Deepabali Poem In Bengali
দীপাবলি
– অর্পিতা সরকার (অপু)
আজ সতেরো বছর ধরে ,
বস্তির এই এক চিলতে ঘরে ,
আমি শ্যমা – কেবল আমিই জানি ,
সংসার টা কি করে আগলে আছি পরে !!
মাস গেলে লোকের বাড়ি কাজ করে পাই ঐ তো কটা টাকা গোনা ,
বছর ঘুরে গেলো,এখনও মেটেনি উমার বিয়ের দেনা ।
এখনও এক খান মেয়ে বসে আছে ঘাড়ে ,
তোকে পার করে তবেই আমি শান্তিতে যাব পর পারে ।
সারাদিনের এই হাড় ভাঙা খাটুনি , শরীর দেয় না সায় ,
এই ভর সন্ধ্যা বেলায় কে এসে দাঁড়ালে বাপু দরজায় !!
আরে !! এ যে আমার উমা !! আয় মা ঘরে আয় !!
আহা দাঁড়ালি কেনও দ্বারে !! ঘরে আয় চৌকাঠ ডিঙ্গায় ।
তা হ্যাঁ রে মা এমন সময় তুই একাই এলি চলে !!
শ্বশুর বাড়ি এসেছিস তো বলে !!
তোর মুখটা শুকনো লাগছে কেনও এমন ধারা !!
সব ঠিক আছে তো !! আমার মন টা কু ডাকছে , বুকটা কেমন প্রান ছাড়া !
হ্যাঁ মা সব ঠিক আছে ,
এত প্রশ্ন করছ কেন ! আমি কত দিন পর এলাম তোমার কাছে ।
মাগো আমার বড্ড খিদে পেয়েছে , দাওনা তোমার হাতে খেতে ,
কত দিন পায়নি তোমাদের এক সাথে ।
এই তো মা আমি এখুনি বসাচ্ছি ভাত , বস দেখি দুই বোন ,
তোদের একসাথে দেখে ভরুক আমার মন ।
এক বছর পরে আজ নবমীর রাতে ,
দেখ দেখি খেয়ে ,একই আছে কিনা মায়ের হাতের ভাতে ভোতে !!
এ কি উমা তোর চোখে জল ,
কি হয়েছে মা আমায় একটি বার সব খুলে বল ।
দেখেছো আমার একটা কথা শোনার আছে জো !!
ঐ দেখো বাড়ি ঢুকেছে ভদ্রলোকের পো ।
সব লোকের মরণ জোটে , মরে না শুধু তোদের বাপ ,
আমার ঘাড় থেকে নামবে না এ অভিশাপ ।
আমিও এবার ছেড়ে ছুড়ে পালাবো এ সংসার ,
রেল লাইনে মাথা দিয়েই জুড়াবে আমার হাড় ।
আরে বৌ চেঁচাচ্ছিস কেন !! দেনা কটা টেকা ,
পুজো র বাজারে দোস্ত দের সাথে মজা করব , পকেট দেখ একে বারে ফাঁকা ।
একটা টাকাও তোকে দেবনা আমি আজ ,
তুই মদ খাবি , গতর খাটিয়ে কর কাজ ।
টাকা দিবি নে বৌ !! তবে এই নে ভাতের থালা ,
আমিও খাবনা – তোরাও খাবিনা , শোধ বোধ জ্বালা ।
মেয়েটা আমার কত দিন পর এলো বাড়ি ,
আর তুই কিনা ফেলে দিলি ভাতের হাড়ি !!
তুই তো জানিস বৌ টাকা দিলেই চলে যাব আমি ,
তাহলে রোজ রোজ কেন করিস ন্যাকামি !!
আজ যদি মরেও যাই তবুও একটা টাকাও দেব না আমি আর ,
কপাল ঠোকে শ্যামা!তোর জন্য আমার দোকানে বাজারে ধার ।
মা তুমি কাঁদছ !! আর কেঁদোনা মা ,
সব টুকু এবার ভাগ্য বলেই মেনে নাও না ।
কত দিন পর এলাম বাড়ি , কালই তো যাব চলে ,
আর যে টুকু রাত বাকি আছে চলো ঘুমায় তোমার কোলে ।
হ্যাঁ রে মা তুই বললি না তো কোন কথা ,
আমায় বলে দেখ , হালকা হবে বুকের ব্যাথা ।
না না মা তেমন কিছু নয় , বড় ঘুম লাগে যে চোখে ,
তখন চোখে জল এসেছিল , শুধুই আনন্দের ই ঝোঁকে ।
আরে এ কি অনেক টা সকাল হয়ে গেছে , বড্ড হল দেরি ,
এত লোক আসছে কেন এদিক পানে আমাদের বাড়ি !!
কি হয়েছ গো দাস বৌ !! তোমরা সবাই চুপচাপ !!
মরল বুঝি আমার উমার বাপ ।
দাস বৌ আমতা আমতা করে –
তুমি নিজেই না হয় দেখো চোখ ভরে !
ধীর পায়ে শ্যামা এগিয়ে যায় রেল লাইনের ধারে ,
থমকে থেমে শ্যামা আছড়ে পরে রেলের উপরে ।
পাগলের মত চিৎকার করে , তোমরা জানো আমি না মা !!!
আমার ছেলে মেয়ে না বললেও আমি বুঝি তা !
কাল সন্ধ্যা বেলা বুকে অনেক জ্বালা নিয়ে এসেছিল উমা !!
আজ সব জ্বালা জুড়িয়ে গেল , এবার তুই শান্তিতে ঘুমা ,
আর কেউ জ্বালাবে না মা ,
তুই ঘুমা , আমি আছি তো , তুই শান্তিতে ঘুমা !!
বেশ কয়েক টা দিন হল পার , শ্যামা একাই বির বির করে বকে ,
সবাই বলে ………………
মাথাটা গেলো এবার মেয়ের শোকে ।
আর এক টা মেয়ের মাথায় থাকলো না কেউ আর ,
ঘরের চাল ডাল ও বাড়ন্ত হবার জোগাড় ।
মাতাল টা বেশ কদিন ছিল উধাও , আজ আবার গেল দেখা ,
নিশ্চয় বেটা বৌ এর কাছে চাইতে এসেছে টাকা !!
কি রে বৌ তোর মেয়ে টাও গেল মরে ,
কেন বলতো কাঁদছিস এমন পরে পরে !!
আজ মদ খাবি বৌ , মদে প্রচুর মজা ,
না করি কারো তোয়াক্কা , না করি পরোয়া , আমিই আমার রাজা ।
অনেক কদিন পরে শ্যামা আবার বসল নড়ে চরে ,
আবার তুই এসেছিস আমার ঘরে !!
দেখ বৌ আজ টেকা চাইনা , নিয়ে যাচ্ছি তোর আর এক মেয়ে ,
আমার দোস্ত বলেছে তোর মেয়ে কে করবে বেয়ে ।
আমার দোস্ত জানিস খুব সৎ ,
বলেছে পেট ভরে দেবে মদ ।
শ্যামা নিজের অস্তিত্ব কে পায় আবার খঁুজে !
আর সে পারে না সইতে মুখ বুঁজে !
তাকিয়েছিস যদি একবার ও আমার মেয়ের পানে ,
তবে তোকে আমি ই এবার মারব প্রানে ।
শ্যামা আবার কাটিয়ে উঠেছে সব ঝোঁক ,
পেটের খিদে ভুলিয়ে দিয়েছে মেয়ে মরার শোক ।
শ্যামা কাজের তাগিদে আবার ছুটছে মনিব বাড়ির পানে ,
ওরা মশলা মাখিয়ে হাজার কাহন শুনিয়ে দিল কানে ।
তোমার মেয়ে মরেছে বলে তো আর থামবে না জগত সংসার ,
আর দরকার হবে না তোমার এখানে আসবার ।
তোমার মত তো আর আমাদের করলে চলবে না শোক ,
আমরা দেখে নিয়েছি কাজের লোক ।
বন্ধ দরজায় স্থির চোখে চেয়ে শ্যামা একেবারে চুপচাপ ,
কে জানে ! মনে মনে কি করছিল পরিমাপ !!
শ্যামা দরজায় দরজায় উদ্ভ্রান্তের মত ছোটে ,
কোথাও যদি এক খান কাজ জোটে ।
গোটা দিন টাই ফুরিয়ে গেল ধীরে ধীরে ,
শ্যামা ক্লান্ত হয়ে আসে ঘরে ফিরে ।
আমার মেয়েটা , কোথাও নেই তো ঘর – বার ,
এ নিশ্চয় কাজ বজ্জাত মাতালটার ।
শ্যামা দৌড়ে ঘর থেকে বার করে আনে বঁটি ,
অনেক হল , আজ তোকে করবই সহস্র কুটি ।
পিছু হতে ডাক আসে,মা ও মা তুমি যাচ্ছ কোথায় এই সন্ধ্যা বেলা !!
এই দেখো কেমন পয়সা এনেছি মেলা ।
শ্যামা বঁটি ফেলে বুকে জড়িয়ে ধরে মেয়ে ,
অঝোরে কেঁদে ওঠে মেয়েকে কাছে পেয়ে ।
মা তুমি তাকিয়ে দেখো , কালী পুজো উঠেছে কেমন সেজে ,
মাটির প্রদীপ গড়ে ছিলাম নিজে ।
সেই প্রদীপ নিয়ে গেলুম বাজার ধারে ,
কেউ কেনেনা একটিও , বলেছি কত কর জোরে ।
তার পর সে এক কালো মেয়ে ,এক মাথা চুল , দাঁড়ালো সামনে এসে ,
“এ প্রদীপের দাম কত গো ? “ -কইল মুচকি হেসে ।
তার পর সে সকল প্রদীপ নিয়ে গেল শেষে ,
ফেরবার পথে দেখলাম আমি , আমার প্রদীপ জ্বলছে পুজা মণ্ডপ ঘেঁষে ।
দেখো না মা দেখতে দেখতে বেড়ে গেলো রাতি ,
চারিধারে জ্বলছে টুনি , জ্বলছে হাজার বাতি ,
সারাদিন খায়নি কিছু , পেট যে বড় খালি ,
তুমি আমি চুলার আগুন জ্বেলে দেখব আজ ,
আমাদের দীপাবলি ……………।।