কলেজের পাশের গুমটি দোকানটায় যেতে পারমিতার ভীষণ খারাপ লাগে।
একে তো দোকানটা পান সিগারেটের, তার ওপর সেখানে রাজ্যের আজেবাজে উটকো লোকের ভিড়।
পারতপক্ষে কোন মেয়ে সেখানে যায়না।
কিন্তু পারমিতা যায়।
তাকে যেতে হয়।
যেতে হয় অর্কর জন্য।
কারণ গুমটি দোকানটার উলটো দিকের খাতা পেন্সিলের দোকানটা হল, অর্কর ছোট কাকার।
তাই অর্ক সেখান থেকে সিগারেট কিনতে পারেনা।
পারমিতাকে পাঠায়, এবং এক পয়সা না দিয়েই পাঠায়।
কতবার পারমিতা চেষ্টা করেছে বলার যে, – ” আমার খুব লজ্জা করে রে, তুই অন্য দোকান থেকে কিনে আন না, টাকা নয় আমি দিয়ে দিচ্ছি….”
কিন্তু না, অর্ককে কথাটা সে আজ অবধি মুখের ওপর কোনদিন বলতে পারেনি।
এমন আরও অনেক কিছুতেই, অর্কর ব্যাপারে পারমিতা নীরব।
তার বাড়ির থেকে আনা টিফিন যখন অর্ক গোগ্রাসে একাই খেয়ে নেয়, তখনও সে নীরব।
তার পার্স খুলে অর্ক যখন তার একটু একটু করে জমানো, সাধের টাকাগুলো ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে যায়, তখনও পারমিতা নীরব, অথবা
বিয়ার খেয়ে ক্লাসে এসে অর্ক যখন তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে, তখনও ক্লাস টিচারের মুখ ঝামটা খাওয়ার সময়ও পারমিতা নীরব।
সর্বদা সে নীরবে থেকে এসেছে, এবং অর্ককে প্যামপার করে এসেছে।
অনেক বন্ধুরা তো বলে যে, পারু (পারমিতা) তুই হলি অর্কর সেই মা যে, নিজের ছেলের দোষ দেখেনা কখনও।
তবে পারমিতার অর্কর এই উন্নাসিক জীবনও ভাললাগেনা।
দিনের পর দিন, টিউশন কামাই করে অর্ক মূর্তি গড়ে।
ছবি আঁকে। কবিতা লেখে।
আর,প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট ধ্বংস করে।
ক্লাস কামাই করাটা না হয় একরকম,
কবিতা টবিতা লেখাও মন্দ নয়, তবে অর্কর এইটুকু বয়স থেকেই সিগারেটের নেশাটা পারমিতা একদম মেনে নিতে পারেনা।
কিন্তু সে জানে যে, অর্ক সেই জাতের ছেলে যাকে নিষেধ করলে, সে সেই কাজটাই আরও বেশি করে করবে।
তাই নরম ভাবে অর্ককে সাবধান বানী দেওয়া ছাড়া পারমিতা আর কিছুই করতে পারেনা। চুপচাপ অর্কর উন্নাসিকতা দেখে যায়।
তবে আজ কিন্তু তাকে অর্ক পাঠায়নি এই সিগারেটের দোকানটায়।
সে নিজে এসেছে।
কারণটা অন্যদের কাছে খুব ছেঁদো হলেও, পারমিতার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
অর্ক বহুদিন ধরে তটিনীর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।
যদিও তা একতরফা, মানে শুধুমাত্রই অর্কর দিক থেকে, তবুও খাচ্ছে।
অর্কর ব্যাপারে তটিনীর কি দৃষ্টিভঙ্গি, তা অবশ্য কারুরই জানা ছিলনা।
তবে অর্ক সেটা জানার একটি পরিকল্পনা করে।
একটি দীর্ঘ চিঠির মাধ্যমে সে তটিনীকে জানায় যে, সে যদি অর্ককে তেমন তেমন ভাবে ভালবেসে থাকে তবে আগত বসন্ত উৎসবের দিন কলেজে যেন লাল পাড় শাড়ি পড়ে আসে, এবং হাতে লাল কাচের চুড়ি।
তাহলেই অর্ক বুঝে যাবে যে তার প্রেম একতরফা নয়।
চিঠিটা গতকাল পারমিতাই তটিনীর হাতে পৌঁছে দিয়েছে, এবং অবশ্যই তার আগে একবার লুকিয়ে পড়ে।
অন্যের চিঠি পড়া যে ভাল নয় তা পারমিতার মত ভদ্র মার্জিত ও রুচিশীল মেয়ের অজানা নয়।
তবু, সে পড়েছে।
পড়েছে অদম্য কৌতূহলে।
এদিকে আজ সেই বসন্ত উৎসব।
তটিনী এসেছে কলেজে।
তবে লাল পাড় শাড়িতে নয়, বাসন্তী রঙা সালোয়ারে।
সাথে করে নিয়ে এসেছে একটি বেশ সুদর্শন ছেলেকে।
অর্কদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছে,-” ও হল অনির্বাণ। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির মেকানিকালে ফাইনাল ইয়ার। আমার দাদার বন্ধু।
আমার ফিয়াসে…..”।
তটিনীর শেষ কথাটা শুনে, অর্ক সেই যে কলেজের ছাদের এক কোনে গিয়ে গুম মেরে বসেছে, তো বসেছেই, তার আর নড়নচড়ন নেই।
বারকয়েক পারমিতা তাকে ডেকেছে, অর্ক সাড়া দেয়নি।
পারমিতা অন্য বন্ধুদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করেছে, যাতে তারা অর্ককে ডাকে, বন্ধুরা গা করেনি। কেউ কেউ তো আবার পারমিতার মুখের ওপরেই বলেছে, – ” ধুর ছাড় তো, ওটা একটা পাগল। খানিকক্ষণ বাদে আপসেই ঠিক আসবে।”
কিন্তু পারমিতা তাতে শান্তি পায়নি।
তার খুব ভয় করেছে অর্কর সেই থমথমে মুখ দেখে। তার নীরবতা দেখে।
মাঝেমধ্যে পারমিতার মনে হয় যে সে অর্ককে যেন ঠিক চিনতে পারেনা।
এতদিন তারা বন্ধু, তবু অর্ককে সে চিনতে পারেনি।
তাই তার আজ খুব ভয় করেছে।
অর্কর ভেতরে চলা ঝরের শব্দ হয়ত সে পায়নি, কিন্তু আবহাওয়াটা আন্দাজ করতে পেরেছে।
সেইকারণেই তার আজ এই গুমটি দোকানে সিগারেট কিনতে আসা।
না, আজ আর সস্তার চারমিনার নয়, সে বেশ দামি একটা গোল্ডফ্লেকের প্যাকেট কিনল। সাথে একটা লাইটার।
********************************************
যথা সময় ছাদের কোনে গিয়ে, পারমিতা তার কেনা জিনিস পত্রগুলো বাড়িয়ে ধরল অর্কর সামনে। মুখে বলল, -” নে গেল। সাথে আমার মুণ্ডুটাও খা “।
এদিকে মেঘ না চাইতেই জল দেখে অর্কও আর মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারলনা।
পারমিতার হাত থেকে প্যাকেট ও লাইটারটা নিয়ে বেশ বিস্ময়ের সুরে বলল – ” তুই নিজে নিজে আনলি? “
পারমিতা কিন্তু সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে, অর্ককে প্রশ্ন করল, – ” আচ্ছা, তুই কোনদিন আমাকে কিছু পরে আসার, মানে বিশেষ কিছু পরে আসার কথা বলিসনা তো রে? আমার দিকে ভাল করে কোনদিন দেখিস? “।
অর্ক আরও বেশি বিস্মিত হয়ে ধীরেধীরে উঠে দাঁড়াল…
এবার পারমিতা, অর্কর কাছে আরও একটু সরে এসে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল, – ” দ্যাখ আজ আমি লাল পাড় শাড়ি পরেছি। লাল টিপও পরেছি। আর এই দ্যাখ…..”
কথাটা বলে সে তার কোমল ফর্সা হাত দুটোয় ছোট্ট মুঠি পাকিয়ে অর্কর চোখের সামনে তুলে, রুনঝুণে শব্দে নাড়াতে লাগল, — ” এই দ্যাখ, আমি আজ লাল কাচের চুড়িও পরেছি…. “
অর্ক এতদিনে, এই প্রথম পারমিতার মুখের দিকে ভাল করে চাইল, এবং সেখানে দেখল, পারমিতার ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি, কিন্তু চোখের কোলে নদী উথলে উঠেছে। সেই উথলানো বারিধারা, তার নিটোল গাল বেয়ে ঝরনার মত নেমে আসছে।
অর্ক এবার বোধ হয় কিছু বলতে চাইল,
কিন্তু না, পারলনা। কারণ পারমিতার পদ্মকূড়ির মত আঙুল ততক্ষণে সজোরে অর্কর ঠোঁট চেপে ধরেছে।
আঙুলে অর্কর সেই ঠোঁট দুটো চেপে রেখেই পারমিতা উক্তি করল, – ” না, একদম না, কিচ্ছু বলবিনা। তুই ভারি দুর্মুখ….. “।
নীচে কমন রুমে ততক্ষণে একঝাঁক তরুণ তরুণী তাদের উচ্ছলিত কন্ঠে গেয়ে উঠেছে –
–” ভালবেসে সখী নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো, তোমার মনেরো মন্দিরে……..”
************ সমাপ্ত **************