একটি শিক্ষণীয় গল্প – An Instructive Story In Bengali
শায়রী, এখন তোমার বয়স হয়নি এসব পূজোআচ্চা করার। তুমি বরং ঘরদোর পরিষ্কার করে
রাখো। বাড়িতে একটু পরেই লোকজন আসবে কিনা। শায়রী র খুব ইচ্ছে ছিল পূজোর কাজ
করার। তার নিজের মা’ র বাড়িতে পূজো আচ্চার কোনো চল ছিল না।ঠাকুরের সামনে ধূপ
জ্বালিয়ে প্রণাম করে কাজ সারতো মা।কলকাতার বুকে মানুষ সে। এখন আন্দুলের বাড়িতে
এসে নারকেল গাছ, আম গাছ, পাতকুয়া এসব দেখে তার বেশ সংসার করতে ইচ্ছে
জেগেছে। ১৯ বছর বয়সে এ বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর শায়রীর খুব ইচ্ছে হতো
ঠাকুর ঘরে যেতে। পূজো করতে। বিশেষ করে লক্ষ্মী পূজো করতে তার খুব ইচ্ছে হতো।
কিন্তু দোর্দণ্ডপ্রতাপ শ্বাশুড়ির কায়দা করে তাকে সরিয়ে দেওয়া এসব কাজ থেকে, বয়স
কম হলেও বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি।
তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে এনেছি বলে পড়াশুনো কম করলে চলবে না। সে তোমার বাপের বাড়িতে
সমস্যা ছিল তাই নাহয় বাধ্য হয়ে বিয়েটা তাড়াতাড়ি করেছিল বাবু।আমাদের
পরিবারে কিন্তু সবাই শিক্ষিত। দেখো, মানটা রেখো।” শ্বাশুড়ি খুব নরম করে পেঁচিয়ে
পেঁচিয়ে কথাগুলো শায়রীর কানের কাছে বলতেন।
মাঝে মাঝে স্বামীর কাছে অনুযোগ করতে গেলে সে তার কথাকে ঘুরিয়ে দিয়ে বলতো,
“শায়রী এইসব মায়ের কাজ। তোমার এসবে নাক গলিয়ে কাজ নেই। নেহাত তোমার ও
বাড়িতে থাকতে সমস্যা হচ্ছিল তাই, নয়তো আমার যেন ভারি ইচ্ছে ছিল সাত তাড়াতাড়ি
বিয়ে করে নিজের বোঝা বাড়াতে। ”
ছিল না। জন্মটাই বা কেন যে দিয়েছিলেন কোনদিন মা’ কে মুখফুটে জিজ্ঞেস করতে
পারেনি। মা নিজের স্বামীকে নিয়ে অর্থাৎ তার বাবাকে ঘিরে নিজের এক জগৎ তৈরী করে
রেখেছেন জ্ঞান হওয়া ইস্তক সে দেখে এসেছে, মাছের বড় টুকরোটা, মাংসের বড় টুকরোটা
তার বাবার পাতেই যায়। কখনো ছোটবেলায় শায়রী হয়তো বাবার মতো বড় পিস চেয়ে ফেলেছে,
মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠতেন, আগে বাবার মতো রোজগার করে আনো তারপর বড় পিসের স্বপ্ন
দেখবে। শায়রী আশেপাশে, বন্ধু বান্ধব দের মা’ দের দেখতো যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে,
চুল বেঁধে দিচ্ছে। শায়রী স্বপ্ন দেখতো তার মা ও তাকে খাইয়ে দিচ্ছে, মাথায় হাত
বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোনদিন তার সেই আশা পূর্ণ হয়নি। মায়ের কোলে
মাথা রেখে ঘুমানোর আরাম যে কি, তা কোনদিন উপলব্ধি করতে পারেনি। আস্তে আস্তে
বুঝতে শিখল, তার মা আসলে নিজেকে ভালবাসেন।অদ্ভুত এক চরিত্র। অর্থলোভী। শায়রী
মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভটাও যেন ছাড়তে পারতো না। দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়তে টিউশনি
শুরু করে। টিউশনির টাকা মায়ের হাতে তুলে দিলে কয়েকদিন বড় পিসের মাছটা, মুরগির
ঠ্যাং এগুলো কপালে জুটতো। মাসের মাঝামাঝি হতেই আবার মায়ের গলায় সেই নেই নেই সুর
শুনতে পেত। অথচ বাবা রোজগেরে তাই বাবার পাতে ভালোটা মাসের শেষ দিনে ও
পড়তো।
রাস্তায় লোভী, লালসায় জিভ লকলক করা পুরুষেরা প্রায় গিলছিল তার ভেজা শরীররটা,
হঠাৎ বাসস্ট্যান্ডে ছাতা হাতে এসে দাঁড়িয়েছিল নভোনীল, ছাতাটা বাড়িয়ে দিয়ে
বলেছিল, কিছু যদি মনে না করেন, আপনি আমার ছাতাটা নিয়ে বাড়ি যান। আমার অন্য ছাতা
আছে। শায়রী নিতে চায়নি। নভোনীল বলেছিল, না হয় আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। ছাতাটা
নাহয় ফেরতই নিয়ে তবে আসব। ভয় পাবেন না, আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল
ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। আমি ও কিছু বই কিনতে এসে আটকে পড়েছিলাম। নভোনীলের
সেইদিনের ব্যবহারে আটকে গিয়েছিল শায়রী। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ফোনের দিকে চেয়ে
থাকতো, যদি একবার ফোন আসে সেই আশায়। নভোনীলের ও অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল রোজ
শায়রী কে ফোন করার। ভালবাসার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল একে অপরের কাছে।
রাজি হয়ে বলেছিলেন, “নিয়ে যাবে বাবা নিয়ে যাও, ফেরত দিয়ে যেওনা যেন। আর দেখো
বাবা, বিশেষ গয়নাগাটি দিতে পারবো না, সেই বুঝে নিও মেয়েকে। ”
খুব চমৎকার একটি শিক্ষণীয় গল্প
শায়রী, তুমি চিন্তা কোরো না। চাকরী টা পেয়েই তোমায় নিয়ে যাবো আমার করে। ”
কোনো মেয়ের সাথে বিয়ে দেবেন। সেই মেয়ে বেশ তার বশবর্তী হয়ে থাকবে। কিন্তু এ
শহরের মেয়ের বড্ড বেশি পাখনা। বিয়ের কদিন পর শ্বশুরমশাই তো বলেই বসলেন-
“এ বাড়ির বৌয়েরা শাড়ি পরে থাকে। এইসব সালোয়ার কামিজ আমাদের বাড়িতে কেউ পরে না।
তুমি শাড়ি পরে এসো। ”
নভোনীলকে শায়রী বলতো- “এভাবে শাড়ি পরে হুড়াহুড়ি করে ট্রেনে যাতায়াত করতে গিয়ে
একদিন দেখো ট্রেনের তলায় চাপা পড়ব।”
কে কলকাতায় নিয়ে চলে এসেছিল। গড়েছিল ছোট্ট এক ভাড়াবাড়ি তে সংসার।
শ্বশুর শ্বাশুড়ি র জানার ইচ্ছা প্রবল। শায়রী শ্বশুরবাড়ি গেলেই শ্বাশুড়ি তাকে
একা পেলেই দোষারোপ করা শুরু করেন। শায়রীর আর ও বাড়িতে যেতে ইচ্ছে করে না।
কোনকিছুর ওপর তার যেন অধিকার ই নেই। আজ ও শ্বাশুড়ি ঠাকুরঘরে তাকে ঢুকতে দেন না।
রান্নাবান্না ও কি হবে সবটাই তার হাতে। শায়রী যেন ব্রাত্য সমস্ত জায়গায়।
কথায় কথায় বলেন, ছেলের জন্ম দেয় সৌভাগ্যবতী রা। নভোনীল এত শিক্ষিত হয়েও মায়ের
কথার কোনো উত্তর করতো না।
অনুভব করার স্পৃহা যে তার ও বড়, কি করে সে বোঝায়। নভোনীলের মুখের দিকে তাকিয়ে
কোনদিন সে উত্তর দিতে পারেনি।
শ্বশুর দুজনেই বলে উঠলেন, কোথাকার না কোথাকার বাচ্চা নিয়ে এসেছো, তোমরা এসো
কিন্তু ওকে নিয়ে নয়।
যে কোন বাচ্চাকে এভাবে… ছিঃ, ছিঃ, এই শিক্ষা দিয়েছি তোমায়? তোমার বৌয়ের মা
হওয়ার ক্ষমতা নেই বলে এসব করে কি প্রমাণ করতে চাইছ? ”
এই মেয়েকে বিয়ে করছে, কোনো শিক্ষা নেই, সংস্কার নেই, একে ঘরে তুলো না। তখন তো
লোকসমাজের দোহাই দিয়ে তুলে আনলে। আমার স্কুলের এক ছাত্রীর সাথে বাবুর বিয়ে দেব
ভেবেছিলাম কোথায়, কি বাধ্য মেয়েটা… তা, হতে দিলে না। আমার অপমান করলে? দেখো
এবার তোমার ছেলের কীর্তি। সামলাও এবার। ”
শিক্ষণীয় গল্প
কিসের বাচ্চা তুলে এনে বলছো তাকে মেনে নেব? লজ্জা করে না ভাবতে? আমরা
ব্রাক্ষণ। এই বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত দেবী লক্ষ্মী রয়েছেন। একে বৌটা তো
কায়েতের বাড়ি থেকে তুলে এনেছ, এবার কি চাষা না ডোম তার বাচ্চাকে নিজেদের নাতনি
বলে পরিচয় দিতে হবে? আর কত অপমান করবে আমাদের? সমাজে যে মুখ কাটা যাচ্ছে
আমাদের। লজ্জায় বাড়ি থেকে বের হতে পারিনা, সে খবর রাখো? এক বছর বাচ্চা এনেছ,
এদিকে পা দাওনি। লোককে কি জবাব দেব? তোমার অবশ্য কি, কলকাতার হাওয়া খাওয়াচ্ছে
বৌ। লজ্জা থাকলে এ কাজ করতে না। তোমার বাবার সমাজে সম্মান আছে। আমি শিক্ষিকা
ছিলাম, আমার সম্মান তো ধুয়ে মুছে দিলে। ”
আগে বলোনি? এ বাচ্চা তো সুস্থ নয় দেখছি। শেষমেষ ম্লেচ্ছ না কার বাচ্চা, তাও
আবার পাগল তাকে নিয়ে এসেছ? মহান হতে চাও না কি ঠিক বুঝতে পারছি না বাবু। ”
হঠাৎ কপাল চাপড়ে কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বলে চলেছেন -“তুমি
আমার সন্তান বলতে লজ্জা হচ্ছে বাবু….কত কষ্ট করে তোমায় ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছি
জানো? আমাদের মত সাধারণ বাড়ির রোজগার কত কম ছিল। কেন পড়িয়েছি? যাতে ভালো চাকরী
করো, বৌ আনলে আমাদের সেবা যত্ন করবে। তা, না ওনার বৌ ওনাকে বগলদাবা করে নিয়ে
গিয়ে শহরের হাওয়া খাওয়াচ্ছেন। ”
সন্তান ও ব্রাক্ষণ হবে এ তো স্বাভাবিক। তাই হিসেবমতো আমাদের সন্তান প্রাপ্তি ও
ব্রাক্ষণ। যদিও তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র চিন্তাভাবনা নেই। আর হ্যাঁ, অনেকবছর
শায়রী কে অনেকরকম কথা শুনিয়েছ। শায়রীর শিক্ষা ওকে বলেছে জবাব না দিতে গুরুজনদের
মুখে মুখে, তাই আজ ও সে দিতে পারলো না তোমাদের জবাব। মা- বাবা এই চরম সত্য টা
জেনে নাও, আমার মধ্যে বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই। শায়রীর আছে মা হওয়ার ক্ষমতা । ও
চাইলেই পারতো সন্তান গর্ভে নিতে অন্যান্য উপায়ে। কিন্তু আমায় ছেড়ে ও চলে
যায়নি। বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন ওকে হতে হয়েছে , আমায় নয়। কারণ আজ ও আমাদের
সমাজ মেয়েদের দিকেই আঙ্গুল তোলে। ”
”
দাওনি কিছু। সন্তান না হলে কত কথা শুনতে হয় সবটাই দেখেছি নীরব হয়ে। আর না। এখন
আমাদের প্রাপ্তি আছে। ”
প্রাপ্তি তোমার চেয়ে বেশি সুস্থ। ওকে আমরা হোম থেকে এনেছি জেনেই। ওর ডাউন
সিনড্রোম আছে। অসুস্থ নয়। আমরা কি আদপেই সবাই সুস্থ? কেউ নই। এই ফুটফুটে
মেয়েটার কি দোষ ছিল যে ওকে জন্মের পরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল বলতে পারো? সুস্থ
বাচ্চা তো সবাই নিতে চায়। ওদের তো কেউ নেয় না। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমি ও
বাবা হতে অসমর্থ তাই আমি ও অসুস্থ…. ”
গুণকীর্তন করতে হবে না। শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায়? বৌয়ের দোষ নিজের ঘাড়ে
নিচ্ছে। দেখো, দেখো ,ওগো দেখে শেখো, বৌকে বাঁচাচ্ছে। বাবু তোকে আমি পেটে ধরেছি,
আর আজ তুই সবার সামনে আমার অপমান করলি? এর থেকে মরে যাওয়া ভালো” বলতে বলতে
হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
সবচেয়ে আগে প্রয়োজন। মা, তুমি ও শিক্ষিকা ছিলে একসময় অথচ তোমার অন্তরের কালিমার
ওপর আচ্ছাদন চড়িয়ে শিক্ষকতা করে গেছ। শায়রীর শিক্ষিকা হওয়া শোভা পায়। ওই
প্রাপ্তিকে দেখে প্রথমেই বলেছিল ওকে আমাদের করে নিতে পারি, যদি তোমার আপত্তি না
থাকে। ওর ভাবনাকে সেদিন আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করেছিলাম।প্রাপ্তি কে এনেছিলাম
আমাদের জীবনে। শিক্ষক শিক্ষিকা হয়ে চাকরী করলেই হয় না, মন, ধ্যান ধারনা তাদের
অনেক উঁচু হতে হয়। সেই শিক্ষাই আসল শিক্ষা। ”
কাঁদতে বললেন” বাবু, তুই আমাদের এভাবে অপমান করলি? বৌয়ের কথায় একটা অসুস্থ
বাচ্চাকে তুলে আনলি? আমাদের ও তো ইচ্ছে ছিল, অন্যান্য দের মতো আমাদের বাড়িতে ও
আমাদের নাতি খেলবে..বয়সকালে বুঝবি, মা কেন বলেছিল। ”
হ্যাঁ, সে তোমাদের মত সুস্থ হোক এখন আর চাই না। সুস্থ সন্তান দত্তক নেওয়া যায়,
কিন্তু কজন পারে জেনেশুনে এইরকম শিশুদের আপন করে নিতে? তাকে সমাজের যোগ্য করে
তুলবো, আজ জেদটা আরো বাড়িয়ে দিলে তোমরা। ভালোই করলে। বাড়ি থেকে বের করে দিল আজ
ওকে, তাই আমি ওকে ছাড়া তো ঢুকবো না। তবে তোমাদের কোনো অসুবিধায় ডেকো। পাশে
থাকবো। এটা আমার অন্তরের শিক্ষা। আসি মা। ”