– এই শোন
– কি রে?
– এবার জ্বর ছাড়লে একদিন রেলগাড়ি দেখাতে নিয়ে যাবি?
– আগে তুই সেরে ওঠ তো দিকি
সেই রাতে প্রবল ঝড় উঠল।অপুর ঘুম এলোনা।সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকে গোটা নিশ্চিন্দিপুর জ্বলে উঠছে।সেই আলোয় রোয়াকের উপর দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল অপুর। দিদি যে কখন সেরে উঠবে! রেলগাড়ি দেখাতে নিয়ে যেতে হবে।বাবার সাথে গিয়ে আগেরবার সে রাস্তাটা চিনে রেখেছে।নবাবগঞ্জের সড়ক পেরিয়ে সেই ধানের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে গেলেই রেলের রাস্তা পড়বে।দিদির সাথে সে ভুল দিকে ছুটেছিল।কিন্তু এবার সে রাস্তা চেনে।তাই তার ভুল হবেনা।বাবা আগের বার রেলগাড়ির জন্য দাঁড়ায়নি।আর চার ঘন্টা রেলের রাস্তার ধারে বসে থাকলেই রেলগাড়ি দেখা যেতো।দিদিকে নিয়ে সে এবার দেখেই আসবে।
ভোরের দিকে ঝড় থামলো,অপু কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়াল নেই।সর্বজয়া মেয়ের শিওরে সারারাত জেগেছিলো,ভোরের দিকে তারও চোখ লেগে যায়।দুর্গার জ্বর একটু পড়ল,সে চোখ মেলে দেখল মিহি আলো ঘরের মধ্যে এসে পড়ছে।পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে চারিদিক মাতিয়ে রেখেছে।বৃষ্টি ভেজা সোঁদা মাটির গন্ধ ভেসে আসছে বাতাসে।প্রাণবায়ু নেওয়ার জন্য তা যে কতদূর আরামের যে নেয়নি সে জানেনা। দুর্গা মাথা তুলে বাইরের দিকে চাওয়ার চেষ্টা করলো,কিন্তু পারলোনা।মাথাটা ভার হয়ে আছে।সে আবার মায়ের পাশে শুয়ে পড়ল।চোখ বুজে এলো আবেশে।
একটু বেলা হতেই দুর্গার ঘোর কাটল।এবার অনেক টা সুস্থ সে।উঠে বসে খান কতক হায় তুলল।কথায় বলে হায় খুব হিংসুটি,অপুও ঘরে ঢুকতে ঢুকতে একটা হায় তুলল।দিদিকে বসে থাকতে দেখে সে ছুটে এলো।
– এখন কেমন আছিস দিদি!
– একটু ভালো রে।জ্বর টা পড়েচে একটু।
অপু ছুটে গেল সর্বজয়ার কাছে,”মা মা,দিদি উঠে বসেছে,দেখবে এসো”… দুর্গা ভাই এর কান্ড দেখে হেসে ফেললো। সে কিছুক্ষণ বসেই থাকল একরকম ভাবে।জ্বর কমলেও গায়ে জোর পাচ্ছেনা একদম।শরীর টা ভার ভার লাগছে।সর্বজয়া একটু পরেই অপুর সাথে ঘরে ঢুকল।
– কেমন লাগচে দুগগা
-একটু ভালো আগের থেকে…বলেই সে আর একখান হায় তুলল।
অপু বলল, মা বাবাকে চিঠি লিকে দাও,দিদি ভালো হয়ে গেচে…
সর্বজয়া মেয়ের কপালে হাত রেখে বলল,দেবো দেবো,তুই আগে গিয়ে খে নেতো বাবা।
জ্বরটা পড়েচে,ভালো।শরৎ ডাক্তার কে একটা খবর দিতে হবে,এসে একবার দেকে যাক; সর্বজয়া মেয়ের কপাল থেকে হাত নামিয়ে বলল
মা আমার খুব খিদে পেয়েছে,দুর্গা অবশ মুখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।ওর এখন খুব মায়ের কোলে মাথা দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছে করছে।
দাড়া খাবার নিয়ে আসছি; সর্বজয়া উঠে রান্নাঘরের দিকে গেল।তারপর একটা বাটিতে দুধ আর মুড়ি মেখে নিয়ে এসে মেয়েকে দিল;এই নে দুধ টা খেলে শক্তি পাবি।
(২)
তিনদিন পর দুপুরবেলার দিকে অপু এসে দুর্গাকে বলল,দিদি যাবি রেলগাড়ি দেখতে?
দুর্গার শরীর এখন সম্পূর্ণ সুস্থ,জোর ও পেয়েছে,সে ভাই এর দিকে একবারটি তাকিয়ে বলল,চল।
দুজনে হাত ধরে ছুট লাগালো,আম কাঁঠালের বন পেরিয়ে তারা গিয়ে উঠল নবাবগঞ্জের সড়কের উপর,তারপর কিছুদূর সড়ক ধরে এগিয়ে নেমে পড়ল পাশের ধান ক্ষেতে। অপু আগে আগে ছুটে চলেছে।দুর্গা তার পেছন পেছন।রূদ্ধশ্বাসে তারা কখনো আলপথ ধরে,কখনও ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে।ধানের শিষের আঁচড় লেগে দুজনেরই হাত পা কেটে গেলো।তবু তারা ছুটে চলল।
হঠাৎ অপুর মনে হল পৃথিবী কাঁপতে শুরু করেছে।গমগম একটা শব্দ তাদের কানে আসছে।সেই শব্দের উৎস বোঝার আগেই রেলগাড়ির হুইসেলের শব্দ দূর থেকে ভেসে এলো।অপু দুর্গার মুখের দিকে চাইল।দুর্গার মুখ জ্বলজ্বল করে উঠল।দুজনে প্রায় একসাথে চিৎকার করে উঠল,রেলগাড়ি। দুই ভাইবোনে ছুট লাগালো শব্দটাকে লক্ষ্য করে,আরও জোরে,আরোও জোরে।অপু ছুটতে গিয়ে দু একবার পড়ে গেল।আবার উঠে ছুট লাগালো।ক্ষেত পেরিয়ে ওরা যখন খোলা মাঠে এসে পৌঁছোলো,তখন তাদের সামনে নবাবগঞ্জের সড়কের মতো উঁচু রেলপথ টা চোখের নাগালে এসে পড়ল।পূর্ব দিক থেকে ভয়ংকর শব্দ তুলে, প্রায় পৃথিবী কাঁপিয়ে রেলগাড়ির ইঞ্জিন কালো ধোঁওয়া ছাড়তে ছাড়তে ঘরের মতো দেখতে কয়েক টা বগি টেনে নিয়ে ওদের চোখের সামনে দিয়ে পশ্চিমের দিকে ছুটে গেলো।অপুর মনে হল কালো বড়ো একটা লোহার পিঁপড়ে পায়ে কটা চাকা লাগিয়ে এই যে চলে গেল, এটাই রেলগাড়ি! বিস্ময়ের ঘোর কাটতে কয়েকমুহূর্ত লাগল দুজনের। ততক্ষণে রেলগাড়ি চোখের আড়াল থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে।দুজনে প্রায় ছুটে রেলপথের উপর গিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দুটো লোহার বরাবর পাতা।সেই লোহা দুটো তখনও কাঁপছে।দুজনের কারোর মুখ থেকেই কথা সরছেনা।এই তবে রেলগাড়ি। এই বিশাল লোহার দানবটা। দুজনে পরস্পরে দিকে চাইল,বিস্ময়ের ঘোর কেটে তখন দুজনের মুখে হাসি ছড়িয়ে গেছে।খিলখিল করে হেসে উঠল অপু।দুর্গাও তাল মেলালো।তারা হাসতে হাসতে বসেই পড়ল রেল পথের উপর….
(৩)
-শ্রেয়ান! শ্রেয়ান! মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল শ্রেয়ানের।দুচোখ ডলে সে উঠে বসল বিছানার উপর।বিকেলের শেষ রোদ জানালা দিয়ে উঁকি মারছে ঘরের ভেতর।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল শ্রেয়ান। কোথায় দুর্গা? কোথায় অপু? কোথায় সেই রেলপথ? কোথায় সেই স্টিম ইঞ্জিন? এতো সে তার নিজের ঘরের মধ্যে বসে আছে।তাহলে কি সবটা স্বপ্ন ছিল! শ্রেয়ান দেখল তার বালিশের বাঁপাশে তখনও আম-আঁটির-ভেঁপু খুলে রাখা।হাওয়ায় তার শেষের দিকে পাতাগুলো এপাশ ওপাশ করছে।হঠাৎ কি মনে হল শ্রেয়ান রুদ্ধশ্বাসে পাতাগুলো উলটে একশ বিয়াল্লিশ পাতায় চলে গেল। কিন্তু কই? দুর্গা তো চোখ খোলেনি।তাহলে? দুর্গার রেলগাড়ি দেখা হলনা আর?
শ্রেয়ান মুখটা বিকেলের শেষ রোদের মতোই বিষণ্ণ হয়ে উঠল।উপন্যাস তাহলে দুর্গাকে ফিরিয়ে দেয়নি।কেবল তার কল্পনায় কিছু মুহূর্তের জন্য জীবন্ত হয়ে উঠেছিল দুর্গা।ইসসস এরম টা যদি সত্যি সত্যিই হতো।দুর্গা যদি বেঁচে যেতো।শ্রেয়ানের দুচোখ অজান্তেই ভিজে গেল।
ছোট্ট শ্রেয়ান জানেনা দুর্গা বেঁচে আছে।পথের পাঁচালির পাতায় পাতায়।যতবার কোনো পাঠক তাকে পড়ে,তার চোখ দিয়ে দুর্গারা আবার প্রাণ পায়।দুর্গারা মরে না।শ্রেয়ানের মতো আরও অসংখ্য পাঠকের স্বপ্নে দুর্গারা রেলগাড়িও দেখতে পায়।
মেঘের আড়াল থেকে কোথাও যেন একমুখ হাসলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ…