জীবনের গল্প – Life Story – Bangla Golpo
খুব ভোরবেলা ঋতুর ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। পাশে রাহুল অকাতরে ঘুমোচ্ছে। গায়ের থেকে
চাদরটা সরে গেছে। ঋতু চাদরটা ওর গায়ে ভালো করে জড়িয়ে দিয়ে বিছানা ছাড়লো। পাশের
ঘরে পুপুন ঘুমোচ্ছে। চোখ আধবোজা। ঋতু পুপুনের মাথায় হাত বুলিয়ে হাসলো একটু। ওর মা
বলেন “নাতি আমার শিবঠাকুর, আধবোজা চোখে ঘুমায়।” সেই শুনে রাহুল মজা করে
বলে,”সারাদিন অত নেশাভাঙ্গ করলে চোখ এমনিই বুজে আসে। শিবঠাকুরেরও সেই
অবস্থা!”
ঋতু চোখেমুখে জল দিয়ে ব্রাশ করে রাত পোশাকটা বদলে বেরলো হাঁটতে। বহুদিন পর
ভোরবেলা হাঁটতে ওর ভালোই লাগছিল। তখন অন্ধকার সরিয়ে অল্প অল্প আলো ফুটছে চারপাশে।
হাল্কা মাধবীলতা, বেলফুল, করবীর গন্ধ বাতাসে। কোকিল ডাকছে। রাস্তার পাশের বড় বড়
গাছগুলো থেকে পাতা খসে পড়ছে। নারকেল গাছের পাতাগুলো দোল খাচ্ছে যেন। রাস্তার আলোয়
সেই পাতার দোল খাওয়া দেখতে দেখতে ঋতু ফিরে যাচ্ছিলো ছোটবেলার দিনগুলোতে। মা
ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে দিতেন। মুখ ধুয়ে পড়তে বসতো ওরা দুই বোন।
জীবনের গল্প বাংলা
সামনের খোলা জানলা দিয়ে কতবার সূর্যোদয় দেখেছে। ওদের বাড়ির পরেই ছিল একটা পুকুর।
পুকুরের পিছনের দিকটায় নারকেল গাছের সারি। সেই ভোরবেলায় মুরগীগুলো ‘কোকর কো’ করে
ডেকে ওঠাতো পাড়ার সবাইকে। ‘প্যাক প্যাক’ করে ডাকতে ডাকতে সাদা হাঁসগুলো পুকুরের
জলে খেলে বেড়াতো রাজকীয় ভঙ্গিতে। পড়া ফেলে দুই বোনে হাঁস মুরগিদের কলকলানি দেখতো।
সূর্য উঠলে নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে প্রায় দিনই রক্তিম আকাশের সৌন্দর্য
দেখতো বাক রুদ্ধ হয়ে। ওরা তখনও পাহাড় বা সমুদ্র থেকে সূর্যোদয় দেখেনি। কিন্তু
কল্পনার রঙের অভাব ছিল না মনে। পরে অনেকবার রাহুলের সাথে ট্যুরে গেছে। দেখেছে
পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য। সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত। সমুদ্রের ঢেউ গুনতে গুনতে হারিয়ে
গেছে নিজেদের ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে। কিন্তু ছোটবেলায় দেখা সেই অভিজ্ঞতাগুলো
ম্লান হয়নি এখনও। চিলেকোঠার ঘরে দুই বোনের কত গল্প, সারা দুপুর অংক করতে করতে
চুরি করা আচার লুকিয়ে খাওয়া, সাধারণ কথাতেও হেসে গড়িয়ে পড়া সেই ছোট্ট ছোট্ট
খুশিগুলো ছিল অমূল্য। ঋতু বিউটিশিয়ানের কোর্স করে একটা বিউটি পার্লারের মালিক।
রাহুল বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করে। সাজানো সংসার, গাড়ি, বাড়ি কিছুরই অভাব নেই।
তবুও এত সুখের মাঝে ছোটবেলার সুখ, আনন্দের মুহূর্তগুলো আজও মনে রেখেছে যত্ন করে।
মাঝে মাঝে সেসব কথা মনে পড়লে এক অদ্ভুত আত্মতৃপ্তিতে ভরে ওঠে মন। খুব ভোরে মা
উনুনে আঁচ দিতেন। বড়মা উনুনে হাওয়া করতেন বার কয়েক। তারপর গলগল করে ধোঁয়া বেরতো।
একটা ধোঁয়াটে পরিবেশ উঠোনটা জুড়ে, বাগানের জবা, টগরফুলের গাছগুলোর মাঝে মাঝে
ধোঁয়াটা জমে থাকতো গাছের পাতার ফাঁকে। ধোঁয়ার গন্ধে চোখ জ্বালা করতো। সকালে দুধ
দিয়ে চা করে বড়মা সবাইকে ডাকতেন চা খেতে। ফুলকাটা ব্রিটানিয়া বিস্কুট দিয়ে চা
খেতেন বাবা আর জেঠুন। খবরের কাগজের পাতাগুলো ভাগাভাগি করে পড়তেন ওনারা। তারপরে
তাড়াহুড়ো করে স্নান করে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে অফিসে দৌড়তেন। বড়মা নিজেও জর্দা পান
খেতেন আর বাবা জেঠুনের হাতে অফিস যাওয়ার আগে পান দিতেন। বড়মায়ের সাজা পান ঋতুরা
দুই বোনও কতবার খেয়েছে। বড়মা রাগ করতেন, “দাঁতগুলি কুচ্ছিত হইয়া যাইবো, খাইস না।”
কে শোনে সে কথা। ঐ পানের স্বাদ যেন বিরিয়ানি কোপ্তা কালিয়াকেও হার মানায়। দাদাভাই
বিকেলে ফুটবল খেলে এসে ঘেমো গায়ে দুই বোনের মাথায় চাঁটি দিয়ে বলতো, “ভালো করে পড়।
না হলে মুটে মজুর যাকে পাবো তার সাথেই বিয়ে দিয়ে দেবো। মদ খেয়ে এসে পেটন দেবে
তোদের। তখন বুঝবি পড়াশোনা না করে কি ভুলটাই না করেছিস।” সেই দাদাভাই আমেরিকায়
সেটেলড্। আসে না বহুদিন হলো। জেঠুন মারা গেছেন। মা বাবা আর বড়মা বাড়িটা আগলে বসে
আছেন। বোনের বিয়ে হয়েছে দিল্লিতে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই বিরাট চাকরি করে। এদিকে
তেমন যোগাযোগ করে না। ন’মাসে, ছ’মাসে ফোনে দু একটা কথাবার্তা হয়।
ঋতু হাঁটতে হাঁটতে এসব কথা ভাবছিলো। হঠাৎ করে উনুনের ধোঁয়ার গন্ধ নাকে এলো।
তাকিয়ে দেখলো একটা ঝুপড়ি থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। সামনেই চায়ের দোকান। ঋতু দোকানের
সামনে রাখা বেঞ্চে বসলো। অনেকটা হেঁটে পা টনটন করছে। অনভ্যাসের ফল। আগে কত
হাঁটতো। স্কুলে যেতে আসতে, পাড়ার টিউশনে কিংবা এমনিই বান্ধবীদের সাথে ঘোরাঘুরি।
কৈ তখন পা ব্যাথা করেনি তো! দোকানি লোকটা ঝুপড়ির থেকে বেরিয়ে এসে বললো, “দিদিমণি
চা খাবেন? একটু দেরি হবে। উনুনটা ধরিয়েছি।” ঋতু ঘাড় কাত করে ‘হ্যা’ বলে বসেই
রইলো। কয়েকজন লোক, কমবয়সী ছেলেরা জগিং করবার জন্য দৌড়চ্ছে। ওরা ছোটবেলায় বাড়ির
পাশেই ছেলেদের খেলা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে। সে সময় মেয়েরা এতো স্বাস্থ্য বা
সৌন্দর্য সচেতন ছিল না। ঘরেই মা কাকিমাদের রান্নাঘরের ভাঁড়ার থেকে ময়দা, বেসন,
টমেটো, মধু, দই এসব নানা উপকরণ মুখে মাখতো। পাড়ায় পাড়ায় এতো বিউটি পার্লার গজিয়ে
ওঠেনি।
ঋতু অনেকদিন পরে মাটির ভাঁড়ে চা খেলো। পোড়া মাটির ভাঁড়ে চা দিলে একটা সোঁদা গন্ধ
পাওয়া যায়। সেই গন্ধটা ঋতুর খুব প্রিয়।প্রতিদিন রান্নার মেয়েটা এসে দুবেলা রান্না
করে দিয়ে যায়। ঋতু রান্না করে শখে; বর ছেলের বায়নায়। ছোটবেলায় দেখেছে মা আর
বড়মায়ের সারাদিন কেটে গেছে রান্নাঘরে। আত্মীয়স্বজনরা তখন আসতো মাঝে মাঝেই। একটা
হলুদ পোস্ট কার্ডের চিঠি একে অপরকে মনের অনেকটা কাছে নিয়ে আসতো। সংসারের শত কাজেও
মা আর বড়মার মুখটা তেলে ঘামে দূর্গাঠাকুরের মুখের মতোই চকচক করতো। জ্যান্ত দূর্গা
ঘরে ঘরে। সিঁদুরের টিপটা কপালে লেপ্টে গিয়ে বড়মাকে কেমন যেন তেজোদীপ্ত দেবী
চৌধূরানী মনে হতো ঋতুর। রবীন্দ্রনাথ শরৎচন্দ্র আর বঙ্কিমবাবুর লেখা নারী চরিত্ররা
মূর্ত হয়ে উঠতো বাংলার ঘরে বাইরেই। এখন তো তেমন কেউ কারোর বাড়িতে যাতায়াত করেই
না। মোবাইলে যোগাযোগ হয়ে সম্পর্কগুলো বড্ড মেকি হয়ে গেছে। সবাই যেন দৌড়চ্ছে।
আর্থিক বা সামাজিক পরিস্থিতিটা খুব দ্রুত বদলাচ্ছে। এটা সার্বিকভাবে ভালো হলেও
মানুষ অনেক ছোট গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
চা শেষ করে আবার হাঁটা দিলো ঋতু নিজের ফ্ল্যাটের দিকে। তখন আলো ফুটেছে পুরোপুরি।
যে পরিবেশটাকে আলো আঁধারিতে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিলো কিছুটা; দিনের আলো
পুরোপুরি ফুটে উঠতেই ছেলেবেলার সেই দিনগুলো হারিয়ে গেল আবার স্মৃতির অতলে।
বাস্তবের মাটিতে পা রেখে ঋতুর মতো হাজার হাজার মহিলার পথ চলা শুরু আবারও একটা
নতুন দিনের জন্য নতুন আশাকে সঙ্গী করে। ঘরে স্বামী সন্তান অপেক্ষায় তাঁর। এই
সম্পর্কের বাঁধনটুকুই সম্বল। এই সুখটুকু পাওয়ার জন্যই মেয়েরা সংসার আঁকড়ে থাকে।
জন্ম নিতে চায় আবারও। তাই তো কবি হেলাল হাফিজ বলেছেন,
“আমাকে স্পর্শ করো,
নিবিড় স্পর্শ করো নারী।
অলৌকিক কিছু নয়,
নিতান্তই মানবিক যাদুর মালিক তুমি,
তোমার স্পর্শেই শুধু আমার উদ্ধার।
আমাকে উদ্ধার করো পাপ থেকে, পঙ্কিলতা থেকে, নিশ্চিত পতন থেকে।
নারী তুমি আমার ভিতরে হও প্রবাহিত, দুর্বিনিত নদীর মত,
মিলেমিশে একাকার হয়ে এসো বাঁচি।।”
===================================================