আমার তখন 12 বছর বয়স । ক্লাস সিক্সে পড়া এক গ্রাম্য মেয়ে। সরল সাদাসিধে হলেও, বয়সের তুলনায় শরীরে আমি খুব বাড়বাড়ন্ত ছিলাম।
বাবা একদিন কাজ থেকে এসে জানালেন, তাঁর কারখানার মালিকের মেয়ের বিয়েতে আমরা সপরিবারে নিয়ন্ত্রিত! কারখানার মালিকের বাড়ি কলকাতায়।
কলকাতায় আমার আগে কোনদিন যাওয়া হয়নি। কলকাতা সম্বন্ধে বন্ধুদের মুখে অনেক অনেক রঙিন গল্প শুনেছি শুধু! সেই কলকাতায় যাব! তাও আবার অগাধ বিত্তশালী লোকের মেয়ের বিয়ের নেমন্তন্ন! এত বড় খবরটা আমার স্কুলের সব বন্ধু-বান্ধব, এমনকি স্কুলের আন্টিরা ও জানতে বাকি ছিল না!
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে, ড্রেসের বা সাজসজ্জার সরঞ্জাম গ্রামের দিকে এখনকার মতো সুন্দর সুন্দর না থাকলেও, বাবা কলকাতা থেকে আমার দুই ভাই, আমরা দুই বোন আর মায়ের জন্য নতুন জামা-কাপড় এবং মেকআপের টুকিটাকি জিনিস কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন।
দিন গুনতে গুনতে, কদিন পরেই সেই বিশেষ দিনটি চলে এল। আমরা ভাইবোনেরা কেউই সেদিন স্কুলে গেলাম না। রাত্রে বিয়ের নেমন্তন্ন, কিন্তু দুপুরের ভাত খাওয়ার পর থেকে, আমরা রেডি হতে শুরু করলাম । অবশ্য কারণও ছিল, আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে রেলস্টেশন আধাঘন্টা , ট্রেনের জার্নি একঘন্টা , স্টেশন থেকে বিয়ে বাড়ির দূরত্ব প্রায় আধাঘন্টা। কাজেই তাড়াতাড়ি যে যেতে হবে, তা বাবাই বলে দিয়েছিলেন । পাছে পৌঁছতে দেরি না হয়ে যায়, আর বিয়ের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের কোন কিছু বাদ পড়ে না যায়, তাই মা আমাদের দুই বোনকে, বিশেষ করে বলে দিয়েছিলেন__ যাতে আমরা তাড়াতাড়ি বিকেল চারটের আগেই রেডি থাকি।
যথাসময়ে বাবার সাথে আমরা চার ভাই বোন আর মা স্টেশনে উপস্থিত হলাম । ট্রেনে চড়া ও আমার আগে হয়নি । এই প্রথম ট্রেনে করে কোথাও যাব! আনন্দে চোখের সামনের ঘটনাগুলোকে যেন একটা সিনেমা মনে হচ্ছে !
আরো পড়ুন,
Bangla Premer Golpo – পেটুক প্রেমিকা
যাইহোক, ট্রেনে করে রওনা দিলাম কলকাতার উদ্দেশ্যে । যাওয়ার সময় ট্রেন ফাঁকা ছিল । তাই জানালার ধারে ভাই-বোনেরা বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলাম, আর একে অন্যকে সৌন্দর্যের বর্ণনা করতে লাগলাম চিৎকার করে করে!
ট্রেন থেকে যে স্টেশনে নামলাম, সেখানে লেখা ছিল __বালিগঞ্জ স্টেশন । নামটা বার কয়েক উচ্চারণ করে মুখস্ত করে ফেললাম! ভাই-বোনেরা হাত ধরাধরি করে, স্টেশন পার হয়ে একটা বাসে উঠলাম, বাবা-মায়ের সাথে।
মিনিট কুড়ি পরে বাস থেকে আমরা সবাই এক জায়গায় নামলাম । তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তায় আলো , রাস্তার দু’ধারে বহু দোকানপাটের আলো, ট্রাম- বাস ইত্যাদি যানবাহনের আলো; তাদের আওয়াজ বিভিন্ন সুরে! পথচারীদের কোলাহল ; দোকানদারদের কলকলানি; সব মিলিয়ে যেন একটা বিশাল মেলা! এটাই যে কোলকাতা, তা বন্ধুদের মুখে শোনা গল্পকেও হার মানায়!
বাস থেকে নেমে আমার চোখ দুটি কেবল বাস, ট্রাম , পথচারী আর হরেক রকমের দোকানের দিকে আকৃষ্ট হয়ে পড়ছিল । মায়ের হাতের হ্যাঁচকা টানে টানে রাস্তায় এগোচ্ছি!! কখনওবা হোঁচট খাচ্ছি! একটু পরে একটা আলোয় আলোয় ঝলমলে বিশাল বড় বাড়িতে আমরা প্রবেশ করলাম । কি সুন্দর সুন্দর ড্রেস পরে মেয়েরা, ছেলেরা সেজেগুজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হালকা সুরে সানাই বাজছে! কেউ কেউ কফি হাতে, কোল্ডড্রিংকস হাতে মুখে হাল্কা চুমুক দিচ্ছে। আর হেসে হেসে একে অন্যের সাথে গল্প করছে! আমরা বাবার পিছন পিছন একটা সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় উঠে গেলাম।
দোতালায় উঠে, একটা হলঘরে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, লম্বা-চওড়া এক ভদ্রলোককে দেখিয়ে বাবা আমাদের বললেন__” ওনাকে প্রণাম করো।”
আমরা ভাইবোনেরা এবং মা ভদ্রলোককে প্রণাম করলাম। পরে জানলাম, উনি বাবার কারখানার মালিক।
ভদ্রলোক বাবা মার দিকে তাকিয়ে বললেন , আমরা যেন সবাই ঠিকঠাক করে খাওয়া দাওয়া করি। তারপর উনি ব্যস্তসমস্ত ভাবে চলে গেলেন। আমরা সবাই কোল্ডড্রিঙ্কস নিয়ে খেতে লাগলাম। তারপর কফি এবং নানান ধরনের স্টার্টার খেতে শুরু করলাম!
বেশ কিছুক্ষণ পরে মহিলারা সব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন__” বর এসেছে! বর এসেছে ! শাঁখ বাজাও!” বরকে দেখার জন্য সবাই উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগল ।আমারও মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল, বরকে এক ঝলক দেখার আশায় । দেখলাম, হল ঘরের পাশেই আর একটা সাজানো গোছানো ঘরে বরকে নিয়ে বসানো হলো একটু ফাঁকা হতেই, মায়ের সঙ্গে গুটিগুটি গিয়ে বরকে দেখলাম । সত্যি সুন্দর দেখতে! মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রইলাম! রাত হয়ে যাচ্ছিল, তাই বাবা তাড়া লাগালেন__” পরের ব্যাচটায় খেয়ে নিতে হবে ! নাহলে দেরি হয়ে যাবে!”
কিন্তু খাবারের জায়গাটা তিনতলায় , ওখানে যেতে যেতে দেখা গেল সিট আর ফাঁকা নেই । ফলে আমরা আবার দোতালায় বসার জায়গায় ফিরে এলাম । ঘন্টাখানেক পরে , তার পরের ব্যাচে যখন খেয়ে উঠলাম, তখন অনেক রাত হয়েগেছে!! বাবার মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে উঠেছে! তিনি তাড়া দিতে লাগলেন__” তাড়াতাড়ি চলো! নাহলে ট্রেন ফেল হয়ে যাবে !” বলে বাবা তাঁর মালিককে খুঁজতে ছুটলেন। যাবার আগে উনাকে একটু জানিয়ে যাওয়াটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে। সেখানে আরও 10 মিনিট গেল । তারপর রাস্তায় বেরিয়ে বাসের জন্য আরও কিছুটা সময় গেল। অবশেষে বালিগঞ্জ স্টেশনে টিকিট কেটে, যখন প্লাটফর্মে পৌঁছলাম, তখন আমাদের ক্যানিং যাওয়ার ট্রেন টা চলে গেছে। বাধ্য হয়ে স্টেশনে ঘন্টাখানেক বসে থাকতে হলো , পরের তথা লাস্ট ট্রেন টার জন্য।
সবাই গল্প করছি । বর-কনেকে কেমন দেখতে! কি, কি ; কতটা পরিমানে কে খেয়েছে ,ইত্যাদি ইত্যাদি।
সময় কতটা কেটেছে জানিনা। উল্টোদিক থেকে একটা ট্রেন এসেছে, তাতে প্লাটফর্ম জমজমাট হয়ে উঠেছে । আমি ট্রেন থেকে নামা এবং ওঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়া যাত্রীদের দেখছি। এর মধ্যেই আমাদের ট্রেন কখন ঢুকে পড়েছে, আমি জানিনা। যখন আমার ঘোর কাটল, তাকিয়ে দেখলাম পাশে বাবা-মা , ভাইয়েরা আর ছোট বোন কেউ নেই! ট্রেন থেকে নামা যাত্রীদের ভিড়ে , বাবা-মা-ভাই-বোন কে খুজতে লাগলাম! প্ল্যাটফর্মের এমাথা থেকে ওমাথা ছুটতে লাগলাম! বাবা-মা কোথাও নেই ! দিশেহারা আমি ঠোঁট ফুলিয়ে , ফোঁপাতে লাগলাম !
মিনিট কয়েকের মধ্যে পুরো প্ল্যাটফর্মটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেল! বাবা-মায়ের প্রতি অভিমানে আমার তখন দুচোখে শ্রাবণের ধারা নেমে এসেছে! আমার কান্না দেখে, এক হকার এগিয়ে এলেন! লোকটি আমার বাবার বয়সী হবেন বোধ হয়! উনি আমার কান্না দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, যে আমি নির্ঘাৎ হারিয়ে গেছি! উনি কাছে এসে বললেন__” তোমার কি হয়েছে ! তুমি কাঁদছো কেন?”
__’আমার বাবা-মা, ভাই- বোনেরা , সবাই চলে গেছে !” ফোপাতে ফোঁপাতে কোনভাবে কথা ক’টি বলতে পেরেছিলাম।
__”ঠিক আছে, কাঁদতে হবেনা! কত দূরে তোমার বাড়ি?”
__”ক্যানিং স্টেশনে নেমে; তারপরে ভ্যানে করে যেতে হয় আমাদের বাড়ি!”
__”ঠিক আছে মা! আমার সঙ্গে চলো , পাশেই আমার বাড়ি। আমার বাড়িতেও তোমার বয়সী আমার মেয়ে আছে একটা। দু-তিন ঘণ্টা আমার বাড়িতে চলো বিশ্রাম নেবে। ভোরের ফার্স্ট ট্রেনে, তোমাকে আমি তোমার বাড়িতে ছেড়ে আসবো।”
কেন জানিনা, লোকটাকে বাবার মতোই মনে হয়েছিল সেদিন ! নিশ্চিন্তে চলে গেছিলাম, ওই গরিব লোকটার হাত ধরে!
পরদিন কথামতোই ভোরের প্রথম ট্রেন টাতেই উনি আমাকে নিয়ে, একদম আমাদের বাড়িতে ছেড়ে এসেছিলেন!
সেদিনের সেই উপকারের ঋণ ভোলার নয় ! তাই এখনও যাই সেই অচেনা-অজানা পিতার বাড়ি! উনি ট্রেনের হকার হওয়ায়, ক্যানিং স্টেশনে নেমে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসতেন , আমায় দেখতে। সেই পিতা -পুত্রীর সম্পর্ক থেকে গেছে এখনো ! আমি এখন দুই সন্তানের জননী। দুই পিতার বাড়িতেই আমাকে যেতে হয়। দুই পিতাই আমার কাছে __পিতাই ধর্ম! পিতাই স্বর্গ! পিতাই পরম তপ:!