একবার কাছে আসবে অমৃতা। এসো না,একটু কাছে।
এই তো আমি তোমার কাছেই আছি। কি ছেলেমানুষি করছো বলো তো!
তুমি বাড়িতে না থাকলে মনটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় অনেকক্ষণ যেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।
আমি তো সবসময় তোমার কাছে থাকি ঋষি ।শুধু এই কয়েক ঘন্টা তোমাকে ছেড়ে…
সে আমি জানি অমৃতা। কিন্তু তবুও..
আচ্ছা আমি না বেরুলে সংসারটা কিভাবে চলবে শুনি!
সকাল থেকে তুমি হারভাঙ্গা পরিশ্রম করে যাচ্ছ আর আমি শুধু শুয়ে আছি। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানো অমৃতা এই জীবনটা…
আবার তুমি এই কথা বলছো। কতবার বলেছি এইরকম কথা বলবে না।
আমি হেরে গেলাম অমৃতা, জীবন যুদ্ধে আমি হেরে গেলাম।
কিন্তু আমি যে তোমাকে হারতে দেবো না ঋষি.. আমি আজও প্রতিনিয়ত নতুন ভোরের অপেক্ষায়।…
দশ বছর প্রেমের দীর্ঘ পথ অতিক্রান্ত করে বিয়ের ঠিক একবছরের মধ্যেই অফিস থেকে ফেরার সময় একটা ট্রাক অন্য একটা ট্রাককে ওভারটেক করার সময় সজোরে ঋষির বাইকে আঘাত। মত্যু মুখ থেকে ফিরে এলেও স্পাইনাল কডে তীব্র আঘাতের জন্য কোমর থেকে নিচের অংশ প্যারালাইসড। বহু টাকা খরচা করে ঋষিকে বাঁচানো গেলেও সেই যে বিছানা নিলো আজও সেই একই রুটিন। ডাক্তার অমৃতাকে বলেছে নিয়মিত ওষুধ ফিজিওথেরাপি আর মানসিক ভাবে যদি ও ঋষির পাশে থাকে তাহলেই একদিন ঠিক হয়ে যাবে। হেল্থ ইনসিওরেন্স থাকলেও সেটা খুবই নগন্য। প্রাইভেট চাকরি তাই কিছুদিনের মধ্যে মাইনে বন্ধ। জমানো টাকাও সব শেষ। বাড়ির অমতে অসবর্ণে বিবাহের জন্য যেহুতু উভয় বাড়িতে কেউ মেনে নেয়নি তাই সেই দরজাও বন্ধ। কিছু আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব কিছুদিনের জন্য পাশে থাকলেও দীর্ঘ পথের সাথী হিসেবে কাউকে পায়নি। সেই থেকে শুরু অমৃতার দাঁতে দাঁত চেপে যুদ্ধ।
বাথরুমের সাওয়ারটা খুলে অমৃতা নিজের নষ্ট হয়ে যাওয়া শরীরটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই নিজেকে ধিক্কার দেয়। মনে মনে কষ্ট পায় অমৃতা। সবাই ওকে এখন অন্য নজরে দেখে,হয়তো বাঁকা চোখে। কেউ কেউ তো বলেই ফেলে নষ্ট মেয়ে। যে শরীরটা ঋষি ছাড়া আর কারও কাছে তুলে ধরার চিন্তা কোনদিন করেনি আজ ভাগ্যের পরিহাসে সেই ঋষির শরীরকে সারিয়ে তোলার জন্য নিজের শরীরকে পর পুরুষের সামনে উন্মুক্তকরণ। সমাজে সৎ হয়ে বাঁচার জন্য নিরন্তর লড়াই চালিয়ে হেরে গেছে অমৃতা। আট ঘন্টা কাজের বিনিময়ে মাস গেলে মাত্র আটহাজার টাকা! যেখানে ঋষির ওষুধ আর ফিজিওথেরাপির জন্য খরচ মাসে দশ হাজার টাকা। এরপর বাড়িভাড়া, খাওয়া দাওয়া সব মিলিয়ে খুব টেনেটুনে চলেও আরও দশ হাজার। কুড়ি হাজার টাকা কেউ দিতে চায়নি। দিতে চেয়েছে অনেকে কিন্তু তার বদলে নিতে চেয়েছে অনেক বেশী। না না শ্রমের বিনিময়ে টাকা নয়। শরীরের বিনিময়ে টাকা। টাকা নামক ছোট্ট কাগজের কাছে আজ অমৃতা পরাভূত। সন্মান আর ভালোবাসার প্রবল যুদ্ধে সন্মানকে বিসর্জন দিয়ে ঋষির ভালোবাসার টানে অমৃতা আজ অপরের ভোগ্যপণ্য।….
বলছি না বাঁদিকে পাশ ফিরে থাকো। ইস! তোমার এই বেডসোরটা কিছুতেই ভালো হচ্ছে না। ডাক্তার বললো ভালো হয়ে যাবে কিন্তু হচ্ছে না। পাড়ার নীলা বৌদি বললো গরম জলে নিমপাতা কিছুক্ষণ ভিজিয়ে রেখে তারপর যদি সেঁক দিই তাহলে নাকি তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে। আজকে এইজন্য অনেক নিমপাতা নিয়ে এলাম। হালকা বাঁ দিকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকো তো দেখি আমি একটু সেঁকটা দিয়ে দিই।
আহ্ লাগছে! ভীষণ লাগছে অমৃতা!
তুমি ছেলেমানুষী কোরো না ঋষি। এগুলো ভালো না হলে ধীরে ধীরে গোটা জায়গাটা এইরকম হয়ে যাবে।
অনেকক্ষণ সেঁক দিয়ে মলম লাগিয়ে ঋষির পা, হাত, পিঠ, মাথা ম্যাসাজ করে দিয়ে কিছুক্ষণ পরে রান্নাঘরে গিয়ে ঝটপট দু’টো রুটি আর একটু আলুভাজা বানিয়ে আখের গুড়ের ডিব্বার দিকে তাকাতেই দেখলো গুড় শেষ। ব্যাগে মাত্র পড়ে আছে আজকের রোজকার। ফিজিওথেরাপির বকেয়া টাকা আর ঔষুধ কিনতেই কালকেই এই টাকাটা চলে যাবে। অথছ গুড় না হলে ঋষি একদম রুটি খেতে পারে না। আগে মিষ্টি খেত রুটির শেষে। পরিস্থতি বুঝে ঋষি হাসিমুখে গুড়কেই মেনে নিয়েছে কিন্তু যদি গুড়টাও না দিতে পারি!
রুটি আর আলুভাজা যখন অমৃতা ঋষিকে খাইয়ে দিচ্ছে তখন ঋষির চোখ দিয়ে নীরবে জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে।….” আর কতদিন আমায় এইভাবে ভালোবাসবে অমৃতা।আমি যে তোমায় কিছুই দিতে পারলাম না।
জানো অমৃতা আমার মনে হয় সুগারটা বেড়েছে। তুমি রুটির সঙ্গে গুড় দাওনি তো! আজ থেকে ভাবছি আর গুড় খাবো না। তাছাড়া গুড় খেলে আজকাল একটু অম্বলও করে”।
অমৃতা জানে ঋষি কেন এইকথা বলছে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং ডিব্বা খোলার আওয়াজে ঋষি বুঝে গেছে বাড়িতে গুড় নেই। টানাটানির সংসারে যতটা কমানো যায়। ঋষির এই কথায় অমৃতাও চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না।
আজ দূর্গাপুজোর ষষ্ঠী। প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে দেবীর বোধন শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে আলোর রোশনাইয়ের মাঝে ছোট্ট এই বাড়িটা যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। তবুও নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এই নষ্টমেয়ে অমৃতা। এ যেন জীবন্ত চিন্ময়ীর লড়াই। অসুর নিধনে মায়ের রূপের থেকেও আজ এই নষ্টমেয়ে রূপী হরগৌরীর ভালোবাসার রূপ প্রকট থেকে প্রকটতর। ঋষির নবজীবনের আশায় নষ্টমেয়ে অমৃতার লড়াই এখন শুধু নতুন ভোরের অপেক্ষায়।…..