Lojja By Taslima Nasrin (লজ্জা পর্ব – 8) Lajja PDF
পর্ব – ৮
Lajja By Taslima Nasrin
নীলা আসে। ছিপছিপে শরীর তার, সুন্দরী। সেজেগুজে থাকে। আজ তার আলুথালু বেশ। চোখের নীচে কালি, উদ্বিগ্ন চোখ, সে এসেই জিজ্ঞেস করে-সুরঞ্জনদা, কতদিন আসেন না, খবর নেন না, বেঁচে আছি কি মরে গেছি জানতেও আসেন না। খবর পাই পাশের বাড়িতেই আসেন। বলতে বলতে নীলা হঠাৎ কেঁদে ওঠে।
সুরঞ্জন আসে না বলে কেঁদে উঠবে কেন নীলা? সে কি তার সম্প্রদায়ের অসহায়ত্বের জন্মই কেঁদে উঠল, যেহেতু কষ্ট যা ধারণ করে এখন নীলা, একই বেদনা বা নিরাপত্তাহীনতা সুরঞ্জনকেও ধারণ করতে হয়? সে তা বোঝে বলে নিজের অসহায়বোধের সঙ্গে পুলক, অলক এবং সুরঞ্জনের বোধকেও সে নিদ্বিধায় মিলিয়েছে। এই পরিবারটিকে বড় আপন মনে হচ্ছে সুরঞ্জনের। বেলালের বাড়িতে চার-পাঁচ দিন আগেও আড্ডা দিয়েছে সুরঞ্জন, এ বাড়িতে আসবার প্রয়োজনই বোধ করেনি। এই বোধ তার নতুন করে জন্ম নিচ্ছে।
—ভূমি এত ন্যাভাস হচ্ছে কেন? ঢাকায় বেশি কিছু করতে পারবে না। পুলিশ পাহারা আছে শাঁখারি বাজারে, ইসলামপুরে, তাঁতিবাজারে।
-পুলিশ তো গতবারও দাঁড়িয়ে ছিল, তারা ঢাকেশ্বরী মন্দির লুট করুল, আগুন ধরাল পুলিশের সামনে, পুলিশ কিছু করল?
一হুঁ।
—আপনি রাস্তায় বেরোলেন কেন? কোনও বিশ্বাস নেই মুসলমানদের। ভাবছেন বন্ধু, দেখবেন সেই আপনার গলা কেটে ফেলে রাখিল।
সুরঞ্জন আবার চোখ বন্ধ করে। দু চোখ বন্ধ করে রাখলে কি অন্তৰ্জােলা কিছু কমে! বাইরে কোথায় যেন হইচই হচ্ছে, বোধহয় কোনও হিন্দুর দোকান ভাঙছে, পুড়ছে। চোখ বন্ধ করলেই পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে লাগে। চোখ বন্ধ করলেই দা কুড়োল রামদা হাতে ধেয়ে আসা মৌলবাদীর দল মনে হয় চোখের সামনে নাচছে। গত রাতে গৌতমকে দেখতে গিয়েছিল সে, শুয়ে আছে, চোখের নীচে, বুকে পিঠে কালশিরে দাগ। ওর বুকে হাত রেখে বসেছিল সুরঞ্জন। কিছু জিজ্ঞেস করেনি, যে স্পর্শ সে রেখেছিল, এসে স্পর্শের পর কথা বলবার দরকার পড়ে না। গৌতমই বলেছিল–‘দাদা, আমি কিছুই করিনি। ওরা মসজিদ থেকে দুপুরের নামাজ সেরে বাড়ি ফিরছিল, বাড়িতে বাজার নেই। কিছু, মা বললেন ডিম কিনে আনতে। পাড়ার দোকান ভয় কী, আমি তো আর দূরে কোথাও যাচ্ছি। না। ডিম হাতে নিয়ে টাকা ফেরত নিচ্ছি, হঠাৎ পিঠের পেছনে দুম করে লখি এসে পড়ে। ওরা ছসৈাতজন ছেলে, আমি একা কী করে পারি! দোকানঅলা, রাস্তার লোকেরা দূর থেকে মজা দেখল, কিছু বলল না। আমাকে কোনও কারণ ছাড়াই মারল ওরা, নীচে ফেলে মারল। বিশ্বাস কর কিছু বলিনি আমি ওদের। ওরা বলছিল—’হিন্দু শালা, মালাউনের বাচ্চা, শালাকে মেরে শেষ করে দেব। আমাদের মসজিদ ভেঙে পার পেতে চাস তোরা। তোদের দেশ থেকে তাড়াবই।’ সুরঞ্জন শোনে শুধু কিছু যে বলবে, খুঁজে পায় না। গৌতমের বুকের টিপচিপ শব্দ অনুভূত হয় তার হাতে। এই শব্দ সে কি তার বুকেও বাজতে শুনেছে? বোধহয় শুনেছে। দু-একবার।
নীলা চা আনে। চা খেতে খেতে মায়ার কথা ওঠে।
—মায়াকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হয়। সে আবার হুট করে জাহাঙ্গীরকে বিয়েই করে বসে কি না।
—সে কী সুরঞ্জনদা? এখনও ফেরান ওকে। দুঃসময়ে মানুষ ঝটি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
—দেখি যাবার পথে পারুলের বাড়ি থেকে ওকে নিয়ে যাব। মায়াটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বেঁচে থাকবার প্রচণ্ড লোভে ও বোধহয় ফরিদা বেগম জাতীয় কিছু একটা হয়ে যাবে। সেলফিস।
নীলার চোখে নীল দুশ্চিন্তা খেলা করে। অলক কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে, গালে তার চোখের জলের দাগ। পুলক পায়চারি করে, ওর অস্থিরতা সুরঞ্জনকেও স্পর্শ করে। চায়ের মত চা পড়ে থাকে, জুড়িয়ে জল হয়ে যায়। সুরঞ্জনের চায়ের পিপাসা ছিল, কোথায় যে উবে যায় সব পিপাসা। সে চোখ বুজে ভাবতে চায় দেশটি তার, তার বাবার, তার ঠাকুরদার, ঠাকুরদারও ঠাকুরদার দেশ। এটি। সে কেন তবু বিচ্ছিন্ন বোধ করছে! কোন মনে হয় এই দেশে তার কোনও অধিকার নেই!
তার চলবার, বলবার, যা কিছু পরবার, ভাববার অধিকার নেই। তাকে সিঁটিয়ে থাকতে হবে, লুকিয়ে থাকতে হবে, তার যখন ইচ্ছে বেরোনো চলবে না, যা কিছু করা চলবে না। গলায় ফাঁস পরালে যেমন লাগে মানুষের, সুরঞ্জনের তেমন লাগে। সে নিজেই নিজের দুহাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে কণ্ঠদেশ। শ্বাস তার কিছু রোধ হয় কী হয় না। সে হঠাৎ চেচিয়ে ওঠে—আমার কিছু ভাল লাগছে না পুলক ৷
পুলকের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। এই শীতেও ঘাম জমে কেন? সুরঞ্জনের হাত নিজের কপালেও ওঠে। সে অবাক হয় তার কপালেও ঘাম জমেছে। ভয়ে? কেউ তো তাদের ধরে পেটাচ্ছে না। মেরে ফেলছে না। তবু কোন ভয় হয়, বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ হয়?
সুরঞ্জন ফোনের ডায়াল ঘোরায়। দিলীপ দে, এক সময়ের তুখোড় ছাত্র নেতা, ওর নম্বরটি মনে পড়ে হঠাৎ। বাড়িতেই ছিলেন দিলীপ দে।
—কেমন আছেন দাদা? কোনও অসুবিধে নেই তো? কিছু ঘটেনি তো?
—অসুবিধে নেই, কিন্তু মনে স্বস্তি পাচ্ছি না। আর আমারই ঘটতে হবে কেন? সারা দেশেই তো ঘটছে।
—তা ঠিক।
—তুমি কেমন আছ? চট্টগ্রামের অবস্থা তো শুনেছ নিশ্চয়ই?
—কি রকম?
—সন্দ্বীপ থানায় বাউরিয়ায় তিনটে, কালাপানিয়ায় দুটো, মগধরায় তিনটে, টেউরিয়ায় দুটো, হরিশপুরে একটি, রহমতপুরে একটি, পশ্চিম সারিকাইতে একটি, মাইটভাঙায় একটি মন্দির ধ্বংস করেছে। পশ্চিম সারকাইতে সুচারু দাস নামের এক লোককে মারধাের করে পনেরো হাজার টাকা নিয়ে যায়। টোকাতলিতে দুটো বাড়ি লুট করে দুজনকে ছুরি মেরেও গেছে। পটিয়া থানার কচুয়ায় একটি বাড়ি, ভাটিকাইনে একটি মন্দির…
—আপনি এমন একটি দুটির হিসেব পেলেন কোথায়?
—আরে আমি চিটাগাঙের ছেলে না? ওসব এলাকায় কি হচ্ছে খবর না নিলেও খবর চলে আসে। শোন, বাঁশখালি থানার বইলছড়িতে তিনটে, পূর্ব চাম্বলে তিনটে বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে। রাঙ্গুনিয়া থানায় সরফভাটা ইউনিয়নে পাঁচটি ঘর, পায়রা ইউনিয়নে সাতটি ঘর, শিলক ইউনিয়নে একটি মন্দির, চন্দনাইশ থানায় বাদামতলিতে একটি মন্দির, জোয়ারার একটি মন্দিরে লুটপাট করা হয়, ভাঙা হয়। আনোয়ারা থানার বোয়ালগাঁও-এ। চারটে মন্দির, একটি ঘর, তেগোটায় ষোলোটি বাড়িতে হামলা, লুট, ভাঙচুর সবই হয়। বোয়ালখালি থানার মেধস মুনির আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
—আমি কৈবল্যধাম, তুলসীধাম আশ্রম, অভয় মিত্র শ্মশান, শ্মশান কালীবাড়ি, পঞ্চাননধাম নিয়ে দশটি কালীবাড়ি যে পুরো জ্বলিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনেছি। সুরঞ্জন বলে।
–সদরঘাট কালীবাড়ি, গোলপাহাড় শ্মশান মন্দিরেও হামলা হয়েছে। জামালখান রোড আর সিরাজউদ্দৌলা রোড়ে দোকান ভাঙচুর করা হয়। এনায়েত বাজার, কে সি দে রোড, ব্ৰিকফিল্ড রোডের হিন্দুদের দোকান ও বাড়ি লুট করে, আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। কৈবল্যধাম মালী পাড়ায় আটত্রিশটি বাড়ি, সদরঘাট জেলেপাড়ায় একশর ওপর বাড়ি লুট হয়েছে, আগুন ধরানো হয়েছে। ঈদগাঁও আগ্রাবাদ জেলেপাড়া আর বহদ্দারহাটে ম্যানেজার কলোনিতে লুটপাট করে, ভেঙেও ফেলে। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে মীরেরসরাই আর সীতাকুণ্ডে। মীরেরসরাই-এর সাতবাড়িয়া গ্রামে পঁচাত্তরটি পরিবার, মসদিয়া ইউনিয়নে দশটি পরিবার, হাদিনগরে চারটি পরিবার, বেশরতে ষোলটি পরিবার, তিনটি মন্দির, ওদেয়পুরে বিশটি পরিবার, খাজুরিয়ায় বারোটি পরিবার, জাফরাবাদে সােতাশিটি পরিবারে হামলা হয়েছে। তাদের বাড়িঘর লুটপাট, ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর ইউনিয়নে একটি পরিবার, বারুইয়ার ঢালা ইউনিয়নের মহালঙ্কা গ্রামে তেইশটি পরিবার, বহরপুরে আশিটি পরিবার, বারইপাড়ায় তিনশ চল্লিশটি পরিবার, নারায়ণ মন্দির, বাঁশবাড়িয়ায় বারোটি পরিবার, বাড়বকুণ্ডে সতেরোটি পরিবার, দুটো মন্দির, ফরহাদপুরে চৌদ্দটি পরিবারে হামলা হয়েছে, লুট করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
–আর কত শুনব দিলীপদা, ভাল লাগছে না।
–তুমি কি অসুস্থ সুরঞ্জন? কণ্ঠস্বর কেমন যেন লাগছে।
–ঠিক বুঝতে পারছিনা।
ফোন ছাড়তেই পুলক বলে দেবব্রতর খবর নাও তো। সুরঞ্জন দেবব্রত, মহাদেব ভট্টাচাৰ্য, অসিত পাল, সজল ধর, মাধবী ঘোষ, কুন্তলা চৌধুরী, সরল দে, রবীন্দ্র গুপ্ত, নিখিল সানাল, নির্মল সেনগুপ্ত-কে এক এক করে ফোন করে। জানতে চায় ‘ভাল আছেন কি না।‘ অনেকদিন পর পরিচিত অনেকের সঙ্গে কথা হয়। এক ধরনের আত্মীয়তাও অনুভূত হয়।
ক্রিং ক্রিং বেজে ওঠে ফোনটি। সুরঞ্জনের কানের কাছে ক্রিংক্রিং শব্দটি দ্রিম দ্রিম হয়ে বাজে। তার অস্বস্তি হয়। পুলকের ফোন। কক্সবাজার থেকে। ফোনে কথা সেরে পুলক বলে–কক্সবাজারে জামাত শিবিরের লোকেরা জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছে।
সুরঞ্জন শোনে এবং নিজের নিলিপ্তি দেখে সে নিজেই অবাক হয়। এই খবর শুনে তার ক্ষোভে ফেটে পড়বার কথা। আজ মনে হচ্ছে এই পতাকা পুড়ে গেলে তার কিছু যায় আসে না। এই পতাকা তার নয়। সুরঞ্জনের এমন হচ্ছে কেন? এমন হচ্ছে বলে সে নিজেকে ধিক্কার দেয়, নিজেকে বড় ক্ষুদ্র মনে হয়, বড় নীচ, বড় স্বার্থপর, তবু তার নির্লিপ্তি কাটে না। পতাকা পুড়েছে বলে তার ভেতর যে ক্রোধ হওয়া উচিত ছিল, তার কিছুই হয় না।
পুলক সুরঞ্জনের কাছে এসে বসে। বলে—আজ আর যেও না। এখানেই থেকে যাও। বাইরে বেরোলে কখন কী বিপদ ঘটে বলা যায় না। এ সময় আমাদের কারও রাস্তায় বেরোনোটা ঠিক নয়।
গতকাল লুৎফর তাকে এ ধরনের একটি উপদেশ দিয়েছিল। সুরঞ্জন অনুভব করে পুলকের কণ্ঠের আন্তরিকতা আর লুৎফরের কণ্ঠের সূক্ষ্ম অহঙ্কার বা ঔদ্ধত্য।
নীলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—দেশে বোধহয় আর থাকতে পারব না। আজ হয়ত কিছু হচ্ছে না, কাল হবে, পরশু হবে। কী ভীষণ অনিশ্চিত জীবন আমাদের। এর চেয়ে নিশ্চিত নিরাপদ দরিদ্র জীবন অনেক ভাল।
পুলকের প্রস্তাবে সুরঞ্জন রাজি প্রায় হয়েই যেত, কিন্তু সুধাময় এবং কিরণময়ীর কথা মনে পড়ায়, ওঁরা দুশ্চিন্তা করবেন ভেবে সুরঞ্জন উঠে যায়। বলে—যা হয় হবে। মুসলমানের হাতে না হয় শহীদ হলাম। কেওয়ারিশ লাশ পড়ে থাকবে জাতীয় ফুল শাপলার নীচে। লোকে বলবে ও কিছু না অ্যাকসিডেন্ট। কী বল? সুরঞ্জন হোসে ওঠে। পুলক আর নীলার মুখে হাসি খেলে না।
রাস্তায় নেমে একটি ক্লিক্সা পেয়ে যায় সুরঞ্জন, মাত্র আটটা বাজে, তার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। পুলক তার কলেজ জীবনের বন্ধু। বিয়ে করে চমৎকার সংসার সাজিয়েছে, তারই হল না কিছু বয়স তো অনেক হল, রত্না নামের এক মেয়ের সঙ্গে মাস দুই হল পরিচয় হয়েছে। সুরঞ্জনের হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছে হয় বিয়ে করে সংসারী হতে। পারভিনের বিয়ে হয়ে যাবার পর সে তো ভেবেইছিল সন্ন্যাসব্যাপনের কথা। তবু রত্না কেমন যেন এলোমেলো করে দিল তার ছন্নছাড়া জীবন। এখন বড় গুছিয়ে উঠতে ইচ্ছে করে, এখন স্থির হতে ইচ্ছে করে কোথাও। রত্নাকে অবশ্য এখনও বলা হয়নি ‘তোমাকে এই যে এত ভাল লাগছে আমার, তুমি বোঝা সে কথা?’
রত্নার সঙ্গে প্রথম আলাপের কয়েকদিন পর রত্না বলেছিল–এখন করছেন কি?
—কিছু না। সুরঞ্জন ঠোঁট উল্টে বলেছিল।
—চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য কিছু না?
–না।
–রাজনীতি করতেন, সেটা?
–ছেড়েছি।
—খুব ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন জানতাম।
–ওসব আর ভাল লাগে না।
–কি ভাল লাগে?
–ঘুরে বেড়াতে। মানুষ দেখতে।
–গাছপালা, নদী উদী দেখতে ভাল লাগে না?
—লাগে। তবে সবচেয়ে ভাল লাগে মানুষ। মানুষের ভেতর যে রহস্যময়তা আছে তার জট খুলতে আমার ভাল লাগে।
–কবিতা-টবিতা লেখেন নাকি?
—আরে না। তবে প্রচুর কবি বন্ধু আছে।
—মদ-টদ খান?
–মাঝে মধ্যে।
—সিগারেট তো বেশ ফোঁকেন।
–হ্যাঁ, তা ফুঁকি। পয়সা-টয়সা তেমন পাই না।
—সিগারেট ইজ ইনজুরিয়াস টু হেলথ, তা জানেন তো?
—জানি। করার কিছু নেই।
—বিয়ে করেননি কেন?
—কেউ পছন্দ করেনি তাই।
–কেউ না?
—একজন করেছিল। সে রিস্ক নেয়নি আলটিমেটালি।
–কেন?
—সে মুসলমান ছিল, আর আমাকে তো বলা হয় হিন্দু। হিন্দুর সঙ্গে বিয়ে, ওকে তো আর হিন্দু হতে হত না। আমাকেই আবদুস সাকের নাম-টাম রাখতে হত।
রত্না হেসেছিল শুনে। বলেছিল–বিয়ে না করাই ভাল, ক’দিনের মাত্র জীবন। বন্ধনহীন কাটিয়ে দেওয়াই তো ভাল।
—তাই বুঝি আপনিও ওপথ মাড়াচ্ছেন না।
—ঠিক তাই।
—ঐ অবশ্য একদিক থেকে ভালই।
—ঐকই সিদ্ধান্ত হলে আপনার আমার বন্ধুত্ব জামবে ভাল।
—বন্ধুত্বের খুব বড় অর্থকরি আমি। দু-একটা সিদ্ধান্ত মিললেই বন্ধু হওয়া যায় নাকি!
—আপনার বন্ধু হতে গেলে বুঝি খুব সাধনা করতে হবে?
সূরঞ্জন জোরে হেসে উঠে বলেছিল—আমার কি এত সৌভাগ্য হবে নাকি?
–আত্মবিশ্বাস খুব কম বুঝি আপনার?
–না সে কথা না। নিজেকে বিশ্বাস আছে। অন্যকে বিশ্বাস নেই।
—আমাকে বিশ্বাস করে দেখুন তো।
সূরঞ্জনের সেদিন সারাদিন মন ভাল ছিল। আজ আবার রত্নার কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে তার, সম্ভবত মন ভাল করবার জন্য। ইদানীং সে তাই করে, কিছুতে মন খারাপ হলে রত্নাকে স্মরণ করে। রত্না আছে কেমন? একবার যাবে নাকি আজিমপুরে। গিয়ে জিজ্ঞেস করবে–কেমন আছেন রত্না মিত্ৰ?’ প্রত্না কি সামান্য অপ্রস্তুত হবে তাকে দেখে? সুরঞ্জন স্থির করতে পারে না তার কি করা উচিত। সাম্প্রদায়িক সম্রাসের কারণে এক ধরনের হিন্দু পুনর্মিলনী হচ্ছে, তা সে অনুমান করে। আর রত্না নিশ্চয় অবাক হবে না, ভাববে। এ সময় হিন্দুরা হিন্দুদের খোঁজ নিচ্ছে, দুঃসময়ে যখন পাশেই দাঁড়াচ্ছে সবাই, তখন, হঠাৎ, কোনও নিমন্ত্রণ ছাড়াই সুরঞ্জন নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারে রত্নার সামনে।
রিক্সাকে আজিমপুরের দিকে ঘুরতে বলে সে। রত্না তেমন লম্বা নয়, সুরঞ্জনের কাঁধের নীচে পড়ে, ফসর্ণ গোল মুখ, কিন্তু ওর চোখে কী যে অতল বিষন্নতা, সুরঞ্জন থাই পায় না। সে বুক পকেট থেকে টেলিফোন ইনডেক্সে লিখে রাখা ঠিকানাটি বের করে বাড়িটি খোঁজে। চাইলে খুঁজে পাবে না এমন কী হয়!
রত্না বাড়িতে নেই। দরজা সামান্য ফাঁক করে বুড়োমত এক লোক বললেন–আপনার নাম কি?
—সুরঞ্জন।
—ও তো ঢাকার বাইরে গেছে।
—কবে? কোথায়? সুরঞ্জন নিজেই তার কণ্ঠস্বরে আবেগ বা আকুলতা টের পেয়ে সামান্য লজা পায়।
—সিলেট।
–কবে ফিরবে জানেন কিছু?
—না।
সিলেটে কি অফিসের কাজে গেছে রত্না নাকি বেড়াতে, নাকি পালিয়েছে? নাকি আদৌ সিলেট যায়নি, বলা হচ্ছে সিলেট। কিন্তু সুরঞ্জন নাম শুনে, যেহেতু এটি ‘হিন্দু নাম’, লুকোবার তো কিছু নেই—এরকম ভাবতে ভাবতে সুরঞ্জন আজিমপুরের রাস্তায় হাঁটতে থাকে। এখানে কেউ তাকে হিন্দু বলে চিনতে পারছে না। টুপি মাথার পথচারী, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা উত্তপ্ত যুবকেরা, রাস্তার টোকাই কিশোরেরা কেউ যে তাকে চিনতে পারছে না। এ বেশ মজার ব্যাপার বটে। যদি ওরা চিনতে পারে, যদি ওদের ইচ্ছে করে চ্যাংদোলা করে কবরস্থানে ফেলে আসবে তাকে, সুরঞ্জনের কি একার শক্তি হবে নিজেকে বাঁচায়! তার বুকের ভেতর ঢিপিটিপ শব্দটি আবার শুরু হয়। হাঁটতে হাঁটতে দেখে সে ঘািমছে। পরনে কোনও গরম জামা নেই তার, পাতলা একটি শার্ট, শার্টের ভেতর সূচের মত হাওয়া ঢুকছে, অথচ তার কপালে জমছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। হাঁটতে হাঁটতে পলাশি পৌঁছে যায় সুরঞ্জন। পলাশি যখন এসেছেই, একবার নির্মলেন্দু গুণের খবর নেওয়া যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির ফোর্থ ক্লাস এমপ্লয়িদের জন্য কলোনি আছে পলাশিতে। কলোনির মালির ঘরটি ভাড়া নিয়ে থাকেন নির্মলেন্দু গুণ। সত্যভাষী এই মানুষটির প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা সুরঞ্জনের। দরজায় টোকা পড়লেই পাল্লা হাট করে খুলে দেয় দশ-বারো বছরের একটি মেয়ে। নির্মলেন্দু গুণ বিছানায় পা তুলে বসে মন দিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। সুরঞ্জনকে দেখেই সুর করে বলে উঠলেন—‘এস এস এস আমার ঘরে এস, আমার ঘরে…।‘
—টিভিতে দেখার কি আছে?
—বিজ্ঞাপন দেখি। সানলাইট ব্যাটারি, জিয়া সিল্ক শাড়ি, পেপসি জেল টুথপেস্ট-এর বিজ্ঞাপন। হামদ নাত দেখি। কোরানের বাণী দেখি।
সুরঞ্জন হেসে ওঠে। বলে—সারাদিন এই করেই কাটে আপনার? বাইরে বের-টের হননি নিশ্চয়?
—আমার বাড়িতে চার বছরের এক মুসলমান ছেলে থাকে। ওর ভরসায় তো বেঁচে আছি। কাল অসীমের বাড়ি গেলাম, ও আগে আগে গেল, আমি পেছন পেছন।
সুরঞ্জন হেসে ওঠে আবার। বলে—এই যে না দেখে দরজা খুলে দিলেন। যদি অন্য কেউ হত?
গুণ হেসে বলেন–কাল রাত দুটোর সময় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে কিছু ছেলে মিছিল করবার প্ল্যান করছিল, হিন্দুদের গাল দিয়ে কী কী শ্লোগান দেওয়া যায়, আলোচনা চলছিল। হঠাৎ হাঁক দিলাম, ‘কে ওখানে, গেলি?’ ওরা সরে গেল। আর আমার চুল দাড়ি দেখে অনেকে তো ভাবে আমি মুসলমান, মৌলভি।
—কবিতা লেখেন না?
—না। ওসব লিখে কি হবে। ছেড়ে দিয়েছি।
–রাতে নাকি আজিমপুর বাজারে জুয়ো খেলেন?
–হ্যাঁ। সময় কাটাই। তবে ক’দিন তো যাচ্ছি না।
–কেন?
–বিছানা থেকেই নামি না, ভয়ে। মনে হয় নামলেই বুঝি ওরা ধরে ফেলবে।
—টিভিতে কিছু বলছে, মন্দির ভাঙা-টাঙা কিছু দেখাচ্ছে?
—আরে না। টিভি দেখলে মনে হবে এ দেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে দাঙ্গা-টাঙ্গা কিছু ঘটছে না। যা কিছু ঘটছে ভারতে।
—সেদিন একজন বলল, ভারতে এ পর্যন্ত চার হাজার দাঙ্গা হয়েছে। তবু তো ভারতের মুসলমান দেশ ত্যাগ করছে না। কিন্তু এখানকার হিন্দুদের এক পা থাকে বাংলাদেশে, আরেক পা ভারতে। অৰ্থাৎ ভারতের মুসলমানরা লড়াই করছে, আর বাংলাদেশের হিন্দুরা পালাচ্ছে।
গুণ গভীর হয়ে বলেন-ওখানকার মুসলমানরা লড়াই করতেই পারে। ভারত সেকুলার রাষ্ট্র। আর এখানে ফান্ডামেন্টালিস্টরা ক্ষমতায়। এখানে আবার লড়াই কিসের। এখানে হিন্দুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের কি লড়াই করবার জোর থাকে?
—এসব নিয়ে কিছু লেখেন না কেন?
—লিখতে তো ইচ্ছে করেই। লিখলে আবার ভারতের দালাল বলে গাল দেবে। কত কিছু লিখতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করেই লিখি না। কী হবে লিখে!
গুণ বোধহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন টেলিভিশন নামের খেলনা বাক্সটির দিকে। গীতা চা রেখে যায় টেবিলে। সুরঞ্জনের খেতে ইচ্ছে করে না। গুণদার ভেতরের যন্ত্রণা তাকেও স্পর্শ করে।
হঠাৎ হেসে ওঠেন গুণ, বলেন—তুমি যে অন্যের খোঁজ-খবর নিচ্ছ, তোমার নিজের নিরাপত্তা আছে তো?
—আচ্ছা গুণদা, জুয়ো খেলে কি জেতেন কখনও?
না।
–তাহলে খেলেন কেন?
—না খেললে ওরা মা বাপ তুলে গাল দেয়, তাই খেলতে হয়।
শুনে হো হো করে হেসে ওঠে সুরঞ্জন। গুণও হাসেন। চমৎকার রসিকতা জানেন মানুষটি। আমেরিকার লাস ভেগাসের ক্যাসিনোয় বসে তিনি জুয়ো খেলতে পারেন, আবার পলাশির বস্তিতে বসে মশার কামড়ও খেতে পারেন। কিছুতে আপত্তি নেই, বিরক্তি নেই তাঁর। বারো বাই বারো ফুটের একটি ঘরে দিব্যি তিনি তুচ্ছ আমোদ আহ্রদে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এত অমল আনন্দে তিনি ভেসে থাকেন কী করে, সুরঞ্জন ভাবে। আসলেই কি আনন্দ নাকি বুকের ভেতরে তিনিও গোপনে গোপনে দুঃখ পোষেন। কিছুই করবার নেই বলে হেসে পার করেন দুঃসহ সময়।
সুরঞ্জন উঠে পড়ে। তার নিজের ভেতরেও দুঃখবোধটা বেড়ে উঠছে। দুঃখ কি সংক্রামক কিছু? সে হেঁটে হেঁটে টিকাটুলির দিকে যেতে থাকে। রিক্সা নেবে না। পাঁচটি টাকা আছে পকেটে। পলাশির মোড় থেকে সিগারেট কেনে। বাংলা ফাইভ চাইলে দোকানিটি সুরঞ্জনের মুখের দিকে অবাক তাকায়। ওর তোকানো দেখে বুকের মধ্যে সেই টিপচিপ শব্দটি হয়। লোকটি কি টের পাচ্ছে সে হিন্দু ছেলে, লোকটি কি জানে ব্যবরি মসজিদ ভেঙেছে বলে ঐখন যে কোনও হিন্দুকেই ইচ্ছে করলে পেটানো যায়? সিগারেট কিনে দ্রুত্ব সরে যায় সুরঞ্জন। তার এমন হচ্ছে কেন? সে সিগারেটটি দোকানে না ধরিয়েই চলে এসেছে। আগুন চাইতে গেলে যদি বুঝে ফেলে সে হিন্দু? হিন্দু মুসলমান পরিচয় তো আর গায়ে লেখা থাকে না। তবু তার সন্দেহ হয় তার হাঁটায়, ভাষায়, চোখের চাহনিতেও বোধহয় ধরে ফেলবার কিছু আছে। টিকাটুলির মোড়ে আসতেই একটি কুকুর ঘেউ করে ওঠে। চমকে ওঠে। সে। হঠাৎ পেছনে শোনো একপাল ছেলের ‘ধর ধর’ আওয়াজ। শুনে সে আর পেছন ফেরে না। উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োয়। গা ঘামতে থাকে তার। শার্টের বোতাম খুলে যায়, তবু দৌড় দৌড়। অনেকদূর দৌড়ে এসে সে পেছনে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। তবে কি সে মিছিমিছি দৌড়োলো। শব্দটি তার উদ্দেশ্যে ছিল না? নাকি এ তার অডিটরি হ্যালুশিনেশন!
রাত বেশি হয়ে গেলে, সুরঞ্জন সদর দরজায় ডাকাডাকি না করে বাইরে থেকে অলা দিয়ে যাওয়া নিজের ঘরটিতে ঢুকে পড়ে। ঢুকেই পাশের ঘর থেকে ভগবান ভগবান বলে করুণ একটি ক্ৰন্দন শোনে সুরঞ্জন। বাড়িতে কোনও হিন্দু অতিথি বা আল্পীয় এসেছে কিনা একবার ভাবে সে। হতেও পারে। এরকম ভেবেই সে যখন সুধাময়ের ঘরে ঢুকতে যাবে, দেখে সে অবাক হয়, কিরণময়ী ঘরের কোণে একটি জলচৌকিতে মাটির এক মূর্তি নিয়ে বসেছেন। মূর্তিটির ব্ল্যামনে গলায় আঁচল পেঁচিয়ে উবু হয়ে ‘ভগবান ভগৱােন বলে ৰুদ্রিছেন। এরকম দৃশ্য এই বাড়িতে দেখা যায় না। অদ্ভুত অচেনা একটি দৃশ্য সুরঞ্জনকে এত স্তম্ভিত করে, সে কিছুক্ষণ বুঝে পায় না তার কী করা উচিত। সে কি মুর্তিটিকে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলবে, নাকি কিরণময়ীকে নতমস্তক সে নিজে হাতে টেনে সরিয়ে আনবে। নতমস্তক দেখিলে তার গা ঘিনঘিন করে।
কাছে এসে কিরুণাময়ীর দু বাহু ধরে দাঁড় করায়। বলে–হয়েছে কি তোমার। মূর্তি নিয়ে বসেছ কেন? মূর্তি তোমাকে বাঁচাবে?
কিরুণাময়ী ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। বলেন—তোর বাবার হাত পা অবশ হয়ে গেছে। কথা জড়িয়ে আসছে।
সঙ্গে সঙ্গে সুধাময়ের দিকে চোখ পড়ে তার। শুয়ে আছেন। বিড়বিড় করে কথা বলছেন। কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না। কী বলছেন। বাবার গা ঘেঁষে বসে সে ডান হাতটি নগ্নড়ে, হাতে কোনও চেতন নেই, শক্তি নেই। বুকের ঝোপে কুড়োলের কোপ পড়ে সুরঞ্জনের। তার ঠাকুরুদ্রার ঠিক এরকম শরীরের একদিক অবশ হয়ে গিয়েছিল, ডাক্তার বলেছিলেন-ষ্ট্রেক! মুড়ির মত ওষুধ খেতে হত শুয়ে শুয়ে। আর ফ্রিািজওথেরাপিস্ট এসে হাত পায়ের এক্সক্লসাইজ কন্নতেন। বোঝা চোখে একবার কিরণময়ীর দিকে একবার সূরঞ্জনের দিকে তাকান সুধাময়।
আত্মীয়স্বজনও ধারে কাছে কেউ নেই। কার কাছে যাবে সে? ঘনিষ্ঠ কোনও আত্মীয়াই অবশ্য নেই তাদের। এক এক করে সবাই দেশ ছেড়েছে। খুব একা, অসচ্ছল, অসহায় বোধ করে সুরঞ্জন। ছেলে হিসেবে এখন সব দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তাবে। সংসারের অপদাৰ্থ ছেলে সে। আজও তার ঘুরে ঘুরে জীবন কাটে। কোনও চাকরিতে সে স্থায়ী হয়নি। ব্যবসাও করতে চেয়েছিল, সম্ভব হয়নি। সুধাময় অসুস্থ পড়ে থাকলে বাড়ির চুলো বন্ধ হবে, বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় দাঁড়াতে হরে সবাইকে।
—কামাল-টামাল কেউ আসেনি? সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে।
—না। কিরণময়ী মাথা নাড়েন।
কেউ একবার খোঁজ নিতে আসেনি। সুরঞ্জন কেমন আছে। অথচ শহরে ঘুরে কতজনের খবৰ নিয়ে এল সে ৷ সকলে ভাল আছে, কেবল সে ছাড়া। এত দারিদ্র্য, অনিশ্চয়তা আর কোনও সংসারে বোধহয় নেই। সুধাময়ের অচেতন হাতটি চেপে ধরে সুরঞ্জনের বড় মায় হয়। এই বিরুদ্ধ-জগতে তিনি কি ইচ্ছে করেই অচল হয়ে গেলেন কিনা কে জানে।
–মায়া ফেরেনি? হঠাৎ উঠে দাঁড়ায় সুরঞ্জন।
–না।
—কোন ফেরেনি সে? আচমকা চিৎকার করে ওঠে সুরঞ্জন। কিরণময়ীও অবাক হন নম্র স্বভাবের ছেলেটি কখনও এমন মাথা গরম করে কথা বলে না। আজ হঠাৎ চেঁসিয়ে কথা বলছে কোন! মায়া যে পাক্রিলের ব্রাড়ি গিয়েছে। এ এমন কোনও অন্যায় ঘটনা নয়, বরং এ অনেকটা নিশ্চিম্ভের। হিন্দু বাড়ি লুট করতে এলে মায়া ছাড়া আর কোনও সম্পদ নেই তো ঘরে। মেয়েদের তো মানুষ সোনাদোনর মত সম্পদই মনে করে।
সুরঞ্জন সারাঘর জুড়ে অস্থির হাঁটে আর বলে–মুসলমানদের এত বিশ্বাস কেন ওর? ক’দিন বাঁচাবে ওরা?
কিরণময়ী বুঝে পান না। সুধাময় অসুস্থ, এখন ডাক্তার ডাকতে হবে। এই মুহুর্তে মায়া কেন মুসলমানের বাড়ি গেল, এ নিয়ে রাগারগি করছে কেন ছেলে?
সুরঞ্জন বিভূবিভু করে-ডাক্তার ডাকতে হবে, চিকিৎসার খরচাটা কোথায় পাবে, শুনি? পাড়ার দুটো-পিচ্চি ছেলে ভয় দেখিয়েছিল, সেই ভয়ে দশ লাখ টাকার বাড়ি দু লাখ টাকায় বিক্রি করে এলে, এখন ভিক্ষুকের মত বাঁচতে লজ্জা করে না।
–কেবল কি ছেলে-ছোকরাদের ভয়ে, বাড়ি নিয়ে মামলার ঝামেলাও তো কম ছিল না। কিরণময়ী উত্তর দেন।
বারান্দায় একটি চেয়ার ছিল, সুরঞ্জন সেটিকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়।
—আর মেয়ে গেছে মুসলমানকে রিয়ে করতে। ভেবেছে মুসলমানরা তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে। মেয়ে বড়লোক হতে চায়।
বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় সে। পাড়ায় দুজন ডাক্তার আছেন। হরিপদ সরকার টিকাটুলির মোড়ে, আর দু বাড়ি পরে আছেন। আমজাদ হোসেন। কাকে ডাকবে সে? সুরঞ্জিল এলোমেলো হাঁটতে থাকে। মায়া বাড়ি ফেরেনি বলে এই যে কেঁচালো সে, সেকি মায়া ফেরেনি বলে, নাকি মুসলমানদের ওপর মায়ার নির্ভরতা দেখে? সুরঞ্জন কি অল্প অল্প কমুনীল হয়ে উঠছে? নিজেকে সন্দেহ হয় তার। সে হেঁটে টিকাটুলির মোড়ের দিকে যায়।
পর্ব – ৯
হায়দার এসেছে সুরঞ্জনের বাড়িতে। কেমন আছে জানতে নয়, স্রেফ আড্ডা দিতে। হায়দার আওয়ামি লিগ করে। একসময় সুরঞ্জন তার সঙ্গে ছোটখাটো বাণিজ্য করতে সেমেছিল, পরে উন্নতির সম্ভাবনা নেই বলে বাদ দিতে হয়েছে পরিকল্পনাটি। হায়দারের প্রিয় বিষয় রাজনীতি। সুরঞ্জনেরও বিষয় ছিল এটি, আজকাল অবশ্য রাজনীতি প্রসঙ্গ সে একেবারেই পছন্দ করে না। এরশাদ কি করেছিল, খালেদা কি করছে, হাসিনা কি করবে: এসব চিন্তায় মাথা নষ্ট না করে চুপচাপ শুয়ে থাকাই ঢের ভাল। হায়দার এক-একই কথা বলে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে সে লম্বা একটি বক্তৃতা দেয়।
–আচ্ছা হায়দার, সুরঞ্জন তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে প্রশ্ন করে–তোমাদের রাষ্ট্রের বা সংসদের কি অধিকার আছে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবার?
হায়দার চেয়ারে বসে টেবিলে পা তুলে দিয়ে সুরঞ্জনের লাল মলাটের বইগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিল, শুনে ঠা ঠা করে হেসে ওঠে। বলে–তোমাদের রাষ্ট্রের মানে? রাষ্ট্র কি তোমারও নয়?
সুরঞ্জন ঠোঁট চেপে হাসে। সে ইচ্ছে করেই আজ ‘তোমাদের’ শব্দটি হায়দারকে উপহার দিয়েছে। সে হেসেই বলে–আমি কিছু প্রশ্ন করব, প্রশ্নগুলোর জবাব তোমার কাছে চাইছি।
হায়দার সোজা হয়ে বসে বলে—তোমার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে–না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের কোনও অধিকার নেই বিভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবার।
সুরঞ্জন সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে প্রশ্ন করে–রাষ্ট্রের বা সংসদের কি অধিকার আছে কোনও ধর্মকে অন্য ধর্মের চেয়ে প্রাধান্য বা বিশেষ আনুকুল্য দেখাবার?
হায়দার সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দেয়–না।
সুরঞ্জন তৃতীয় প্রশ্ন করে—রাষ্ট্রের বা সংসদের কি অধিকার আছে পক্ষপাতিত্বের?
হায়দার মাথা নাড়ে।
—সংসদের কি অধিকার আছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধানে বর্ণিত অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি পরিবর্তনের?
হায়দার মন দিয়ে কথা কটি শোনে। বলে–নিশ্চয়ই না।
সুরঞ্জন আবার প্রশ্ন করে—দেশের সার্বভৌমত্ব সকল মানুষের সমান অধিকারের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। সংবিধান সংশোধনের নামে সেই-ভিত্তিমূলেই কি কুঠারাঘাত করা হচ্ছে না?
হায়দার এবার চোখ ছোট করে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে। ও ঠাট্টা করছে না তো! এসব পুরনো প্রশ্ন ও আবার নতুন করে টানছে কেন।
সুরঞ্জন তার ষষ্ঠ প্রশ্ন করে–রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম ইসলাম ঘোষণার মাধ্যমে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্ৰীয় আনুকুল্য বা স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয় না কি?
হায়দার কপাল কুঁচকে বলে—হয়। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সব জানা সুরঞ্জনের, হায়দারেরও। সুরঞ্জনও জানে হায়দার আর সে এসবের উত্তরের ব্যাপারে একমত। তবু প্রশ্ন করবার অর্থ কি এই যে, হায়দার ভাবে, সুরঞ্জন হায়দারকে একটি বিশেষ সময়ে প্রশ্ন করে পরীক্ষা করছে হায়দার ভেতরে ভেতরে সামান্যও সাম্প্রদায়িক কি না, তাই অষ্টম সংশোধনীর প্রসঙ্গ ওঠায় সে এই প্রশ্নগুলো করে।
সুরঞ্জন তার সিগারেটের শেষ অংশটুকু এসট্রেতে চেপে বলে-আমার শেষ প্রশ্ন ব্রিটিশ ভারতে ভারতবর্ষ থেকে আলাদা হয়ে ভিন্ন রাষ্ট্র সৃষ্টির কারণে প্রবর্তিত দ্বিজাতিতত্ত্বের জটিল আবর্তে বাংলাদেশকে আবার জড়িয়ে ফেলার এ অপচেষ্টা কেন এবং কাদের স্বার্থে?
হায়দার এবার কোনও উত্তর না দিয়ে একটি সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছেড়ে বলে-জিন্নাহ নিজেও কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বকে রাষ্ট্ৰীয় কাঠামো হিসেবে প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন ‘আজ থেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান, বীেন্ধ রাষ্ট্ৰীয় জীবনে নিজের নিজের ধর্ম পরিচয়ে পরিচিত থাকবে না। তারা সকলেই শুধু জাতি ধর্ম নির্বিশেষে এক জাতি পাকিস্তানের নাগরিক পাকিস্তানি এবং তারা শুধু পাকিস্তানি হিসেবেই পরিচিত হবে। ‘
সুরঞ্জন আধশোয়া থেকে সোজা হয়ে বসে বলে–পাকিস্তানই বোধহয় ভাল ছিল, কি বল?
উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে যায় হায়দার। বলে–আসলে পাকিস্তান ভাল ছিল না মোটেও, পাকিস্তানে তোমাদের আশা করবার কিছু ছিল না। বাংলাদেশ হবার পর তোমরা ভেবেছ এই দেশে তোমাদের সবরকম অধিকার থাকবে, এ হচ্ছে সেকুলার রাষ্ট্র, কিন্তু এই দেশ যখন তোমাদের স্বপ্ন পূরণে বাধা হল, তখন বুকে তোমাদের লাগল বেশি।
সুরঞ্জন জোরে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে—শেষ পর্যন্ত তুমিও বেশ তোমাদের আশা তোমাদের স্বপ্ন-টল্প বলে গেলে গেলে? এই তোমরা কারা? হিন্দুরা তো? তুমি আমাকেও হিন্দুর দলে ফেললে? এতকাল নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাস করে এই লাভ হল আমার?
সুরঞ্জন ঘর জুড়ে অস্থির পায়চারি করে। ভারতে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ছশ ছাড়িয়ে গেছে। পুলিশ আটজন মৌলবাদী নেতাকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে বি জে পি-র সভাপতি মুকুলী মনোহর যোশী। আর এল কে আদভানিও রয়েছেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে সারা ভারতে বন্ধ পালিত হয়। বোম্বে, রাঁচি, কণাটক, মহারাষ্ট্রে দাঙ্গা হচ্ছে, মানুষ মরছে। উগ্ৰ হিন্দু মৌলবাদীদের প্রতি ঘূণীয় সুরঞ্জন হাত মুষ্টিবদ্ধ করে। তার যদি শক্তি থাকত, জগতের সব মৌলবাদীকে সে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করত। এ দেশের সাম্প্রদায়িক দলটি মুখে বলছে ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ভারত সরকার দায়ী। ভারত সরকারের এই দোষের জন্য বাংলাদেশের হিন্দুরা দায়ী নয়। বাংলাদেশের হিন্দু ও মন্দিরের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও ক্ষোভ নেই। ইসলামিক চেতনায় উদ্ধৃদ্ধ হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষা করতে হবে।’ সাম্প্রদায়িক দলটির কক্তব্য রেডিও টেলিভিশনে, সংবাদপত্রে প্রচার হচ্ছে। কিন্তু মুখে এ কথা বললেও সারাদেশে হরতালের দিন মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদ করবার নামে যে তাণ্ডব, যে সন্ত্রাস চালিয়েছে তা না দেখলে বিশ্বাস হবার নয়। প্রতিবাদের ছুতোয় একাত্তরের ঘাতকের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির অফিস এমনকি কমিউনিস্ট পাটির অফিসও ভাঙচুর করছে আগুন লাগাচ্ছে, কেন? জামাতে ইসলামির একটি প্রতিনিধি দল বি জে পি-র নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছে। কঁী কথা হয়েছে তাদের? কী আলোচনা, কী ষড়যন্ত্র সুরঞ্জন তা অনুমান করে। পুরো উপমহাদেশে ধর্মের নামে যে দাঙ্গা শুরু হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর যে নৃশংস নির্যাতন, সুরঞ্জন নিজে সংখ্যালঘু হয়ে টের পায় এই নৃশংসতা। কত ভয়াবহ। বসনিয়া হারজেগোভেনিয়ার ঘটনার জন্য যেমন বাংলাদেশের কোনও খ্রিস্টান নাগরিক দায়ী নয় তেমনি ভারতের কোনও দুর্ঘটনার জন্য বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিক দায়ী নয়। এ কথা সুরঞ্জন কাকে বোঝাবে!
হায়দার বলে—’চল চল, তৈরি হও। মানব-বন্ধনে যাব। মানব-বন্ধন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণে জাতীয় ঐক্য ও একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীসহ সকল সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এবং সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আঞ্চলিক সৌহার্দ ও বিশ্ব শান্তির লক্ষে বিশ্ব মানবতার ঐক্যের প্রতীক হিসেবে জাতীয় সমন্বয় কমিটির ডাকে সারাদেশে মানক-বন্ধন।
—তাতে আমার কী? সুরঞ্জন প্রশ্ন করে।
–তোমার কি মানে? তোমার কিছুই না? হায়দার অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
সুরঞ্জন শান্ত, স্থির। বলে–না!
হায়দার এত বিস্মিত হয়। সে দাঁড়িয়েছিল। বসে পড়ে। আবার একটি সিগারেট ধরায় সে। বলে—এক কাপ চা খাওয়াতে পারো?
সুরঞ্জন বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বলে—ঘরে চিনি নেই।
বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে জাতীয় সংসদ ভবন পর্যন্ত মানব-বন্ধনের রুট। সকাল এগারোটা থেকে দুপুর একটা অবধি এই ক্লটে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। হায়দার মানব-বন্ধন সম্পর্কে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, সুরঞ্জন থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে–কাল আওয়ামি লিগের মিটিং-এ হাসিনা কি বলল?
–শান্তি সমাবেশে।
—হ্যাঁ।
–সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখবার জন্য প্রত্যেক মহল্লায় ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে শান্তি ব্রিগেড গড়ে তুলতে হবে।
—এতে কি হিন্দুরা অর্থাৎ আমরা রক্ষা পাবো? মানে প্ৰাণে বাঁচব?
হায়দার উত্তর না দিয়ে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে। শেভ না করা মুখ। চুল উড়োথুড়ো। হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টায় সে। জিজ্ঞেস করে–মায়া কোথায়?
–ও জাহান্নামে গেছে। সুরঞ্জনের মুখে জাহান্নাম শব্দটি হায়দারকে চমকিত করে। সে হোসে বলে-জাহান্নামটা কিরকম শুনি?
—সাপ কামড়ায়, বিচ্ছু ধরে, আগুন জ্বলে শরীরে, পুড়ে ছাই হয়ে যায়, তবুও মরে না।
—বাহ্ তুমি তো আমার চেয়ে বেশি খবর রাখো জাহান্নামের।
—রাখতেই হয়। আগুন আমাদেরই পোড়ায় কি না।
–বাড়ি এত নিস্তব্ধ কেন? মেসো মাসিমা কোথায়? অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছ?
–না।
—আচ্ছা সুরঞ্জন, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ গোলাম আজমের বিচারের দাবিকে জামাতিরা বাবরি মসজিদের ছুতোয় ভিন্ন খাতে নিয়ে যাচ্ছে?
–তা হয়ত নিচ্ছে। কিন্তু গোলাম আজমকে নিয়েও বিশ্বাস কর তুমি যেভাবে ফিল করছ, আমি সেভাবে করছি না। তার জেল ফাঁসি হলে আমার কী আর না হলেই বা আমার কী?
—তুমি খুব বদলে যাচ্ছ।
—হায়দার, খালেদা জিয়াও বললেন বাবরি মসজিদ পুননির্মাণ করতে হবে। আচ্ছা! তিনি কেন মন্দির পুনর্নির্মাণের কথা বলছেন না?
—তুমি কি মন্দির নির্মাণ চাও?
–খুব ভাল করেই জানো মন্দির মসজিদ কিছুই চাই না আমি। কিন্তু নির্মাণের কথা যখন উঠছেই, তখন কেবল মসজিদ নির্মাণ কেন?
হায়দার আরেকটি সিগারেট ধরায়। সে ভেবে পায় না মানক বন্ধনের দিন সুরঞ্জন এক একা ঘরে বসে থাকবে কেন। গণআদালত যেদিন হল, এ বছরের ছাবিবশে মার্চ, সুরঞ্জনই হায়দারকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। গণসমাবেশের দিন ঝড়বৃষ্টি ছিল, হায়দার একটি কাঁথা গায়ে দিয়ে শুয়েছিল, হাই তুলে বলেছিল-’আজি বরং না। যাই, ঘরে বসে মুড়ি ভাজা খাই চল।’ সুরঞ্জন রাজি হয়নি, উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল—’যেতে তোমাকে হবেই। এক্ষুণি তৈরি হও। আমরাই যদি পিছিয়ে যাই তবে উপায় কী হবে? ঝড়বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ওরা বেরিয়েছিল। সেই সুরঞ্জন কি না। আজ বলছে তার এই সব সভা-সমিতি ভাল লাগে না। মানব-বন্ধন-স্টন্ধন সব ফাঁকি মনে হয় তার।
হায়দার সকাল নটা থেকে এগারোটা অবধি বসে থেকেও সুরঞ্জনকে মানব-বন্ধনে নিতে পারে না।
পারুলের বাড়ি থেকে মায়াকে নিয়ে এসেছেন কিরণময়ী। এসেই মায়া অক্ষম, আচল, অকল, অকর বাবার বুকের ওপর পড়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। কান্নার শব্দ শুনলে বড় রাগ ধরে সুরঞ্জনের। চোখের জল ফেলে জগতে কিছু হয়? তার চেয়ে চিকিৎসা করা জরুরি। হরিপদ ডাক্তারের লেখা ওষুধ সুরঞ্জন কিনেছে মোটে তিন দিনের ডোজ। কিরণময়ীর আলমারি খুললে। এরপর আর কত বেরোবে? আদৌ বেরোবে কি না কে জানে!
সে নিজেও কোনও চাকরি বাকরি করল না। আসলে পরের ‘গোলামি করা ধাতে সইবে না তার। হায়দারের সঙ্গে পুরনো ব্যবসায় সে আবার জড়াবে কি না ভাবতে ভাবতে সুরঞ্জনের বড় ক্ষিদে পায়। কিন্তু কাকে সে এই অসময়ে ক্ষিদের কথা বলবো? মায়া কিরশময়ী কেউ তো এ ঘরে আসছে না। সে বেকার বলে, অকৰ্মণ্য বলে তাকে কেউ গোণায় নিচ্ছে না। বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে নাকি হচ্ছে না, এসবের খবর নিতে তার ইচ্ছে করে না। সেও আজ সুধাময়ের ঘরের দিকে যায়নি। সুরঞ্জনের ঘরের দরজা আজ বাইরে থেকে খোলা, বন্ধুবান্ধব এলে বাইরের দরজা দিয়েই সোজা তার ঘরে ঢেকে। আজ অন্দরের দরজা সে ভেজিয়ে রেখেছে, তাই কি কেউ টোকা দিচ্ছে না ঘরে, ভাবছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে গভীর আড্ডায় মগ্ন সে! আর সুরঞ্জন এত আশাই বা করে কেন? কি করেছে সে এই সংসারের জন্য? কেবল বাইরে বাইরে ঘুরেছে বন্ধুবান্ধব নিয়ে, বাড়ির সবার সঙ্গে যে কোনও কিছু নিয়ে চিৎকার করেছে নয়। উদাসীন থেকেছে। কেবল আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছে। পার্টির যে কোনও নির্দেশ বশংবাদ ভূত্যের মত পালন করেছে। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে মার্কস লেনিনের বই মুখস্থ করেছে। কী লাভ হয়েছে। এতে তার? তার পরিবারের?
হায়দার চলে গেছে, যাক। সুরঞ্জন যাবে না। কেন সে মানব-বন্ধনে যাবে? মানব-বন্ধন তার বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে মুক্তি দেবে তাঁকে? বিশ্বাস হয় না। সুরঞ্জনের আজকাল এরকম হচ্ছে, সব কিছুতে সে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। এই হায়দার, অনেক দিনের বন্ধু তার, দিনের পর দিন যুক্তি বুদ্ধি বিবেকের চর্চা করেছে তারা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছে দেশের মানুষকে, সভ্যতাকে রক্ষণ কক্সবার জন্য, মানবিক মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য তারা কতগুলো বছর পার করেছে। আজ সুরঞ্জনের মনে হচ্ছে কোনও প্রয়োজন ছিল লা। এসবের, তার চেয়ে পেট ভরে মদ খেত, ভি সি আর-এ ছবি দেখাত, ব্লু ফিল্ম দেখাত, ইভ টিজিং-এ মেতে থাকত, অথবা বিয়ে-থা করে প্রচণ্ড বৈষয়িক লোক হয়ে যেত, পিঁয়াজ রসূনের হিসেব কষত, মাছের শরীর টিপে টিপে ভদ্রলোকের মত মাছ কিনে আনত, তাতেই বোধহয় ভাল হত, এত কষ্ট-টষ্ট হত না। সিগারেট ধরায় সুরঞ্জন। টেবিল থেকে চুটি একটি বই টেনে চোখ বুলোয়। নব্বইয়ের সাম্প্রদায়িক সম্রাসের খবর আছে। বইটি কোনওদিন খুলেও দেখেনি সে। আগ্রহ বোধ করেনি। আঙ্গ গভীর মনোযোগ আসে সুরঞ্জনের। তিরিশে অক্টোবর রাত একটা তখন। হঠাত মিছিলের শব্দ শুনে পঞ্চাননধাম আশ্রমের মানুষ জেগে ওঠে। মিছিলকারীরা গেট আর দেওয়াল ভেঙে ঢুকে পড়ে, ঢুকেই গালাগাল করল আশ্রমবাসীদের, কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় পাশের টিনের ছাউনি ঘরে। আশ্রমের লোক ভয়ে এদিক ওদিক পালিয়ে যায়। এক এক করে সব বিগ্ৰহ মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে। সাধুবাবার সমাধিমন্দিরের চুড়া ভেঙে ফেলে, ধর্মের বইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আশ্রমের মধ্যেই ছিল সংস্কৃত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের আলমারি ভেঙে সব বইপত্রে আগুন দেয় এবং টাকা পয়সা সব লুট করে নিয়ে যায়। সদরঘাট কালীবাড়িতে তিরিশে অক্টোবর রাত বারোটায় প্রায় আড়াই হাজার লোক ইট ছুঁড়তে ছুঁড়তে মন্দির প্রধান ফটক ভেঙে সশস্ত্র ভেতরে ঢুকে পড়ে। মূল মন্দিরের ভেক্তর ঢুকে তারা বিগ্রহ ভাঙে, ভারি লোহার রড, খন্তা দিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। চট্টেশ্বরী মায়ের মন্দিরে উঠবার সিঁড়ির দুপাশের দোকান এবং বাড়িঘর ভেঙে লুট করে আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। গোলপাহাড় শ্মশানের সব জিনিস লুট করে নিয়ে যায় রাত সাড়ে এগারোটায়, শ্মশানে আগুন লাগিয়ে দেয়। শ্মশান কালীমূর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। তিরিশে অক্টোবর রাতে ভয়েস অব আমেরিকার খবরের পর সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নগ্ন হামলা চালায় কৈবল্যধাম আশ্রমে। আশ্রমের প্রতিটি দেবপ্রতিকৃতি ভেঙে, প্রতিটি ঘরের জিনিসপত্রে আগুন লাগিয়ে দেয়। আশ্রমের লোক ভয়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেয়। তাদের নাগাল পেলেই মার দেওয়া হয়। কয়েক হাজার লোক মন্দিরের ওপর কয়েকবার আক্রমণ চালায়। লোহার রদ, খন্তা দিয়ে মন্দিরের কাঠামো নষ্ট করে ফেলে। হরগৌরী মন্দিরের ভেতর মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলে, টাকা পয়সা, মূল্যবান জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে যায়। ধর্মগ্রন্থগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয় আগুনে। মন্দিরের আশেপাশের প্রতিটা এলাকা, মালিপাড়ার প্রতিটি পরিবার আকাশের নীচে দিনযাপন করতে বাধ্য হয়, তাদের কিছুই ছিল না সম্বল। চট্টেশ্বরী রোড়ের কৃষ্ণ গোপালজীর মন্দিরে সশস্ত্ৰ লোকেরা আক্রমণ করে রাত নটার দিকে। তারা দুশ ভরি রূপা, পঁচিশ ভরি স্বৰ্ণলঙ্কার সহ বহু মূল্যবান জিনিস লুট করে বিগ্রহ সহ মূল ঘরটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। মন্দিরে ঢুকবার পথে তোরণের ওপর গাড়ীমূর্তিটি ভেঙে ফেলে তাদের শাবলের আঘাতে মন্দিরের পাইনগাছগুলো ভুলুষ্ঠিত হয়। রাস উপলক্ষে বানানো মুর্তিগুলোও রেহাই পায়নি। বদ্দরহাট ইলিয়াস কলোনির প্রতিটি হিন্দু ঘরে লুটতরাজ, ভাঙচুর, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার ওপর অকথ্য শারীরিক নির্যাতন চালায়। সিলিংফ্যানের শাখাগুলো ঘটিকা করে অকেজো করে দেয়।
চট্টগ্রাম শহরের কলেজ রোডের দশভুজা সুগৰ্বিাড়ি, কোরবনিগঞ্জের বরদেশ্বরী কালীমন্দির, চকবাজারের পরমহংস মহাত্মা নরসিংহ মন্দির, উত্তর চান্দগাঁয় বর্ষা কালীবাড়ি, দুর্গা কালীবাড়ি, সদরঘাটের সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, দেওয়ানহাটের দেওয়ানেশ্বরী কালীবাড়ি, কাটঘরের উত্তর পতেংগা শ্মশান কালীবাড়ি, পূর্ব মাদারবাড়ির মগধেশ্বরী বিগ্ৰহ, রক্ষাকালী মন্দির, মোগলটুলির মিলন পরিষদ মন্দির, টাইগার পাসের দুর্গ মন্দির,শিব বাড়ি ও হরিমন্দির, সদরঘাটের রাজ-রাজেশ্বরী ঠাকুরবাড়ি, জালালাবাদের কালীমন্দির, দুৰ্গাবাড়ি, কুল গাঁওর নাপিতপাড়া শ্মশান মন্দির, কাতালগঞ্জের করুণাময়ী কালীমন্দির, চান্দগাঁওর নাথপাড়া জয়কালী মন্দির, নাজিরপাড়ার দয়াময়ী কালীবাড়ি ও মগধেশ্বরী কালীমন্দির, পশ্চিম বাকলিয়ার কালীবাড়ি, কাতালগঞ্জের ব্ৰহ্মময়ী কালীবাড়ি, পশ্চিম বাকলিয়ার বড় বাজার শ্ৰীকৃষ্ণ মন্দির, হিমাংশু দাস, সতীন্দ্র দাশ, রামমােহন দাশ, চণ্ডীচরণ দাশের শিবমন্দির, মনোমোহন দাশের কৃষ্ণমন্দির, নন্দন কাননের তুলসীধাম মন্দির, বন্দর এলাকার দক্ষিণ হালিশহর মন্দির, পাঁচলাইশের গোলপাহাড় মহাশ্মশান ও কালীবাড়ি, আমান আলী রোডের জেলেপাড়া কালীমন্দির, মেডিকেল কলেজ রোডের আনন্দময়ী কালীমন্দিরে লুটপাট, ভাঙচুর আর আগুন ধরানো হয়।
সাতকানিয়ার নলুয়ার বুড়া কালীবাড়ি, জগরিয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি ও দুগামণ্ডপ, দক্ষিণ কাঞ্চনার চণ্ডীমণ্ডপ, মগধেশ্বরী মন্দির, দক্ষিণ চরতির মধ্যপাড়া কালীবাড়ি, মধ্যনলুয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি, চরতির মন্দির, দক্ষিণ চরতির বাণাকপাড়া রূপ কালীবাড়ি ও ধরমন্দির, পশ্চিম মাটিয়াডাঙার জ্বালাকুমারী মন্দির, বাদোনা ডেপুটি হাটের কৃষ্ণহরি মন্দির, বাঙ্গালিয়া দূরনিগড়ের দুরনিগড় মহাবোধি বিহার, বোয়ালখালি কফুল্লখিলের ঐতিহ্যবাহী মিলনমন্দির ও কৃষ্ণ মন্দির, আবুরুদণ্ডীর জগদানন্দ মিশন, পশ্চিম শাকপুরার সার্বজনীন মগধেশ্বরী মন্দির, মধ্য শাকপুরার মোহিনীবাবুর আশ্রম, ধোেরল কালাইয়া হাটের কালীমন্দির, কখুল্লখিলের সার্বজনীন জগদ্ধাত্রী মন্দির, কোক দণ্ডীয় ঋষিধাম অধিপতি, কণুৱলি শাশ্বত চৌধুরীর বিগ্ৰহ মন্দির, মগধেশ্বরী, ধনপােতা, সেবাখেলা, পটিয়ার সার্বজনীন কালীবাড়ি, সাতকানিয়ার নলুয়ার দ্বিজেন্দ্র দাশ, হরিমন্দির ও জগন্নাথ বাড়ি, সাতকানিয়া দক্ষিণ চরতির দক্ষিণপাড়া সার্বজনীন কালীবাড়ি, দক্ষিণ ব্ৰাহ্মণডাঙার সাৰ্বজনীন কালীবাড়ি ভেঙে, লুট করে আগুন জ্বলিয়ে দিয়েছে।
হাটহাজারি উপজেলার মিজাপুর জগন্নাথ আশ্রমে একত্ৰিশে অক্টোবর রাত এগারেটার দিকে একশ সাম্প্রদায়িক লোক চড়াও হয়। আশ্রমের মূর্তিগুলো ওরা আছড়ে ভেঙে ফেলে। জগন্নাথ ঠাকুরের সব অলঙ্কার লুটপাট করে নিয়ে যায়, পরদিন একশ লোক আশ্রমের টিনের ওপর সাদা পাউডার ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরদিন যখন ওরা আসে, পুলিশ দাঁড়িয়েছিল, মিছিল আসতে দেখে পুলিশ সরে যায়। পরে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পুলিশ জ্বদের সীমাবদ্ধতার কথা জানায়। সে রাতেই চল্লিশ পায়তাল্লিশ জন লোক অস্ত্রশস্ত্ৰ নিয়ে মেখল গ্রামে নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা প্রথম এসে কমান্ডো কায়দায় ককটেল ফাটিয়ে হিন্দুদের ভয় ধরিয়ে দেয়। লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেলে ঘরের দরজা জানোলা ভেঙে লুটপাট শুরু করে, ঘরের মূর্তিগুলো ভেঙে চুরমার করে দেয়। পার্বতী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাস্টার মদীননাথের মন্দির এবং মগধেশ্বরী বাড়ির সবগুলো মূর্তি ভেঙে ফেলে।
চন্দনাইশ উপজেলার ধাইরহাট হরিমন্দিরের মূর্তি ভেঙে ফেলে দেয়, জগন্নাথের রথ ভেঙে ফেলে। বড় কল ইউনিয়নের পাঠানদণ্ডীগ্রামে মাতৃ মন্দির এবং রাধাগোবিন্দ মন্দির আক্রমণ করে। বোয়ালখালির চারশ লোক রাত বারোটায় কথুরখিল ইউনিয়নের মিলনমন্দির, হিমাংশু চৌধুরী, পরেশ বিশ্বাস, ভূপাল চৌধুরী, ফণীন্দ্ৰ চৌধুরী, অনুকুল চৌধুরীর বাড়ির মন্দির ভাঙচুর করে। বাঁশখালি উপজেলার প্রাচীন ঋষিধাম আশ্রম ধ্বংস করে দেয়। প্রতিটি ঘর পুড়িয়ে দেয়, বইপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সীতাকুণ্ডের জগন্নাথ আশ্রমে মুসলমান মৌলবাদীরা লাঠি দা খন্তা নিয়ে হামলা চালায় একত্ৰিশে অক্টোবর রাতে। ১২০৮ সালে স্থাপিত বটতলা শ্ৰী শ্ৰী কালীমন্দিরে ঢুকে কালী মুর্তির মাথা ভেঙে ফেলে দিয়ে রূপার মুকুট আর বিগ্রহের সোনার অলঙ্কার লুট করে নিয়ে যায়। চরশরৎ একটি হিন্দুপ্রধান গ্রাম। দুশ তিনশ লোক পয়লা নভেম্বর রাত দশটায় মিছিল করে এসে পুরো গ্ৰাম লুট করে নেয়। যা নিতে পারেনি, পুড়িয়ে দিয়ে গেছে, স্তৃপ ভূপ ছাই ভস্মের বাড়িঘর আর আধাপোড়া নিবাক বৃক্ষরাজি। ওরা যাওয়ার সময় বলে গেছে দশ তারিখের মধ্যে চলে না গেলে সবাইকে মেরে লাশ বানিয়ে দেবে। গ্রাম থেকে যে গরু ছাগল বের হচ্ছিল না সেগুলোকে কুপিয়ে মারা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে ধানের গোলায়। প্রায় ৪০০০ হিন্দু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পঁচাত্তর ভাগ ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে, একজন মরেছে, অসংখ্য গরু ছাগল আগুনে পুড়ে গেছে। অনেক নারী ধর্ষিতা হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। সাতবাড়িয়া গ্রামে রাত সোয়া নটায় প্রায় দুশ লোক লাঠি দা কিরিস লোহার রড নিয়ে জয়রাম মন্দির আক্রমণ করে মন্দিরের প্রতিটি বিগ্ৰহ ভেঙে চুৰ্ণ করে দেয়। হামলার খবর পেয়ে আশেপাশের লোক প্রাণভয়ে চারদিকে ভয়ে পালিয়ে যায়, সে রাতে প্রতিটি পরিবার কাটিয়েছে জঙ্গলে, নয়। ধানক্ষেতে। তারা প্রতিটি বাড়ি লুট করে। সাতবাড়িয়া সার্বজনীন দুৰ্গর্বিাড়ির কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। খেজুরিয়া গ্রামের মন্দির আর বাড়িঘরেও আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। চাষী পরিবারগুলো সর্বস্বাস্ত এখন। শৈলেন্দ্ৰ কুমারের স্ত্রীর গায়ে আগুন লাগিয়েছে, আগুনে ঝলসে গেছে তার শরীর। শিব মন্দিরে যখন ভক্তরা প্রার্থনারত ছিল, তখন কয়েকজন লোক এসে অশ্রাব্য গালাগাল করে, মূর্তি ও আসন ভেঙে দিয়ে তাতে প্রস্রাব করে চলে যায়।
সুরঞ্জনের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। ওদের প্রস্রাব যেন সুরঞ্জনের গায়ে এসে লাগে। সে চটি বইটি ছুড়ে ফেলে দেয়।
পর্ব – ১০
হরিপদ ডাক্তার শিখিয়ে দিয়েছেন হাত পায়ের শক্তি ফিরিয়ে আনতে গেলে কী করে এক্সারসাইজ করতে হবে। মায়া কিরুণাময়ী দুজনই দুবেলা সুধাময়ের হাত পায়ের এক্সারসাইজ করাচ্ছে। সময় করে ওষুধ খাওয়াচ্ছে। মায়ার সেই চঞ্চল স্বভাব হঠাৎ চুপসে গেছে। বাবাকে দেখেছে সে প্রাণবান পুরুষ। আর এখন নিথর শুয়ে আছেন মানুষটি। মায়া মায়া’ বলে যখন জড়ানো কণ্ঠে ডাকেন, বুক ভেঙে যায় মায়ার। অসহায় বোবা দুটো চোেখ কী যেন বলতে চায়। বাবা তাকে মানুষ হতে বলতেন, শুদ্ধ মানুষ। নিজে সৎ ও সাহসী মানুষ ছিলেন। কিরণময়ী মাঝে মধ্যেই বলতেন, মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়ে দিই। সুধাময় রুখে উঠতেন শুনে। বলতেন-’পড়াশুনা করবে, চাকরি-বাকরি করবে, তারপর যদি বিয়ে করতে মন চায়, করবে।’ কিরণময়ী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন–নাকি কলকাতায় ওর মামার কাছে পাঠিয়ে দেব! অঞ্জলি, নীলিমা, স্বাভা, শিবানী, মায়ার বয়সী মেয়েগুলো কলকাতায় পড়াশুনো করতে চলে গেছে। ‘ সুখময় বলতেন—’তাতে কী। এখানে কি পড়ালেখা করবার নিয়ম নেই। স্কুল কলেজ উড়ে গেছে?’
–মেয়ে বড় হয়েছে। রাতে রাতে ঘুম হয় না আমার। বিজয়াকে কলেজ যাবার পথে সেদিন আটকাল না ছেলেরা?
–সে তো মুসলমান মেয়ে হলেও আটকায়। মুসলমান মেয়েরা রেপড হচ্ছে না? তাদের কিডনাপ করা হয় না?
—তা হয়। তবু।
কিরণময়ী বুঝতে পারতেন সুধাময় কিছুতে সায় দেবেন না। বাপের ভিটে না থাক, দেশের মাটি তো আছে পায়ের নীচে। এই তাঁর সান্ত্বনা। মায়ার অবশ্য কলকাতা যাবার কোনও আগ্রহ ছিল ন কখনও। কলকাতা বেড়াতে গিয়েছে সে একবার, মাসির বাড়িতে। ভাল লাগেনি। মাসতুতো বোনগুলো কেমন যেন নাকউঁচু স্বভাবের। তাকে গল্প আড্ডায় কিছুতে নেয় না। সারাদিন একলা বসে সে বাড়ির কথা ভাবত। পুজোর ছুটিতে যাওয়া, অথচ ছুটি শেষ হবার আগেই সে মেসোমশাইকে ধরল—দেশে ফিরব।
মাসি বললেন—সে কি রে, দিদি তো তোকে দশ দিনের জন্য পাঠালেন।
—বাড়ির জন্য মন কাঁদছে।
মায়ার চোখে জল চলে এসেছিল বলতে গিয়ে। কলকাতার পুজোয় অত হৈ হুল্লোড় তার ভালও লাগেনি। সারা শহর ঝকমক করছিল, তবু কী যে এক লাগছিল তার। তা না হলে দশ দিনের জায়গায় সাত দিনের মাথায় সে চলে আসে! কিরণময়ীর ইচ্ছে ছিল ভূভাল লাগলে মায়া থেকে যাবে ওখানে।
সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসে মায়া জাহাঙ্গীরের কথা ভাবে। পারুলের বাড়ি থেকে ফোনে ওর সঙ্গে কথাও হয়েছে দু’বার। জাহাঙ্গীরের কণ্ঠে আগের সেই আবেগ ছিল না। তার চাচা আমেরিকা থাকেন। ওখানে যাবার কথা লিখেছেন তিনি, সে চলে যাবার চেষ্টা করছে। শুনে মায়া প্রায় আর্তনাদ করে উঠল—তুমি চলে যাবে?
—বাহ, আমেরিকার মত জায়গা। যাব না?
—গিয়ে কি করবে?
—আপাতত অড জব করতে হবে। সিটিজেনশিপ পেয়ে যাব একসময়।
—ফিরিবে না দেশে?
–দেশে ফিরে কী করব। এই বাজে দেশে মানুষ থাকতে পারে?
—কবে যাবে ঠিক করেছ?
–সামনের মাসেই। চাচা তাড়া দিচ্ছেন ৷ ভাবছেন এখানে রাজনীতিতে জড়িয়ে আমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।
–ও।
জাহাজীর একবারও বলেনি সে চলে গেলে মায়ার কী হবে–মায়া কি তার সঙ্গে যাবে, নাকি দেশে বসে তার জন্য অপেক্ষা করবে! আমেরিকার স্বপ্ন তার দীর্ঘ চার বছরের প্রেম, রেস্তোরাঁয় ক্রিসেন্ট লেকের ধারে টি এস সি-তে বসে বিয়ের কথা বলা সব একেবারে ভুলিয়ে দিল? প্রাচুর্য আর জৌলুসের মোহ মানুষের এত যে জলজ্যান্ত এক মায়া, তাকে ছেড়ে চলে যাবে জাহাঙ্গীর! সুধাময়ের শিয়রের কাছে বসে মায়ার বারবারই জাহাঙ্গীরের কথা মনে পড়ে। ভুলতে চায় সে, পারে না। সুধাময়ের এই নিথর পড়ে থাকার কষ্টও মায়া একই সঙ্গে ধারণ করছে। কিরণময়ীর কষ্ট বোঝা যায় না। তিনি হঠাৎ হঠাৎ মধ্যরাতে কেঁদে ওঠেন। কেন কাঁদেন, কার জন্য কাঁদেন কিছুই বলেন না। সারাদিন নিঃশব্দে কাজ করেন; রান্না করা, স্বামীর মল মুত্র পরিষ্কার করা সবই নিঃশব্দে।
কিরণময়ী সিঁদুর পরেন না। লোহা শাঁখা কিছুই না। সুধাময় খুলে রাখতে বলেছিলেন একাত্তরে। পঁচাত্তরের পর কিরুণময়ী নিজেই খুলে রাখলেন। পঁচাত্তরের পর সুধাময় নিজেও ধুতি ছেড়েছেন। সাদা লংক্ৰন্থ কিনে তারু খলিফার দোকানে পাজামার মাপ দিয়ে এলেন যেদিন, বাড়ি ফিরে কিরণময়ীকে বলেছিলেন—দেখ তো কিরণ, গা-টা গরম হচ্ছে কি না। জ্বর-জ্বর লাগছে।
কিরণময়ী কথা বলেননি। তিনি জানতেন। সুধাময়ের মন খারাপ হলেই গায়ে জ্বর-জ্বর লাগে।
মায়ার অবাক লাগে, সুরঞ্জন। এ সময়ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকছে। সারাদিন ঘরে গুম হয়ে পড়ে থাকে, খাবে কী খাবে না কিছুই বলে না, বাবা তার আছেন কী মরে গেছেন সে খোঁজও কি নেবার প্রয়োজন নেই তার? ঘরে তার বন্ধুরা আসছে, আড্ডা দিচ্ছে, সে বাইরে থেকে ঘর তালা দিয়ে চলে যাচ্ছে, কখন যাচ্ছে, ফিরবে। কখন কিছুই বলছে না-কিছুই কি দায়িত্ব নেই তার? তার কাছে কেউ তো টাকা পয়সা চাইছে না, ছেলে হিসেবে খোঁজ-খবরটুকু করা, ডাক্তার ডাকা, ওষুধ কেনা, পাশে এসে একটু বসলেও তো মনে জোর পাওয়া যায়। অন্তত সুধাময় তো দাবি করতে পারুেন ছেলের কাছে যে তার বাম হাতখানা একবার এসে স্পর্শ করুক সুরঞ্জন। ডান হাত না হয় অচল, বাম হাতে এখনও তো অনুভবের শক্তি আছে।
হরিপদ ডাক্তারের ওষুধে সুধাময় অনেকটা সুস্থ হচ্ছেন। জড়ানো কথা কমে আসছে। তবে হাত পায়ের চেতন ফেরেনি। ডাক্তার বলেছেন-নিয়মিত ব্যায়াম করলে শিগরি ভাল হয়ে যাকেন। মায়ার তো আর কোনও কাজ নেই। টিউশনিতে যেতে হচ্ছে না। মিনতি নামের এক মেয়ে পড়ত, ওর মা বলে দিয়েছে আর পড়াতে হবে না, ওরা ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছে।
-ইন্ডিয়া কেন? মায়া জিজ্ঞেস করেছিল।
ওর মা বিষণ্ণ হেসেছিল শুধু কিছু বলেনি।
মিনতি ভিখারুন্নেসা স্কুলে পড়ত। একদিন সে মিনতিকে অঙ্ক করাতে গিয়ে লক্ষ করল মিনতি পেন্সিল নাড়ছে আর বলছে আলহামদুলিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আর রাহমানির রাহিম।
মায়া অবাক হয়ে বলেছিল—এসব কি বলছি তুমি?
মিনতি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিয়েছিল—আমাদের এসেম্বলিতে সূরা পড়া হয়।
–তাই নাকি? এসেম্বলিতে সূরা পড়ে ভিখারুন্নেসায়?
—দুটো সূরা পড়া হয়। তারপর জাতীয় সঙ্গীত।
—সূরা যখন পড়ে, কী কর তুমি?
— আমিও পড়ি। মাথায় ওড়না দিই।
—স্কুলে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের জন্য কোনও প্রেয়ার নেই?
–না।
মায়ার যেন কেমন করে উঠেছিল মন। দেশের বড় একটি স্কুলের এসেম্বলিতে মুসলমানের ধর্ম পালন হয়, আর সেই স্কুলের হিন্দু মেয়েদেরও নীরবে সেই ধর্ম পালনে অংশগ্ৰহণ করতে হয়-এ নিশ্চয়ই এক ধরনের অনাচার।
মায়ার আর একটি টিউশনি ছিল, পারুলেরই আত্মীয় হয় মেয়েটি, সুমাইয়া, ও একদিন বলল-দিদি, আপনার কাছে আর পড়ব না।
–কেন?
–আব্বা বলেছেন একজন মুসলমান টিচার রাখবেন।
–ও আচ্ছা।
টিউশনি দুটো যে আর নেই মায়া বাড়ির কাউকে জানায়নি সে কথা। সুরঞ্জন সংসার থেকে নিচ্ছে, এখন মায়াকেও যদি হাত পাততে হয়, কিরণময়ী সামলাবেন কী করে! সংসারের এত বড় একটি দুর্ঘটনার ওপর সে আর এই দুঃসংবাদটি পাড়ে না।
কিরণময়ীও চুপ হয়ে গেছেন। হঠাৎ। নিঃশব্দে দুটো ডাল ভাত রাঁধেন। সুধাময়ের জন্য ফলের রস, সুপ করতে হয়। ফলই বা কে এনে দেবে এত, সুরঞ্জন সারাদিন শুয়ে থাকে, মানুষ এত শুয়ে থাকতে পারে! মায়ার খানিকটা অভিমােনও আছে দাদাকে নিয়ে। সাত তারিখে এত সে বলেছে—দাদা, চল কোথাও যাই বাড়ি ছেড়ে, সে গা করল না। এখনও কি আর বিপদ কেটে গেছে? বাড়ির সবার নির্লিপ্তি দেখে মায়াও অনেকটা নির্লিপ্ত হয়ে গেছে। সেও ভাবতে চাচ্ছে যা হয় হোক আমার কী। সুরঞ্জনই যদি না ভাবে মায়া একা ভেবে কী করবে!! তার তো এমন কোনও বন্ধু নেই। যেখানে সবাই মিলে উঠতে পারে। পারুলের বাড়িতেই তার অস্বত্তি হচ্ছিল। এমনিতে পারুল তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন, দিন রাত ওবাড়িতে কেটেছে তার আড্ডা দিয়ে, কেউ কখনও প্রশ্ন করেনি ও কেন এসেছে। কিন্তু সেদিন, মায়া এত চেনা ওবাড়িতে, তবু ওরা অচেনা চোখে তাকাল তার দিকে, এত যায় সে ওবাড়িতে, তবু চোখে চোখে প্রশ্ন ছিল কেন এসেছে। পারুল অবশ্য বারবারই বলেছে-এ সময় ওর বাড়িতে থাকা নিরাপদ না।
নিরাপদ অনিরাপদের কথা কেবল মায়াকে নিয়ে ওঠে, কই পারুলকে নিয়ে তো ওঠে। না! পারুলকে কি কখনও বাড়ি ছেড়ে মায়ার বাড়িতে উঠতে হবে? মায়া কুষ্ঠিত হয়, কুঞ্চিত হয়, তবু বেঁচে থাকবার প্রয়োজনে সে পারুলের বাড়িতেই অবাঞ্ছিত অতিথির মত পড়ে থেকেছে। পারুল আতিথেয়তা কম করেনি তবু তার আত্মীয়রা বেড়াতে এসে অনেকেই যখন জিজ্ঞেস করেছে–কী নাম তোমার?
—মায়া।
-পুরো নাম কি?
পারুল মায়াকে পুরো নাম বলতে না দিয়ে নিজে বলেছে–ওর নাম জাকিয়া সুলতানা।
মায়া চমকেছে নাম শুনে। পরে আত্মীয়রা বিদেয় হলে পারুল বলেছে—তোর নাম মিথ্যে বলতে হল, কারণ এরা আবার অন্যরকম, মুন্সি টাইপের। বলে বেড়াবে আমরা হিন্দুদের শেল্টার দিচ্ছি।
–ও।
মায়া বুঝেছে। কিন্তু মনে খুব কষ্ট হয়েছে তার। হিন্দুকে শেল্টার দেওয়া বুঝি অন্যায় কাজ? আর আরেকটি প্রশ্নও তাকে প্রায় রাতেই ঘুমোতে দেয়নি যে হিন্দুকে কেন শেল্টার দিতে হয়? মায়া ইন্টারমিডিয়েট স্টার পাওয়া মেয়ে, আর পারুল সাধারণ দ্বিতীয় বিভাগ। তবু প্রায়ই মনে হয় পারুল বুঝি তাকে করুণা করছে।
–বাবা, আঙুলগুলোকে মুঠি কর তো। হাত একটু ভুলতে চেষ্টা করে তো।
মায়ার কথা লক্ষ্মী ছেলের মত শোনেন সুধাময়। মায়ার মনে হয় একটু একটু জোর ফিরছে। সুধাময়ের আঙুলে।
–দাদা কি খাবে না?
—কি জানি, ঘুমোচ্ছে দেখলাম। কিরণময়ী বিরস মুখে বলেন।
কিরণময়ী নিজে খান না। মায়ার জন্য ভাত বেড়ে রাখেন। দরজা জানোলা বন্ধ করা ঘর, আঁধার আঁধার লাগে। মায়ারও ঘুম ঘুম লাগে। হঠাৎ আধা-স্কুমেই চমকে ওঠে মিছিলের শব্দ শুনে। মিছিল যায়-হিন্দু যদি বাঁচতে চাও, এ দেশ ছেড়ে চলে যাও। ‘ সুধাময়ও শোনেন, মায়ার হাতে ধরা ছিল সুধাময়ের হাত, হাতটি তার কেঁপে ওঠে, সে টের পায়।
৪ঘ.
সুরঞ্জনের পেট মোচড় দিয়ে ওঠে ক্ষিদেয়। আগে তো খাক না খাক টেবিলে তার ভাত বাড়া থাকত। সে আজ কারও কাছেই বলবে না ক্ষিদের কথা। পাকা উঠোনের কলতলায় গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে তারে ঝোলানো তোয়ালে দিয়ে মুখ মেছে। ঘরে এসে শার্ট পাল্টে বেরিয়ে যায় বাইরে। বাইরে যে বেরোয় সে ভেবে পায় না যাবে কোথায়? হায়দারের বাড়িতে? হায়দারের তো এ সময় বাড়ি থাকবার কথা নয়। তবে কি বেলাল, কামাল কারও বাড়িতে? সুরঞ্জন এদের বাড়িতে গেলে ওরা যদি ভাবে বিপদে পড়েছে বলে এসেছে আশ্রয় বা অনুকম্প চাইতে? না সুরঞ্জন যাবে না। সে সারা শহর ঘুরে বেড়াবে একা একা। শহরটি তো তার নিজেরই। একসময় সে ময়মনসিংহ ছেড়ে আসতে চায়নি, আনন্দমোহনে বন্ধুবান্ধব ছিল প্রচুর, ওদের ছেড়ে হঠাৎ করে নতুন একটি শহরে কেন আসতে চাইবে সে। কিন্তু কোনও এক গভীর রাতে রইসউদ্দিনের কাছে বাড়ি যখন বিক্রি করে এলেন সুধাময়, তার পরদিন ভোরে সুরঞ্জন জানত না তার জন্মের এই বাড়িটি, কামিনী ফুলের গন্ধ ভরা, স্বচ্ছ পুকুরে সাঁতার কাটা দত্ত বাড়িটি আর তাদের নেই। সুরঞ্জন যখন শুনল এ বাড়ি তাদের ছেড়ে দিতে হবে সাত দিনের মধ্যে, অভিমানে সে বাড়িই ফেরেনি দুদিন।
সুরঞ্জন বুঝে পায় না। এত অভিমান কেন তার। বাড়ির সবার ওপর তা ছাড়া নিজের ওপরও মাঝে মধ্যেই তার তীব্র অভিমান হয়। পারভিনের ওপরও অভিমান হত তার। মেয়েটি তাকে ভালবাসত, লুকিয়ে চলে আসত তার ঘরে, বলত–চল পালাই।
–পালিয়ে যাবে কোথায়?
—দুরে কোনও পাহাড়ের কাছে।
—পাহাড় পাবে কোথায়? পাহাড় পেতে হলে সিলেট নয় চট্টগ্রাম যেতে হয়।
–তাই যাব। পাহাড়ের ওপর ঘর বানিয়ে থাকব।
—খাবে কি? লতাপাতা?
পারভিন হেসে গড়িয়ে পড়ত সুরঞ্জনের গায়ে। বলত—তোমাকে ছাড়া আমি মরেই যাব।
–এরকম কথা মেয়েরা বলে, আসলে কিন্তু মরে না।
ঠিকই তো বলেছিল সুরঞ্জন। পারভিন মরেনি। বরং বাধ্য মেয়ের মত বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিল। বিয়ের দুদিন আগে জানিয়েছিল, বাড়িতে বলছে তোমাকে মুসলমান হতে হবে। সুরঞ্জন হেসে বলেছিল–আমি নিজে ধর্ম টর্ম মানি না। সে তো তুমি জানোই।
—না তোমাকে মুসলমান হতে হবে।
—আমি মুসলমান হতে চাই না।
–তার মানে তুমি আমাকে চাও না?
–নিশ্চয়ই চাই। কিন্তু সেজন্য আমাকে মুসলমান হতে হবে এ কেমন কথা?
পারভিনের ফর্সা মুখ মুহুর্তে লাল হয়ে উঠেছিল অপমানে। সুরঞ্জন জানত তাকে ত্যাগ করবার জন্য পরিবার থেকে পারভিনের ওপর চাপ আসছে। তার খুব জানতে ইচ্ছে করে হায়দার তখন কোন পক্ষে ছিল। হায়দার পারভিনের ভাই, এদিকে আবার সুরঞ্জনের বন্ধু। সে সব সময় নীরব থেকেছে৷ তাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। নীরব থাকাটা সুরঞ্জনের তখন একদমই পছন্দ ছিল না। যে কোনও একটি পক্ষ তো নেওয়া উচিত। হায়দারের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডাগু হত তখন, পারভিন প্রসঙ্গে কোনও কথা হত না। হায়দার যেহেতু প্রসঙ্গ তুলত না, সুরঞ্জনও তুলত না।
পারভিনের একদিন বিয়ে হয়ে গেল এক মুসলমান ব্যবসায়ীর সঙ্গে। সুরঞ্জন যেহেতু মুসলমান হল না সম্ভবত পারভিনও তাই তাকে নিয়ে পাহাড়ে যাবার স্বল্প বিসর্জন দিল। স্বল্প কি এত সহজে পুজোর মূর্তির মত হাসি আনন্দ শেষ হলে ভাসিয়ে দেওয়া যায় জলে! পারভিন যেমন দিয়েছিল? সুরঞ্জনের ধর্মই প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল পারভিনের পরিবারে।
আজ সকালে হায়দার বলেছে–পারভিন বোধহয় ডিভোর্স দেবে তার হাসবেন্ডকে।
দু বছরের মধ্যেই ডিভোর্স? সুরঞ্জন বলতে চেয়েও বলেনি। সে পারভিনকে তো ভুলেই গিয়েছিল, তবু ডিভোর্সের খবরটি শুনে বুকের মধ্যে ধ্বক করে ওঠে। পারভিন নামটি কি খুব যত্ন করে বুকের সিন্দুকে রাখা নেপথলিন দিয়ে? বোধহয়। কতদিন সে পারভিনকে দেখে না। বুকের ভেতর কষ্ট মোচড় দিয়ে ওঠে। সে ইচ্ছে করেই রত্নীর মুখটি মনে করে। রত্না মিত্র। মেয়েটি চমৎকার। সুরঞ্জনের সঙ্গে মানাবেও ভাল। পারভিন ডিভোর্স দেবে তাতে সুরঞ্জনের কী। মুসলমানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, পরিবারের পছন্দের বিয়ে, জাত ধর্ম মিললেই বুঝি বিয়ে টেকে? তবে ফেরত আসতে হয় কেন এখন? পাহাড়ে ওঠেনি। স্বামী তাকে নিয়ে? স্বপ্ন পূরণ করেনি? সে বেকার হিন্দু ছেলে, উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, সে কি আর বিয়ের পাত্র হিসেবে ভাল? সুরঞ্জন একটি ক্লিক্সা নেয় টিকাটুলির মোড়ে উঠে। বুকের সিন্দুক থেকে আরশোলার মত বারবারই লাফিয়ে উঠছে পারভিনের মুখ। পারভিন তাকে চুমু খেত, সে পারভিনকে জড়িয়ে ধরে বলত–তুমি একটা পাখি, চড়ুইপাখি।
পারভিন হেসে গড়িয়ে পড়ত, বলত–তুমি একটা বানর।
আচ্ছা সে কি আসলেই একটা বানর? বানর না হলে পাঁচ বছরে সে যা ছিল তাই কি আর থেকে যায়। বয়স ভেসে গেছে। কচুরিপানার মত, তার পাওয়া হয়নি কিছু। কেউ এসে পারভিনের মত বলেনি-তোমাকে খুব ভাল লাগে আমার। পারভিন যেদিন এই কথা বলেছিল, পারভিনকে সেদিন সে বলেছিল—কারও সঙ্গে বাজি হয়েছে বুঝি?
–মানে?
–এই কথাটি আমাকে বলতে পারো কি না এই নিয়ে?
–মোটেও না।
—তবে কি মন থেকে বলছি?
–আমি মন থেকে ছাড়া কথা বলি না।
সেই ঘাড় শক্ত মেয়েটি বাড়িতে বিয়ের কথা উঠল আর ভেঙে পড়তে লাগল, উৰে গেল তার অদ্ভুত অদ্ভুত স্বল্প আর মন যা চাইবে তা করবার ইচ্ছে। তাকে ধরে বেঁধে যেদিন বিয়ে দিয়ে দিল, পারভিন তো একবারও বলেনি। আমি ওবাড়ির বানরকে বিয়ে করব। দু বাড়ি পার হলেই হায়দারদের বাড়ি, বিয়েতে মায়া গিয়েছিল, কিরণময়ীও, সুরঞ্জন যায়নি।
রিক্সাকে চামেলিবাগের দিকে যেতে বলে। সন্ধে নামছে। ক্ষিদেয় পেট কামড়াচ্ছে। বুক জ্বলা রোগ তার আছেই, টক ঢেকুর ওঠে। সুধাময় এন্টাসিড খেতে বলেন। ঠোঁট সাদা করে ট্যাবলেট খেতে তার বিচ্ছিরি লাগে! তা ছাড়া মনেও থাকে না পকেটে ওষুধ নিয়ে বেরোতে। পুলকের বাড়ি গিয়ে কিছু খেতে হবে। পুলককে ঘরেই পাওয়া যায়। সে পাঁচ দিন ঘর বন্দি, দরজায় তালা দিয়ে ঘরে বসে থাকে। ঘরে ঢুকেই সুরঞ্জন বলে—কিছু খাবার দাও। বাড়িতে বোধহয় রান্না-টান্না কিছু হয়নি আজ।
–কেন রান্না হয়নি?
–ডাঃ সুধাময় দত্তের ষ্ট্রেক হয়েছে। তাঁর স্ত্রী কন্যা আপাতত তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত। এককালের ধনাঢ্য সুকুমার দত্তের পুত্র সুধাময় দত্ত এখন নিজের চিকিৎসার খরচ যোগাতে পারেন না।
–আসলে তোমার কিছু করা উচিত ছিল। চাকরি টাকরি।
–মুসলমানের দেশে চাকরি পাওয়া খুব কঠিন। আর এই মূর্খদের আন্ডারে চাকরি করব কি বল!
পুলক বিস্মিত হয়, সুরঞ্জনের আরও কাছে সরে আসে, বলে–তুমি মুসলমানদের গাল দিচ্ছ সুরঞ্জন?
–ভয় পাচ্ছ কেন? গাল তো তোমার সামনে দিচ্ছি, ওদের সামনে তো আর দিচ্ছি। না। সামনে ওদের গাল দেওয়া কি সম্ভব? ধড়ে কি তবে মুণ্ডুটি থাকবে?
সুরঞ্জন দাঁতে দাঁত চেপে সোফার হাতলটি চেপে ধরে। পুলকও কেমন হতভম্ব বসে থাকে। নীলা ভাত তরকারি গরম করে টেবিলে দেয়। কষ্ট-কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে–সুরঞ্জনদা, সারাদিন কিছুই খাননি?
সুরঞ্জন ম্লান হাসে। বলে–আমার আবার খাওয়া। আমার খাওয়ার জন্য ভাবে কে বল।
—বিয়ে-টিয়ে করে নেন।
–বিয়ে? সুরঞ্জন বিষম খায়। —আমাকে কে করবে বিয়ে?
—সেই পারভিনের কারণে বিয়ে থেকেই মন উঠে গেল? এ কিন্তু ঠিক না।
—না না। তা হবে কেন? আসলে বিয়ে যে করতে হবে এ আমি এতদিন ভুলেই বসেছিলাম।
কষ্টের মধ্যেও পুলক আর নীলা হাসে।
সূরঞ্জনের তেমন রুচি নেই খাবারে। তবু সে ক্ষিদেটাকে চাপা দেবার জন্য খায়।
—আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবে পুলক? খেতে খেতেই সে জিজ্ঞেস করে।
–কত টাকা?
—যত পারে। বাড়িতে কেউ আমাকে কিছু জানাচ্ছে না। টাকা পয়সা দরকার কি না। কিন্তু টের পাচ্ছি মা’র হাত খালি।
–তা না হয় দিচ্ছি। দেশের খবর জানো তো? ভোলার, চট্টগ্রামের, সিলেটের? কক্সবাজারের? পিরোজপুরের?
–এই তো বলবে যে সব মন্দির ভেঙে গুড়িয়ে ফেলেছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুট করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। পুরুষদের মেরেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে। এ ছাড়া নতুন কোনও খবর থাকলে বল।
—এগুলো তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
—নিশ্চয় স্বাভাবিক। কী আশা কর তুমি এই দেশ থেকে? পিঠ পেতে বসে থাকবে আর তারা কিল দিলে গোসা করবে, এ তো ঠিক নয়।
খাবার টেবিলে সুরঞ্জনের মুখোমুখি চেয়ারে বসে পুলক। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলে—সিলেটে চৈতন্যদেবের বাড়িটি পুড়িয়ে দিয়েছে। পুরনো লাইব্রেরীটিও রাখেনি। সিলেট থেকে আমার দাদা এসেছে। কালীঘাট কালীবাড়ি, শিকবাড়ি, জগন্নাথ আখড়া, চালি বন্দর ভৈরব বাড়ি, চালি বন্দর শ্মশান, ষন্তরীপুর মহাপ্রভুর আখড়া, মীরা বাজার রামকৃষ্ণ মিশন, মীরা বাজার বলরামের আখড়া, নির্মলবালা ছাত্রাবাস, বন্দর বাজার ব্রাহ্ম মন্দির, জিন্দাবাজার জগন্নাথের আখড়া, গোবিন্দজীর আখড়া, লামা বাজার নরসিংহের আখড়া, নয়া সড়ক আখড়া, দেবপুর আখড়া, টিলাগড় দুৰ্গাবাড়ি, বিয়ানি বাজার কালীবাড়ি, ঢাকা দক্ষিণ মহাপ্রভুর বাড়ি, গোটাটিকর শিব বাড়ি, মহালক্ষ্মী বাড়ি মহাপীঠ, ফেঞ্চুগঞ্জ, সারকারখানা দুৰ্গর্বিাড়ি, বিশ্বনাথে শাজিবাড়ি, বৈরাগী বাজার আখড়া, চন্দগ্রাম শিব মন্দির, আকিলাপুর আখড়া, কোম্পানিগঞ্জ জীবনপুর কালীবাড়ি, বালাগঞ্জ যোগীপুর কালীবাড়ি, জকিগঞ্জ আমলসী কালীমন্দির, বারহাটা আখড়া, গাজীপুর আখড়া, বীরশ্ৰী আখড়া ভেঙে আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। বেণুভূষণ দাস, সুনীল কুমার দাস, কানুভুষণ দাস আগুনে পুড়েছে।
—তাই নাকি?
—ক’ত যে কাণ্ড হচ্ছে সুরঞ্জন, আমরা এ দেশে থাকব কি করে বুঝি না। চট্টগ্রামে তো জামাত আর বি এন পি মিলে বাড়িঘর মন্দির পুড়িয়েছে। হিন্দুদের ঘটিবাটি, পুকুরের মাছ পর্যন্ত ধরে নিয়ে যাচ্ছে ওরা। সাত-আট দিন পেটে ভাত নেই হিন্দুদের। সীতাকুণ্ডের খাজুরিয়া গ্রামের কানুবিহারী নাথ আর তার ছেলে অৰ্জ্জুন বিহারী নাথের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে জামাত শিবিরের লোকেরা বলেছে বিশ হাজার টাকা না দিতে পারলে বাড়িতে থাকতে দেওয়া হবে না। তারা বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। মীরেরসরাই কলেজের অধ্যাপকের মেয়ে উৎপলা রানী ভৌমিককে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নিয়ে যায়, ফেরত দেয় শেষ রাতে। আচ্ছা বল তো এসবের প্রতিবাদ কি আমরা করব না?
—করলে কি হবে জানো? ডি এল রায়ের কবিতাটা জানো তো, আমি যদি পিঠে তোর ঐ লাথি একটা মারিই রাগে, তোর তো স্পর্ধা বড় পিঠে যে তোর ব্যথা লাগে?
সুরঞ্জন সোফায় হেলান দেয়। চোখ বোজে।
–ভোলায় তো কয়েক হাজার বাড়ি লুট হয়েছে, কয়েক হাজার বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আজ সকালে কার্ফ ভেঙেছিল বারো ঘন্টার জন্য। তিনশ লোক শাবল কুড়াল নিয়ে লক্ষ্মী নারায়ণ আখড়ায় থার্ড টাইম হামলা করে। পুলিশ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বোরহানউদ্দিনে দেড় হাজারের বেশি ছাই হয়ে গেছে। দু হাজার বাড়ির ক্ষতি হয়েছে। তজমুদ্দিনে ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে দু হাজার দুশ, অর্ধেক ধ্বংস দু হাজার। ভোলায় মন্দির ধ্বংস করেছে। দুশ ষাটটি।
সুরঞ্জন হেসে বলে—একদমে রিপোর্টারের মত কথা বলে গেলে। তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে এসব ঘটনায়?
পুলক অবাক চোখে তাকায় সুরঞ্জনের দিকে। বলে—তোমার কষ্ট হচ্ছে না?
সুরঞ্জন ঘর কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। বলে—একবিন্দু না। কষ্ট হবে কেন?
পুলক সামান্য চিন্তিত হয়। বলে—আসলে ওদিকে আমার অনেক আত্মীয় আছেন তো, খুব ভাবনা হচ্ছে ওদের জন্য।
—মুসলমানের কাজ মুসলমান করেছে, আগুন দিয়েছে ঘরে, তাই বলে কি মুসলমানের ঘর পোড়ানো হিন্দুর শোভা পায়? তোমাকে আমি কোনও রকম সাল্কনা দিতে পারছি না পুলক। আই অ্যাম সরি।
পুলক দু হাজার টাকা ভেতর ঘর থেকে নিয়ে সুরঞ্জনের হাতে দেয়। টাকা কটি পকেটে পুরে সুরঞ্জন বলে–অলকের খবর কি, খেলায় নিয়েছে। ওকে?
–না। সারাদিন সে মন খারাপ করে ঘরে বসে থাকে। করার কিছু নেই। ও জানোলা দিয়ে দেখছে ওর বন্ধুরা মাঠে খেলছে। ও একা একা ঘরে ছটফট করে।
—শোন পুলক, যাদের অসাম্প্রদায়িক ভাবি, নিজেদের মানুষ ভাবি, বন্ধু ভাবি, তারা ভেতরে ভেতরে সাম্প্রদায়িক। এ দেশের মুসলমানের সঙ্গে এমন ভাবে মিশেছি যে আমরা এখন অনর্গল আসসালামু আলায়কুম বলি, খোদা হাফেজ বলি, জলকে পানি বলি, স্নানকে গোসল বলি, যাদের রমজান মাসে আমরা বাইরে চা সিগারেট খাই না, এমন কি প্রয়োজনে হোটেল রেস্তোরাঁয় খেতে পারি না দিনের বেলা, তারা আসলে আমাদের কতটুকু আপন? কাদের জন্য আমাদের এই স্যাক্রিাফাইস, বল? পুজোয় কদিন ছুটি পাই? আর দুটো ঈদে তো সরকারি হাসপাতালগুলোয় ঘাড় ধরে হিন্দুদের দিয়ে কাজ করানো হয়। অষ্টম সংশোধনী হয়ে গেল, আওয়ামি লিগ কদিন চেঁচালো ব্যাস, হাসিনা নিজেই তো এখন মাথা ঢেকেছে ঘোমটায়। হজ্ব করে আসার পর চুল দেখা যায় না। এমন ঘোমটাই দিয়েছিল। সবার চরিত্র এক পুলক, সবার। এখন আমাদের সবার হয় আত্মহত্যা করতে হবে, নয় দেশ ছাড়তে হবে।
পুলক দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুরঞ্জন দরজার দিকে এগোয়। কিরণময়ী একবার বলেছিল ময়মনসিংহে রইসউদ্দিনের কাছে একবার যেতে, এত অল্প টাকায় বাড়িটি নিয়েছেন, তিনি যদি এ সময় কিছু সাহায্য করেন। সুরঞ্জন টাকা ধার চায় না কারও কাছে। মুন্দির দোকানে বাকি পড়ে, মাস শেষে দিয়ে দেয়। পুলকের কাছে সে সহজে চাইতে পেরেছে। সম্ভবত একসময় তাকে দিয়েছে সে, সে কারণে, এও হতে পারে পুলক হিন্দু ছেলে, সে যত বুঝবে সংখ্যালঘুর কষ্ট, তত আর কেউ বুঝবে না। অন্যদের কাছে চাইলে হয়ত দেবে কিন্তু মন থেকে দেবে না। সুরঞ্জন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবার সে কেনিও মুসলমানের কাছে হাত পাতবে না। বাড়ি থেকে তাকে কোনও দায়িত্ব দিচ্ছে না কেউ। ভাবছে দেশপ্রেমিক ছেলে, দেশের মঙ্গল চিন্তায় দিনরাত খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করছে, একে খামোক বিরক্ত করে কী লাভ। টাকা কটি সে কিরণময়ীর হাতে দেবে। কী করে যে সংসারের হাল ধরে আছে মানুষটি, কারও প্রতি তার কোনও অভিযোগ নেই। অকৰ্মণ্য ছেলেটির প্রতিও। এত যে দারিদ্র গেছে, তিনি কোনও দিন বিরক্ত হননি।
পুলকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে হনহন হাঁটতে থাকে টিকাটুলির দিকে। তার হঠাৎ মনে হয় কী লাভ মানুষের বেঁচে থেকে। এই যে সুধাময় বেঁচে আছেন ধুঁকে ধুঁকে, তাঁকে অন্যরা পেচ্ছাব পায়খানা করাচ্ছে, খাওয়াচ্ছে দাওয়াচ্ছে, কী লাভ তার এরকম বেঁচে থেকে? সুরঞ্জনই বা কেন বেঁচে আছে। একবার ভাবে টাকা তো আছেই প্যান্টের পকেটে, কয়েক এস্পপুল পেথিডিন কিনে একবার পুশ করলে কেমন হয় শিরায়। মরে যাবার ব্যাপারটি সে বেশ উপভোগ করে। মরে গেলে, ধরা যাক বিছানায় শুয়ে মরে পড়ে আছে, বাড়ির কেউ জানবে না, ভাববে ঘুমিয়ে আছে ছেলে, তাকে বিরক্ত করা ঠিক নয়। একসময় মায়া হয়ত ডাকতে আসবে, দাদা ওঠ, বাবার জন্য আমাদের জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা কর, দাদা তখন আর সাডা দেবে না। এরকম সে ভাবছে যখন, তখনই বিজয় নগরের মোড়ে দেখে মিছিল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিছিল। হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই জাতীয় শ্লোগান। সুরঞ্জনের ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি খেলে যায়।
বাড়ি যাবার আগে সে গৌতমের বাড়ি যায়। গৌতম শুয়ে ছিল। আগের চেয়ে ভাল এখন। কিন্তু তার চোখে মুখে সেই আশঙ্কাটুকু আছেই। কোথাও শব্দ হলে চমকে ওঠে। সাদাসিধে ছেলে, মেডিকেলে পড়ে, রাজনীতি করে না, পাড়ায় শত্ৰু নেই কোনও, আর তাকেই মার খেতে হল, ভারতের বাবরি মসজিদ কোন ভাঙল সেই অপরাধে!
গৌতমের মা কাছেই বসেছিলেন। কেউ যেন না শোনে এমন সতর্ক কণ্ঠে বললেন–বাবা, আমরা তো চলে যাচ্ছি।
–চলে যাচ্ছেন? সুরঞ্জন চমকে ওঠে।
–হ্যাঁ, বাড়ি বিক্রি করার ব্যবস্থা হচ্ছে।
ওরা কোথায় চলে যাবে তা আর শুনতে ইচ্ছে করে না। সুরঞ্জনের। সে জিজ্ঞেসও করে। না। ওরা কি দেশ ছেড়ে চলে যাবে? বসে থাকলে এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি সুরঞ্জনকে শুনতে হবে বলে সে হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে পড়ে। বলে-যাই। গৌতমের মা বলেন, বস বাবা, যাবার আগে আর দেখা হয়। কিনা। দুটো কথা বলি বস। তাঁর কণ্ঠে দলা পাকানো কান্না।
–না মাসি, বাড়িতে কাজ আছে, যাই। আরেকদিন না হয় আসব।
সুরঞ্জন না মাসির দিকে তাকায়, না গীেতমের দিকে। চোখ নামিয়ে চলে যায়। সে একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করতে চায়, পারে না।
Tags – Lojja, Bangla Golpo, lajja