিদ্ধান্তের কথা স্বামী তীর্থঙ্করকে জানালো। তীর্থঙ্কর সেন পেশায় অধ্যাপক। তাদের একমাত্র মেয়ে তিতাসের নাম তারা স্বামী স্ত্রী মিলেই রেখেছিল। তার বয়স মাত্র দুবছর।
তীর্থঙ্কর স্ত্রীর কথা শুনে প্রথমে হকচকিয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে বলল———কেন জানতে পারি?আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা?আমি কি কোনোভাবেই তোমার চলে যাওয়ার পিছনে দায়ী?সুতপা বলল———না তীর্থ,তুমি কোনোভাবেই দায়ী নও। আমি গত ছমাস ধরে অন্য কাউকে ভালোবাসি। আমরা একদিন ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ঠিক সেই জন্যেই আমি তোমার সংগে প্রতারণা করতে পারলাম না। ———তুমি কি ডিভোর্স চাও?———যদি তুমি মিউচ্যুয়াল ডিভোর্স দাও। ———অবশ্যই দেব। শুধু একটাই অনুরোধ। তুমি তিতাসকে কেড়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করে দিওনা। সুতপা বলল———না আমি তিতাসকে চাইবনা। কারণ তিতাস আমার নতুন বিবাহিত জীবনে সমস্যা হবে। তাছাড়া তিতাস আমার থেকে তোমার ওপর বেশী নির্ভর করে।
তীর্থঙ্কর বলল———একটা বাচ্চার জীবনে মা বাবা দুটোরই সমান দরকার। তিতাসের মুখ চেয়ে কি আমরা একসংগে থাকতে পারিনা?———দুঃখিত তীর্থ। এইভাবে বেঁচে থাকা আমার কাছে অর্থহীন। তুমি তিতাসের দায়িত্ব না নিতে চাইলে ওকে আমি কোনো হস্টেলে রাখতে বাধ্য হব। ——— তপাই আমি সানন্দে আমার মেয়ের দায়িত্ব নেব। তুমি ভেবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছ তো?———তোমাদের জন্য আমার খারাপ লাগছে। তবু আমি ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুমি একবারও জানতে চাইবেনা আমি কার সংগে চলে যাচ্ছি?
তীর্থ বলল———প্রশ্ণটা আমার কাছে অবান্তর তপাই। তোমার সিদ্ধান্তটাই আসল। আমার সব এ্যাকাউন্ট দুজনের নামে। ইচ্ছা করলে সব টাকা তুমি নিতে পারো। আর গয়নার ভল্টও তোমার আমার নামে। সেটাও তুমি নিতে পারো। চাকরীটা শুধু আমার।
সুতপা বলল——আমি আত্মসম্মানহীন লোভী মহিলা নই। তুমি তোমার এ্যাকাউন্টের টাকা তোমার একার অথবা তোমার বাবা মার নামে করতে পারো। আমি শুধু আমার বাবা মার দেওয়া গয়নাগুলো নিয়ে যাব। তোমার দেওয়া কোনো উপহার বা পোষাক কোনোটাই নিয়ে যাবনা।
সুতপার আঙুলে তীর্থর ফুলশয্যায় দেওয়া একটা দামী হীরের আংটি ছিল। বছরখানেক আগে ওটা খোলা যাচ্ছিলনা বলে সে তীর্থকে বলেছিল। তীর্থ বলেছিল———ওটা খোলার কি দরকার তপাই?ওটা তোমার আঙুলেই মানায়। পরে না হয় একটু বড় করে নিও। আজও সে আংটিটা খোলার অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বলল——— তীর্থ এই আংটিটা তোমাকে দোকান থেকে খুলে পরে ফেরত দিয়ে যাব। ওদের ডিভোর্সটা খুব তাড়াতাড়ি হয়ে গেল।
তিতাস প্রথম প্রথম মা মা করে খুব কান্নাকাটি করত। তীর্থ নিজেকে খুব অসহায় বোধ করত। ওর জন্য আয়া সেন্টার থেকে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত আয়া রাখা হয়েছিল। মেয়েটা তাকে আঁকড়ে ধরে রাতে ঘুমিয়ে গেলে তীর্থর দুচোখ দিয়ে জল ঝরে বিছানা ভিজে যেত। কত রাত তার নির্ঘুম কেটে যেত। ভাবত মা কি কখনও এত নিষ্ঠুর হতে পারে?এইটুকু দুধের শিশুকে সুতপা ছেড়ে যেতে পারল?ওকে চিনতে কি সে এতটাই ভুল করেছিল?তীর্থ ভেবেছিল মা বাকে সে কিছু জানাবেনা। কিন্তু সে কাজে চলে গেলে আয়ার কাছে তিতাস কিছুই খেতে চাইতনা। আয়া প্রতিদিন তাকে একথা বলত। শেষে নিরুপায় হয়ে তীর্থ দেশ থেকে বাবা মাকে সব কিছু জানালো।
তীর্থ বাবা মায়ের একটাই সন্তান। খবর পেয়ে তার বাবা মা একটা বছর আঠারোর ছেলেকে সংগে করে নিয়ে এল। মা বলল——বাবু এর নাম জগন্নাথ। ওর বাবা মা দুজনেই একই দিনে কলেরায় মারা গ্যাছে। ও আমাদের কাছে থাকে। ও এখন থেকে এখানে থাকবে। তীর্থ বলল———মা তোমরাও এখন থেকে এখানেই থাকো। তোমরা না থাকলে তিতাসকে আমি বড় করতে পারবনা। বাবা বলল——বাবু আমার মনে হচ্ছে বৌমা কোনো কারণে তোর ওপর রাগ করে ওর দাদার কাছে কিংবা কোনো বন্ধুর কাছে চলে গ্যাছে। বৌমা তো এমন মেয়ে নয়। ও তো বড্ড ভালো মেয়ে রে। তুই কি খোঁজখবর করেছিস?
তীর্থ বলল———মা তোমাদের বলিনি। ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গ্যাছে। ——বাবা তোর গোটা জীবন পড়ে আছে। কপালে যা ছিল হয়েছে। তুই আবার বিয়ে কর। ———না মা আমি আর বিয়ে করব না। সুতপাকে বিয়ের আগে তিনবছর মেলামেশার পর বিয়ে করেছিলাম। একছাদের তলায় সাতবছর থেকেও তাকে চিনতে পারিনি। আমি আর কোনো মেয়েকে বোধহয় জীবনে বিশ্বাস করতে পারবোনা মা।
জীবন থেমে থাকেনি। স্মৃতির ওপর আস্তে আস্তে সময়ের পলিমাটি পড়েছে। সুতপার স্মৃতি ঝাপসা হতে হতে এখন প্রায় ধুসর। তার ব্যবহার করা কোনো জিনিষই তীর্থ ফ্ল্যাটে রাখেনি। তিতাস তার জগন্নাথ দাদার কোলে আর দাদু ঠামির ছায়ায় আস্তে আস্তে বড় হতে লাগল। তবু কোথাও মায়ের অভাব তাকে কখনো কখনো কুড়ে কুড়ে খেত। হঠাৎ হঠাৎই বলত———সবার মা আছে আমার মা নেই কেন?তীর্থ মেয়েকে বলত———তোর মা হারিয়ে গ্যাছে সোনা।
তিতাস অনেকটা বড় হয়েও ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল———আচ্ছা বাবা তুমি বলেছিলে আমার মা হারিয়ে গ্যাছে। তুমি মাকে খুঁজেছিলে?থানায় কোনো মিসিং ডায়েরি করিয়েছিলে?তীর্থ সত্যিটা আজও মেয়েকে বলতে পারেনি। বলেছিল———হ্যাঁ রে মা সব রকম ভাবেই খুঁজেছিলাম। ———আমার মার একটাও ছবি নেই কেন বাবা?———আমাদের দুজনের বিয়ের ছবি ছিল। কিছু বেড়ানোর ছবিও খামবন্দি ছিল। সবগুলো একটা বইএর আলমারিতে রেখেছিলাম। ইচ্ছা ছিল একটা বড় এ্যালবাম বানাবো। কিন্তু উই লেগে অনেক বইএর সংগে ছবিগুলোও নষ্ট হয়ে গ্যাছে মামণি।
তিতাস এখন একজন নামকরা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। তার স্বামী অরুনাভও ডাক্তার। ওরা ভালোবেসেই বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে তীর্থ মেয়েকে বলেছিল——তুই অরুনকে ভালো করে চিনেছিস তো মা?———কেন একথা জিজ্ঞেস করছ বাবা?তোমার কি অরুনকে পছন্দ নয়?———না তা নয় মা। আসলে বাবার মন তো?———বাবা শিলিগুড়িতে অরুনের বাবা মা থাকেন। ওর দাদাও ডাক্তার। শিলিগুড়িতে প্র্যাকটিস করে। ওর বাবা মা দাদার সংগেই থাকেন। ————তুই সুখি হলেই আমি সুখি। তিতাস বলল———জানি বাবা। তুমি নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে তিলতিল করে আমাকে মানুষ করেছো। মায়ের অভাব আমি কখনো টের পাইনি।