অফিসের বস নির্মাল্য সেন..
অনুশাসন ও নিয়মশৃঙ্খলার চাদরে মোড়া,যেন আপাদমস্তক এক পথিকৃৎ.
অধীনস্ত কর্মীরা ওনাকে পরম শ্রদ্ধার সহিত ‘জি.টি’ বলে ডাকেন…
অর্থাৎ “গোমড়ামুখো টেটিয়া”..
এদিক থেকে ওদিক হলেই রক্ষে নেই কারো..
****************************************************
অফিসের চৌকাঠ টপকানোর আগে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে চরম দুশ্চিন্তায় একঝলক হাত’ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে নিলো লাবনী.
.এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট.
নাজানি আজ কতটা রুক্ষ ভাষায় কটূক্তি শুনতে হবে তাকে..
মিস্টার সেন মানুষটা এমনিতেই প্রখর মেজাজের,তার উপর যখন তিরস্কারমুখী মনোভাবে এগিয়ে আসেন, তখন সামনে দাঁড়ানো মানুষটির অবস্থা রীতিমতো আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে.
গতসপ্তাহে অফিসে দুদিন দেরি করে আসার ফলে লাবনী’কে হজম করতে হয়েছিল স্থুল পরিমানের ভোকাল টনিক,,প্রায় চোখে জল এসে গিয়েছিলো তার,অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছিল সে নিজেকে..
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিল যেন এ’যাত্রায় চাকরিটা না যায়..
****************************************************
একজন দক্ষ কর্মী হিসেবে লাবনীর বেশ সুনাম,,
সিস্টেমে রেকর্ড কিপিং থেকে শুরু করে, ম্যানুয়াল ফাইলিং,ক্লায়েন্ট-করেস্পন্ডেন্স,প্রেসেন্টেশন ,সব’টাই একাহাতে সামলানোর ক্ষমতা রাখে সাধারণ মেয়েটি..
সেহেতু অন্যান্য সতীর্থদের তুলনায় তার বেতন’টিও কিছুটা বেশি,,তবে তার কষ্টার্জিত অর্থের গুরুভাগটাই ব্যয় হয় তার অসুস্থ বাবা ও মানসিক ভারসাম্যহীন ভাইয়ের চিকিৎসার নেপথ্যে.. কার্যত সংসারের সমস্ত দায়দায়িত্ব তার একলার কাঁধে.. বাবা ও ভাইকে ঘিরে তার ছোট্ট স্বপ্নের পৃথিবী.
সেন মহাশয় অফিসে একটি পদক্ষেপ’ও চলতে পারেন’না লাবনী’কে ছাড়া..তা সত্ত্বেও স্বভাব বৈশিষ্ঠ মানুষটি কথা শোনাতে কার্পণ্য করেন’না লাবনী’কে.
বাড়ির কাজকর্ম সেরে,প্রতিকূল জীবনের দৈনন্দিন কার্যকলাপ মিটিয়ে,কোনোরকমে তাড়াহুড়োতে তাকে ঢুকতে হয় অফিসে..
আজ বেশ কিছুটা সময় হাতে নিয়ে বেরিয়েছিল সে বাড়ি থেকে, কিন্তু এমন এক ঘটনাচক্রের সম্মুখীন হতে হলো তাকে,যে কিছুতেই তা এড়িয়ে সে সময়মতো আসতে পারলোনা..
কিন্তু সে’সব বোধয় নির্মাল্য বাবুর মতো মানুষদের কে বিশ্লেষণ করা নিরর্থক.
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে গোগ্রাসে গিলছিল লাবনী, নির্মাল্য সেনের কঠোর উক্তিগুলি..
দুচোখ বেয়ে জল পড়ছিলো মেয়েটির..
মিনিট’কুড়ি পর চোখের জল মুছে নিজেকে সামলিয়ে ফিরে গেলো সে নিজের ডেস্কে..
****************************************************
লাবনীর মন চাইছিলো : ‘আর একদম’না,এখনই ত্যাগপত্র’টি টাইপ করে রেখে আসি নির্মাল্য সেনের টেবিলে’..
কিন্তু বিবেক…?
বিবেক না জানি কেন দিচ্ছিলো অন্য এক যুক্তি..’এখনই চাকরি ছেড়ে দিলে,
কিভাবে সে দেখাশোনা করবে তার অসুস্থ বাবা ও অসহায় ভাই’কে ! মনটা যেন তোলপাড় হচ্ছিলো তার.’
খবর পেলো নির্মাল্য’বাবু কোনো এক বিশেষ কারণে ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন..ফলস্বরূপ স্বাভাবিক কারণেই কিছুটা স্বস্তি পেলো মেয়েটি.
****************************************************
সন্ধ্যা নেমেছে.. কোনোরকমে শনিবারের অফিস আওয়ার্স’টি কাটিয়ে বাড়ির পথ ধরলো লাবনী..
রাত্রে বিছানায় শুয়ে কিছুতেই ঘুম আসছিলোনা মেয়েটির..দিনের শেষে, নিয়তির প্রতি একগুচ্ছ নালিশ উগরে দিচ্ছিলো সেই নিয়তি’কেই..
এমন সময় বেজে উঠলো চার্জে বসানো সেল’ফোনটা..
টানা’ রিং হয়ে কেটে গেলো..
সবে উঠতে যাবে..কানে এলো আরও একটি মেসেজ’টোন..
ফোনটা চেক করতে গিয়ে,রীতিমতো চমকে উঠলো লাবনী..
নির্মাল্য সেনের মোবাইল থেকে দেখলো,একটা মিস্ড’কল এসেছে ..
আরও চমক অপেক্ষা করছিলো হয়তো মেয়েটির জন্য..
মেসেজ’টি দেখলো সেন মহাশয়’ই পাঠিয়েছেন..
লেখা ছিল :- “সরি”
বেশ কয়েকবার চোখ দুটি ভালো করে হাত দিয়ে মুছে আবারো দৃষ্টিপাত করলো লাবনী..
না ! ভুল নয়..একদম ঠিক’ই দেখেছে সে..
কিন্তু ..কেনো? স্বয়ং নির্মাল্য সেনের মতো এক ব্যক্তিত্ব কাউকে সরি বলতে পারেন, তা যেন অবিশ্বাস্য..
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফোন করলো লাবনী..দুবার টানা রিং হতেই,কলটি রিসিভ হলো….
ইতস্তত কণ্ঠে লাবনী বললো :
–“গুড ইভিনিং স্যার ! “
ভারী গলায় উত্তর এলো :
–“ইয়েস ইভিনিং !”
লাবনী ইতস্তত ভাবে বললো :
–“নাআআ মানে ! বোধয় আপনি ভুল করে কন্ট্যাক্ট করে ফেলেছিলেন আমাকে..একটু আগে..”
উত্তর এলো স্বাভাবিক আঙ্গিকেই :
—” না ..ভুল করে নয়..জেনে বুঝেই করেছি..”
লাবনী শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করলো:
–“কিন্তু কেনো ?”
—“আজ সকালে অফিসে আসতে কেনো দেরি হয়েছিল সেটা বললেন নাতো ?”
-দৃঢ়তার সাথে মেয়েটি বললো :
–” সুযোগ পেলামনা,আপনি দিলেননা ..
আজ সত্যি এমন একটা পরিস্থিতি হয়েছিল যে,আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিলোনা. তাছাড়া আপনি কোনো এক্সপ্ল্যানেসন শোনার অবস্থায় হয়তো ছিলেন’না..”
থামলো লাবনী ….
**************************************************
আজ আসার পথে, মাঝ রাস্তায় এসে বাসটা হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে….কপালে ভাঁজ পড়ে গিয়েছিলো লাবনীর..অগত্যা অটো ধরে এগোচ্ছিল গন্তব্যে..
ঘটনাচক্রে,তার পাশে বসা এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলার সাথে কথাপ্রসঙ্গে কিঞ্চিৎ বাক্য বিনিময় হচ্ছিলো তার..
বেশ কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল মানুষটিকে..
কথা বলতে বলতে থেমে গিয়ে হঠাৎ লাবনীর কাঁধে মাথা রেখে দিয়েছিলো বৃদ্ধা..
শুধু আধো গলায় দুবার বলেছিলো :
–“আমার মাথা ঘুরছে’রে মা ! কিছু মনে করিসনা !”
বেশ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল লাবনী..
তার হাতে গোনা মুহূর্তের পর’ই দুচোখ বন্ধ হয়ে যায় বয়স্কার..
কেমন যেন দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলো লাবনী,,
ঘটনাটির জন্য একদম’ই প্রস্তুত ছিলোনা সে..
অটোতে বসা বাকি আরোহী’গণেরা কেউ’ই সেভাবে এগিয়ে এলেন’না সাহায্যের স্বার্থে,
নাজানি কেনো তার মৃতা মায়ের মুখ’খানি ভেসে উঠেছিল মেয়েটির চোখের সামনে..
শয্যায় আধশোয়া অবস্থায় ইহলোকের মায়া ত্যাগ করার পূর্বে অনেকটা এভাবেই লাবনীর কাঁধে ঢোলে পড়েছিল তার মা.
কেমন যেন মনটা মোচড় দিয়ে উঠলো..সব ভুলে, দায়িত্ব সহকারে স্থানীয় চিকিৎসা কেন্দ্রে তাকে নিয়ে যায় লাবনী,তারপর যত্ন করে নিজে তাকে বাড়ি পৌছিয়ে দেয়.
লাবনী’কে দ্বিতীয়’বার এভাবে কাছে পেয়ে কিছুতেই ছাড়তে চাইছিলেন না বৃদ্ধা.
****************************************************
ওপার থেকে কথা ভেসে এলো..
–“কি ব্যাপার ! কিছু বলছেন না যে ?”
সম্বিৎ ফিরলো লাবনীর ….
বিনয়ের সাথে মেয়েটি বলে উঠলো :
–“তেমন কিছু না স্যার ,ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো,তাই….
–” আপনি ভীষণ মিথ্যেবাদী তো? কি আনন্দ পান এসব মিথ্যে বলে ? “
উত্তরে কোনো কথাই বল্লোনা লাবনী..
কোনো উত্তর না পেয়ে নির্মাল্য’সেন বলে উঠলেন ::
–” আজ আপনি না থাকলে হয়তো আমি চিরদিনের জন্য অনাথ হয়ে যেতাম,, থ্যাঙ্ক ইউ সো’সো মাচ লাবনী !..
নির্মাল্য সেনের কথা শুনে বিস্ময়ে ভেসে যাচ্ছিলো মেয়েটি..
লাবনীকে বিদায় জানবার আগে ,বৃদ্ধা…অর্থাৎ নির্মাল্য সেনের মা সরলা দেবী, তার গাল টিপে তাকে স্নেহের প্রলেপ দিয়েছিলেন এবং,তাকে জড়িয়ে সেলফোনে দুজনার নিজস্বী নিয়েছিলেন..
বোধয় তার বেশ কিছুক্ষন’পর সরলা’দেবীর ফোন পেয়ে নির্মাল্য সেন অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে..
আস্তে আস্তে ছবি’টা পরিষ্কার হয়ে আসছিলো লাবনীর কাছে…
–“জানেন ! তখন রাগের বশে অনেক কিছু বলে ফেলেছি আপনাকে, প্লিস কিছু মনে করবেন’না, বোধয় ভূল’টা আমার’ই..”
অবাক হয়ে সেন মহাশয়ের কথা’গুলি শুনছিলেন লাবনী ..
অফিসের নির্মাল্য সেন ও বাড়ির নির্মাল্য’কে কিছুতেই মেলাতে পারছিলোনা মেয়েটি ..
***************************************************
দেড় বছর পর ………
টেলিফোনের কথোপকথন :
—“কি ব্যাপার ! তখন যে বললাম চারটের মধ্যে আজ বাড়ি ফিরবে !,শপিং করবো একটু..কটা বাজে? ঘড়ি দেখেছো ?”
—” নাআ মানে, একটা ক্লায়েন্ট মিট ছিল তো..
তাই … “
—“তাতে কি ! ওটাতো পোস্টপন্ট’ও করা যেতো !, মা কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করে আছেন,,
তাড়াতাড়ি ফেরো,তিনজন একসাথে বেরোবো.. “
—“ওকে হানি…আমি বেরোচ্ছি একটু পরেই”…
ফোনটা রেখেই আর বিলম্ব না করে, অধীনস্ত এক কর্মী কে সমস্ত কাজ বুঝিয়ে বেরিয়ে পড়লেন নির্মাল্য বাবু…
সরলা’দেবী, লাবনী সেনের থুতনি ধরে আদর করতে করতে বললেন :
–“একদম ঠিক করেছিস মা ! এভাবেই বেঁধে রাখবি সারাজীবন আমার কাজপাগল’টাকে “
****************************************************
আমাদের ওয়েবসাইট থেকে আপনার প্রিয় গল্পগুলো শেয়ার করতে নীচে Facebook , What’s app এ ক্লিক করুন …
ভালো থাকুন , সুস্থ থাকুন চোখ রাখুন বং কানেকশনের পাতায় ❤️