SUKUMAR ROY KOBITA (সুকুমার রায়ের কবিতা) Bengali Poem

Bongconnection Original Published
45 Min Read



SUKUMAR ROY KOBITA (সুকুমার রায়ের কবিতা) Bengali Poem

SUKUMAR ROY KOBITA (সুকুমার রায়ের কবিতা) Bengali Poem
Loading...


Sukumar Roy Kobita

Loading...

            কত বড় 

ছোট্ট সে একরতি ইঁদুরের ছানা,
ফোটে নাই চোখ তার, একেবারে কানা।
ভাঙা এক দেরাজের ঝুলমাখা কোণে
মার বুকে শুয়ে শুয়ে মার কথা শোনে।

যেই তার চোখ ফোটে সেই দেখে চেয়ে-
দেরাজের ভারি কাঠ চারিদিক ছেয়ে।
চেয়ে বলে মেলি তার গোল গোল আঁখি-
“ওরে বাবা! পৃথিবীটা এত বড় নাকি?”

==========
==========



      কলিকাতা কথা রে 

গিরিধি আরামপুরী, দেহ মন চিৎপাত,
খেয়ে শুয়ে হু হু করে কেটে যায় দিনরাত;
হৈ চৈ হাঙ্গামা হুড়োতাড়া হেথা নাই;
মাস বার তারিখের কোন কিছু ল্যাঠা নেই;
খিদে পেলে তেড়ে খাও, ঘুম পেলে ঘুমিও-
মোট কথা, কি আরাম, বুঝলে না তুমিও !
ভুলেই গেছিনু কোথা এই ধরা মাঝেতে
আছে যে শহর এক কলকাতা নামেতে-
হেন কালে চেয়ে দেখি চিঠি এক সমুখে,
চায়েতে অমুক দিন ভোজ দেয় অমুকে ।
‘কোথায়? কোথায়?’ বলে মন ওঠে লাফিয়ে
তাড়াতাড়ি চিঠিখানা তেড়ে ধরি চাপিয়ে,
ঠিকানাটা চেয়ে দেখি নীচু পানে ওধারে
লেখা আছে ‘কলিকাতা’ – সে আবার কোথারে !
স্মৃতি কয় ‘কলিকাতা ‘ রোস দেখি; তাই ত ,
কোথায় শুনেছি যেন , মনে ঠিক নাই ত,
বেগতিক শুধালেম সাধুরাম ধোপারে ;
সে কহিল, হলে হবে উশ্রীর ওপারে।
ওপারের জেলেবুড়ো মাথা নেড়ে কয় সে ,
‘হেন নাম শুনি নাই আমার এ বয়সে ।’
তারপরে পুছিলাম সরকারী মজুরে
তামাম মুলুক সে ত বাৎলায় ‘হুজুরে’
বেঙাবাদ বরাকর , ইদিকে পচম্বা ,
উদিকে পরেশনাথ ,পাড়ি দাও লম্বা ;
সব তার সড়গড় নেই কোন ভুল তায় –
‘কুলিকাতা কাঁহা’ বলি সেও মাথা চুলকায় !
অবশেষে নিরুপায় মাথা যায় ঘুলিয়ে ‘
‘টাইম টেবিল’ খুলি দেখি চোখ বুলয়ে ।
সেথায় পাটনা পুরী গয়া গোমো মাল্‌দ
বজবজ দমদম হাওড়া ও শ্যালদ –
ইত্যাদি কত নাম চেয়ে দেখি সামনেই
তার মাঝে কোন খানে কলিকাতা নাম নেই !!
-সব ফাঁকি বুজ্‌রুকী রসিকতা -চেষ্টা !
উদ্দেশে ‘শালা ‘ বলি গাল দিনু শেষটা।-
সহসা স্মৃতিতে যেন লাগিল কি ফুৎকার
উদিল কুমড়া হেন চাঁদপানা মুখ কার!
আশে পাশে ঢিপি ঢুপি পাহাড়ে পুঞ্জ,
মুখ চাঁচা ময়দান, মাঝে কিবা কুঞ্জ !
সে শোভা স্মরণে ঝরে নয়নের ঝরনা ;
গৃহিনীরে কহি ‘প্রিয়ে !মারা যাই ধর না ।
তার পরে দেখি ঘরে অতি ঘোর অনাচার –
রাখে না কো কেউ কোন তারিখের সমাচার !
তখনি আনিয়া পাঁজি দেখা গেল গণিয়া,
চায়ের সময় এল একেবারে ঘনিয়া !
হায়রে সময় নেই, মন কাদে হতাশে-
কোথায় চায়ের মেলা! মুখশশী কোথা সে !
স্বপন শূকায়ে যায় আধারিয়া নয়নে ,
কবিতায় গলি তাই গাহি শোক শয়নে।

==========
==========

Sukumar Roy Kobita Lyrics

        কহ ভাই কহ রে

কহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকা চোরা শহরে,
বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে
ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।

==========
   (অন্যান্য ছড়াসমূহ)
==========

     

          কাঁদুনে 

ছিচ্‌কাঁদুনে মিচকে যারা সস্তা কেঁদে নাম কেনে,
ঘ্যাঁঙায় শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর ঘ্যান্‌ঘ্যানে আর প্যানপ্যানে—
কুঁকিয়ে কাঁদে খিদের সময়, ফুঁপিয়ে কাঁদে ধম্‌কালে,
কিম্বা হঠাৎ লাগলে ব্যাথা, কিম্বা ভয়ে চম্‌কালে;
অল্পে হাসে অল্পে কাঁদে, কান্না থামায় অল্পেতেই;
মায়ের আদর দুধের বোতল কিম্বা দিদির গল্পেতেই—
তারেই বলি মিথ্যে কাঁদন, আসল কান্না শুনবে কে?
অবাক্ হবে থম্‌কে রবে সেই কাঁদনের গুণ দেখে!
নন্দঘোষের পাশের বাড়ী বুথ্ সাহেবের বাচ্চাটার
কান্নাখানা শুনলে বলি কান্না বটে সাচ্চা তার।
কাঁদবে না সে যখন তখন, রাখবে কেবল রাগ পুষে,
কাঁদবে যখন খেয়াল হবে খুন–কাদুনে রাক্ষুসে!
নাইকো কারণ নাইকো বিচার মাঝরাতে কি ভোরবেলা,
হঠাৎ শুনি অর্থবিহীন আকাশ–ফাটান জোর গলা।
হাঁকড়ে ছোটে কান্না যেমন জোয়ার বেগে নদীর বান,
বাপ মা বসেন হতাশ হয়ে শব্দ শুনে বধির কান।
বাসরে সে কি লোহার গলা? এক মিনিটও শান্তি নেই?
কাঁদন ঝরে শ্রাবণ ধারে, ক্ষান্ত দেবার নামটি নেই!
ঝুমঝুমি দাও পুতুল নাচাও, মিষ্টি খাওয়াও একশোবার,
বাতাস কর, চাপড়ে ধর, ফুটবে নাকো হাস্য তার।
কান্নাভরে উল্‌টে পড়ে কান্না ঝরে নাক দিয়ে,
গিলতে চাহে দালানবাড়ী হাঁ’খানি তার হাঁক্ দিয়ে,
ভূত–ভাগানো শব্দে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ে—
কান্না শুনে ধন্যি বলি বুথ্ সাহেবের বাচ্চারে।

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========



      কাজের লোক 

প্রথম।
বাঃ – আমার নাম ‘বাঃ’,
বসে থাকি তোফা তুলে পায়ের উপর পা!
লেখাপড়ার ধার ধারিনে , বছর ভরে ছুটি,
হেসে খেলে আরাম ক’রে দুশো মজা লুটি।
কারে কবে কেয়ার করি , কিসের করি ডর?
কাজের নামে কম্প দিয়ে গায়ে আসে জ্বর।
গাধার মতন খাটিস্ তোরা মুখটা করে চুন-
আহাম্মুকি কান্ড দেখে হেসেই আমি খুন।

                    সকলে।
আস্ত একটি গাধা তুমি স্পষ্ট গেল দেখা,
হাস্‌ছ যত, কান্না তত কপালেতে লেখা।

                    দ্বিতীয়।
‘যদি’ বলে ডাকে আমায় নামটি আমার যদি –
আশায় আশায় বসে থাকি হেলনা দিয়ে গদি।
সব কাজেতে থাকতে যদি খেলার মত মজা,
লেখাপড়া হত যদি জলের মত সোজা –
স্যান্ডো সমান ষন্ডা হতাম যদি গায়ের জোরে,
প্রশংসাতে আকাশ পাতাল যদি যেত ভরে –
উঠে পড়ে গেলে যেতাম বাজে তর্ক ফেলে।
করতে পারি সবি – যদি সহজ উপায় মেলে।

                    সকলে।
হাতের কাছে সুযোগ, তবু যদির আশায় বসে
নিজের মাথা খাচ্ছ বাপু নিজের বুদ্ধি দোষে

                    তৃতীয়।
আমার নাম ‘বটে’ আমি সদাই আছি চটে-
কট্‌মটিয়ে তাকাই যখন, সবাই পালায় ছুটে।
চশমা পরে বিচার ক’রে চিরে দেখাই চুল-
উঠ্‌তে বস্‌তে কচ্ছে সবাই হাজার গন্ডা ভুল।
আমার চোখে ধুলো দেবে সাধ্যি আছে কার?
ধমক শুনে ভূতের বাবা হচ্ছে পগার পার।
হাসছ? বটে ভাবছ বুঝি মস্ত তুমি লোক,
একটি আমার ভেংচি খেলে উল্টে যাবে চোখ।

                    সকলে।
দিচ্ছ গালি, লোকের তাতে কিবা এল গেল?
আকাশেতে থুতু ছুঁড়ে – নিজেই গায়েই ফেল।

                    চতুর্থ।
আমার নাম ‘কিন্তু’ আমায় ‘কিন্তু’ বলে ডাকে,
সকল কাজে একটা কিছু গলদ লেগে থাকে।
দমটা কাজে লাগি কিন্তু আটটা করি মাটি,
ষোল আনা কথায় কিন্তু সিকি মাত্র খাঁটি।
লম্ফ ঝম্ফবহুৎ কিন্তু কাজের নাইকো ছিরি-
ফোস করে যাই তেড়ে – আবার ল্যাজ গুটিয়ে ফিরি।
পাঁচটা জিনিস গড়তে গেলে দশটা ভেঙে চুর –
বল্ দেখি ভাই কেমন আমি সাবাস বাহাদুর!

                    সকলে।
উচিত তোমায় বেধে রাখা নাকে দিয়ে দড়ি,
বেগারখাটা পশুকাজের মূল্য কানাকড়ি।

                    পঞ্চম।
আমার নাম ‘তবু’ তোমার কেউ কি আময়ি চেনো?
দেখতে ছোট তবু আমার সাহস আছে জেনো।
এতটুকু মানুষ তবু দ্বিধা নাইকো মনে,
যে কাজেতেই লাগি আমি খাটি প্রাণপণে।
এম্নি আমার জেদ, যখন অঙ্ক নিয়ে বসি,
একুশ বারে না হয় যদি বাইশ বারে কষি।
হাজার আসুক বাধা তবু উৎসাহ না কমে,
হাজার লোকে চোখ রাঙালে তবু না যাই দ’মে।

                    সকলে।
নিস্কম্মারা গেল কোথা,পালাল কোন দেশে?
কাজের মানুষ কারে বলে দেখুন এখন এসে।
হেসে খেলে, শুয়ে বসে কত সময় যায়,
সময়টা যে কাজে লাগায়,চালাক বলে তায়।

==========
কবিতাটি খাই খাই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========


Sukumar Roy Kobita Bengali

    কাঠ বুড়ো 
 
হাঁড়ি নিয়ে দাড়িমুখো কে–যেন কে বৃদ্ধ
রোদে বসে চেটে খায় ভিজে কাঠ সিদ্ধ ।
মাথা নেড়ে গান করে গুন্ গুন্ সঙ্গীত
ভাব দেখে মনে হয় না–জানি কি পণ্ডিত !
বিড়্ বিড়্ কি যে বকে নাহি তার অর্থ—
‘আকাশেতে ঝুল ঝোলে, কাঠে তাই গর্ত ।’
টেকো মাথা তেতে ওঠে গায়ে ছোটে ঘর্ম,
রেগে বলে, ‘কেবা বোঝে এ সবের মর্ম ?
আরে মোলো, গাধাগুলো একেবারে অন্ধ,
বোঝেনাকো কোনো কিছু খালি করে দ্বন্দ্ব ।
কোন্ কাঠে কত রস জানে নাকো তত্ত্ব,
একাদশী রাতে কেন কাঠে হয় গর্ত ?’

আশে পাশে হিজি বিজি আঁকে কত অঙ্ক
ফাটা কাঠ ফুটো কাঠ হিসাব অসংখ্য ;
কোন্ ফুটো খেতে ভালো, কোন্‌টা বা মন্দ,
কোন্ কোন্ ফাটলের কি রকম গন্ধ ।
কাঠে কাঠে ঠুকে করে ঠকাঠক শব্দ ।
বলে, ‘জানি কোন্ কাঠ কিসে হয় জব্দ ;
কাঠকুঠো ঘেঁটেঘুঁটে জানি আমি পষ্ট,
এ কাঠের বজ্জাতি কিসে হয় নষ্ট ।
কোন্ কাঠ পোষ মানে, কোন কাঠ শান্ত,
কোন্ কাঠ টিম্‌টিমে, কোন্‌টা বা জ্যান্ত ।
কোন্ কাঠে জ্ঞান নেই মিথ্যা কি সত্য,
আমি জানি কোন্ কাঠে কেন থাকে গর্ত ।’

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========


Sukumar Roy Kobita Katukutu Buro

         কাতুকুতু বুড়ো

আর যেখানে যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার,
কাতুকুতু বুড়োর কাছে যেও না খবরদার!
সর্বনেশে বৃদ্ধ সে ভাই যেও না তার বাড়ি—
কাতুকুতুর কুলপি খেয়ে ছিঁড়বে পেটের নাড়ি।
কোথায় বাড়ি কেউ জানে না, কোন্‌ সড়কের মোড়ে,
একলা পেলে জোর ক’রে ভাই গল্প শোনায় প’ড়ে।
বিদ্‌ঘুটে তার গল্পগুলো না জানি কোন দেশী,
শুনলে পরে হাসির চেয়ে কান্না আসে বেশি।
না আছে তার মুণ্ডু মাথা না আছে তার মানে,
তবুও তোমায় হাসতে হবে তাকিয়ে বুড়োর পানে।
কেবল যদি গল্প বলে তাও থাকা যায় সয়ে,
গায়ের উপর সুড়সুড়ি দেয় লম্বা পালক লয়ে।
কেবল বলে, “হোঃ হোঃ হোঃ, কেষ্টদাসের পিসি—
বেচ্‌ত খালি কুমড়ো কচু হাঁসের ডিম আর তিসি।
ডিমগুলো সব লম্বা মতন, কুমড়োগুলো বাঁকা,
কচুর গায়ে রঙ‐বেরঙের আল্‌পনা সব আঁকা।
অষ্ট প্রহর গাইত পিসি আওয়াজ করে মিহি,
ম্যাও ম্যাও ম্যাও বাকুম বাকুম ভৌ ভৌ ভৌ চীঁহি।”
এই না বলে কুটুত্‍‌ ক’রে চিম্‌টি কাটে ঘাড়ে,
খ্যাংরা মতন আঙুল দিয়ে খোঁচায় পাঁজর হাড়ে।
তোমায় দিয়ে সুড়সুড়ি সে আপনি লুটোপুটি,
যতক্ষণ না হাসবে তোমার কিচ্ছুতে নাই ছুটি।

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========



       কানাখোঁড়া সংবাদ 

পুরাতন কালে ছিল দুই রাজা,
          নাম ধাম নাহি জানা,
একজন তার খোড়া অতিশয়,
          অপর ভূপতি কানা।
মন ছিল খোলা, অতি আলো ভোলা
          ধরমেতে ছিল মতি,
পর ধনে সদা ছিল দোঁহাকার
          বিরাগ বিকট অতি।
প্রতাপের কিছু নাহি ছিল ত্রুটি
          মেজাজ রাজারি মত,
শুনেছি কেবল, বুদ্ধিটা নাকি
          নাহি ছিল সরু তত,
ভাই ভাই মত ছিল দুই রাজা,
          না ছিল ঝগড়াঝাঁটি,
হেনকালে আসি তিন হাত জমি
          সকল করিল মাটি।
তিন হাত জমি হেন ছিল, তাহা
          কেহ নাহি জানে কার,
কহে খোঁড়া রায় “এক চক্ষু যার
          এ জমি হইবে তার”।’
শুনি কানা রাজা ক্রোধ করি কয়
          “আরে অভাগার পুত্র,
এ জমি তোমারি- দেখ না এখনি
          খুলিয়া কাগজ পত্র”।
নক্সা রেখেছে এক বছর
          বাক্সে বাঁধিয়া আঁটি,
কীট কুটমতি কাটিয়া কাটিয়া
          করিয়াছে তারে মাটি ;
কাজেই তর্ক না মিটিল হায়
          বিরোধ বাধিল ভারি,
হইল য্দ্দু হদ্দ মতন
          চৌদ্দ বছর ধরি।
মরিল সৈন্য, ভাঙিল অস্ত্র,
          রক্ত চলিল বহি,
তিন হাত জমি তেমনি রহিল,
          কারও হার জিত নাহি
তবে খোঁড়া রাজা কহে, হায় হায়,
          তর্ক নাহিক মিটে,
ঘোরতর রণে অতি অকারণে
          মরণ সবার ঘটে”
বলিতে বলিতে চঁটাৎ করিয়া
          হঠাৎ মাথায় তার
অদ্ভুত এক বুদ্ধি আসিল
          অতীব চমৎকার।
কহিল তখন খোঁড়া মহারাজ,
          শুন মোর কানা ভাই,
তুচ্ছ কারণে রক্ত ঢালিয়া
          কখনও সুযশ নাই।
তার চেয়ে জমি দান করে ফেল
          আপদ শান্তি হবে।”
কানা রাজা কহে, খাসা কথা ভাই,
          কারে দিই কহ তবে।”
কহেন খঞ্জ, ” আমার রাজ্যে
          আছে তিন মহাবীর-
একটি পেটুক, অপর অলস,
          তৃতীয় কুস্তিগীর।
তোমার মুলুক কে আছে এমন
          এদের হারাতে পারে?-
সবার সমুখে তিন হাত জমি
          বকশিস দিব তারে।
কানা রাজা কহে ভীমের দোসর
          আছে ত মল্ল মম,
ফালাহারে পটু, পঁচাশি পেটুক
          অলস কুমড়া সম।
দেখা যাবে কার বাহাদুরি বেশি
          আসুক তোমার লোক;
যে জিতিবে সেই পাবে এই জমি-
          খোড়া বলে, তাই হোক।
পড়িল নোটিস ময়দান মাঝে
          আলিশান সভা হবে,
তামাসা দেখিতে চারিদিক হতে
          ছুটিয়া আসিল সবে।
ভয়ানক ভিড়ে ভরে পথঘাট,
          লোকে হল লোকাকার,
মহা কোলাহল দাড়াবার ঠাই
          কোনোখানে নাহি আর।
তারপর ক্রমে রাজার হুকুমে
          গোলমাল গেল থেমে,
দুইদিক হতে দুই পালোয়ান
          আসরে আসিল নেমে।
লম্ফে ঝম্ফে যুঝিল মল্ল
          গজ-কচ্ছপ হেন,
রুষিয়া মুষ্টি হানিল দোহায়-
          বজ্র পড়িল যেন!
গুঁতাইল কত ভোঁতাইল নাসা
          উপাড়িল গোফ দাড়ি,
যতেক দন্ত করিল অন্ত
          ভীষণ চাপটি মারি
তারপরে দোঁহে দোঁহারে ধরিয়া
          ছুঁড়িল এমনি জোরে,
গোলার মতন গেল গো উড়িয়া
          দুই বীর বেগভরে।
কিহল তাদের কেহ নাহি জানে
          নানা কথা কয় লোকে,
আজও কেহ তার পায়নি খবর,
          কেহই দেখেনি চোখে।
যাহোক এদিকে, কুস্তির শেষে
          এল পেটুকের পালা,
যেন অতিকায় ফুটবল দুটি,
          অথবা ঢাকাই জালা।
ওজনেতে তারা কেহ নহে কম,
          ভোজনেতে ততোধিক,
বপু সুবিপুল, ভুড়ি বিভীষন-
          ভারি সাতমন ঠিক।
অবাক দেখিছে সভার সকলে
          আজব কান্ড ভারি-
ধামা ধামা লুচি নিমেষে ফুরায়
          দই ওঠে হাঁড়ি হাঁড়ি!
দাড়ি পাল্লায় মাপিয়া সকলে
          দেখে আহারের পরে ,
দুজনেই ঠিক বেড়েছে ওজনে
          সাড়ে তিন মন করে।
কানা রাজা বলে একি হল জ্বালা,
          আক্কেল নাই কারো ,
কেহ কি বোঝেনা সোজা কথা এই,
          হয় জেতো নয় হারো।”
তার পর এল কুঁড়ে দুই জন
          ঝাকার উপর চড়ে,
সভামাঝে দোহে শুয়ে চিৎপাত
          চুপ চাপ রহে পড়ে।
হাত নাহি নাড়ে, চোখ নাহি মেলে,
          কথা নাই কারো মুখে,
দিন দুই তিন রহিল পড়িয়া,
          নাসা গীত গাহি সুখে।
জঠরে যখন জ্বলিল আগুন,
          পরান কণ্ঠাগত,
তখন কেবল মেলিয়া আনন
          থাকিল মড়ার মত।
দয়া করে তবে সহৃদয় কেহ
          নিকটে আসিয়া ছুটি
মুখের নিকটে ধরিল তাদের
          চাটিম কদলি দুটি।
খঞ্জের লোকে কহিল কষ্টে,
          “ছাড়িয়া দে নারে ভাই”
কানার ভৃত্য রহিল হা করে
          মুখে তার কথা নাই ।
তখন সকলে কাষ্ঠ আনিয়া
          তায় কেরোসিন ঢালি,
কুড়েদের গায়ে চাপাইয়া রোষে
          দেশলাই দিল জ্বালি।
খোঁড়ার প্রজাটি বাপরে বলিয়া
          লাফ দিয়া তাড়াতাড়ি
কম্পিত পদে চম্পট দিল
          একেবারে সভা ছাড়ি।
দুয়ো বলি সবে দেয় করতালি
          পিছু পিছু ডাকে “ফেউ”?
কানার অলস বলে কি আপদ
          ঘুমুতে দিবিনা কেঊ?
শুনে সবে বলে “ধন্য ধন্য
          কুঁড়ে-কুল চুড়ামণি!”
ছুটিয়া তাহারে বাহির করিল
          আগুন হইতে টানি।
কানার লোকের গুণপনা দেখে
          কানা রাজা খুসী ভারি,
জমিতে দিলেই আরও দিল কত,
          টাকাকড়ি ঘরবাড়ি।

==========
==========

         Sukumar Kobita Bangla

কানে খাটো বংশীধর

কানে খাটো বংশীধর যায় মামাবাড়ি,
গুনগুন গান গায় আর নাড়ে দাড়ি।।
চলেছে সে একমনে ভাবে ভরপুর,
সহসা বাজিল কানে সুমধুর সুর।।
বংশীধর বলে, ‘আহা, না জানি কি পাখি
সুদুরে মধুর গায় আড়ালেতে থাকি।।
দেখ, দেখ সুরে তার কত বাহাদুরি,
কালোয়াতি গলা যেন খেলে কারিকুরি।।’
এদিকে বেড়াল ভাবে, ‘এযে বড় দায়,
প্রাণ যদি থাকে তবে ল্যাজখানি যায়।।
গলা ছেড়ে এত চেঁচামেচি এত করি হায়
তবু যে ছাড়ে না বেটা, কি করি উপায়।।
আর তো চলে না সহা এত বাড়াবাড়ি,
যা থাকে কপালে, দেই এক থাবা মারি।।’
বংশীধর ভাবে, ‘একি! বেসুরা যে করে,
গলা গেছে ভেঙে তাই ‘ফ্যাঁস্‌’ সুর ধরে।।’
হেনকালে বেরসিক বেড়ালের চাঁটি,
একেবারে সব গান করে দিল মাটি।

==========
==========





       কি মুশকিল 

সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত,
সরকারী সব অফিসখানার কোন্ সাহেবের কদর কত৷
কেমন ক’রে চাট্‌নি বানায়, কেমন ক’রে পোলাও করে,
হরেক্ রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখছে ফলাও ক’রে৷
সাবান কালি দাঁতের মাজন বানাবার সব কায়দা কেতা,
পূজা পার্বণ তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখছে হেথা৷
সব লিখেছে, কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায়—
পাগলা ষাঁড়ে কর্‌লে তাড়া কেমন ক’রে ঠেকাব তায়!

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

     কি চাই 

কারোর কিছু চাই গো চাই ?
এই যে খোকা, কি নেবে ভাই?
জলছবি আর লাট্টু লাটাই
কেক বিস্কুট লাল দেশলাই
খেলনা বাঁশি কিংবা ঘুড়ি
লেড্‌ পেনসিল রবার ছুরি?
এসব আমার কিছুই নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?

কারোর কিছু চাই গো চাই?
বৌমা কি চাও শুনতে পাই?
ছিটের কাপড় চিকন লেস্‌
ফ্যান্সি জিনিস ছুঁচের কেস্‌
আল্‌তা সিঁদুর কুন্তলীন
কাঁচের চুড়ি বোতাম পিন্‌?
আমার কাছে ওসব নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?

কারোর কিছু চাই গো চাই?
আপনি কি চান কর্তামশাই?
পকেট বই কি খেলার তাস
চুলের কলপ জুতোর ব্রাশ্‌
কলম কালি গঁদের তুলি
নস্যি চুরুট সুর্তি গুলি?
ওসব আমার কিছুই নাই,
কারোর কিছু চাই গো চাই?

==========
==========

                 আরো পড়ুন, বীরপুরুষ

 
কিম্ভুত

বিদঘুটে জানোয়ার কিমাকার কিম্ভুত,
সারাদিন ধ’রে তার শুনি শুধু খুঁৎ খুঁৎ।
মাঠ পারে ঘাট পারে কেঁদে মরে খালি সে,
ঘ্যান্ ঘ্যান আব্দারে ঘন ঘন নালিশে।
এটা চাই সেটা চাই কত তার বায়না-
কি যে চায় তাও ছাই বোঝা কিছু যায়না ।
কোকিলের মত তার কন্ঠেতে সুর চাই,
গলা শুনে আপনার বলে, ‘উহু, দুর ছাই!’
আকাশেতে উড়ে যেতে পাখিদের মানা নেই-
তাই দেখে মরে কেঁদে- তার কোন ডানা নেই!
হাতিটার কি বাহার দাঁতে আর শুন্ডে-
ও রকম জুরে তার দিতে হবে মুন্ডে!
কাঙ্গারুর লাফ দেখে ভারি তার হিংসে-
ঠ্যাং চাই আজ থেকে ঢ্যাংঢেঙে চিমসে!
সিংহের কেশরের মত তার তেজ কৈ?
পিছে খাসা গোসাপের খাজ কাটা লেজ কৈ?
একলা সে সব হলে মেটে তার প্যাখনা;
যারে পায় তারে বলে, ‘মোর দশা দেখ্না!’
কেদেঁ কেদেঁ শেষটায়- আষাঢ়ের বাইশে
হল বিনা চেষ্টায় চেয়েছে যা তাই সে।
ভুলে গিয়ে কাঁদাকাটি আহ্লাদে আবেশে
চুপিচুপি একলাটি ব’সে ব’সে ভাবে সে-
লাফ দিয়ে হুশ্ করে হাতি কভু নাচে কি?
কলাগাছ খেলে পরে কাঙ্গারুটা বাঁচে কি ?
ভোঁতামুখে কুহুডাক শুনে লোকে কবে কি?
এই দেহে শুঁড়ো নাক খাপ ছাড়া হবে কি?
‘বুড়ো হাতি ওড়ে’ ব’লে কেউ যদি গালি দেয় ?
কান টেনে ল্যাজ মলে ‘দুয়ো’ ব’লে তালি দেয়?
কেউ যদি তেড়েমেরে বলে তার সামনেই-
কোথাকার তুই কেরে, নাম নেই ধাম নেই?
জবাব কি দেবে ছাই,আছে কিছু বলবার?
কাচুঁ মাচুঁ বসে তাই ,মনে শুধু তোলপার-
‘নই ঘোড়া,নই হাতি, নই সাপ বিচছু
মৌমাছি প্রজাপতি নই আমি কিচছু।
মাছ ব্যাং গাছপাতা জলমাটি ঢেউ নই,
নই জুতা নই ছাতা,আমি তবে কেউ নই!’

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

       কুম্‌ড়োপটাশ 

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ নাচে—
   খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে;
   চাইবে নাকো ডাইনে বাঁয়ে চাইবে নাকো পাছে;
   চার পা তুলে থাকবে ঝুলে হট্টমূলার গাছে!

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ কাঁদে—
খবরদার! খবরদার! বসবে না কেউ ছাদে;
উপুড় হয়ে মাচায় শুয়ে লেপ কম্বল কাঁধে;
বেহাগ সুরে গাইবে খালি ‘রাধে কৃষ্ণ রাধে’!

   (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ হাসে—
   থাকবে খাড়া একটি ঠ্যাঙে রান্নাঘরের পাশে;
   ঝাপ্‌সা গলায় ফার্সি কবে নিশ্বাসে ফিস্‌ফাসে;
   তিনটি বেলায় উপোশ করে থাকবে শুয়ে ঘাসে!

(যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ছোটে—
সবাই যেন তড়বড়িয়ে জানলা বেয়ে ওঠে;
হুঁকোর জলে আলতা গুলে লাগায় গালে ঠোঁটে;
ভুলেও যেন আকাশ পানে তাকায় না কেউ মোটে!

   (যদি) কুম্‌ড়োপটাশ ডাকে—
   সবাই যেন শাম্‌লা এঁটে গামলা চড়ে থাকে;
   ছেঁচকি শাকের ঘন্ট বেটে মাথায় মলম মাখে;
   শক্ত ইঁটের তপ্ত ঝামা ঘষতে থাকে নাকে!

তুচ্ছ ভেবে এ‐সব কথা করছে যারা হেলা,
কুম্‌ড়োপটাশ জানতে পেলে বুঝবে তখন ঠেলা।
দেখবে তখন কোন কথাটি কেমন করে ফলে,
আমায় তখন দোষ দিও না, আগেই রাখি বলে।

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========



          কেন সব কুকুরগুলো

কেন সব কুকুরগুলো খামখা চ্যাঁচায় রাতে ?
কেন বল দাঁতের পোকা থাকেনা ফোক্‌লা দাঁতে ?
পৃথিবীর চ্যাপ্টা মাথা, কেন সে কাদের দোষে?-
এস ভাই চিন্তা করি দুজনে ছায়ায় বসে ।

==========
কবিতাটি খাই খাই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

Sukumar Roy Kobita Khai Khai

       খাই খাই
     

খাই খাই করো কেন, এসো বসো আহারে—
খাওয়াব আজব খাওয়া, ভোজ কয় যাহারে।
যত কিছু খাওয়া লেখে বাঙালির ভাষাতে,
জড় করে আনি সব— থাক সেই আশাতে।
ডাল ভাত তরকারি ফল-মূল শস্য,
আমিষ ও নিরামিষ, চর্ব্য ও চোষ্য,
রুটি লুচি, ভাজাভুজি, টক ঝাল মিষ্টি,
ময়রা ও পাচকের যত কিছু সৃষ্টি,
আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে—
খুঁজে পেতে আনি খেতে— নয় বড়ো সিধে সে!
জল খায়, দুধ খায়, খায় যত পানীয়,
জ্যাঠাছেলে বিড়ি খায়, কান ধরে টানিয়ো।
ফল বিনা চিঁড়ে দৈ, ফলাহার হয় তা,
জলযোগে জল খাওয়া শুধু জল নয় তা।

ব্যাঙ খায় ফরাসিরা (খেতে নয় মন্দ),
বার্মার ‘ঙাপ্পি’তে বাপ্ রে কি গন্ধ!
মান্দ্রাজী ঝাল খেলে জ্বলে যায় কণ্ঠ,
জাপানেতে খায় নাকি ফড়িঙের ঘণ্ট!
আরশুলা মুখে দিয়ে সুখে খায় চীনারা,
কত কি যে খায় লোকে নাহি তার কিনারা।
দেখে শুনে চেয়ে খাও, যেটা চায় রসনা;
তা না হলে কলা খাও— চটো কেন? বসো না—
সবে হল খাওয়া শুরু, শোনো শোনো আরো খায়—
সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায়।
বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি-গাড়িতে,
খাসা দেখ ‘খাপ্ খায়’ চাপ্‌কানে দাড়িতে।
তেলে জলে ‘মিশ খায়’, শুনেছ তা কেও কি?
যুদ্ধে যে গুলি খায় গুলিখোর সেও কি?
ডিঙি চড়ে স্রোতে প’ড়ে পাক খায় জেলেরা,
ভয় পেয়ে খাবি খায় পাঠশালে ছেলেরা;
বেত খেয়ে কাঁদে কেউ, কেউ শুধু গালি খায়,
কেউ খায় থতমত— তাও লিখি তালিকায়।
ভিখারিটা তাড়া খায়, ভিখ্ নাহি পায় রে—
‘দিন আনে দিন খায়’ কত লোক হায় রে।
হোঁচটের চোট্ খেয়ে খোকা ধরে কান্না
মা বলেন চুমু খেয়ে, ‘সেরে গেছে, আর না।’
ধমক বকুনি খেয়ে নয় যারা বাধ্য
কিলচড় লাথি ঘুঁষি হয় তার খাদ্য।
জুতো খায় গুঁতো খায়, চাবুক যে খায় রে,
তবু যদি নুন খায় সেও গুণ গায় রে।
গরমে বাতাস খাই, শীতে খাই হিম্‌সিম্,
পিছলে আছাড় খেয়ে মাথা করে ঝিম্‌ঝিম্।

কত যে মোচড় খায় বেহালার কানটা,
কানমলা খেলে তবে খোলে তার গানটা।
টোল খায় ঘটি বাটি, দোল খায় খোকারা,
ঘাব্‌ড়িয়ে ঘোল খায় পদে পদে বোকারা।
আকাশেতে কাৎ হ’য়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা,
পালোয়ান খায় দেখ ডিগ্‌বাজি কুড়িটা।
ফুটবলে ঠেলা খাই, ভিড়ে খাই ধাক্কা,
কাশীতে প্রসাদ খেয়ে সাধু হই পাক্কা।
কথা শোনো, মাথা খাও, রোদ্দুরে যেও না—
আর যাহা খাও বাপু বিষমটি খেয়ো না।
‘ফেল্’ ক’রে মুখ খেয়ে কেঁদেছিলে সেবারে,
আদা-নুন খেয়ে লাগো পাশ করো এবারে।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ো নাকো; যেয়ো নাকো ভড়্‌কে,
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বসে খাও খড়্‌কে।
এত খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা—
খাও তবে কচুপোড়া খাও তবে ঘণ্টা।

==========
কবিতাটি খাই খাই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

           খিচুড়ি 

হাঁস ছিল, সজারুও, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না ৷
বক কহে কচ্ছপে—’বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের ‘বকচ্ছপ মূর্তি’ ৷’
টিয়ামুখো গিরগিটি মনে ভারি শঙ্কা—
পোকা ছেড়ে শেষে কিগো খাবে কাঁচা লঙ্কা ?
ছাগলের পেটে ছিল না জানি কি ফন্দি,
চাপিল বিছার ঘাড়ে, ধড়ে মুড়ো সন্ধি !
জিরাফের সাধ নাই মাঠে–ঘাটে ঘুরিতে,
ফড়িঙের ঢং ধরি সেও চায় উড়িতে ৷
গরু বলে, ‘আমারেও ধরিল কি ও রোগে ?
মোর পিছে লাগে কেন হতভাগা মোরগে ?’
‘হাতিমি’র দশা দেখ–তিমি ভাবে জলে যাই
হাতি বলে, ‘এই বেলা জঙ্গলে চল ভাই ৷’
সিংহের শিং নাই এই বড় কষ্ট—
হরিণের সাথে মিলে শিং হল পষ্ট ৷

==========
==========



       খুচরো ছড়া 

শুনেছ কি ব’লে গেলো

শুনেছ কি ব’লে গেলো সীতানাথ বন্দ্যো?
আকাশের গায়ে নাকি টকটক গন্ধ?
টকটক থাকে নাকো হ’লে পরে বৃষ্টি–
তখন দেখেছি চেটে একেবারে মিষ্টি।

বল্‌ব কি ভাই

বলব কি ভাই হুগলি গেলুম
             বলছি তোমায় চুপি-চুপি–
দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর
             মাথায় তাদের নেইকো টুপি।।

কহ ভাই কহ রে

কহ ভাই কহ রে, অ্যাঁকা চোরা শহরে,
       বদ্যিরা কেন কেউ আলুভাতে খায় না?
লেখা আছে কাগজে আলু খেলে মগজে,
       ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না।

ঢপ্‌ ঢপ্‌ ঢাক ঢোল

ঢপ্‌ ঢপ্‌ ঢাক ঢোল ভপ্‌ ভপ্‌ বাশিঁ
ঝন্‌ ঝন্‌ করতাল্‌ ঠন্‌ ঠন্‌ কাসিঁ।
ধুমধাম বাপ্‌ বাপ্‌ ভয়ে ভ্যাবাচ্যাকা
বাবুদের ছেলেটার দাঁত গেছে দেখা।
আকাশের গায়ে

আকাশের গায়ে কিবা রামধনু খেলে,
দেখে চেয়ে কত লোক সব কাজ ফেলে;
তাই দেখে খুঁৎ ধরা বুড়ো কয় চটে,
দেখছ কি, এই রং পাকা নয় মোটে।।

শোন শোন গল্প শোন

শোন শোন গল্প শোন,’এক যে ছিলো গুরু’,
      এই আমার গল্প হলো শুরু।
            যদু আর বংশীধর যমযজ ভাই তারা,
                   এই আমার গল্প হলো সারা।

মাসি গো মাসি

মাসি গো মাসি, পাচ্ছে হাসি
              নিম গাছেতে হচ্ছে শিম্‌–
হাতীর মাথায় ব্যাঙের ছাতা
              কাগের বাসায় বগের ডিম।।

ডাক্তার ফস্টার

ডাক্তার ফস্টার
ইস্কুল মাস্টার
বেত তার চটপট
ছাত্রেরা ছটফট–
ভয়ে সব পস্তায়,
বাড়ি ছেড়ে রাস্তায়,
গ্রাম ছেড়ে শহরে,
গয়া কাশী লাহোরে।
ফিরে আসে সন্ধ্যায়
পড়ে শোনে মন দেয়।।

বাসরে বাস! সাবাস বীর

বাসরে বাস! সাবাস বীর!
        ধনুকখানি ধরে,
পায়রা দেখে মারলে তীর–
         কাগটা গেল মরে!

বলছি ওরে, ছাগল ছানা

বলছি ওরে, ছাগল ছানা, উড়িস নে রে উড়িস নে।
জানিস তোদের উড়তে মানা– হাতপাগুলো ছুড়িস নে।।
তিন বুড়ো পণ্ডিত

তিন বুড়ো পণ্ডিত টাকচুড়ো নগরে
           চড়ে এক গামলায় পাড়িড় দেয় সাগরে।
গামলাতে ছেদা ছিলো, আগে কেউ দেখেনি,
           গানখানি তাই মোর থেমে গেল এখনি।।
রঙ হলো চিড়েতন

রঙ হল চিড়েতন, সব গেল গুলিয়ে,
গাধা যায় মামাবাড়ি, টাকে হাত বুলিয়ে
বেড়াল মরে বিষম খেয়ে চাঁদের ধরল মাথা,
হঠাৎ দেখি ঘরবাড়ি সব ময়দা দিয়ে গাথা ।।

নাচন

নাচ্ছি মোরা মনের সাধে গাচ্ছি তেড়ে গান
হুলো মেনি যে যার গলায় কালোয়াতীর তান।
নাচ্ছি দেখে চাঁদা মামা হাসছে ভরে গাল
চোখটি ঠেরে ঠাট্টা করে, দেখনা বুড়ার চাল।

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

           

              খুড়োর কল 

কল করেছেন আজবরকম চণ্ডীদাসের খুড়ো—
সবাই শুনে সাবাস বলে পাড়ার ছেলে বুড়ো।
খুড়োর যখন অল্প বয়স— বছর খানেক হবে—
উঠল কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষন অট্টরবে।
আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে,
খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চম্‌কে গেল লোকে।
বল্‌লে সবাই, “এই ছেলেটা বাঁচলে পরে তবে,
বুদ্ধি জোরে এ সংসারে একটা কিছু হবে।”
সেই খুড়ো আজ কল করেছেন আপন বুদ্ধি বলে,
পাঁচ ঘণ্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘণ্টায় চলে।
দেখে এলাম কলটি অতি সহজ এবং সোজা,
ঘণ্টা পাঁচেক ঘাঁটলে পরে আপনি যাবে বোঝা।
বলব কি আর কলের ফিকির, বলতে না পাই ভাষা,
ঘাড়ের সঙ্গে যন্ত্র জুড়ে এক্কেবারে খাসা।

সামনে তাহার খাদ্য ঝোলে যার যেরকম রুচি—
মণ্ডা মিঠাই চপ্‌ কাট্‌লেট্‌ খাজা কিংবা লুচি।
মন বলে তায় ‘খাব খাব’, মুখ চলে তায় খেতে,
মুখের সঙ্গে খাবার ছোটে পাল্লা দিয়ে মেতে।
এমনি করে লোভের টানে খাবার পানে চেয়ে,
উত্সাহেতে হুঁস্ রবে না চলবে কেবল ধেয়ে।
হেসে খেলে দু‐দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে,
খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে।
সবাই বলে সমস্বরে ছেলে জোয়ান বুড়ো,
অতুল কীর্তি রাখল ভবে চণ্ডীদাসের খুড়ো।

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

   
              খোকা ঘুমায় 

কোন্‌খানে কোন্‌ সুদূর দেশে, কোন্‌ মায়ের বুকে,
কাদের খোকা মিষ্টি এমন ঘুমায় মনের সুখে?
অজানা কোন্‌ দেশে সেথা কোন্‌খানে তার ঘর?
কোন্‌ সমুদ্র, কত নদী, কত দেশের পর?
কেমন সুরে, কি ব’লে মা ঘুমপাড়ানি গানে
খোকার চোখে নিত্যি সেথা ঘুমটি ডেকে আনে?
ঘুমপাড়ানি মাসীপিসী তাদেরও কি থাকে?
“ঘুমটি দিয়ে যাওগো” ব’লে মা কি তাদের ডাকে?
শেয়াল আসে বেগুন খেতে, বর্গি আসে দেশে?
ঘুমের সাথে মিষ্টি মধুর মায়ের সুরটি মেশে?
খোকা জানে মায়ের মুখটি সবার চেয়ে ভালো,
সবার মিষ্টি মায়ের হাসি, মায়ের চোখের আলো।
স্বপন মাঝে ছায়ার মত মায়ের মুখটি ভাসে,
তাইতে খোকা ঘুমের ঘোরে আপন মনে হাসে।

==========
==========

          খোকার ভাবনা 

মোমের পুতুল লোমের পুতুল আগ্‌লে ধ’রে হাতে
তবুও কেন হাব্‌লা ছেলের মন ওঠে না তাতে?
একলা জেগে একমনেতে চুপ্‌টি ক’রে ব’সে,
আন্‌মনা সে কিসের তরে আঙুলখানি চোষে?
নাইকো হাসি নাইকো খেলা নাইকো মুখে কথা,
আজ সকালে হাব্‌লাবাবুর মন গিয়েছে কোথা?
ভাব্‌ছে বুঝি দুধের বোতল আস্‌ছে নাকো কেন?
কিংবা ভাবে মায়ের কিসে হচ্ছে দেরী হেন।
ভাব্‌ছে এবার দুধ খাবে না কেবল খাবে মুড়ি,
দাদার সাথে কোমন বেঁধে করবে হুড়োহুড়ি,
ফেল্‌বে ছুঁড়ে চামচটাকে পাশের বাড়ির চালে,
না হয় তেড়ে কামড়ে দেবে দুষ্টু ছেলের গালে।
কিংবা ভাবে একটা কিছু ঠুক্‌তে যদি পেতো—
পুতুলটাকে করত ঠুকে এক্কেবারে থেঁতো।

==========
==========

   গন্ধবিচার 

সিংহাসনে বস্‌ল রাজা বাজল কাঁসর ঘন্টা,
ছট্ফটিয়ে উঠল কেঁপে মন্ত্রীবুড়োর মনটা।
বললে রাজা, ‘মন্ত্রী, তোমার জামায় কেন গন্ধ?’
মন্ত্রী বলে, ‘এসেন্স দিছি- গন্ধ ত নয় মন্দ!’
রাজা বলেন, ‘মন্দ ভালো দেখুক শুঁকে বদ্যি,’
বদ্যি বলে, ‘আমার নাকে বেজায় হল সর্দি।’
রাজা হাঁকেন , ‘বোলাও তবে- রাম নারায়ণ পাত্র।’
পাত্র বলে, ‘নস্যি নিলাম এক্ষনি এইমাত্র-
নস্যি দিয়ে বন্ধ যে নাক, গন্ধ কোথায় ঢুকবে?’
রাজা বলেন, ‘কোটাল তবে এগিয়ে এস শুক্‌বে।’
কোটাল বলে, ‘পান খেয়েছি মশলা তাহে কর্পূর,
গন্ধে তারি মুন্ড আমার এক্কেবারে ভরপুর।’
রাজা বলেন, ‘আসুক তবে শের পালোয়ান ভীমসিং,’
ভীম বলে, ‘আজ কচ্ছে আমার সমস্ত গা ঝিম্ ঝিম্
রাত্রে আমার বোখার হল, বলছি হুজুর ঠিক বাৎ’-
ব’লেই শুল রাজসভাতে চক্ষু বুজে চিৎপাত।
রাজার শালা চন্দ্রকেতু তারেই ধ’রে শেষটা
বল্ল রাজা, ‘তুমিই না হয় কর না ভাই চেষ্টা।’
চন্দ্র বলেন, ‘মারতে চাও ত ডাকাও নাকো জল্লাদ,
গন্ধ শুকে মর্‌তে হবে এ আবার কি আহ্লাদ?’
ছিল হাজির বৃদ্ধ নাজির বয়সটি তার নব্বই,
ভাব্‌ল মনে, ‘ভয় কেন আর একদিন তো মরবই-‘
সাহস করে বল্লে বুড়ো, ‘মিথ্যে সবাই বকছিস,
শুঁকতে পারি হুকুম পেলে এবং পেলে বক্‌শিস।’
রাজা বলেন, ‘হাজার টাকা ইনাম পাবে সদ্য,’
তাই না শুনে উৎসাহতে উঠ্ল বুড়ো মদ্দ।
জামার পরে নাক ঠেকিয়ে- শুক্‌ল কত গন্ধ,
রইল অটল, দেখ্ল লোকে বিস্ময়ে বাক্ বন্ধ।
রাজ্য হল জয় জয়কার বাজ্‌ল কাঁসর ঢক্কা,
বাপ্‌রে কি তেজ বুড়োর হাড়ে, পায় না সে যে অক্কা!

==========
==========

       গল্প বলা 

‘এক যে রাজা’–’থাম্ না দাদা,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা৷’
‘তার যে মাতুল’–’মাতুল কি সে?—
সবাই জানে সে তার পিশে৷’
‘তার ছিল এক ছাগল ছানা’—
‘ছাগলের কি গজায় ডানা?’
‘একদিন তার ছাতের ‘পরে’—
‘ছাত কোথা হে টিনের ঘরে?’
‘বাগানের এক উড়ে মালী’—
‘মালী নয়তো! মেহের আলী৷’
‘মনের সাধে গাইছে বেহাগ’—
‘বেহাগ তো নয়! বসন্ত রাগ৷’

‘থও না বাপু ঘ্যাঁচা ঘেঁচি’—
‘আচ্ছা বল, চুপ করেছি৷’
‘এমন সময় বিছনা ছেড়ে,
হঠাৎ মামা আস্‌ল তেড়ে,
ধর্‌ল সে তার ঝুঁটির গোড়া’—
‘কোথায় ঝুঁটি? টাক যে ভরা৷’
‘হোক না টেকো তোর তাতে কি?
লক্ষীছাড়া মুখ্যু ঢেঁকি!
ধর্‌ব ঠেসে টুঁটির ‘পরে,
পিটব তোমার মুণ্ড ধ’রে—
কথার উপর কেবল কথা,
এখন বাপু পালাও কোথা?’

==========
==========

  গানের গুতো

গান জুড়েছেন গ্রীষ্মকালে ভীষ্মলোচন শর্মা—
আওয়াজখানা দিচ্ছে হানা দিল্লী থেকে বর্মা!
গাইছে ছেড়ে প্রাণের মায়া, গাইছে তেড়ে প্রাণপণ,
ছুটছে লোকে চারদিকেতে ঘুরছে মাথা ভন্‌ভন্।
মরছে কত জখম হয়ে করছে কত ছট্‌ফট্—
বলছে হেঁকে “প্রাণটা গেল, গানটা থামাও ঝট্‌পট্।”
বাঁধন‐ছেঁড়া মহিষ ঘোড়া পথের ধারে চিত্‍‌পাত;
ভীষ্মলোচন গাইছে তেড়ে নাইকো তাহে দৃক্‌পাত।
চার পা তুলি জন্তুগুলি পড়ছে বেগে মূর্ছায়,
লাঙ্গুল খাড়া পাগল পারা বলেছে রেগে “দূর ছাই!”

       জলের প্রাণী অবাক মানি গভীর জলে চুপচাপ্,
       গাছের বংশ হচ্ছে ধ্বংস পড়ছে দেদার ঝুপ্‌ঝাপ্।
       শূন্য মাঝে ঘূর্ণা লেগে ডিগবাজি খায় পক্ষী,
       সবাই হাঁকে, “আর না দাদা, গানটা থামাও লক্ষ্মী।”
       গানের দাপে আকাশ কাঁপে দালান ফাটে বিল্‌কুল,
       ভীষ্মলোচন গাইছে ভীষণ খোশমেজাজে দিল্ খুল্।
       এক যে ছিল পাগলা ছাগল, এমনি সেটা ওস্তাদ,
       গানের তালে শিং বাগিয়ে মারলে গুঁতো পশ্চাত্‍‌।
       আর কোথা যায় একটি কথায় গানের মাথায় ডাণ্ডা,
       ‘বাপ রে’ বলে ভীষ্মলোচন এক্কেবারে ঠাণ্ডা।

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

Sukumar Roy Kobita Gof Churi

SUKUMAR ROY KOBITA (সুকুমার রায়ের কবিতা) Bengali Poem



       গোঁফ চুরি 

হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জান্‌ত?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিম্‌ঝিমিয়ে হটাত্‍‌ গেলেন ক্ষেপে!
আঁত্‍‌কে উঠে হাত‐পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল!
হটাত্‍‌ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধ’রে তোল!”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ‐বা হাঁকে পুলিশ,
কেউ‐বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”
ব্যস্ত সবাই এদিক‐ওদিক করছে ঘোরাঘুরি—
বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!”
গোঁফ হারানো! আজব কথা! তাও কি হয় সত্যি?
গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমে নি এক রত্তি।
সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয় নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না।

রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
“কারো কথার ধার ধারি নে, সব ব্যাটাকেই চিনি।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,
এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।
এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”—
এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়।
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়—
“কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়।
আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর
গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর।
ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,
মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি।
গোঁফকে বলে তোমার আমার— গোঁফ কি কারো কেনা?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।”

==========
==========

         গ্রীষ্ম 

রৌদ্র ঝলে আকাশতলে অগ্নি জ্বলে জলেস্থলে।
ফেল্‌ছে আকাশ তপ্ত নিশাস ছুট্‌ছে বাতাস ঝলসিয়ে ঘাস,
ফুলের বিতান শুক্‌নো শ্মশান যায় বুঝি প্রাণ হায় ভগবান।
দারুণ তৃষায় ফির্‌ছে সবায় জল নাহি পায় হায় কি উপায়,
তাপের চোটে কথা না ফোটে হাঁপিয়ে ওঠে ঘর্ম ছোটে।
বৈশাখী ঝড় বাধায় রগড় করে ধড়্‌ফড়্‌ ধরার পাঁজর,
দশ দিক হয় ঘোর ধূলিময় জাগে মহাভয় হেরি সে প্রলয়,
করি তোলপাড় বাগান বাদাড় ওঠে বারবার ঘন হুঙ্কার,
শুনি নিয়তই থাকি থাকি ওই হাঁকে হৈ হৈ মাভৈ মাভৈঃ।

==========
==========

   গ্রীষ্ম   (ঐ এল বৈশাখ)

ঐ এল বৈশাখ, ঐ নামে গ্রীষ্ম,
খাইখাই রবে যেন ভয়ে কাঁপে বিশ্ব !
চোখে যেন দেখি তার ধুলিময় অঙ্গ,
বিকট কুটিলজটে ভ্রুকুটির ভঙ্গ,
রোদে রাঙা দুই আঁখি শুকায়েছে কোটরে,
ক্ষুধার আগুন যেন জ্বলে তার জঠরে !
মনে হয় বুঝি তার নিঃশ্বাস মাত্রে
তেড়ে আসে পালাজ্বর পৃথিবীর গাত্রে !
ভয় লাগে হয় বুঝি ত্রিভুবন ভস্ম-
ওরে ভাই ভয় নাই পাকে ফল শস্য !
তপ্ত ভীষণ চুলা জ্বালি নিজ বক্ষে
পৃথিবী বসেছে পাকে, চেয়ে দেখ চক্ষে,-
আম পাকে, জাম পাকে, ফল পাকে কত যে,
বুদ্ধি যে পাকে কত ছেলেদের মগজে !

==========
==========

  গ্রীষ্ম ( সর্বনেশে গ্রীষ্ম)

সর্বনেশে গ্রীষ্ম এসে বর্ষশেষে রুদ্রবেশে
আপন ঝোঁকে বিষম রোখে আগুন ফোঁকে ধরার চোখে।
তাপিয়ে গগন কাঁপিয়ে ভুবন মাত্‌ল তপন নাচল পবন।
রৌদ্র ঝলে আকাশতলে অগ্নি জ্বলে জলে স্থলে।
ফেল্‌ছে আকাশ তপ্ত নিশাস ছুটছে বাতাস ঝলসিয়ে ঘাস,
ফুলের বিতান শুকনো শ্মশান যায় বুঝি প্রাণ হায় ভগবান।
দারুণ তৃষায় ফিরছে সবায় জল নাহি পায় হায় কি উপায়,
তাপের চোটে কথা না ফোটে হাঁপিয়ে ওঠে ঘর্ম ছোটে।
বৈশাখী ঝড় বাধায় রগড় করে ধড়্‌ফড়্ ধরার পাঁজর,
দশ দিক হয় ঘোর ধুলিময় জাগে মহাভয় হেরি সে প্রলয়।
করি তোলপাড় বাগান বাদাড় ওঠে বারবার ঘন হুংকার,
শুনি নিয়তই থাকি থাকি ওই হাঁকে হৈ হৈ মাভৈ মাভৈঃ।

==========
কবিতাটি খাই খাই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

চলে হনহন 



চলে হন্ হন্ ,    ছোটে পন্ পন্
ঘোরে বন্ বন্ ,    কাজে ঠন্ ঠন্
বায়ু শন্ শন্ ,    শীতে কন্ কন্
কাশি খন্ খন্ ,    ফোঁড়া টন্ টন্
মাছি ভন্ ভন্ ,   থালা ঝন্ ঝন্

==========
কবিতাটি খাই খাই বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

      চোর ধরা 

আরে ছি ছি! রাম রাম! ব’লো নাহে ব’লো না,
চল্‌ছে যা জুয়াচুরি, নাহি তার তুলনা!
যেই আমি দেই ঘুম টিফিনের আগেতে,
ভয়ানক ক’মে যায় খাবারের ভাগেতে!
রোজ দেখি খেয়ে গেছে, জানিনাকো কারা সে,
কালকে যা হ’য়ে গেল ডাকাতির বাড়া সে!
পাঁচখানা কাট্‌লেট‌, লুচি তিন গণ্ডা,
গোটা দুই জিবে গজা, গুটি দুই মণ্ডা,
আরো কত ছিল পাতে আলুভাজা ঘুঙ্‌নি—
ঘুম থেকে উঠে দেখি পাতাখানা শূন্যি!

তাই আজ ক্ষেপে গেছি—কত আর পার্‌ব?
এতদিন স’য়ে স’য়ে এইবারে মার্‌ব৷
খাড়া আছি সারাদিন হুঁশিয়ার পাহারা,
দেখে নেব রোজ রোজ খেয়ে যায় কাহারা৷
রামু হও, দামু হও, ওপাড়ার ঘোষ বোস্—
যেই হও, এইবারে থেমে যাবে ফোঁস্‌ফোঁস্৷
খাট্‌বে না জারিজুরি আঁটবে না মার্‌প্যাঁচ্
যারে পাব ঘাড়ে ধ’রে কেটে দেব ঘ্যাঁচ্‌ঘ্যাঁচ্৷
এই দেখ ঢাল নিয়ে খাড়া আছি আড়ালে,
এইবারে টের পাবে মুণ্ডুটা বাড়ালে৷

রোজ বলি ‘সাবধান!’ কানে তবু যায় না?
ঠেলাখানা বুঝ্‌বি তো এইবারে আয় না!

==========
কবিতাটি আবোল তাবোল বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========

           ছবি ও গল্প 

ছবির টানে গল্প লিখি নেইক এতে ফাঁকি
যেমন ধারা কথায় শুনি হুবহু তাই আঁকি ।

পরীক্ষাতে গোল্লা পেয়ে
হাবু ফেরেন বাড়ি

চক্ষু দুটি ছানাবড়া
মুখখানি তার হাঁড়ি

রাগে আগুন হলেন বাবা
সকল কথা শুনে

আচ্ছা ক’রে পিটিয়ে তারে
দিলেন তুলো ধুনে

মারের চোটে চেঁচিয়ে বাড়ি
মাথায় ক’রে তোলে

শুনে মায়ের বুক ফেটে যায়
‘হায় কি হল’ ব’লে

পিসী ভাসেন চোখের জলে
কুট্‌নো কোটা ফেলে

আহ্লাদেতে পাশের বাড়ি
আটখানা হয় ছেলে ।

==========
==========

সুকুমার রায়ের আরো কবিতা পড়তে 

Tags – Bangla Kobita, Bengali Poem, Sukumar Roy

Share This Article