Choto Golpo – ন্যায্য প্রাপ্তি – Bengali Short Story
ছোটো গল্প
ন্যায্য প্রাপ্তি
সঞ্চারী ভট্টাচার্য্য
“এমনই এক দুর্গাপূজার সপ্তমীর দিনে আমার উমার বিসর্জন হয়েছিল।” কথা গুলো বলতে বলতে শাড়ির আঁচলটা তে চোখ মোছেন সোমা দেবী।
“হ্যাঁ দেখতে দেখতে পঁচিশটা বছর পার হয়ে গেল। আজ ও সেই দিন- টার কথা মনে পড়লে…” কথাটা শেষ করতে পারেন না বিজয় বাবু , তাঁর বড় ছেলে অমল এসে হাজির হয় তাঁদের ঘরে। একটু বিরক্ত হয়ে অমল বলে,“ আবার সেই সব কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছ তো? কি হবে বলতো শুধু শুধু উমার কথা ভেবে। আমাদেরও কতো আদরের ছোট বোন ছিল সে। কিন্তু কি আর করা যাবে বল? এই সবে অজয় এসেছে । তাই তোমাদের ডাকতে এসেছি।” সোমা দেবী ও বিজয় বাবু দুজনে আনন্দ সহকারে নিচে এসে দেখেন তাঁদের ছোট ছেলে ও ছোট বৌমা পুনে থেকে এসেছে , মিষ্টি ছয় বছরের নাতিকে নিয়ে।একদিন আগে বড়ছেলে অমলওদুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে আসে পাটনা থেকে।
দুই ছেলে কর্মসূত্রে বাইরে থাকলেও পূজোর কটা দিন কলকাতায় তারা আসবেই।
বিজয় বাবু ও সোমা দেবীর তিন টি সন্তান, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। দুই ছেলের পর উমা হওয়ায় বাবা মা সমেত বাড়ির সকলের আনন্দের পরিসীমা ছিল না। যেমন রূপ ঠিক তেমনি গুন ছিল তার। দুই দাদার বড় আদরের বোন ছিল উমা। কালের নিয়মে উমার বিয়ের বয়স হলে বিজয় বাবু নিজের পছন্দ করা একটি সু পাত্রের হাতে উমা কে সম্প্রদান করেন।
ছোট বেলায় বাবা মা কে হারায় কল্যান ,স্ত্রীরূপে উমা কে পেয়ে তার জীবন ভরে ওঠে খুশিতে।
বিডিও হবার জন্যে কল্যান কে বদলি হয়ে যেতে হল সুন্দর বনে। উমা তখন সন্তান সম্ভবা। উমার বাবা ,মা ও দাদারা সকলেই চেয়ে ছিল উমা এই সময় বাপের বাড়িতে থাকুক।কল্যান ও অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে উমাকে। কিন্তু একরকম জেদ করে স্বামীর সঙ্গে চলে যায় উমা। কল্যান ভয় পেয়ে উমা কে বলে “এখানে কোন ভালো ডাক্তার নেই।তার উপর প্রচন্ড কাজের চাপ থাকার জন্যে আমি তোমাকে ঠিক ভাবে যত্ন করতে পারবোনা। তুমি বরং কলকাতায় মার কাছে গিয়ে থাকো। কলকাতায় কতো সুবিধা তুমি বরং..”
“না কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাবো না। অফিসের এই কঠিন পরিশ্রম করে এসে একটু যত্ন পাবে না , আর আমি কিনা বাপের বাড়িতে গিয়ে বসে থাকবো? তাছাড়া এখানে কি কেউ মা হচ্ছেনা?” কারুর কথার কোন গুরুত্ব দিলনা উমা।
কিন্তু যা হবার তাই হলো পূজোর সময় হাসপাতালে ডাক্তার নেই বললেই চলে। তাই ভালো ডাক্তারের অভাবে উমা কে চলে যেতে হল পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়ে।
Premer Choto Golpo
বোনের এই মৃত্যু টা কিছুতেই মেনে নিতে পারে নি দুই দাদা। বোনের মৃত্যুর জন্যে কল্যান কে তারা দায়ী করে। প্রথমে কিছু না বললেও ক্রমাগত এই অপবাদ আর সহ্য করতে পারে না সে ।কল্যান ও দু -চার কথা শুনিয়ে দেয় বিজয় বাবুর দুই ছেলেকে।সম্পর্কটা এতোটাই তিক্ত হয়ে ওঠে শেষে সম্পর্কটা ভেঙে যায় দুই পরিবারের।
আজ পঁচিশ বছর হয়ে যাবার পরেও কোন যোগাযোগ নেই দুই বাড়ির মধ্যে। বিজয় বাবু ও সোমা দেবী বিবাদ টা মিটিয়ে নিতে চেয়েছিলেন নাতির মুখ চেয়ে। কিন্তু দুই ছেলের তীব্র আপত্তির কারণে তাঁদের ইচ্ছে পূরণ হলো না। তবে দূরের এক আত্মীয়ের কাছথেকে বিজয় বাবু জামাই ও নাতির খবর পেতেন। নাতিকে হোস্টেলে রেখে মানুষ করছে কল্যান। নাতিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করলে ও কোনো উপায় ছিল না তাঁদের।
পূজোর ছুটির পর দুই ছেলে ফিরে যায় কর্মস্থলে ।আর বয়স্ক মানুষ দুজন ফাঁকা বাড়িতে নিত্য কাজে ব্যাস্ত হয়ে যান। মাঝে মধ্যেই অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করেন। এইরকম গতানুগতিক জীবনে হঠাৎ করে এক নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। বেশ কিছু দিন ধরে ল্যাণ্ড ফোনটা ঠিক রাত নটার সময় বেজে ওঠে। সোমা দেবী বা বিজয় বাবু ফোন টা ধরে ‘হ্যালো,হ্যালো ‘করলেও কোন উত্তর আসে না ফোনের অপর দিক থেকে। বিরক্তি প্রকাশ করে ফোনটা কেটে দেন তাঁরা। বহুদিনের পুরনো এই ফোনটার মায়া কাটাতে পারেননি বিজয় বাবু তাই মোবাইল ফোনের যুগেও বহু দিনের এই পুরনো ফোনটাকে ছাড়তে পারেননি তিনি। নটার ফোনের ঘটনাটা একমাস ধরে চলার পর বিজয় বাবু ফোনে ছেলেদের সব কথা জানান। ঘটনাটা ছেলেদের ও খুব চিন্তায় ফেলে। দিন কাল যা পড়েছে তাতে দুই বয়স্ক মানুষদেরকে একা রাখাটা ঠিক নয়। তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করে ছেলেরা ঠিক করে যে বাড়ি বিক্রি করে বাবা ও মা কে নিজেদের কাছে নিয়ে আসবে । ফোনে ফোনে এক দালালের মাধ্যমে বাড়ি বিক্রির ব্যবস্থা করে ছেলেরা। বেশ কিছু দিনের ছুটি নিয়ে কলকাতায় আসে তারা বাড়ি বিক্রির জন্যে।
অমল খুব ভালো করে বুঝিয়ে মা ও বাবা কে বলে এই বাড়ি বিক্রির পর দুই ভাই যেমন অর্ধেক করে টাকা নেবে ঠিক তেমনি ভাবে বাবা মা কে ও দুজনে মিলে ভাগ করে নেবে। চমকে উঠেন সোমা দেবী “আমরা দুজনে আলাদা থাকবো!”হেসে অজয় উত্তর দেয় “হ্যাঁ ঠিক তাই বাবা থাকবে দাদার কাছে আর তুমি আমার সাথে।” “তবে আর বাড়ি বিক্রি করার দরকার নেই আমরা দুজনে যেমন আছি ঠিক তেমনি ভাবে থাকবো এই শেষ বয়সে এসে স্বামী-স্ত্রী কোনো ভাবেই আলাদা হয়ে থাকতে পারবোনা ।”একটু বিরক্ত হয়ে কথা গুলো বললেন সোমা দেবী। “সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে । এতো দূর এগিয়ে যাবার পর আর কোন ভাবেই পিছানো সম্ভব নয়।”দুই ছেলেই অবাক হয়ে বলে মাকে।
সোমা দেবীর বড় ছেলে অমল বলে “তোমাদের একসাথে রাখার ইচ্ছা থাকলেও কোন উপায় নেই। আমার ফ্ল্যাট টা এতো ছোট যে নিজেদের ই জায়গা কুলয়না তাই এই ব্যবস্থা। কলকাতায় তোমাদের একা রাখা যাবেনা । হঠাৎ কোন বিপদ হলে , দূরে থেকে তখনই আসা সম্ভব নয়। তাই এই সব কথা ভেবে…
সব সময় চিন্তা হয় আমাদের।”
ছোট ছেলেরও একই যুক্তি, তার ও কোয়াটারটা ছোট । তাই সম্পত্তি ভাগের মত বাবা মা ও ভাগ হয়ে গেলো।
সব কথা চুপ করে শুনে যান বিজয় বাবু। হঠাৎ তিনি বলে ওঠেন “বাড়ি বিক্রির টাকাটা দুই ভাগ হবে না তিন ভাগে ভাগ করতে হবে।”আশ্চর্য হয়ে দুই ছেলে জানতে চায় “বাবা-মা কি তবে টাকার ভাগ চায়?” বিজয় বাবু স্পষ্ট জানিয়ে দেন উমার ছেলেকে তার প্রাপ্য টাকা দিতে হবে।
দুই ছেলে রাজি হয়ে যায় এই প্রস্তাবে কারণ বর্তমানে মেয়েদের ও অধিকার আছে। হাতে খুব বেশি আর সময় নেই তাই তাড়াতাড়ি একটা রেজিস্ট্রি চিঠি পাঠিয়ে দেয় উমারশ্বশুর-বাড়িতে।
বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেও উমার ছেলের কোন উত্তর না পেয়ে তারা বাড়িটা বিক্রি করে দুই ভাগে টাকাটা ভাগ করে নেয়।
হাতে আর মাত্র দশটা দিন সময় আছে তার পর চির বন্ধনের বাঁধন খুলে দুজন দুই প্রান্তে চলে যাবেন এই কথাটা সারাক্ষনই কষ্ট দিচ্ছে সোমা দেবীকে। মাঝে মাঝে ছেলেদের ওপর একটু বিরক্তি প্রকাশ করে ফেলেছেন। কিন্তু বিজয় বাবু একদম চুপচাপ।
যাবার দিন যত এগিয়ে আসছে ততই সোমা দেবী ও বিজয় বাবু দুজনের প্রতি দুজনে আরো বেশি করে দূর্বল হয়ে পড়ছেন।
Choto Golpo Somogro PDF
ব্যাগ গোছানোর কাজ শেষ করে সোমা দেবী বিজয় বাবু কে বললেন “ছেলেদের ইচ্ছে পূরণ করতে গিয়ে আজ আমাদের এই অবস্থা। কি সব ফোনে ভিডিও কল করে কথা বলতে ও দেখতে পাওয়া যায় ছেলেরা বললো এই ভাবে আমি তোমাকে দেখতে পাবো।” বিজয় বাবু শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানলার দিকে তাকিয়ে রইলেন। খুব ভালো করেই বোঝা যাচ্ছে তিনি এই ব্যবস্থায় মোটেই খুশি নন। কিন্তু নিতান্তই নিরুপায় হয়েই তাঁকে রাজি হতে হয়।
বিজয় বাবু উদাস ভাবে জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন হঠাৎ স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন একটা বড় প্রাইভেট কার আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল।”গাড়ীর আওয়াজ পেয়ে
দুই ছেলে সমেত বিজয় বাবু ও সোমা দেবী সকলেই কৌতুহলী হয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হাতে একটা বড় মিষ্টির বাক্স ও কিছু জামা কাপড়ের প্যাকেট নিয়ে একটি সুপুরুষ গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে।না চিন্তে আর কারুর বাকি রইল না সেই সুপুরুষ যুবকটিকে । একেবারে মায়ের মুখটা কেটে বসানো।আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারেন না সোমা দেবী উমার ছেলে এসেছে বলে চেঁচিয়ে উঠলেন।
সবাই আনন্দ সহকারে উমার ছেলে অর্থাৎ আর্য কে বাড়িতে নিয়ে যায়।
উমা যে ঘরে থাকতো আর্যর থাকার ব্যবস্থা করে দেন সোমা দেবী সেই ঘরে। ঘরের দেয়ালে উমার একটা বড়ো ফোটা টাঙানো আছে। জলভরা চোখে উমার ফোট টার দিকে তাকিয়ে থাকেন সোমা দেবী। মনে মনে ভাবলেন উমার ছেলে এসেছে তাঁর কাছে এ যেন তাঁর স্বপ্নের মতো লাগছে।
পরেরদিন দুপুরে সকলের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে অমল আর্য কে বলে,“তোমার ভাগটা এবার বুঝে নাও তাহলে।”আর্য মৃদু হেসে বলল ,“ ভাগ নেবার জন্যেই তো এতো দূর থেকে এখানে আসা, ভাগ্নে বলে কথা । সম্পর্কে র মধ্যে তো ভাগ নেবার কথা বলা আছে।”
সকলে হেসে ওঠে একসাথে তার এই মজাদার কথায়।
বিজয়বাবুর ঘরে এসে হাজির হয় আর্য কে নিয়ে অমল ও অজয়, হিসাব করে আর্য র ভাগটা তারা বুঝিয়ে দেয় এবং আর্যে র প্রাপ্য টাকাটা তারা আজই দিয়ে দিতে চায়। আর্য একটু হেসে মামাদের বলে“আমি কিন্তু অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট তাই ভাগের হিসাবটায় একটু অসুবিধা আছে বলে মনে হচ্ছে।”দুই মামা সমেত একটু অবাক হন সোমা দেবী ও বিজয় বাবু। বিরক্তি প্রকাশ করে অজয় বলে ,“আমরা কিন্তু তিনটে ভাগ সমান সমান ভাবে ভাগ করেছি।”এবার অমল বললে “যদি তোমাকে আমরা ভাগ না দিতাম তাহলে কি চিঠি পাঠাতাম?”
মামাদের উত্তেজিত দেখে আর্য একটু হেসে বলে “আমি তো টাকার হিসাবের কথা বলিনি, আমি সঠিক ভাবে সব কিছু ভাগ না হবার কথা বলেছি।” দুই মামা এবার খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে আর্য র দিকে। অমল বলে বাড়িটা বিক্রি করে যে টাকা টা পাওয়া গেছে , সেটাই তো তিন ভাগ করা হয়েছে আর তো কোন কিছু…”
“ আমি দাদু দিদার ভাগ চাই” আর্য র এই কথাটা শুনে ঘরের সবাই খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।” “দাদু দিদার ভাগ!” অমল বলে “আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না”।
অজয় বলে “ মা ও বাবা তো আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে থাকবেন।”
“সেই জন্যে তো আমি বললাম সঠিক ভাবে ভাগ হয়নি। এতোদিন দাদু দিদাকে তোমরা কাছে পেয়েছো আমি পাইনি। এবার কিন্তু আমার পালা। এখন থেকে আমার কাছে এঁরা থাকবেন। ”মিষ্টি হাসি মাখা মুখে আর্য কথা গুলো বলে।
সোমা দেবী ও বিজয় বাবু দুজনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন উমার ছেলের দিকে।
থামেনা আর্য আবেগ প্রবণ হয়ে বলে যায়“একদিন মায়ের পুরনো একটা ডাইরির ভেতরে তোমাদের এই ল্যান্ডফোনের নম্বর টা দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। তোমাদের গলাটা শুনবো বলে রোজ অফিস থেকে ফিরে রাত নটার সময় ফোন করতাম। কিন্তু কথা বলতে পারতাম না। একটা সংকোচ বোধ হতো। কিন্তু আজ যখন এই বাড়িতে আসার সুযোগ পেলাম তখন …”
বিজয় বাবুর দুই ছেলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো হঠাৎ সবাই কে চমকে দিয়ে বিজয় বাবু আর্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,“তোমার সঠিক ভাগই তুমি পাবে আমরা দুজনে তোমার কাছে যাবো , কারুর নিষেধ আর মানবোনা।”
সোমা দেবী কখন এই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উমার ফোটো দিকে তাকিয়ে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন “তোর ছেলে আমাদের বৃদ্ধ বয়সে স্বামী ও স্ত্রী র বিচ্ছেদের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিলো।
পরেরদিন সকালে দিদা ও দাদুকে নিয়ে আর্য নিজের বাড়ির দিকে রওনা হবার সময় মামাদের প্রণাম করে বাড়ি বিক্রির তার প্রাপ্য টাকা টা ফেরৎ দিয়ে বলে “এই টাকার ভাগ নিতে আমি আসিনি,যাদের নিতে এসেছি তাদের কে নিয়ে তবেই যাচ্ছি। ভাগ্নে না ভাগ না নিয়ে কখনো কি যেতে পারি? ”
সমাপ্ত
Tags – Bangla Golpo, Bengali Story, Choto Golpo