Sukanta Kobita Somogro (সুকান্তের কবিতা) Sukanta Bhattacharjee
Sukanta Kobita Bangla
১৯৪১ সাল
নীল সমুদ্রের ইশারা-
অন্ধকারে ক্ষীণ আলোর ছোট ছোট দ্বীপ,
আর সূর্যময় দিনের স্তব্ধতা;
নিঃশব্দ দিনের সেই ভীরু অন্তঃশীল
মত্ততাময় পদক্ষেপঃ
এ সবের ম্লান আধিপত্য বুঝি আর
জীবনের ওপর কালের ব্যবচ্ছেদ-ভ্রষ্ট নয়
তাই রক্তাক্ত পৃথিবীর ডাকঘর থেকে
ডাক এল-
সভ্যতার ডাক
নিষ্ঠুর ক্ষুদার্ত পরোয়ানা
আমাকে চিহ্নিত ক’রে গেল।
আমার একক পৃথিবী
ভেসে গেল জনতার প্রবল জোয়ারে।
মনের স্বচ্ছতার ওপর বিরক্তির শ্যাওলা
গভীরতা রচনা করে,
আর শঙ্কিত মনের অস্পষ্টতা
ইতস্ততঃ ধাবমান।
নির্ধারিত জীবনেও মাটির মাশুল
পূর্ণতায় মূর্তি চায়;
আমার নিষ্ফল প্রতিবাদ,
আরো অনেকের বিরুদ্ধে বিবক্ষা
তাই পরাহত হল।
কোথায় সেই দূর সমুদ্রের ইশারা
আর অন্ধকারের নির্বিরোধ ডাক!
দিনের মুখে মৃত্যুর মুখোস।
যে সব মুহূর্ত-পরমাণু
গেঁথেছিল অস্থায়ী রচনা,
সে সব মুহূর্ত আজ
প্রাণের অস্পষ্ট প্রশাখায়
অজ্ঞাত রক্তিম ফুল ফোটে।।
==========
অতি কিশোরের ছড়া
তোমরা আমায় নিন্দে ক’রে দাও না যতই গালি,
আমি কিন্তু মাখছি আমার গালেতে চুনকালি,
কোনো কাজটাই পারি নাকো বলতে পারি ছড়া,
পাশের পড়া পড়ি না ছাই পড়ি ফেলের পড়া।
তোতো ওষুধ গিলি নাকো, মিষ্টি এবং টক
খাওয়ার দিকেই জেনো আমার চিরকালের সখ।
বাবা-দাদা সবার কাছেই গোঁয়ার এবং মন্দ,
ভাল হয়ে থাকার সঙ্গে লেগেই আছে দ্বন্দ্ব ।
পড়তে ব’সে থাকে আমার পথের দিকে চোখ,
পথের চেয়ে পথের লোকের দিকেই বেশী ঝোঁক।
হুলের কেয়ার করি নাকো মধুর জন্য ছুটি,
যেখানে ভিড় সেখানেতেই লাগাই ছুটোছুটি।
পণ্ডিত এবং বিজ্ঞজনের দেখলে মাথা নাড়া,
ভাবি উপদেশের ষাঁড়ে করলে বুঝি তারা।
তাইতো ফিরি ভয়ে ভয়ে, দেখলে পরে তর্ক,
বুঝি কেবল গোময় সেটা,- নয়কো মধুপর্ক।
ভুল করি ভাই যখন তখন, শোধরাবার আহ্লাদে
খেয়ালমতো কাজ করে যাই, কস্ট পাই কি সাধে ?
সোজাসুজি যা হয় বুঝি, হায় অদৃস্ট চক্র!
আমার কথা বোঝে না কেউ পৃথিবীটাই বক্র।।
==========
(মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
==========
অবৈধ
আজ মনে হয় বসন্ত আমার জীবনে এসেছিল
উত্তর মহাসাগরের কূলে
আমার স্বপ্নের ফুলে
তারা কথা কয়েছিল
অস্পষ্ট পুরনো ভাষায়
অস্ফুট স্বপ্নের ফুল
অসহ্য সূর্যের তাপে
অনিবার্য ঝরেছিল
মরেছিল নিষ্ঠুর প্রগল্ভ হতাশায়।
হঠাৎ চমকে ওঠে হাওয়া
সেদিন আর নেই-
নেই আর সূর্য-বিকিরণ
আমার জীবনে তাই ব্যর্থ হল বাসন্তীমরণ!
শুনি নি স্বপ্নের ডাকঃ
থেকেছি আশ্চর্য নির্বাক
বিন্যস্ত করেছি প্রাণ বুভুক্ষার হাতে।
সহসা একদিন
আমার দরজায় নেমে এল
নিঃশব্দে উড়ন্ত গৃধিনীরা।
সেইদিন বসন্তের পাখি
উড়ে গেল
যেখানে দিগন্ত ঘনায়িত ।
আজ মনে হয়
হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুরে,
কী ক’রে সম্ভব হল
আমার রক্তকে ভালবাসা!
সূর্যের কুয়াশা
এখনো কাটে নি
ঘোচে নি অকাল দুর্ভাবনা।
মুহূর্তের সোনা
এখনো সভয়ে ক্ষয় হয়,
এরই মদ্যে হেমন্তের পড়ন্ত রোদ্দুর
কঠিন কাস্তেতে দেয় সুর,
অন্যমনে এ কী দুর্ঘটনা-
হেমন্তেই বসন্তের প্রস্তাব রটনা।।
==========
Kobita Sukanta Bhattacharjee
অভিবাদন
হে সাথী, আজকে স্বপ্নের দিন গোনা
ব্যর্থ নয় তো, বিপুল সম্ভাবনা
দিকে দিকে উদ্যাপন করছে লগ্ন,
পৃথিবী সূর্য-তপস্যাতেই মগ্ন।
আজকে সামনে নিরুচ্চারিত প্রশ্ন,
মনের কোমল মহল ঘিরে কবোষ্ণ
ক্রমশ পুষ্ট মিলিত উন্মাদনা,
ক্রমশ সফল স্বপ্নের দিন গোনা।
স্বপ্নের বীজ বপন করেছি সদ্য,
বিদ্যুৎবেগে ফসল সংঘবদ্ধ!
হে সাথী, ফসলে শুনেছো প্রাণের গান?
দুরন্ত হাওয়া ছড়ায় ঐকতান।
বন্ধু, আজকে দোদুল্যমান পৃথ্বী
আমরা গঠন করব নতুন ভিত্তি;
তারই সুত্রপাতকে করেছি সাধন
হে সাথী, আজকে রক্তিম অভিবাদন।।
==========
আগামী
জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;
মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে।
যদিও নগণ্য আমি, তুচ্ছ বটবৃক্ষের সমাজে
তবু ক্ষুদ্র এ শরীরে গোপনে মর্মরধ্বনি বাজে,
বিদীর্ণ করেছি মাটি, দেখেছি আলোর আনাগোনা
শিকড়ে আমার তাই অরণ্যের বিশাল চেতনা।
আজ শুধু অঙ্কুরিত, জানি কাল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতা
উদ্দাম হাওয়ার তালে তাল রেখে নেড়ে যাবে মাথা:
তারপর দৃপ্ত শাখা মেলে দেব সবার সম্মুখে,
ফোটাব বিস্মিত ফুল প্রতিবেশী গাছেদের মুখে।
সংহত কঠিন ঝড়ে দৃঢ়প্রাণ প্রত্যেক শিকড়:
শাখায় শাখায় বাধা, প্রত্যাহত হবে জানি ঝড়;
অঙ্কুরিত বন্ধু যত মাথা তুলে আমারই আহ্বানে
জানি তারা মুখরিত হবে নব অরণ্যের গানে।
আগামী বসন্তে জেনো মিশে যাব বৃহতের দলে;
জয়ধ্বনি কিশলয়ে: সম্বর্ধনা জনাবে সকলে।
ক্ষুদ্র আমি তুচ্ছ নই- জানি আমি ভাবী বনস্পতি,
বৃষ্টির, মাটির রসে পাই আমি তার তো সম্মতি।
সেদিন ছায়ায় এসো: হানো যদি কঠিন কুঠারে,
তবু তোমায় আমি হাতছানি দেবো বারে বারে;
ফল দেব, ফুল দেব, দেব আমি পাখিরও কূজন
একই মাটিতে পুষ্ট তোমাদের আপনার জন।।
==========
কবিতাটি ছাড়পত্র বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========
আজব লড়াই
ফেব্রুয়ারী মাসে ভাই, কলকাতা শহরে
ঘটল ঘটনা এক, লম্বা সে বহরে!
লড়াই লড়াই খেলা শুরু হল আমাদের,
কেউ রইল না ঘরে রামাদের শ্যামাদের;
রাস্তার কোণে কোণে জড়ো হল সকলে,
তফাৎ রইল নাকো আসলে ও নকলে,
শুধু শুনি ‘ধর’ ‘ধর’ ‘মার’ ‘মার’ শব্দ
যেন খাঁটি যুদ্ধ এ মিলিটারী জব্দ।
বড়রা কাঁদুনে গ্যাসে কাঁদে, চোখ ছল ছল
হাসে ছিঁচকাঁদুনেরা বলে, ‘সব ঢাল জল’।
ঐ বুঝি ওরা সব সঙ্গীন উঁচোলো,
ভয় নেই, যত হোক বেয়নেট ছুঁচোলো,
ইট-পাটকেল দেখি রাখে এরা তৈরি,
এইবার যাবে কোথা বাছাধন বৈরী!
ভাবো বুঝি ছোট ছেলে, একেবারে বাচ্চা!
এদের হাতেই পাবে শিক্ষাটা আচ্ছা;
ঢিল খাও, তাড়া খাও, পেট ভরে কলা খাও,
গালাগালি খাও আর খাও কানমলা খাও।
জালে ঢাকা গাড়ি চড়ে বীরত্ব কি যে এর
বুঝবে কে, হরদম সামলায় নিজেদের।
বার্মা-পালানো সব বীর এরা বঙ্গে
যুদ্ধ করছে ছোট ছেলেদের সঙ্গে;
ঢিলের ভয়েতে ওরা চালায় মেশিনগান,
“বিশ্ববিজয়ী” তাই রাখে জান, বাঁচে মান।
খালি হাত ছেলেদের তেড়ে গিয়ে করে খুন;
সাবাস! সাবাস! ওরা খেয়েছে রাজার নুন।
ডাংগুলি খেলা নয়, গুলির সঙ্গে খেলা,
রক্ত-রাঙানো পথে দু’পাশে ছেলের মেলা;
দুর্দম খেলা চলে, নিষেধে কে কান দেয়?
ও-বাড়ি ও ও-পাড়ার কালো, ছোটু প্রাণ দেয়।
স্বচে দেখলাম বস্তির আলী জান,
‘আংরেজ চলা যাও’ বলে ভাই দিল প্রাণ।
এমন বিরাট খেলা শেষ হল চটপট
বড়দের বোকামিতে আজো প্রাণ ছটফট;
এইবারে আমি ভাই হেরে গেছি খেলাতে,
ফিরে গেছি দাদাদের বকুনির ঠেলাতে;
পরের বারেতে ভাই শুনব না কারো মানা,
দেবই, দেবই আমি নিজের জীবনখানা ।
==========
আঠারো বছর বয়স
আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়-
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।
এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।
আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।
আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।
আঠারো বছর বয়সে আঘাত আসে
অবিশ্র্রান্ত; একে একে হয় জড়ো,
এ বয়স কালো লক্ষ দীর্ঘশ্বাসে
এ বয়স কাঁপে বেদনায় থরোথরো।
তবু আঠারোর শুনেছি জয়ধ্বনি,
এ বয়স বাঁচে দুর্যোগে আর ঝড়ে,
বিপদের মুখে এ বয়স অগ্রণী
এ বয়স তবু নতুন কিছু তো করে।
এ বয়স জেনো ভীরু, কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়-
এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে।।
==========
আমরা এসেছি
কারা যেন আজ দুহাতে খুলেছে, ভেঙেছে খিল,
মিছিলে আমারা নিমগ্ন তাই দোলে মিছিল।
দুঃখ-যুগের দারায় দারায়
যারা আনে প্রাণ, যারা তা হারায়
তারাই ভরিয়ে তুলেছে সাড়ায় হৃদয়-বিল।
তারাই এসেছে মিছিলে, আজকে চলে মিছিল-
কে যেন ক্ষুব্ধ ভোমরার চাকে ছুঁড়েছে ঢিল,
তাইতো দগ্ধ, ভগ্ন, পুরনো পথ বাতিল।
আশ্বিন থেকে বৈশাখে যারা
হাওয়ার মতন ছুটে দিশেহারা,
হাতের স্পর্শে কাজ হয় সারা, কাঁপে নিখিল
তারা এল আজ দুর্বারগতি চলে মিছিল-
আজকে হালকা হাওয়ায় উড়ুক একক চিল
জনতরঙ্গে আমরা ক্ষিপ্ত ঢেউ ফেনিল।
উধাও আলোর নিচে সমারোহ ,
মিলিত প্রাণের একী বিদ্রোহ!
ফিরে তাকানোর নেই ভীরু মোহ, কী গতিশীল!
সবাই এসেছে, তুমি আসোনিকো, ডাকে মিছিল-
একটি কথায় ব্যক্ত চেতনাঃ আকাশে নীল,
দৃষ্টি সেখানে তাইতো পদধ্বনিতে মিল।
সামনে মৃত্যুকবলিত দ্বার,
থাক অরণ্য, থাক না পাহাড়,
ব্যর্থ নোঙর, নদী হব পার, খুঁটি শিথিল।
আমরা এসেছি মিছিলে, গর্জে ওঠে মিছিল।।
==========
আমার মৃত্যুর পর
আমার মৃত্যুর পর থেমে যাবে কথার গুঞ্জন,
বুকের স্পন্দনটুকু মূর্ত হবে ঝিল্লীর ঝংকারে
জীবনের পথপ্রান্তে ভুলে যাব মৃত্যুর শঙ্কারে,
উজ্জ্বল আলোর চোখে আঁকা হবে আঁধার-অঞ্জন।
পরিচয়ভারে ন্যুব্জ অনেকের শোকগ্রস্ত মন,
বিস্ময়ের জাগরণে ছদ্মবেশ নেবে বিলাপের
মুহূর্তে বিস্মৃত হবে সব চিহ্ন আমার পাপের।
কিছুকাল সন্তর্পণে ব্যক্ত হবে সবার স্মরণ।
আমার মৃত্যুর পর, জীবনের যত অনাদর
লাঞ্ছনার বেদনায়, ষ্পৃষ্ট হবে প্রত্যেক অন্তর।।
==========
(পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
==========
Sukanta Bhattacharjee Kobita
ইউরোপের উদ্দেশ্যে
ওখানে এখন মে-মাস তুষার-গলানো দিন,
এখানে অগ্নি-ঝরা বৈশাখ নিদ্রাহীন;
হয়তো ওখানে শুরু মন্থর দক্ষিণ হাওয়া;
এখানে বোশেখী ঝড়ের ঝাপ্টা পশ্চাৎ দাওয়া;
এখানে সেখানে ফুল ফোটে আজ তোমাদের দেশে
কত রঙ, কত বিচিত্র নিশি দেখা দেয় এসে।
ঘর ছেড়ে পথে বেরিয়ে পড়েছে কত ছেলেমেয়ে
এই বসন্তে কত উৎসব কত গান গেয়ে।
এখানে তো ফুল শুকনো, ধূসর রঙের ধুলোয়
খাঁ-খাঁ করে সারা দেশটা, শান্তি গিয়েছে চুলোয়।
কঠিন রোদের ভয়ে ছেলেমেয়ে বন্ধ ঘরে,
সব চুপচাপ; জাগবে হয়তো বোশেখী ঝড়ে।
অনেক খাটুনি, অনেক লড়াই করার শেষে
চারিদিকে ক্রমে ফুলের বাগান তোমাদের দেশে;
এদেশে যুদ্ধ মহামারী, ভুখা জ্বলে হাড়ে হাড়ে-
অগ্নিবর্ষী গ্রীষ্মের মাঠে তাই ঘুম কাড়ে
বেপরোয়া প্রাণ; জমে দিকে দিকে আজ লাখে লাখে-
তোমাদের দেশে মে-মাস; এখানে ঝোড়ো বৈশাখ।।
==========
কবিতাটি ছাড়পত্র বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========
এই নবান্নে
এই হেমন্তে কাটা হবে ধান,
আবার শূন্য গোলায় ডাকবে ফসলের বান-
পৌষপার্বণে প্রাণ-কোলাহলে ভরবে গ্রামের নীরব শ্মশান।
তবুও এ হাতে কাস্তে তুলতে কান্না ঘনায়ঃ
হালকা হাওয়ায় বিগত স্মৃতিকে ভুলে থাকা দায়;
গত হেমন্তে মরে গেছে ভাই, ছেড়ে গেছে বোন,
পথে-প্রান্তরে খামারে মরেছে যত পরিজন;
নিজের হাতের জমি ধান-বোনা,
বৃথাই ধুলোতে ছড়িয়েছে সোনা,
কারোরই ঘরেতে ধান তোলবার আসেনি শুভক্ষণ-
তোমার আমার ক্ষেত ফসলের অতি ঘনিষ্ঠ জন।
এবার নতুন জোরালো বাতাসে
জয়যাত্রার ধ্বনি ভেসে আসে,
পিছে মৃত্যুর ক্ষতির নির্বাচন-
এই হেমন্তে ফসলেরা বলেঃ কোথায় আপন জন?
তারা কি কেবল লুকোনো থাকবে,
অক্ষমতার গ্লানিকে ঢাকবে,
প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ করছে উচ্চারণ
এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ?
==========
এক যে ছিলো
এক যে ছিল আপনভোলা কিশোর,
ইস্কুল তার ভাল লাগত না,
সহ্য হত না পড়াশুনার ঝামেলা
আমাদের চলতি লেখাপড়া সে শিখল না কোনোকালেই,
অথচ সে ছাড়িয়ে গেল সারা দেশের সবটুকু পাণ্ডিত্যকে।
কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।
বড়মানুষীর মধ্যে গরীবের মতো মানুষ,
তাই বড় হয়ে সে বড় মানুষ না হয়ে
মানুষ হিসেব হল অনেক বড়।
কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।
গানসাধার বাঁধা আইন সে মানে নি,
অথচ স্বর্গের বাগান থেকে সে চুরি করে আনল
তোমার আমার গান।
কবি সে, ছবি আঁকার অভ্যাস ছিল না ছোট বয়সে,
অথচ শিল্পী ব’লে সে-ই পেল শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের সম্মান।
কেমন ক’রে ? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না।।
মানুষ হল না বলে যে ছিল তার দিদির আক্ষেপের বিষয়,
অনেক দিন, অনেক বিদ্রূপ যাকে করেছে আহত;
সে-ই একদিন চমক লাগিয়ে করল দিগ্বিজয়।
কেউ তাকে বলল, ‘বিশ্বকবি’, কেউ বা ‘কবিগুরু’
উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম চারদিক করল প্রণাম।
তাই পৃথিবী আজো অবাক হয়ে তাকিয়ে বলছেঃ
কেমন ক’রে? সে প্রশ্ন আমাকে ক’রো না,
এ প্রশ্নের জবাব তোমাদের মতো আমিও খুঁজি।।
==========
(মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
==========
কৃষকের গান
এ বন্ধ্যা মাটির বুক চিরে
এইবার ফলাব ফসল-
আমার এ বলিষ্ঠ বাহুতে
আজ তার নির্জন বোধন।
এ মাটির গর্ভে আজ আমি
দেখেছি আসন্ন জন্মেরা
ক্রমশ সুপুষ্ট ইঙ্গিতেঃ
দুর্ভিরে অন্তিম কবর।
আমার প্রতিজ্ঞা শুনেছ কি?
(গোপন একান্ত এক পণ)
এ মাটিতে জন্ম দেব আমি
অগণিত পল্টন-ফসল।
ঘনায় ভাঙন দুই চোখে
ধ্বংসস্রোত জনতা জীবনে;
আমার প্রতিজ্ঞা গ’ড়ে তোলে
ক্ষুদিত সহস্র হাতছানি।
দুয়ারে শত্রুর হানা
মুঠিতে আমার দুঃসাহস।
কর্ষিত মাটির পথে পথে
নতুন সভ্যতা গড়ে পথ।।
==========
খবর
খবর আসে!
দিগ্দিগন্ত থেকে বিদ্যুদ্বাহিনী খবর;
যুদ্ধ, বিদ্রোহ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ঝড়
—এখানে সাংবাদিকতার নৈশ নৈঃশব্দ্য।
রাত গভীর হয় যন্ত্রের ঝঙ্কৃত ছন্দে- প্রকাশের ব্যগ্রতায়;
তোমাদের জীবনে যখন নিদ্রাভিভুত মধ্যরাত্রি
চোখে স্বপ্ন আর ঘরে অন্ধকার।
অতল অদৃশ্য কথার সমুদ্র থেকে নিঃশব্দ শব্দেরা উঠে আসে;
অভস্ত হাতে খবর সাজাই-
ভাষা থেকে ভাষান্তর করতে কখনো চমকে উঠি,
দেখি যুগ থেকে যুগান্তর।
কখনো হাত কেঁপে ওঠে খবর দিতে ;
বাইশে শ্রাবণ, বাইশে জুনে।
তোমাদের ঘুমের অন্ধকার পথ বেয়ে
খবর-পরীরা এখানে আসে তোমাদের আগে,
তাদের পেয়ে কখনো কণ্ঠে নামে ব্যথা, কখনো বা আসে গান ;
সকালে দিনের আলোয় যখন তোমাদের কাছে তারা পৌঁছোয়
তখন আমাদের চোখে তাদের ডানা ঝরে গেছে।
তোমরা খবর পাও,
শুধু খবর রাখো না কারো বিনিদ্র চোখ আর উৎকর্ণ কানের।
ঐ কম্পোজিটর কি কখনো চমকে ওঠে নিখুঁত যান্ত্রিকতার কোনো ফাঁকে?
পুরনো ভাঙা চশমায় ঝাপসা মনে হয় পৃথিবী
৯ই আগস্টে কি আসাম সীমান্ত আক্রমণে?
জ্বলে ওঠে কি স্তালিনগ্রাদের প্রতিরোধে, মহাত্মাজীর মুক্তিতে,
প্যারিসের অভ্যুত্থানে?
দুঃসংবাদকে মনে হয় না কি
কালো অক্ষরের পরিচ্ছদে শোকযাত্রা?
যে খবর প্রাণের পক্ষপাতিত্বে অভিষিক্ত
আত্মপ্রকাশ করে নাকি বড় হরফের সম্মানে?
এ প্রশ্ন অব্যক্ত অনুচ্চারিত থাকে
ভোরবেলাকার কাগজের পরিচ্ছন্ন ভাঁজে ভাঁজে।
শুদু আমরা দৈনন্দিন ইতিহাস লিখি!
তবু ইতিহাস মনে রাখবে না আমাদের-
কে আর মনে রাখে নবান্নের দিনে কাটা দানের গুচ্ছকে?
কিন্তু মনে রেখো তোমাদের আগেই আমরা খবর পাই
মদ্যরাত্রির অন্ধকারে
তোমাদের তন্দ্রার অগোচরেও।
তাই তোমাদের আগেই খবর-পরীরা এসেছে আমাদের
চেতনার পথ বেয়ে।
আমার হৃদ্যন্ত্রে ঘা লেগে বেজে উঠেছে কয়েকটি কথা-
পৃথিবী মুক্ত- জনগণ চূড়ান্ত সংগ্রামে জয়ী।
তোমাদের ঘরে আজো অন্ধকার, চোখে স্বপ্ন।
কিন্তু জানি একদিন সে সকাল আসবেই
যেদিন এই খবর পাবে প্রত্যেকের চোখেমুখে
সকালের আলোয়, ঘাসে ঘাসে পাতায় পাতায়।
আজ তোমরা এখনো ঘুমে।।
==========
কবিতাটি ছাড়পত্র বইয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
==========
গোপন খবর
শোন একটা গোপন খবর দিচ্ছি আমি তোমায়,
কলকাতাটা যখন খাবি খাচ্ছিল রোজ বোমায়,
সেই সময়ে একটা বোমা গড়ের মাঠের ধারে,
মাটির ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ছিল এক্কেবারে,
অনেক দিনের ঘটনা তাই ভুলে গেছ্ল লোকে,
মাটির ভেতর ছিল তাইতো দেখে নি কেউ চোখে,
অনেক বর্ষা কেটে গেল, গেল অনেক মাস,
যুদ্ধ থামায় ফেলল লোকে স্বস্তির নিঃশ্বাস,
হাঠাৎ সেদিন একলা রাতে গড়ের মাঠের ধারে,
বেড়িয়ে ফেরার সময় হঠাৎ চমকে উঠিঃ আরে!
বৃষ্টি পেয়ে জন্মেছে এক লম্বা বোমার গাছ,
তারই মাথায় দেখা যাচ্ছে চাঁদের আলোর নাচ,
গাছের ডালে ঝুলছে কেবল বোমা-ই সারি সারি,
তাই না দেখে ভড়কে গিয়ে ফিরে এলাম বাড়ি।
পরের দিনই সকাল বেলা গেলাম ময়দানে,
হায়রে!- গাছটা চুরি গেছে কোথায় কে তা জানে।
গাছটা ছিল। গড়ের মাঠে খুঁজতে আজো ঘুরি,
প্রমাণ আছে অনেক, কেবল গাছটা গেছে চুরি।।
==========
(মিঠে কড়া কাব্যগ্রন্থ)
==========
ঘুম ভাঙার গান
মাথা তোল তুমি বিন্ধ্যাচল
মোছ উদ্গত অশ্রুজল
যে গেল সে গেল, ভেবে কি ফল?
ভোল ক্ষত!
তুমি প্রতারিত বিন্ধ্যাচল,
বোঝ নি ধূর্ত চতুর ছল,
হাসে যে আকাশচারীর দল,
অনাহত।
শোন অবনত বিন্ধ্যাচল,
তুমি নও ভীরু বিগত বল
কাঁপে অবাধ্য হৃদয়দল
অবিরত।
কঠিন, কঠোর বিন্ধ্যাচল,
অনেক ধৈর্যে আজো অটল
ভাঙো বিঘ্নকেঃ করো শিকল
পদাহত।
বিশাল, ব্যাপ্ত বিন্ধ্যাচল,
দেখ সূর্যের দর্পানল;
ভুলেছে তোমার দৃঢ় কবল
বাধা যত।
সময় যে হল বিন্ধ্যাচল,
ছেঁড় আকাশের উঁচু ত্রিপল
দ্রুত বিদ্রোহে হানো উপল
শত শত।।
==========
(পূর্বাভাস কাব্যগ্রন্থ)
==========
চরম পত্র
তোমাকে দিচ্ছি চরমপত্র রক্তে লেখা;
অনেক দুঃখে মথিত এ শেষ বিদ্যে শেখা৷
অগণ্য চাষী-মজুর জেগেছে শহরে গ্রামে
সবাই দিচ্ছি চরমপত্র একটি খামে :
পবিত্র এই মাটিতে তোমার মুছে গেছে ঠাঁই,
ক্ষুব্ধ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত ‘স্বাধীনতা চাই’৷
বহু উপহার দিয়েছ,—শাস্তি, ফাঁসি ও গুলি,
অরাজক, মারী, মন্বন্তরে মাথার খুলি৷
তোমার যোগ্য প্রতিনিধি দেশে গড়েছে শ্মশান,
নেড়েছে পর্ণকুটির, কেড়েছে ইজ্জত, মান!
এতদিন বহু আঘাত হেনেছ, পেয়ে গেছ পার,
ভুলি নি আমরা, শুরু হোক শেষ হিসাবটা তার,
ধর্মতলাকে ভুলি নি আমরা, চট্টগ্রাম
সর্বদা মনে অঙ্কুশ হানে নেই বিশ্রাম৷
বোম্বাই থেকে শহীদ জীবন আনে সংহতি,
ছড়ায় রক্ত প্লাবন, এদেশে বিদ্যুৎগতি৷
আমাদের এই দলাদলি দেখে ভেবেছ তোমার
আয়ু সুদীর্ঘ, যুগ বেপরোয়া গুলি ও বোমার,
সে স্বপ্ন ভোলো চরমপত্র সমুখে গড়ায়,
তোমাদের চোখ-রাঙানিকে আজ বলো কে ডরায়?
বহু তো অগ্নি বর্ষণ করো সদলবলে,
আমরা জ্বালছি আগুন নেভাও অশ্রুজলে৷
স্পর্ধা, তাইতো ভেঙে দিলে শেষ-রক্তের বাঁধ
রোখো বন্যাকে, চরমপত্রে ঘোষণা : জেহাদ॥
==========
চিরদিনের
এখানে বৃষ্টিমুখর লাজুক গাঁয়ে
এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা,
সবুজ মাঠেরা পথ দেয় পায়ে পায়ে
পথ নেই, তবু এখানে যে পথ হাঁটা।
জোড়া দীঘি, তার পাড়েতে তালের সারি
দূরে বাঁশঝাড়ে আত্মদানের সাড়া,
পচা জল আর মশায় অহংকারী
নীরব এখানে অমর কিষাণপাড়া।
এ গ্রামের পাশে মজা নদী বারো মাস
বর্ষায় আজ বিদ্রোহ বুঝি করে,
গোয়ালে পাঠায় ইশারা সবুজ ঘাস
এ গ্রাম নতুন সবুজ ঘাগরা পরে।
রাত্রি এখানে স্বাগত সান্ধ্য শাঁখে
কিষাণকে ঘরে পাঠায় যে আল-পথ;
বুড়ো বটতলা পরস্পরকে ডাকে
সন্ধ্যা সেখানে জড়ো করে জনমত।
দুর্ভিক্ষের আঁচল জড়ানো গায়ে
এ গ্রামের লোক আজো সব কাজ করে,
কৃষক-বধূরা ঢেঁকিকে নাচায় পায়ে
প্রতি সন্ধ্যায় দীপ জ্বলে ঘরে ঘরে।
রাত্রি হলেই দাওয়ার অন্ধকারে
ঠাকুমা গল্প শোনায় যে নাতনীকে,
কেমন ক’রে সে আকালেতে গতবারে,
চলে গেল লোক দিশাহারা দিকে দিকে।
এখানে সকাল ঘোষিত পাখির গানে
কামার, কুমোর, তাঁতী তার কাজে জোটে,
সারাটা দুপুর ক্ষেতের চাষীরা কানে
একটানা আর বিচিত্র ধ্বনি ওঠে।
হঠাৎ সেদিন জল আনবার পথে
কৃষক-বধূ সে থমকে তাকায় পাশে,
ঘোমটা তুলে সে দেখে নেয় কোনোমতে,
সবুজ ফসলে সুবর্ণ যুগ আসে।।
==========
(কাব্যগ্রন্থঃ ঘুমনেই)
==========
আরো পড়ুন,
কবিতাগুলি ভালো লাগলে প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না। ..
ভালো থাকুন, কবিতায় থাকুন। ..
Thank You, Visit Again ….
Tags – Sukanta Bhattacharjee, Bangla Kobita, Bengali Poem