প্রথম পর্ব
——————————–
রহস্যময় দুয়ার:-
– হাজারবার , হাজার বার মানা করলাম তাও কি একটা কথা শোনে ছেলেটা। কতবার বললাম নিজেদের গ্রুপের সাথে সাথে ঘোরাই ভালো! কে শোনে কার কথা।
কথা গুলো বলতে রুপা দু’ঘা মেরে দিলো তীর্থর পিঠে। তীর্থ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে, যদিও তার মনেও ভয় ঢুকেছে।
কলেজ ট্যুরে আজ মিউজিয়াম এসেছিল সবাই মিলে কিন্তু একসাথে গ্রুপে সবকিছু দেখতে অনেক সময় লাগছিলো, আর ধৈর্য্য ধরছিল না তীর্থের। রুপার হাত ধরে বললো- চল না ওইদিকে একটু ঘুরে আসি এদের সাথে ঘুরলে সব দেখার আগেই মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে। রূপা অনেকবার আপত্তি করে ছিল এভাবে কখন অন্য দিকে চলে যাবে। আর তাছাড়া তাদের প্রেমের ব্যাপারটা অনেকেই জানে যদি কেউ কিছু খারাপ সন্দেহ করে।যদি কেউ কিছু বলে।
কিন্তু তীর্থ নাছোড়বান্দা , সে ক্রমাগত এক কথা বলতে লাগলো। শেষে রূপা গিয়ে গৌরী আর অতনুকে বললো সে আর তীর্থ অন্যদিকে ঘুরে আসছে তারা বেরোনোর আগে যেন ডেকে নেয়। রূপার কথা শুনে তারাও বলল এভাবে ঘুরতে তাদেরও বিরক্ত লাগছে। তারা চারজন ঠিক করলো চুপি চুপি একটু এদিক ওদিক ঘুরে আবার গ্রুপের সাথে মিশে যাবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে একদিকে বাঁক নিয়ে মিউজিয়ামের আরেকপাশে চললো চারজনই।
কলেজের থেকে আর্কিওলজি আর ইতিহাস অনার্সের ছাত্রছাত্রীদের ট্যুরে নিয়ে আসা হয়েছিল। মিউজিয়ামে আসাটা আসল উদ্দেশ্য ছিল না। সবাই গিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরের মোঘলমারি অঞ্চলে বৌদ্ধ স্তুপের ধ্বংসাবশেষ দেখতে। ফিরে আসার পথে খোঁজ পায় পাশেই এক জায়গায় নাকি খুব সুন্দর একটি মিউজিয়াম আছে। হঠাৎ করেই বিকেল বেলা ঠিক হয় সেখানে যাওয়া। ওখান থেকে সোজা ফিরে যাবে তারা এমনটাই ঠিক করা হয়।
তীর্থ, রূপা, গৌরী, অতনু আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশুনো করছে। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছাত্রী তারা। তীর্থ আর রূপা একে অপরকে অনেকদিন ধরে চেনে। স্কুলেও একসাথে পড়েছে, তবে প্রেমটা কলেজে শুরু। অন্যদিকে অতনু আর গৌরীর দেখা কলেজেই, একে অপরকে ভালোবাসলেও এখনো পর্যন্ত কেউ কাউকে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব দেয়নি।
তীর্থর বরাবর ঐতিহাসিক বস্তু, স্থান নিয়ে আগ্রহী। ওর সাথে থেকে থেকেই এই বিষয়ে আগ্রহ হয় রূপার।
কিন্তু মিউজিয়ামে গ্রুপ ছেড়ে একটু অন্যদিকে ঘুরতে গিয়ে আজ এতটাই মশগুল হয়ে সময়ের কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিল। যখন খেয়াল হলো তখন ফিরে আসতে গিয়ে দেখলো সদর দরজায় তালা পড়ে গেছে। গ্রুপের বাকি সদস্যদের উপর রাগ হলো। একবার খেয়ালই করেনি কেউ তাদের কথা। এখানে নেটওয়ার্কের খুব অসুবিধা হচ্ছে হয়তো সবাই ফোন করেও তাদের পাইনি।
তারা যেদিকে গ্রুপের সাথে ঘুরছিল সেদিকে আবার ফিরে গেল যদি আরো কেউ থাকে এই ভেবে কিন্তু সে আশাও খুব কম। ওদিকে গিয়েও স্বাভাবিক ভাবেই কাউকেই দেখতে পেলো না। ইতিমধ্যে রূপা রেগে আগ্নেয়গিরির মতো ফুটছে। বাকিদের মুখ শুকিয়ে গেছে।
এমন সময় আবার ফিরে আসবে সদর দরজায় এমন সময় দেখলো অন্যপাশে আরেকটা দরজা আছে। অতনুই দরজাটা প্রথম লক্ষ্য করলো। এই দরজাটা অনেক বড়। একরকম সিংহদুয়ার বলা যায়।
দরজা খোলা দেখে তারা একটু নিশ্চিন্ত হলো। যাক, এবার বেরোনো যাবে তাহলে।
কিন্তু সেই দুয়ারের সামনে গিয়ে সবাই হতবাক হয়ে গেল! দরজা বাইরে বেরোনোর রাস্তা নয়। বহু পুরোনো এক ধাতব দরজা যা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা আছে।
তারা আরো মন মরা হয়ে পড়লো। এটা মিউজিয়ামের সংগৃহীত বস্তু, কোনো বাইরে বেরোনোর উপায় নয়। সবাই এই নিয়ে চিন্তায় পড়লেও তীর্থ এক মনে দরজাটাকে দেখছিল। বাকিরা সবাই সদর দরজায় ফেরার উদ্যোগ নেবে এমন সময় তীর্থ বলে উঠলো – দেখ দেখ দরজার উপর কিসব খোদাই করা আছে।
রূপা বিরক্ত হয়ে বললো- উফ! তুই এবার থামবি !! তোর জন্যই যত ঝামেলার শুরু।
অতনু খোদাই করা লেখা দেখে বললো- কঙ্গো আদিবাসীদের ভাষা মনে হচ্ছে তো!
– “এক্সাক্টলি! ” ,উৎফুল্ল হয়ে বললো তীর্থ, “আমার এই সব ভাষার প্রতি প্রথম থেকেই খুব আগ্রহ!”
গৌরীর কৌতূহল হলো, বললো- কি লেখা আছে ওতে?
রুপা খিটখিট করতে শুরু করলো- কি হবে জেনে কি লেখা আছে? তাড়াতাড়ি বেরোতে পারলে বাঁচি!
তীর্থ রুপার হাত ধরে টেনে বললো- দেখ না একটা হেঁয়ালি আছে! এখানে লেখা আছে
“গন্তব্যস্থলে পৌঁছবে, পূর্বে যে কাজ বাকি আছে সব মিটে যাবে।
বর্তমান খুঁজে পাবে , যবে সব কিছুর উত্তর মিলবে।
যখন এ মন্ত্র বলবে ,সময়ের গোলকধাঁধা উল্টে যাবে।”
তীর্থর পড়া শেষ হওয়া মাত্র এক অদ্ভুত আলো বেরিয়ে এলো সেই দরজা দিয়ে। গ্রাস করলো তীর্থ এবং তার হাত ধরে থাকা রুপাকে।
ওরা অতনু আর গৌরীর চোখের সামনে দরজার মধ্যে মিলিয়ে গেল। গৌরী ভয়ে অতনুকে জড়িয়ে ধরলো। অতনু বোকার মতো তাকিয়ে রইলো দরজার দিকে।
****************
অতীতের সফর:-
রুপা আর তীর্থ ভয়ে শক্ত করে হাত ধরে চোখ বন্ধ করে নিয়ে ছিল। চোখ খুলতেই হতবাক হয়ে গেল।
এ কোথায় এসে পৌঁছেছে তারা!!
চারপাশে তাকিয়ে অতনু আর গৌরীকে দেখতে পেলো না তারা। যেদিকেই চোখ যায় শুধু সবুজ ধানের ক্ষেত। রুপা এবার কেঁদে ফেললো ভয়ে। তীর্থর মুখে কথা ফুটছে না এমন হবে সে আশা করেনি।
বেশ কিছুক্ষন পর তীর্থ উঠে দাঁড়ালো। হাত ধরে টেনে তুললো রুপাকে, বললো- নাহ এভাবে বসে থাকলে হবে না! চল দেখি কোথায় এসেছি!
রুপা কোনো কথা বললো না চুপচাপ তীর্থর সাথে সাথে চলতে শুরু করলো।সামনেই একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে। তারা ছুটে তাড়াতাড়ি সেখানে পৌঁছলো। বাইরে থেকে শুনতে পেলো ভেতরে মন্ত্রপাঠের শব্দ। তীর্থ রুপার হাত টেনে ধরলো। বললো- ভেতরে যাস না। আগে কি হচ্ছে দেখা দরকার!!
তারা ঘুরে মন্দিরের পিছনের জানলার দিকে গেল। উঁকি মেরে যা দেখলো তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল!
মন্দিরের ভিতরে আবছা অন্ধকার। এক পুরোহিত বসে আছে। বিয়ে করতে এসেছে দুজন! যারা বিয়ে হচ্ছে সেই নব বর-বধূকে দেখতে হুবহু তীর্থ এবং রুপার মতোই দেখতে। বিকেলের পড়ন্ত রোদেও বোঝা যাচ্ছে। সব কিছু কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে!! এটা কিভাবে সম্ভব!
রুপা হতভম্ব হয়ে হয়তো চিৎকার করেই ফেলতো সেই মুহুর্তে তীর্থ তার মুখ চিপে মন্দিরের দেয়াল ঘেষে বসিয়ে দিলো।
পুরোহিত চিৎকার করে বললেন- এ বিয়ে আমি দিতে পারবো না। চলে যাও এখান থেকে। এ অলুক্ষুনে কাজ কিছুতেই করবো না।
ফিস ফিস করে বললো-খুব বড় গন্ডগোল হয়েছে মনে হচ্ছে ঠিক কি হলো বুঝতে পারছি না। কিন্তু এটুকু বুঝেছি যে ওই দরজাটা মন্ত্রপুত ছিল। আমি মন্ত্রটা পড়ার পরই মনে হয় ওই দরজা সময়কে উল্টে দিয়েছে।
বেশ কিছুক্ষন থম মেরে বসে থেকে রুপা বলল- কিন্তু তুই তো মন্ত্র টা বাংলায় বললি তাহলে সেটা কাজ করলো কিভাবে? আর অতনুরা কোথায় গেল? সময় উল্টে গেছে মানেটাই বা কি আমরা কি তাহলে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি?
– আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছি না তবে মনে হচ্ছে এটা ভবিষ্যত নয় অতীত!
– কি ভাবে?
– মন্ত্রে উল্লেখ ছিল পূর্বে যে কাজ বাকি আছে মিটে যাবে। আর আমি মনে মনে একটা করে লাইন পড়ে তার বাংলা মানে বলেছিলাম তাই বোধ হয় মন্ত্রটা কাজ করেছে।
– তুই আমার হাত ধরে ছিলি তাই আমিও তোর সাথে এই জগতে পৌঁছে গেলাম। সব তোর দোষ তীর্থ। এখন কি হবে?
– আমি ক্ষমা চাইছি রুপা। কিন্তু এখন তো বেরোনোর উপায় ভাবতে হবে এছাড়া তো কিছু করার নেই।
– আচ্ছা তুই বললি এটা অতীত তার মানে আমরা পূর্ব জন্মের ঘটনা দেখতে পাচ্ছি?
– তাই মনে হচ্ছে রে।
এবার উঠে দাঁড়ালো তারা দেখলো যারা বিয়ে করতে এসেছিল তারা হেঁটে দূরে চলে গেছে মন্দির থেকে।
ক্রমশ সন্ধ্যে নামছে তারা উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা এক গ্রামে প্রবেশ করলো। দেখেই মনে হচ্ছে বহু পুরাতন সব কিছু। গ্রামে বিদ্যুতের প্রবেশ ঘটেনি। চারিদিকে অন্ধকার। কয়েকটা ঘরে প্রদীপ জ্বলছে। দূর থেকে সন্ধ্যেপুজোর শঙ্খধ্বনি শোনা যাচ্ছে।রুপা তীর্থর কানে কানে বললো- এখানে কোনো ঘরে আশ্রয় নিলে হয় না?
তীর্থ উত্তর দিলো- আমরা যদি সত্যি অতীতে পৌঁছে গেছি তাহলে কোনো কিছু না ঘাটানোই ভালো। আগে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে হবে।
বলেই সে রুপার হাত ধরে একটা বাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো তেমন কোনো আওয়াজ পেলো না। আরো দুএকটা বাড়িতে এইভাবে খুঁজল সেইসব ঘরেও কারো আওয়াজ পেলো না। গোটা গ্রামটাই পরিত্যক্ত নাকি!!
তারা আরো কিছুটা এগিয়ে গেল গ্রামের ভেতরে। হঠাৎ তাদের চোখে পড়লো দূরে এক মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর লোকজন। অনেকের হাতে মশাল রয়েছে। মনে হয় গ্রামের লোকজনের সভা বসেছে। ব্যাপারটা কি তা জানার জন্য তারা পা টিপে টিপে মাঠের একটু কাছে গিয়ে একটা মোটা গাছের আড়ালে লুকোলো।তারা শুনতে পেলো মাঠের মাঝে এক মধ্যবয়স্ক লোক বলছেন-“বিধবা মেয়েটি আমার ছোটছেলেকে বশ করেছে। ও নিশ্চয় ডাইনি। ও আজ মায়ায় ভুলিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিল তারা ওই গ্রামের প্রান্তের মন্দিরে,পুরোহিত খবর দিয়েছে আমায়।বিধবা হয়েও সামাজিক নিয়ম ভঙ্গ করে সে যা অনাসৃষ্টি করেছে তাকে তার চরম শাস্তি ভোগ করতে হবে।”
পাশ থেকে আরেকটি লোক বলল-“কিন্তু আজ ছোটবাবু যে সম্পূর্ণ ওর বশে ওকে কিছু করলে তো ছোটোবাবুর ক্ষতি করতে পারে জমিদার বাবু।”
শুনে সেই লোকটি তথাকথিত জমিদারবাবু বললো-“তোমাদের ছোটবাবুকে আমি সময় মতো ওর থেকে দূরে পাঠাবো তোমরা প্রস্তুত থেকো। “
যদিও তাদের কথা স্পষ্ট নয় তবু তীর্থ আর রুপার ব্যাপারটা বুঝতে পারলো।যাদের বিয়ে হতে দেখেছে তারা সম্ভবত তাদের নিয়েই কথা বলছে এরা।
একে অপরের মুখের দিকে তাকালো তারা। হঠাৎ তীর্থ চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো! সে রুপাকে বললো – মনে হচ্ছে আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছি। ওই মন্ত্রে বলেছিল, সেটা উচ্চারণ করলে সময়ের গোলকধাঁধা উল্টে যাবে। হয়তো আরেকবার মন্ত্রটা মনে আওড়ালে আমরা বর্তমানে পৌঁছব।
রুপা শুনে বললো – তাহলে দেরি না করে চেষ্টা করে দেখি।
প্রথমে তারা সেই মাঠ থেকে বেশ খানিক দূরে সরে এলো তারপর রুপার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে মন্ত্রটা বললো কিন্তু কিছুই হলো না। আরো বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলো পারলো না। কঠিন ভাষার মন্ত্র মনে রাখা কঠিন, কিছু শব্দ মনে পড়ছিল না। শেষে একটি কাঠি এনে বেশ খানিকক্ষণ মনঃসংযোগ করে মন্ত্রটা ধুলোর উপর লিখলো। তারপর আবার রুপার হাত ধরে চোখ বন্ধ করে মন্ত্র আওড়ালো।
তারপর আবার তীব্র আলো গ্রাস করলো তাদের।
***************
মন্ত্রের বেড়াজালে:-
চোখ খুলেই বর্তমানে ফিরে এসেছে ভেবে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো রুপা। তীর্থও উঠে বসেছে। পরক্ষণেই বুঝলো সেটা বর্তমান নয়। তারা পড়ে আছে এক বাগানে। তার একপাশে বিশাল অট্টালিকা। দেখে জমিদার বাড়িই মনে হচ্ছে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো তীর্থ , বললো- নারে এত আরো গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। এ কোথায় এলাম আগে জানা দরকার!
-তাহলে কি আমরা আর ফিরতে পারবো না তীর্থ ? ভীত রুপা প্রশ্ন করলো।
-আমি ঠিক জানি না রে। ওই মন্ত্রের হেঁয়ালিটা আগে বুঝতে হবে! কিন্তু এখানে না বাড়ির পিছনে লুকোই আগে চল। কোথায় এসেছি জানিনা কেউ দেখতে পেলে ক্ষতি হতে পারে।
তারা তাড়াতাড়ি বাড়ির পিছনে লুকলো।বাড়ির পিছনে যেতেই তারা দেখলো একটা বড় খিড়কি দরজা। তার অর্ধেক পাল্লা খোলা। সেখানে এককোনে দেখা যাচ্ছে রুপার মুখ তথা রুপার পূর্বজন্মের মুখ। তার কোলে এক শিশুর কাটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রাখা আছে সেগুলো জড়িয়ে হাউহাউ কাঁদছে এবং তার পাশে এক মহিলা বসে আছে। তার পাশে সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল তীর্থ আর রুপা।
তারা দেওয়াল ঘেষে নীচে ঝোপের আড়ালে বসলো। রুপা তখন মুখ চেপে কেঁদে ফেলেছে। তীর্থও স্তম্ভিত, বুঝতে পারছে না কি বলবে।
সে শুকনো মুখে এক কোনে বসে পড়লো। রুপার দুচোখ অঝরে ঝরে চলেছে।
তারা শুনতে পেলো ভেতরের কথোপকথন।
– দিদিমণি আমি জানতুম এরা এমন কিছু ঘটাবে। তোমাদের জমিদারবাবু ভালোমানুষ নয় গো। তাকে বিশ্বাস করে ভুল করেছ তোমরা। তিনিই ভুলিয়ে তোমাকে এই বাগানবাড়িতে এনেছেন, ছয়মাসের মধ্যে ছোটবাবুকে বাইরে পাঠিয়েছেন যাতে তোমাকে সরাতে পারেন।সেই জন্যই আগে থাকতে তোমায় বলেছিলাম মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যেতে। তুমি স্বামীর ভিটে ছাড়লে না।
– না রে সুমি এটাই আমার কপালে লেখা ছিল! বিধবা হয়ে আমি সমাজের নিয়ম ভেঙে বিয়ে করেছিলাম।কিন্তু দোষ তো আমার ছিল আমার নিষ্পাপ সন্তানকে কেন মারলো তারা!!ভালোই তো ছিলাম মেয়েকে নিয়ে কেন যে এসব করলাম জানি না!
আরো জোরে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে লাগলো। তীর্থ বললো- “আমরা এখনো পূর্ব জন্মেই আছি কিন্তু সময়ে একটু এগিয়ে এসেছি।এখানে থাকাটা সুরক্ষিত নয়। যেকোনো সময় কেউ এলেই আমাদের দেখতে পাবে।মন্ত্র টাও ভালো করে আগে বোঝা দরকার।” তারা বেশ কিছুটা সেখান থেকে সরে এলো। রুপা এদিকে অঝোরে কেঁদে চলেছে। ওই মর্মান্তিক দৃশ্য সহ্য করতে পারছিল না সে। এক দু পা করে পিছিয়ে যাচ্ছিল তারা এমন সময় কারোর পায়ের শব্দে চমকে উঠলো তারা। কেউ আসছে তাদের দিকে। কি ভাবে পালাবে ভাবছে তখনই দেখলো বাগানবাড়িতে অন্য অংশে একটি খিড়কি দরজা খোলা রয়েছে। তারা তাড়াতাড়ি সেদিকে ছুটলো। খিরকির কাছে এসে আগে তীর্থ ভালো করে উঁকি মেরে দেখলো, নাহ ঘরটাতে কেউ নেই। তারা খিড়কি টপকে ঢুকে পড়লো সেই ঘরে। জমিদারি আমলের বাগানবাড়ি, একরকম জমিদার বাড়িই বলা চলে এত বড়। এই ঘরটি নিশ্চয় পাড়ার ঘর ছিল।
ঘরে ঢুকে আগে তীর্থ সব জানলা, দরজা বন্ধ করে দিলো যাতে বাইরে থেকে কেউ না ঢুকে পড়ে। আপাতত সব ব্যাপারটা একটু হজম করতে সময় লাগবে ততক্ষণ এখানে থাকায় ভালো মনে হলো তাদের। বড় বড় কাঠের আলমারি ভরে বই রাখা আছে প্রচুর। একটা বড় কারুকার্য করা কাঠের টেবিল আর চেয়ার। টেবিলে রয়েছে দোয়াত, ফাউন্টেন পেন , বেশ কিছু কাগজের বান্ডিল।
তীর্থ তাড়াতাড়ি কোনো রকমে পেনটা নিয়ে একটা কাগজে মন্ত্রটা লিখে বুঝতে চেষ্টা করতে শুরু করলো।
রূপা তখন কিছুটা ধাতস্থ হয়েছে। সে একটু এগিয়ে আলমারিতে রাখা বই গুলো দেখছিল। হঠাৎ তার হাতে লেগে আলমারি থেকে একটি বই তার পায়ের কাছে পড়ে গেল। সে প্রথমে ভয়ে চমকে উঠেছিল পরক্ষনেই বইটিকে হাতে তুলে নিলো। বেশ কিছুক্ষন বইটির দিকে তাকিয়ে তারপর কাঁদতে কাঁদতে মুখ চেপে বসে পড়লো। তীর্থ উঠে এলো তার কাছে, কাঁধে হাত রেখে বললো- কি হয়েছে রূপা ?
রূপা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- এই বইটা এই বইটার ভেতরে তোর দেওয়া সব চিঠি চিরটুক যত্ন করে রেখেছিলাম। আমার খুব প্রিয় বই ছিল এটা। তুই এখান থেকেই আমায় কবিতা পড়ে শোনাতিস। একটু একটু পড়তে শিখিয়েওছিলি।
-তুই সত্যি বলছিস রুপা? এসব কি করে জানলি ?
রূপা উত্তর দিলো না শুধু বইটা খুলে দেখালো। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো বেশ কিছু চিঠি। তীর্থ একটা চিঠি টেনে বের করলো। এ হাতের লেখা তো তারই হাতের লেখার মতো। চিঠিতে লেখা রয়েছে,
“প্রিয়তমা রত্না,
তোমায় বিবাহের প্রতিশ্রুতি করিয়াও রাখিতে পারি নাই। অন্য দিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের আগুন দিনে দিনে আরো ঘনীভূত হইতেছে। বাবার আদেশ অনুসারে আমায় কলিকাতা যাইতে হইবে। আমার অনুপস্থিতিতে যাতে ওরা তোমায় গ্রাম ছাড়া না করিতে পারে তাই আমার নামে থাকা এই বাগানবাড়ি আজ থেকে তোমার নামে করিয়া যাইতেছি।
ইতি
রুদ্রপ্রতাপ”
চিঠির পিছনে একটি সরকারি কাগজ আটকানো আছে। তীর্থ খুলে দেখলো এ বাড়িরই দলিল সেটা।চিঠিটা পড়ে মাথায় কেমন যেন সব গন্ডগোল হতে শুরু করলো, সে রূপা দিকে তাকাতেই রূপা তাকে জড়িয়ে ধরলো।
রূপা তীর্থকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো- আমার সব মনে পড়েছে তীর্থ। কম বয়সে বিয়ে হয়ে এক মেয়ে হয়েছিল তারপর স্বামী মারা যায়। আমি জমিদার বাড়িতেই পেটের দায়ে কাজ করতাম এমন সময় তুই, জমিদারের ছোট ছেলে আমার প্রেমে পড়িস। সব স্বপ্নের মতো হয়ে যায়। তুই বোঝালি বিধবা বিবাহ এখন আর অপরাধ নয়। নতুন জীবনের আশায় তোকে বিয়ে করতে চাই কিন্তু কেউ বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। তাই তুই তোদের বাগান বাড়িতে আমায় নিয়ে থাকতে শুরু করিস।কিন্তু কয়েকদিন পরেই স্বপ্নভঙ্গ হলো আমার। বিধবা হয়ে তোর সাথে থাকায় সবাই কুনজরে দেখতে শুরু করেছিল আমায়। আমার শ্বশুর তোকে আমার থেকে ষড়যন্ত্র করে আলাদা করে দেয়। আমার বাচ্চাকেও মেরে ফেলে। তারপর ডাইনি অপবাদে পুড়িয়ে মারতে এসেছিল আমাকে। কিন্তু তুই ফিরে আসিসনি।
– কিন্তু আমি ফিরে এসেছিলাম কিন্তু তোকে দেখতে পাইনি তারপর ওরা বলেছিল তুই অন্য এক পুরুষের সাথে পালিয়ে গিয়েছিস! নিজের অজান্তেই যেন কথা গুলো বেরুলো তীর্থর মুখ দিয়ে।
দুজনের সব মনে পড়ে গিয়েছে পরস্পরের মুখ দেখে বুঝতে পারলো তারা।
তীর্থ আরো নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো রুপাকে। গত জন্মের যন্ত্রনাদায়ক বিচ্ছেদের কথা মনে পড়ে গিয়ে দুজনের মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল।
তীর্থ নিজেকে কিছুটা সামলে বললো- আমি মন্ত্রটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখলাম এই মন্ত্র শুধু সময়ের পরিবর্তন ঘটায়। শেষ লাইনে তাই বলেছে। মাঝের লাইনে বলা আছে অতীতের উত্তর মিললে বর্তমানে ফেরার চাবিকাঠি পাবো।অর্থাৎ এখন যতদূর মনে হচ্ছে আমাদের দুজনের স্মৃতির যে অংশ আমাদের দুজনের মধ্যে কারো জানা নেই আছে সেটা মেলাতে পারলেই আমরা ফিরতে পারবো।
-তোর কথা অনুযায়ী চলা ছাড়া তো আর কোনো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। আমারও মনে হচ্ছে এটাই একমাত্র উপায়।
ক্রমশ…
(অবশ্যই মতামত জানাবেন। খুব তাড়াতাড়ি পরের পর্ব নিয়ে আসছি)