Lojja By Taslima Nasrin (লজ্জা পর্ব – 11) Lajja PDF
পর্ব – ১১
বিরূপাক্ষ সুরঞ্জনের পার্টির ছেলে। নতুন ঢুকেছে। বেশ মেধাবী ছেলে। সুরঞ্জন তখনও বিছনা ছাড়েনি, বিরূপাক্ষ ঢোকে।
—দশটা বাজে এখনও ঘুমোচ্ছেন?
–ঘুমোচ্ছি। কই। শুয়ে আছি। কিছুই করার না থাকলে শুয়ে থাকতেই হয়। আমাদের তো আর মসজিদ ভাঙার সাহস নেই। তাই শুয়ে থাকতেই হবে।
–ঠিকই বলেছেন। শত শত মন্দির ভাঙছে ওরা। যদি আমরা একটা চিল ছুঁড়ি কোনও মসজিদে, কী উপায় হবে! চারশ বছরের পুরনো রমনা কালীবাড়িটি পাকিস্তানিরা ধুলোয় মিশিয়ে দিল, কোনও সরকারই তো বলেনি ওটি গড়ে দেবে!
—হাসিনা বার বার বলছেন বাবরি মসজিদ পুনর্নির্মাণের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের হিন্দুদের ক্ষতিপূরণের কথা বললেও ভাঙা মন্দির পুনর্নির্মাণের কথা কিন্তু একবারও বলেননি। বাংলাদেশের হিন্দুরা বানের জলে ভেসে আসেনি। তারা এ দেশের নাগরিক। তাদের বেঁচে থাকবার অধিকার, নিজের জীবন, সম্পত্তি, উপাসনালয় রক্ষা করবার অধিকার কারও চেয়ে কম নয়।
–কেবল কি বাবরি মসজিদ ইস্যু নিয়ে ওরা লুটপাট ভাঙচুর করে? বিরানব্বইয়ের একুশে মার্চ ভোরবেলা বাগেরহাটের বিশারিহাটা গ্ৰাম থেকে কলিন্দ্রনাথ হালদারের মেয়ে পুতুল রানীকে ওই এলাকারই মোখলেসুর রহমান আর চাঁদ মিয়া তালুকদার কিডন্যাপ করেছে। পটুয়াখালির বগা ইউনিয়নের ইউ পি চেয়ারম্যান ইউনুস মিয়া আর ইউ পি সদস্য নবী আলি মৃধার অত্যাচারে গ্রামের মণি আর কানাই লালের পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। রাজনগর গ্রামের বীরেনের জমি দখল করার জন্য বীরেনকে ধরে নিয়ে যায়, আজও বীরেনের কোনও খবর পাওয়া যায়নি। সুধীরের জায়গা জমি দখল করার জন্য অত্যাচার চালালে সুধীরও দেশ ত্যাগ করে। সাবুপুরা গ্রামের চন্দন শীলকে চেয়ারম্যান নিজেই ধরে নিয়ে যায়। আজও তার কোনও খোঁজ নেই। বামনকাঠি গ্রামের দীনেশের কাছ থেকে জোর করে সাদা স্ট্যাম্পে সই নিয়েছে। বগা গ্রামের চিত্তরঞ্জন চক্রবতীর ক্ষেতের ধান কেটে নিয়ে যায়। চিত্তবাবু মামলা করলে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। এমনকি মেরে ফেলার হুমকিও দিচ্ছে।
Lajja By Taslima Nasrin
সুরঞ্জন সিগারেট ধরায়। বিরূপক্ষের আলোচনায় সে অংশ নিতে চায় না। তবু সে লক্ষ করে অল্প অল্প জড়িয়ে যাচ্ছে ঘটনায়। সিগারেট ঠোঁটে চেপে সে বলে-পিয়লা এপ্রিল স্বপন চন্দ্ৰ ঘোষের নিউ জলখাবারে সাত-আটজন লোক পিস্তল দেখিয়ে দশ হাজার টাকা চাঁদা চায়। চাঁদা না পেয়ে দোকানের কর্মচারীদের পেটাতে শুরু করে। পিটিয়ে ক্যাশ ভেঙে বিশ হাজার টাকা নিয়ে যায়। অবশ্য এসব ঘটনা মুসলমানদের দোকানেও ঘটছে। চাঁদাবাজাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছে। তারপর ধর সিদ্দিক বাজারের মানিক লাল থুপীর নিজস্ব সম্পত্তির অর্ধেক অংশ এলাকার সাহাবুদ্দিন, সিরাজ, পারভেজ, সালাউদ্দিন এরা জোর করে দখল করে নিয়েছে। এখন তারা মানিক লালের পুরো সম্পত্তি নিয়ে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে।
সুরঞ্জন কিছুক্ষণ থেমে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—ধান কেটে নেওয়া, মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া, রেপ করা, জমি দখল, মেরে ফেলার হুমকি, পিটিয়ে বাড়ি ছাড়া করা, দেশ ছাড়া করা এসব কি আর এদিক সেদিক উদাহরণ দিয়ে হবে! এ তো সারা দেশ জুড়ে হচ্ছে। আমরা আর কটা অত্যাচারের খবর রাখি, দেশত্যাগের খবর আর কটা রাখি, বল।
—নোয়াখালির সেনাবাগে কৃষ্ণলাল দাসের বউ স্বর্ণবালা দাসকে আবুল কালাম মুলি, আবুল কাশেম সহ কয়েকজন কিডন্যাপ করে, রেপ করে, তারপর অজ্ঞান অবস্থায় বাড়ির পাশের ধানক্ষেতে ফেলে রেখে যায়। বিরূপাক্ষ বলে।
সুরঞ্জন বিছানা ছেড়ে কালতলায় যায়। মুখ ধুতে গিয়ে কিরণময়ীকে দুটো চায়ের কথা বলে। কাল রাতে কিরণময়ীর হাতে সে দু হাজার টাকা দিয়েছে। সুতরাং ছেলে যে একেবারই দায়িত্বজ্ঞানহীন এ কথা নিশ্চয়ই বলবেন না। তিনি। কিরণময়ীকে অন্য দিনের তুলনায় ফ্রেশ লাগছে। সম্ভবত অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা ঘুচেছে বলে। বিরূপাক্ষ শুকনো মুখে চেয়ারে বসেছিল। সুরঞ্জন ঘুরে ঢুকেই বলে–চিয়ার আপ, চিয়ার আপ।
বিরূপাক্ষ ম্লান হাসে। সুরঞ্জনেরও আজ অনেকটা তাজা লাগছে হাত পা। সুধাময়ের ঘরে একবার টু দিয়ে আসবার কথা ভাবে সে। এর মধ্যেই চা চলে আসে। মায়া নিয়ে আসে দু কাপ চা ৷
–কিরে তুই এ ক’দিনে বেশ শুকিয়ে গেছিস মনে হচ্ছে। পারুলের বাড়িতে খাওয়া-টাওয়া দেয়নি বুঝি? মায়া কোনও উত্তর না দিয়ে চলে যায়। সুরঞ্জনের এই রসিকত্ৰা সে গায়ে মাখে না। সুধাময় অসুস্থ। এ সময় এমন হাস্যরস করা বোধহয় উচিত হয়নি সুরঞ্জনের। মায়ার নীরবতা তাকে খানিকটা ভাবায়।
এই ভাবনা থেকে বিরূপাক্ষ তাকে সরিয়ে আনে। সে চা পান করতে করতে বলে—সুরঞ্জনদা, আপনি তো ধর্ম মানেন না। পুজো করেন না, গরুর মাংস খান, মুসলমানদের বলুন আপনি সত্যিকার হিন্দু নন, অর্ধেক মুসলমান।
—আমি যে সত্যিকার মানুষ, ওদের আপত্তি তো ওখানেই। উগ্ৰ মৌলবাদী হিন্দু আর মুসলমানে কোনও বিরোধ নেই। এখানকার জামাত নেতার সঙ্গে ভারতের বি জে পি নেতাঙ্গের বন্ধুত্ব দেখছ না? দুই দেশে দুই মৌলবাদী দল ক্ষমতাবান হতে চাইছে। ভারতের দাঙ্গার জন্য দায়ী বি জে পি নয়, দায়ী কংগ্রেস এ কথা তো বায়তুল মোকাররমের সভায় নিজামি নিজেই বলেছে।
—ভারতের দাঙ্গায় এক হাজার লোক নিহত হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আর এস এস, বজরঙ্গ, জামায়াত, ইসলামি সেবক সংঘ দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এদিকে সিলেটে হরতাল হচ্ছে, পিরোজপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা, ভোলায় কার্ফু, তা ছাড়া টুকরো টুকরো শান্তি মিছিল তো হচ্ছেই। মিছিলে শ্লোগান উঠছে ‘নিজামি আদভানি ভাই ভাই, এক দড়িতে ফাঁসি চাই।’ আজ সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সর্বদলীয় শান্তি সভা। ব্রিটেনের মন্দিরে ও নাকি হামলা হয়েছে। তোফায়েল আহমেদ ভোলা ঘুরে এসে বলেছেন ভোলায় বি ডি আর পাঠানো দরকার। এলাকার অবস্থা খারাপ।
–কেন, পুড়ে সব ছাই হয়ে গেলে বি ডি আর গিয়ে কি করবে ওখানে? ছাই-এর গাদা জমাবো? কোথায় ছিলেন তোফায়েল ছয় তারিখ রাতে? সে রাতেই তিনি কেন প্রটেকশনের ব্যবস্থা করলেন না?
সুরঞ্জন উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে–আওয়ামি লিগকে ধোয়া তুলসীপাতা ভেব না।
–এরকম কি হতে পারে, এই সরকারের ওপর দোষ পড়ার জন্য আওয়ামি লিগও দাঙ্গা থামানোর চেষ্টা করেনি?
-জানি না। হতে পারে। তবে সবার হচ্ছে ভোটের প্রয়োজন। এই দেশে চলে ভোটের রাজনীতি, এখানে আদর্শ ফাদর্শের ধার কেউ ধারে না, ছলে-বলে-কৌশলে ভোট পেলেই হল। আওয়ামি লিগ তো ভেবেছে হিন্দুর ভোট তারা পাবেই। কী যেন বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক না কি। কোথাও কোথাও নাকি ওরাই লুটপাট করেছে।
–কোথাও এমনও হয়েছে, যেসব এলাকা থেকে আওয়ামি লিগ ভোটে জেতে, সেসব এলাকার বি এন পি-র লোকেরা হিন্দু বাড়ি লুট করে মন্দির ভেঙে-পুড়িয়ে বলছে যাদের ভোট দাও, তারা কোথায় এখন? একইরকম বি এন পি যেখানে জেতে, আওয়ামি লিগ করেছে। ভোলায় করেছে বি এন পি-র লোকেরা, এদিকে আবার মহেশখালি, ঘিওর, মানিকগঞ্জে করেছে আওয়ামি লিগের লোক।
—রাজনীতির ব্যাপার তো আছেই। কিন্তু মৌলবাদীদের বাদ দিয়ে কিছু হয়নি। আচ্ছা, আজ নাকি অভিন্ন সম্পাদকীয় বের হয়েছে প্ৰায় সব পত্রিকায়? সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি রক্ষার আবেদন আছে নাকি ওতে?
–আপনি কি পত্রিকা পড়েন না?
—ইচ্ছে করে না। এ সময় মায়া ঢেকে ঘরে। একটি খাম রাখে টেবিলে, বলে—মা দিয়ে দিল, বলল লাগবে না!
মা কি দিল। এই প্রশ্ন করুবার আগে মায়া চলে যায়। সুরঞ্জন খাম খুলে দেখে গত রাতের দু হাজার টাকা। অপমানে লাল হয়ে ওঠে সুরঞ্জনের মুখ। এ কি কিরণময়ীর অহঙ্কার? নাকি তিনি ভেবেছেন বেকার ছেলে চুরি ডাকাতি করে টাকা এনেছে? অভিমানে লজ্জায় সুরঞ্জনের আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বিরূপাক্ষর সঙ্গেও না।
৫খ.
কিরণময়ীর বাবা ছিলেন ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ার নামকরা লোক। বড় উকিল। অখিল চন্দ্ৰ বসু। ষোল বছরের মেয়েকে ডাক্তার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। তাঁদের আশা ছিল মেয়ে জামাইও বুঝি চলে আসবে একসময়। কিরণময়ীও ভেবেছিলেন এক এক করে বাপ মা জ্যাঠা কাকা পিসি মাসি মামা প্রায় সবাই যখন চলে গেছেন, তিনিও বোধহয় যাবেন। কিন্তু এ এক অদ্ভুত ফ্যামিলিতে এসে পড়েছেন তিনি, শ্বশুর শাশুড়ির কাছে ছিলেন ছ’ বছর, ছ’বছরে তাঁরা আত্মীয়স্বজন পাড়া-পড়শিকে চোখের সামনে পাততাড়ি গুটোতে দেখেছেন, তবু ভুলেও কখনও দেশত্যাগের নাম করেননি। কিরণময়ী লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতেন। কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসন্ত-মা কিরণ, তোমরা কি আসিবে না ঠিক করিলে? সুন্ধাময়কে আরও ভাবিতে বল। দেশ ছাড়িয়া আসিতে তো আমাদেরও ইচ্ছা করেনি। কিন্তু আসিতে বাধ্য হইয়াছি। এইখানে আসিয়া খুব যে ভাল আছি তাহা নহে। দেশের জন্য মন কেমন করে। তবু বাস্তবকে তো মানিয়া লইতেই হয়। তোমাদের জন্য চিন্তা হয়। ইতি তোমার বাবা।’ এইসব চিঠি কিরণময়ী কত যে পড়তেন, চোখের জল মুছতেন, রাতে রাতে। সুধাময়কে বলতেন—’তোমার আত্মীয়রা অনেকেই নেই। আমার আত্মীয়রাও চলে গেছে। এখানে থেকে রোগে শোকে মুখ জল দেবার লোক পাব না।’ সুধাময় বিদ্যুপের হাসি হেসে বলতেন-‘জলের এত কাঙালি তুমি। তোমাকে পুরো ব্ৰহ্মপুত্রই দিয়ে দেব। কত জল খেতে পারো দেখব। আন্ধীয়রা কি ব্ৰহ্মপুত্রের চেয়ে বেশি জল ধারণ করে দু’ দেশ ছেড়ে যাবার কথা শ্বশুর নয়, স্বামী নয়, এমনকি পেটের ছেলে সুরঞ্জন, সেও মনোনি কোনও দিন। কিরুণাময়ীকে অগত্যা এই সংসারের স্বাভাবি চরিত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে হয়েছে। তাল মেলাতে গিয়ে কিরণময়ী অবাক হন সংসারের সুখ দুঃখে, সম্পদে দারিদ্রে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন সুধাময়ের চেয়ে বেশি।
কিরণময়ী তাঁর হাতের দুটো বালা বিক্রি করেছেন। হরিপদ ডাক্তারের স্ত্রীর কাছে। বাড়ির কাউকে তিনি জানতে দেননি ঘটনাটি। এসব জানাবারুই বা কি আছে। সোনাদানা তো এমন মূল্যবান কিছু নয় যে প্রয়োজনে বিক্রি করা যাবে না। সুধাময়ের সুস্থ হয়ে ওঠাই এ মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরি। মানুষটির প্রতি কোথেকে যে এত ভালবাসা জন্মায়, কিরণময়ী বুঝতে পারেন না। সেই একাত্তরের পর থেকে সুখময়কে তাঁর গভীর করে পণ্ডিয়া হয় না। মাঝে মধ্যে সুধাময় বলেন—কিরণময়ী, আমি বোধহয় তোমাকে ঠকালাম খুব, তাই না?
কিরণময়ী বোঝেন কিসের ঠিকার কথা বলেন সুধাময়। তিনি চুপ করে থাকেন। কিছু যে বলবেন তিনি, তিনি যে বলকেন-না, আমি আবার ঠিকাছি কোথায়? বলা হয় না। তাঁর। বলবার কোনও কথা তিনি খুঁজে পান না। সুধাময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন-তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে কিরণ? আমার বড় ভয় হয়।
কিরণময়ী কখনও সুন্ধাময়কে ছেড়ে যাবার কথা ভাবতে পারেন না। মানুষের কি ওই একটি সম্পর্কই প্রধান? আর তুচ্ছ সব? তুচ্ছ তবে পিঁয়ত্ৰিশ বছর একঘরের জীকন? এত সহজেই স্নান হয়ে যেতে পারে দীর্ঘ আনন্দ-বেদনার সংসারযাপন? না, কিরণময়ী ভাবেন-জীবন মানুষের একটাই। এই জীকন তো আর ঘুরে ফিরে বার বার আসবে না। জীবনে না হয় মেনেই নিলাম কিছুটা দুঃসহবাস। একাত্তর থেকে সুধাময় যৌন জীবন যাপনে অক্ষম একজন মানুষ। এ নিয়ে কিরণময়ীর কাছে তাঁর লজ্জার অন্ত ছিল না। তিনি প্রায়ই গভীর রাতে ফিসফিস করে তাঁকে ডেকে তুলে বলতেন—তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে কিরণ?
—কি কষ্ট? কিরণময়ী বুঝেও বোঝেননি ভাব করতেন।
সুধাময়ের অস্বক্তি হত বলতে। তিনি অক্ষমতার যন্ত্রণায় বালিশে মুখ খুঁজতেন। আর কিরণময়ী দেয়ালের দিকে ফিরে নিঝুম রাত পার করতেন। মাঝে মধ্যে সুধাময় বলতেন—’তুমি যদি ইচ্ছে কর, না হয় নতুন করে সংসার পাতো, আমি কিছু মনে করব না।‘
কিরণময়ীর শরীরে কোনও তৃষ্ণা ছিল না। এ কথা সত্য নয়। ছিল, সুধাময়ের বন্ধুরা যখন আসতেন, সামনে বসে গল্প করতেন, ওঁদের ছায়া পড়ত তাঁর কোলে, কিরণময়ী প্রায়ই তাঁর কোলের ছায়ার দিকে আড়াচোখে তাকতেন। তাঁর হঠাৎ হঠাৎ ইচ্ছেও হত কোলের ছায়াটি যদি সত্যি হত, যদি ছায়াটির মানুষ একবার মাথা রাখত কোলে। শরীরের তৃষ্ণাটি খুব বেশি বছর ভোগায়নি তাঁকে। সংযমে সংযমে পার হয়ে গেছে। বয়স কি থেমে থাকে! একুশ বছর দেখতে দেখতে কেটে গেল। কিরুণাময়ী এর মধ্যে এও ভেবেছেন সুখময়কে ছেড়ে যার কাছে যাকেন সেও যদি এমন অক্ষম পুরুষ হয়। অথবা অক্ষম না হোক, যদি এত হৃদয়বান না হয় সুধাময়ের মত!
কিরণময়ী মাঝে মধ্যেই ভাবেন সুধাময় বুঝি তাঁকে ভালবাসেন খুব। সঙ্গে ছাড়া খেতে বসেন না, মাছের বড় টুকরোটি নিজের পাত থেকে কিরণময়ীর পাতে তুলে দেন। বাড়িতে কাজের লোক না থাকলে বলেন-বাসন মাজ-টাজ কিছু থাকলে বল, আমি বেশ ভাল বাসন মাজতে পারি।
বিকেলে-টিকেলে কিরণময়ী উদাস বসে থাকলে সুধাময় বলেন-চুলে তোমার জট। পড়েছে কিরণ, এস ছাড়িয়ে দিই। আজ বিকেলে রমনা ভবনে গিয়ে ভাল দুটো শাড়ি কিনে এন। ঘরে পরিবার শাড়ি তোমার নেই-ই তেমন। টাকা থাকলে তোমার নামে বড় একটি বাড়ি বানিয়ে দিতাম কিরণ। তুমি বাড়ির উঠোনে খালি পায়ে হেঁটে বেড়াতে। বাড়ি ভরে ফল ফলাস্তির গাছ লাগাতে। মৌসুমের সবজি লাগাতে, ফুলগাছ লাগাতে। শিমগাছে শিম, লাউয়ের মাচায় লাউ, জানালার ধার ঘেষে হাসনুহেনা, আসলে তোমাকে ব্ৰাহ্মাপল্লীর বাড়িতেই মানাত বেশি। কিন্তু আমার সমস্যাটা কি জানো তো, টাকার লাইনের দিকে আমি মোটে গেলামই না। চাইলে যে টাকা করা যেত না তা নয়। বাড়ি বিত্ত দেখে তোমার বাবা বিয়ে দিয়েছিলেন, সেই বাড়িও আর নেই, বিত্তও নেই। অনেকটা হ্যান্ড টু মাউথ অবস্থা। এ নিয়ে আমার কোনও দুঃখ নেই। তোমার বোধহয় কষ্ট-টষ্ট হয় কিরণ।
কিরণময়ী বুঝতে পারতেন এই সরল সোজা, নিরীহ ভালমানুষটি তাঁকে ভালবাসেন বড়। কোনও ভালমানুষকে ভালবেসে জীবনের ছোটখাট সুখ যদি ত্যাগ করা যায়, অথবা ছোটখাট নয়, বড় কোনও স্বার্থও, তবে ক্ষতি কী। কিরুণময়ী তাঁর আঠাশ বছর বয়স থেকে এক অতৃপ্তি পুষছেন শরীরে, কিন্তু মনের ভেতর যে গোঙরায় এক সমুদ্র ভালবাসার জল, এই জল তাঁর শরীরের অসুখগুলো, ব্যথা ও বেদনাগুলো ধুয়ে দেয় বার বার।
সুরঞ্জন টাকা দিয়েছে। সম্ভবত ধার করে। উপার্জন করে না বলে এক ধরনের হীনমন্যতায় বোধহয় ভোগে ও। কিন্তু দেওয়ালে এখনও পিঠ ঠেকে যায়নি। কিরণময়ীর। এখনও চালিয়ে নেবার মত কিছু টাকা আছে হাতে, সুধাময় কখনও নিজের কাছে একটি পয়সা রাখেননি, উপার্জনের সবটুকুই কিরণের হাতে তুলে দিতেন। তা ছাড়া এখনও সোনাদানও কিছু অবশিষ্ট আছে। তিনি মায়ার হাত দিয়ে সুরঞ্জনের টাকা কটি ফেরত পাঠান। ফেরত পাঠানোয় ও যে কষ্ট পাবে ভাবেননি কিরণময়ী। আচমকা ঘরে ঢুকেই সুরঞ্জন বলে-ভেবেছ চুরি-ডাকাতি করে টাকা এনেছি? নাকি বেকারের টাকা নিতে লজ্জা হয়? কিছুই হয়ত করতে পারি না। কিন্তু করতে তো ইচ্ছে করে আমার। এ কথা কি বোঝা উচিত ছিল না কারও?
নিথর বসেছিলেন কিরণময়ী। কথাগুলো বেঁধে তাঁর বুকে।
৫গ.
রত্নার বাড়িতে কড়া নাড়ে সুরঞ্জন। রত্নাই দরজা খোলে। দেখে খুব চমকায় না। সে। যেন সুরঞ্জনের আসবার কথাই ছিল। সোজা তাকে শোবার ঘরে নিয়ে যায়। যেন কতকালের আত্মীয় সে। এক প্যাঁচে সুতি শাড়ি পড়েছে রত্না। কপালে লাল একটি টিপ হলে চমৎকার মানাত। আর যদি সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ থাকত অল্প। সুরঞ্জন কুসংস্কার মানে না, কিন্তু শাঁখা সিঁদুরের, উলুধ্বনির, শাঁখ বাজানোর বাঙালিয়ানা তাকে মুগ্ধই করে। বাড়িতে তাদের পুজো-আচ্চা একেবারেই নিষেধ ছিল, কিন্তু দল বেধে পুজো দেখতে যাওয়া, আরতিতে শখের নাচা, পুজো মণ্ডপের গানে তাল দেওয়া, দু-চারটে নাডু টাডু খাওয়া এসবে সে আপত্তি করেনি।
রত্না তাকে বসিয়ে রেখে চা করতে গেছে। কেমন আছেন ছাড়া একটি বাক্যও সে বলেনি। সুরঞ্জনও বলেনি। কথা খুঁজে পায়নি সে। সে ভালবাসতে এসেছে। ইঞ্জি করা একটি শার্ট পরে, অনেকদিন পর শেভ করে, স্নান করে, গায়ে একটু সুগন্ধি লাগিয়ে এসেছে। বুড়ো বাবা মা, বড় ভাই আর রত্না, এই নিয়ে সংসার। ভাই-এর বউ ছেলে মেয়ে আছে। ছেলে মেয়েগুলো ঘুরঘুর করছে, নতুন মানুষটি কে, কি চায় এখানে ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর তারা পায় না বলে দরজা থেকে তারা খুব দূরেও যায় না। সুরঞ্জন একটি সাত বছরের মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করে নাম কি?
মেয়েটি ঝটপট উত্তর দেয়–মৃত্তিকা।
—বাহ, সুন্দর নাম তো। কী হয় রত্না তোমার?
—পিসি।
–ও।
—তুমি বুঝি পিসির অফিসে চাকরি কর?
–না। আমি কোনও চাকরি টাকরি করিনা। ঘুরে বেড়াই।
ঘুরে বেড়াই বাক্যটি মৃত্তিকার পছন্দ হয়। সে আরও কিছু কথা বলতে যাবে এমন সময় রত্না ঢেকে ঘরে, হাতে ট্র, ট্রেতে চা বিস্কুট, চানাচুর, দুরকম মিষ্টি।
—কি ব্যাপার হিন্দুদের ঘরে আজকাল তো খাবার থাকার কথা নয়। তারা ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। আর এখানে তো দিব্যি দোকান খুলে বসা হয়েছে। তা সিলেট থেকে এলেন কবে?
—সিলেটে না। গিয়েছিলাম হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভিবাজার। আমার চোখের সামনে হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারে তিনটে মন্দির ভেঙে ফেলেছে।
-কার ভেঙেছে?
-টুপি দাড়িঅলা মুসল্লিরা। এরপর বাজারের কালী মন্দির ভেঙে ফেলেছে। আমার আত্মীয় হন তপন দাশগুপ্ত, ডাক্তার, তার চেম্বারও লুট করে ভেঙে দিয়েছে। সুনামগঞ্জে দুটো মন্দির ভেঙে ফেলল। আট তারিখে। নয় তারিখে চারটে মন্দির, পঞ্চাশটা দোকান, ভেঙে লুট করে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে। মৌলভিবাজারের রাজনগর ও কুলাউড়ায় ছটা মন্দির আর আখড়া ভেঙে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ব্ৰাহ্মণবাজারের সাতটি দোকানও লুট করেছে।
–নিশ্চয় হিন্দুর দোকান!
রত্না হেসে বলে-তো আর বলতে।
চাচানাচুর এগিয়ে দিয়ে রত্না বলে-বলুন তো, এ দেশে কি আর থাকা যাবে?
—কোন যাবে না? এ দেশ কি মুসলমানের বাপের সম্পত্তি?
রত্না হাসে। হাসিতে বিষগ্নতা খেলা করে। বলে-ভোলায় নাকি টিপসই দিয়ে জায়গা বেচে চলে যাচ্ছে মানুষ। কেউ টাকা পয়সা পাচ্ছে সামান্য, কেউ পাচ্ছে না।
–ভোলা থেকে কারা যাচ্ছে? হিন্দুরা তো?
–তা তো নিশ্চয়ই।
—তবে উল্লেখ করছেন না কেন? সুরঞ্জন চানাচুর খেতে খেতে বলে।
হিন্দু শব্দটি উল্লেখ করবার কোনও প্রয়োজন পড়ছে না। তারপরও সুরঞ্জনের ইচ্ছে যারা যাচ্ছে তারা যে হিন্দু, যাদের লুট হচ্ছে বাড়িঘর দোকানপাট, তারা যে ভোলা বা হবিগঞ্জের ‘মানুষ’ নয়, কেবল হিন্দু—এ কথাই রত্নাকে বোঝায়।
রত্না কী বোঝে কে জানে সে গভীর দুচোখ মেলে সুরঞ্জনের চোখে তাকায়। সে ভেবে এসেছিল, কোনও রকম রাখঢাক না করেই আজ সে কথা পড়বে। বলবে–আপনাকে আমার ভাল লাগে, বিয়ে-টিয়ে করতে চাইলে বলুন করে ফেলি।
রত্না জল আনতে ওঠে। ওর শাড়ির আঁচল সুরঞ্জনের বাঁ হাত ছুঁয়ে যায়। স্পর্শ লেগে থাকে বাহুতে। আচ্ছা রত্না তো ইচ্ছে করলেই পারে বউ হতে তার, উড়নচণ্ডী জীবনটিকে একটি সংসারে স্থির করা উচিত এই জন্য যে তার বিয়ে করতে ইচ্ছে হচ্ছে তা কিন্তু নয়। সারাদিন শুয়ে শুয়ে রত্নার আঙুল নিয়ে খেলা করা যাবে, খেলতে খেলতে ন্যাংটোকালের গল্প করতে করতে এমন হবে যে দুজনের মধ্যে না জানা কিছু, দেয়াল কিছু থাকবে না। সে আসলে ঠিক বউ হবে না তার, বন্ধু হবে।
রত্নার গভীর চোখদুটো কি চায়? সুরঞ্জন বিব্রত হয়। বলে ওঠে–দেখতে এসেছিলাম অক্ষত আছেন কি না?
–অক্ষত? অক্ষতার তো আবার দুরকম অর্থ, নারীর বেলায় এক, পুরুষের বেলায় আরেক। কোনটি দেখতে এসেছিলেন?
–দুটোই।
রত্না হেসে মাথা নীচু করে। সে হাসলে মুক্তে হয়ত ঝরে না, কিন্তু বেশ লাগে দেখতে। ওর মুখ থেকে চোখ সরতে চায় না সুরঞ্জনের। তার কি বয়স বেশি বেড়ে গেছে? এই বয়সের ছেলেদের কি খুব বুড়ো বুড়ো লাগে দেখতে? বিয়ের জন্য একেবারেই বেমানান? ভাবতে গিয়ে সুরঞ্জন লক্ষ্য করে রত্না তাকে দেখছে। দৃষ্টিতে মোহঘোর।
—আপনার সেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্তটি এখনও আছে? রত্না হোসে জিজ্ঞেস করে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সুরঞ্জন বলে—জীবন হচ্ছে নদীর মত জানেন তো? নদী কোথাও থেমে থাকে? সিদ্ধান্তও সব সময় অনড় থাকে না। বদলায়।
শুনে বাইরে হিন্দুর ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, আর এই চরম দুঃসময়ে রত্না হাসতে হাসতে বলে–বাঁচলাম।
সুরঞ্জন জিজ্ঞেস করে না ‘বাঁচলাম’ অর্থ কী। সে বুঝে নেয়। রত্না তাকে আমল এক আনন্দ দিচ্ছে। তার ইচ্ছে করে রত্নার সরু সরু আঙুলগুলো খুঁয়ে বলে-চলুন আজ শালবন বিহার যাই। সবুজ ঘাসে সারারাত শুয়ে থাকি। চাঁদ আমাদের পাহারা দেবে। চাঁদকে আমরা তার জ্যোৎস্না লুকোতে বলব না। সুরঞ্জন সিঁড়ির কাছে গিয়েও ভাবে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা রত্নাকে সে বলবে–আমাদের অনড় সিদ্ধান্তগুলো পাল্টে চলুন কিছু একটা করে ফেলি দুজন।
সুরঞ্জনের বলা হয় না। রত্না দুসিঁড়ি নেমে বলে—আবার আসবেন। আপনি এলেন বলে মনে হল পাশে দাঁড়াবার কেউ একজন আছে। একেবারে একা হয়ে যাইনি।
সুরঞ্জন স্পষ্ট বুঝতে পারছে পারভিনের জন্য যেমন হত, ওই চঞ্চল চড়ুইটি তাকে যেমন সুখে ভাসিয়ে রাখত, তেমনই সুখ হচ্ছে তার।
পর্ব – ১২
৬ক.
সকালে চায়ের সঙ্গে পত্রিকা হাতে নেয় সুরঞ্জন। আজ মন ভাল তার। রাতেও ভাল ঘুম হয়েছে। পত্রিকায় চোখ বুলিয়ে মায়াকে ডাকে সে।
—ফিরে তোর হয়েছে কি! এত মন খারাপ করে বসে থাকিস কেন?
—আমার আবার কী হবে। তুমিই তো ঝিম ধরেছ। একবারও বাবার কাছে বস না।
—আমার ওসব দেখতে ভাল লাগে না। সুস্থ সকল মানুষটি মড়ার মত বিছানায় পড়ে আছে দেখলে আমার রাগ ধরে। আর তোরা পাশে বসে মিউ মিউ করে। সারাক্ষণ কাঁদিস, এসব আরও ভাল লাগে না। আচ্ছা, মা টাকা রাখেনি কেন? খুব টাকা বুঝি তাঁর?
–মা গয়না বিক্রি করেছে।
—এ কাজটা অবশ্য ভাল করেছে। গয়না-টয়না। আমি একদম পছন্দ করি না।
—পছন্দ কর না। পারভিন আপকে তো ঠিকই মুক্তোবসানো আংটি দিয়েছিলে?
—তখন কাঁচা বয়স ছিল, মনে রঙ ছিল, এত বুদ্ধি হয়নি তো, তাই।
—এখন বুঝি খুব পেকেছ? মায়া হেসে বলে।
মায়ার মুখে কতদিন পর হাসি দেখল সুরঞ্জন। হাসিটিকে আরও কিছুক্ষণ দেখবে বলে সে পত্রিকার প্রথম পাতার খবরটি দেখায়। বলে-দেখেছিস, নগরীতে শান্তি মিছিল হয়েছে, ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমরা আছি বাংলাদেশে। সাম্প্রদায়িকতা রুখে দাঁড়াও—সর্বদলীয় শান্তি মিছিলের দৃপ্ত ঘোষণা। যে কোনও মূল্যে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী ও লুটেরাদের প্রতিরোধ করার আহ্বান। ভারতে সহিংসতা স্তিমিত। উত্তরপ্রদেশ সরকারের মসজিদের জমি দখলকে হাইকোর্টে অবৈধ ঘোষণা। নরসিমা রাও বলেছেন, বাবরি মসজিদ ভাঙার জন্য কেন্দ্র নয়, উত্তরপ্রদেশ সরকারই দায়ী। পশ্চিমবঙ্গ, গুজরাট, মহারাষ্ট্রে এখনও সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের জেহাদ ঘোষণা। আজ পল্টন মোড়ে সি পি বি-র সমাবেশ আছে। আওয়ামি লিগ বলেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় শান্তি ব্রিগেড গঠন করতে হবে। নগর সমন্বয় কমিটি বলেছে দাঙ্গা বাঁধানোর দায়ে নিজামি কাদের মোল্লাদের গ্রেফতার করুন। নির্মূল কমিটিরও সমাবেশ আজ। টঙ্গীতে সর্বদলীয় শান্তি মিছিল। সাংস্কৃতিক জোটের শ্লোগোন-সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবাজাদের রুখবে এবার বাংলাদেশ। পনেরো জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতি সাম্প্রদায়িক সম্প্ৰীতি সবার নাগরিক দায়িত্ব। কর্নেল আকবর বলেছেন ফ্যাসিবাদী শক্তি জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে। বরিশালে সম্মিলিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা পরিষদ গঠিত। ঢাকা ভার্সিটির শিক্ষক সমিতি সাম্প্রদায়িক সমিতি বিনষ্ট হলে বিজয়ের মাসের পবিত্ৰতা নষ্ট হবে বলেছেন। ধামরাইয়ে মন্দির ভাঙার অভিযোগে আঠাশ জন গ্রেফতার। জ্যোতি বসুর অনুশোচনা ভারতের মুখ দেখাবার জায়গা নেই। –কেবল ভাল খবরগুলো পড়ে গেলে? মায়া বিছানায় পা তুলে আসন করে বসে। পত্রিকাটি টেনে নিয়ে সে বলে—আর বাকি খবরগুলো? ভোলার দশ হাজার পরিবার গৃহহারা। চট্টগ্রামে সাতশ বাড়ি ভস্মীভূত। কিশোরগঞ্জে মন্দির ভাঙচুর। পিরোজপুরে একশ চুয়াল্লিশ ধারা। সীতাকুণ্ড মিরসরাই-এ সাতশ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ।
-আজ কোনও মন্দ খবর শুনতে চাই না। আজ আমার মন ভাল।
–কেন পারভিন আপা ডিভোর্স দিচ্ছে বলে? এসেছিল কাল, বলল স্বামী নাকি তাকে প্রতি রাতে পেটায়।
—এখন কেন? মুসলমানকে বিয়ে করলেই নাকি অপার শান্তি? নারে পারভিন না। আমার মন মজেছে অন্য কোথাও। এবার আর মুসলমান নয়, যেন বিয়ের আগে কাঁদো কাঁদো গলায় না বলতে পারে, তুমি ধর্ম পাল্টাও।
মায়া হেসে ওঠে। অনেকদিন পর মায়া হাসছে।
সুরঞ্জন হঠাৎ গভীর হয়ে বলে–বাবার অবস্থা এখন কেমন? ভাল হয়ে উঠবেন না শিগরি?
—আগের চেয়ে ভাল এখন। ভাল কথা বলতে পারছেন। ধরে ধরে বাথরুমে নিচ্ছি। নরম খাবারও খেতে পারছেন। ও শোনো, কাল সন্ধ্যায় বেলাল ভাই এসেছিলেন। তোমার খোঁজে। বাবাকে দেখে গেলেন। বললেন তুমি যেন বাইরে না বেরোও। বাইরে বের হওয়া এখন রিস্কি।
–ও।
সুরঞ্জন হঠাৎ এক লাফে দাঁড়িয়ে যায়। মায়া বলে–কি ব্যাপার কোথাও যাচ্ছ মনে হয়?
–আমি কি ঘরে বসে থাকার ছেলে?
—তুমি বাইরে গেলে মা যে কি দুশ্চিন্তা করেন। দাদা, তুমি যেও না। আমারও খুব ভয় ভয় লাগে।
—পুলককে টাকাটা ফেরত দিতে হবে। তোর কাছে কিছু টাকা হবে নাকি? তুই তো আবার রোজগোরে মেয়ে। দে না তোর ফান্ড থেকে সিগারেট কেনার টাকা?
—উহু, সিগারেট কেনার টাকা আমি দেব না। তুমি খুব শিগরি মরে যাও এ আমি চাই না।
মায়া বলে কিন্তু দাদার জন্য ঠিকই একটি একশ টাকার নোট এনে দেয়। ছোটবেলায় এই মায়া একবার কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। তাকে স্কুলের মেয়েরা ক্ষেপাত ‘হিন্দু হিন্দু তুলসীপাতা, হিন্দুরা খায় গরুর মাথা।’ মায়া বাড়ি ফিরে কেঁদেকেটে সুরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করেছিল—আমি নাকি হিন্দু। আমি কি হিন্দু দাদা?
–হ্যাঁ। সুরঞ্জন বলেছিল।
–আমি আর হিন্দু হব না। হিন্দু বলে ওরা আমাকে ক্ষেপায়।
সুধাময় শুনে বলেছিলেন–তুমি হিন্দু কে বলল? তুমি হচ্ছে মানুষ। মানুষের চেয়ে বড় কিছু জগতে নেই। সুধাময়ের প্রতি শ্ৰদ্ধায় নুয়ে আসে সুরঞ্জনের প্রাণ। সে এত মানুষ দেখেছে, সুধাময়ের মত আদর্শবান, যুক্তি বুদ্ধি বিবেকসম্পন্ন মানুষ সে খুব কমই দেখেছে। ঈশ্বর যদি সে কাউকে মানে, সুধাময়কেই মানবে। এত উদারতা, সহনশীলতা, যুক্তিবাদী মানুষ সংসারে ক’জন হয়?
৬খ.
চৌষট্টিতে সুধাময় শ্লোগান দিয়েছিলেন ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’। সেদিনের সেই দাঙ্গা বাড়তে পারেনি। শেখ মুজিব এসে থামিয়েছিলেন। আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেন বাড়তে না পারে, সে কারণেই দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল সরকার নিজে। সরকার-বিরোধী আন্দোলনের জন্য সরকার ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের করল। সুধাময় ছিলেন মামলার একজন আসামী। সুধাময় অতীত নিয়ে ভাবতে চান না। তবু অতীত এসে মনের ওপর নগ্ন হয়ে দাঁড়ায়। দেশ দেশ করে কী হয়েছে দেশের? কতটুকু কল্যাণ? পাঁচাত্তরের পর থেকে দেশটি মৌলবাদীদের মুঠোর মধ্যে চলে যাচ্ছে। সব জেনে বুঝেও মানুষগুলো নিস্পন্দ, স্থির। এই প্রজন্ম কি চেতনাহীন? এদের রক্তে কি সেই রক্ত বইছে না, বাহাম্নোয় রাষ্ট্রভাষা করবার দাবিতে যে রক্ত ঝরেছে রাস্তায়, উনসত্তরের গণঅভু্যুত্থানের রক্ত, একাত্তরের ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্ত? সেই উত্তাপ কোথায়? যে উত্তাপ উত্তেজনায় সুধাময় ঝাঁপিয়ে পড়তেন আন্দোলনে? কোথায় টগবগে যুবকেরা এখন? কেন এরা আজ সাপের মত শীতল? কোন ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশে মৌলবাদ খুঁটি গাড়ছে? কেউ কি বুঝতে পারছে না কি ভীষণ দুযোগের দিন আসছে? সুধাময় সমস্ত শক্তি খরচ করে বিছানা থেকে উঠতে চান। পারেন না। মুখ তাঁর বেদনায়, অক্ষমতায়, আক্ৰোশে নীল হয়ে ওঠে।
আইয়ুব খানের শত্ৰু সম্পত্তি আইন আওয়ামি লিগের আইন মন্ত্রী আবার বহাল করলেন সংসদে। অবশ্য নাম পাল্টে। তিনি নাম রাখলেন ‘অৰ্পিত সম্পত্তি আইন। দেশ ছেড়ে হে হিন্দুল্লা চলে গেছে, তাদের সম্পত্তিকে বলা হত শক্রির সম্পত্তি। সুধাময়ের কাক, জাঠা, মামারা কি দেশের শত্রু ছিল? এই ঢাকা শহরে জ্যাঠা মামাদের বড় বড় বাড়িঘর ছিল, সোনারগাঁয়ে ছিল, নরসিংদি, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুরে ছিল, এগুলো কোনওটি কলেজ হয়েছে, কোনওটি হয়েছে পশু হাসপাতাল, পরিবার পরিকল্পনা অফিস, আয়কর রেজিস্ট্রি অফিস। অনিল কাকার বাড়িতে ছোটবেলায় আসতেন। সুধাময়। রামকৃষ্ণ রোডের মন্ত বন্ড বাড়িটিতে দশটি ঘোড়া ছিল, অনিল কাকা তাকে ঘোড়ায় চড়াতেন। সুধাময় দত্ত এখন টিকাটুলির একটি অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে বাড়িতে দিন কাটান, অথচ কাছেই নিজের ককার বাড়ি এখন সরকারের নামে। অৰ্পিত সম্পত্তি আইন বদল হয়ে সম্পত্তি উত্তরাধিকার অথবা সগোত্রে অর্পিত হলে অনেক হিন্দুর দুর্দশা ঘুচত। সুধাময় এই প্রস্তাবটি অনেক হোমরাচোমরা ব্যক্তিকে করেছিলেন, কাজ হয়নি। তিনি তাঁর অচল। অথর্ব। জীবনে আজকাল ক্লান্তি বোধ করেন। বেঁচে থাকবার কোনও অর্থ খুঁজে পান না। জানেন, এই বিছানায় এখন নিঃশব্দে মরে গেলে কারও কোনও ক্ষতি হবে না। বরং নিরস্তুর রাত্রি জাগরণ আর সেবাশুশ্ৰুষার দায়িত্ব থেকে বাঁচবে কিরণময়ী। ‘
১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের বিশেষ পরিবেশে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কারণে শক্ৰ সম্পত্তি আইন হয়েছিল, স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে সুকৌশলে সেই আইনের টিকে থাকা দেখে অবাক হন সুধাময়। স্বাধীন একটি দেশের জন্য, বাঙালি জাতির জন্য এ কলঙ্কের ঘটনা নয়? এই আইন দু কোটি মানুষের মৌলিক, মানবিক, গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার হরণ করেছে, শাসনতন্ত্রের সমঅধিকার আর সামাজিক সাম্য নীতির পরিপহী এ আইন বহাল রেখে দু কোটি মানুষকে তাদের ভিটে বািড় থেকে উচ্ছেদ করে অসহায় সৰ্ব্বনাশা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। এই কারণে হিন্দুদের মধ্যে যদি চরম নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে, এ দোষ কি হিন্দুদের? সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ হচ্ছে সমাজের গভীর মাটিতে। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের প্রতিটি নাগরিকের সমনিরাপত্তা ও সমঅধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হলেও সরকার অর্পিত (শত্রু) সম্পত্তি আইন বহাল রেখে শাসনতন্ত্রের বিধান লঙ্ঘন করে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা দেখাচ্ছে। অথচ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার এই ধারার কথা বলে—
২৬ (১) এই ভাগের বিধানাবলির সহিত অসামঞ্জস্য সকল আইন যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই সংবিধান প্রবর্তন হইতে সেই সকল আইনের ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
(২) রাষ্ট্র এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য কোনও আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনও আইন প্রণয়ন করিকেন না। এবং অনুরূপ কোনও আইন প্রণীত হইলে তাহা এই ভাগের কোনও বিধানের সহিত যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততখানি বাতিল হইয়া যাইবে।
২৭. সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
২৮ (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বৰ্ণ, নারী পুরুষ ভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিকেন না।
৩১. আইনের আশ্রয় লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইল্যানুযায়ী ব্যবহার লাভ যে কোনও স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনও ব্যবস্থা করা যাইবে না, যাহাতে কোনও ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে।
১১২ নং ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে ‘All authorities, executive and judicial, in the Republic shall act in aid of the Supreme Court.’
পাকিস্তানি প্রতিরক্ষণ আইন ৬৫’-র ধারাগুলো এরকম ছিল :
any state, or sovereign of a state, at war with, or engaged in military operation against Pakistan, or
any individual resident in enemy territory, or c. anybody of persons constituted or in corporation in enemy territory, or in or under the laws of a state at war with, or engaged in military operations againt Pakistan, or
any other persons or body of persons declared by the Central Govt. to be an enemy, or
e, any body of persons (whether incorporated or not) carrying on business in any place, if and so long as the body is controlled by a person who under this rule is an enemy, or
f, as respect any business carried on in enemy territory and individual or body of persons (whether incorporate or not) carrying on that business.
১৬৯.১. Enemy subject means:
(a) any individual who possesses the nationality of a state at war with, or engaged in military operation against Pakistan, or having possessed such nationality at any time has lost without acquiring another nationality, or b) any body of persons constituted or incorporated in or under the laws of such state.’
১৬৯ (৪) ‘Enemy property means: any property för the time being belonging to or held or managed on behalf of an enemy as defined in rule 161, an enemy subject or any enemy firm, but does not include the property which is ‘Evacuee property’ under the Pakistan (administration of evacuee property) Act, 1957 (xll of 1957).’
আরও বলা হয় ‘Where an individual enemy subject dies in Pakistan any property, which, individually before his death, belonged to or was held by him, or was managed on his behalf, may not withstanding his death continue to be regarded as enemy property for the purpose of rule 182.’
সাতচল্লিশের পর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারত পাড়ি দেয়। তখনকার পাকিস্তান সরকার East Bengal Evacuees (administration of property) Act VIII of 1949, the East Bengal Evacuees (Restoration of possession) Act XXIII of 1951-the East Bengal Evacuees (Administration of Emmoveable property) Act XXIV of 1951 জারি করেন। ১৯৫১ সালের East Bengal Evacuees (Admiistration of Immoveable Property) Act XXIV-iq ritPt 33, The evacuee property committees constituted under this Act shall not take charge of any evacuate property.
if the sole owner or all the co-sharer owners of the property object to the management of such property by the committee on the ground that he or they has or have made other arrangements for the management and utilisation of the property and if the committee is satisfied that the a large ent so Inade proper and adequate, or
if an objection is filed and allowed under this section.
এই আইনে আরো বলা হয় the property shall be vested only on the applications of the evacuees and it shall be wested with the right to dispose of property as het likes.
১৯৫৭ সালে পাকিস্তান সরকার এই আইনের আরও কিছু বদল করে জারি করলেন Pakistan (administration of evacuee property) Act XII of 1957. এই আইনে বলা হল ‘properties of the persons who is resident in any place in the territories now comprising India or in any area occupied by India and is unable to occupy supervise or manage in person his property in then Pakistan or is being occupied, supervised or managed by a person.’ এই আইনও হিন্দুদের তত অসুবিধে করেনি, যত অসুবিধে করেছে East Pakistan Disturbed Persons and Rehabilitation Ordinance 1964.
১৯৬৫-র পাক-ভারত যুদ্ধের কারণে পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে পাকিস্তান শাসনতন্ত্র ১৯৬২-এর পরিচ্ছদ নং ১ ও ২-এর জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ তারিখে Defence of Pakistan Ordinance mo, XXIII মত Defence of Pakistan Rules Sasa set (stry Defence of Pakistan Rules 1965-এর ১৮২ ধারায় বলা হয় ‘with a view to preventing the payment of money to an enemy firm, and to provide for the administration and disposal by way of transfer or otherwise of enemy property and matters connected there with or incidential thereto, the Central Government may appoint a Custodian of enemy property for Pakistan and one or more Deputy Custodian and Asstt. Custodians of enemy property for such local areas as may be prescribed and may, by order-vest or provide for and regulate the vesting in the prescribed custodian such enemy property as may be prescribed-এর ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষণ আইন ও বিধির আওতায় অন্তর্ভুক্ত সব সম্পত্তি সরকারে ন্যস্ত হল। সে সব শক্ৰ সম্পত্তির প্রকৃত মালিকদের যুদ্ধকালীন অবস্থায় আটক বা চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবং তাদের সম্পত্তির যথাযথ পরিচালনা নিরাপদ না মনে হওয়ায় সে সব সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য শক্ৰ সম্পত্তির মালিকদের অধিকার বা স্বার্থের পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা দেবে বলে সে সব সম্পত্তি প্রকৃত মালিকদের ফিরিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারে অস্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার Enemy Property (Custody and Registration) Order১৯৬৫ জারি করেন এবং পরে Enemy Property (Land and Building) Administration & Disposal order, ১৯৬৬-এর আওতায় ওই সম্পত্তিসমূহের অর্থ ও ক্ষতিপূরণ আদায়, দেওয়া নেওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে হিসাব সংরক্ষণ সহ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের একজন কর্মকর্তার ওপর অৰ্পিত হয়।
পাক-ভারত যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরও আগের আইন বহাল রাখার উদ্দেশ্যে Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) Ordinance No 1 of 1969 জারি করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত মিত্ৰ শক্তি হওয়া এবং দু দেশের মধ্যে কোনও যুদ্ধাবস্থা না থাকার পরও রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ২৯/১৯৭২ অর্থাৎ Bangladesh vesting of property and assets Order স্থায়ী বলে কথিত শত্রু সম্পত্তি যা পাকিস্তান সরকারের কাস্টেডিয়ানের ওপর ন্যস্ত ছিল, তা বাংলাদেশ সরকারের কাছে ন্যস্ত হয়। আসলে ১৯৬৯-এর পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর Enemy Property (Continuance of Emergency Provision) ordinance বহাল রেখে জনগণের মানবিক মর্যাদা, সামাজিক অধিকার ও সমতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা হয়। পাকিস্তান আমলের মতই স্বাধীন বাংলাদেশেও শত্রু সম্পত্তির তদারকি অত্যন্ত অন্যায় ভাবে অব্যাহত রাখা হয়। জনগণের দাবি উপেক্ষা করেও শত্রু সম্পত্তি আইন (Continuance of Emergency Provision) Repeal Act XLV of 1974 জারি করে বাতিলেরনাম করে Vested & Non-Resident Property (Administration) Act XLVI of 1974-এর আবরণে পাকিস্তান আমলে সরকারের হাতে ন্যস্ত সম্পত্তি সহ বাংলাদেশের স্থায়ী অধিবাসী নয় has ceased to be permanent resident বা বৈদেশিক নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন এমন লোকের সম্পত্তি সরকারে ন্যস্ত করবার মধ্য দিয়ে সব সম্পত্তি পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করেন। এই কমিটিকে নিজ উদ্যোগে বা অনাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে বা সরকারের নির্দেশে ঘোষিত সম্পত্তির দায়িত্ব অৰ্পণ করা হয়। এই আইনের আওতায় কেবল পাকিস্তানি আমলের শক্ৰ সম্পত্তি হিসেবে যেসব সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হয় সেগুলোই নয়, পাকিস্তানি সরকার বা শত্ৰু সম্পত্তি তত্ত্বাবধায়কেরা যেসব সম্পত্তি তাদের তদারকিতে আনেননি, সেগুলোও আনবার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু আইন কার্যকর হবার আগেই ১৯৭৬ সালের Ordinance no. XCIII জারি করা হয়। এই আইনে বলা হয়-Those properties which have had wested under the Act shall be administered, controlled, managed and disposed of by transfer or otherwise, by the Government on such officer or authority as Government may direct এরপর এক বছর যেতে না যেতেই ১৯৭৭ সালের মে মাসের ২৩ তারিখে এক সার্কুলারে বলা হয়-10 kathas of vacant non-agricultural land shall be given long term lease to a person deserving to get it, realising full market value as premium and proper rent, that non-agricultural lands situated in business centre shall be settled in open auction with the highest bidder. অর্থাৎ বাংলাদেশের দেড়-দু কোটি জনগণের যে অকৃষিজাত জমিতে অংশ বা দখল রয়েছে তা নিলামে দীর্ঘমেয়াদী ইজারা দেবার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। নির্দেশের ৩৭ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, তহশীল অফিসের যে সব তহশীলদার বা কর্মচারী নিজ নিজ এলাকার গোপন ন্যস্ত সম্পত্তি খুঁজে বের করে দিতে পারকেন, বা ওই সংক্রান্ত খবরাখবর দিতে পারবেন তাদের পুরস্কার দেওয়া হবে।. ৩৮ অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়েছে, এ কাজে নিয়োজিত অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সকল মহকুমা প্রশাসক, সার্কেল অফিসার (রাজস্ব), এবং ভূমি প্রশাসক ও ভূমি সংস্কার বিভাগের কর্মচারীদের সম্মানী দেওয়া হবে। পুরস্কার পাবার লোভে এরা ন্যস্ত সম্পত্তি খুঁজে বের করবার নামে হিন্দুদের ভিটে বাড়ি থেকে বা তাদের দখলকৃত অংশ থেকে জোর করে উচ্ছেদও করেছে।
১৯৬৬-র পর পূর্ব পাকিস্তান সরকার সারাদেশে জরিপ চালিয়েছিলেন, এতে দেখা যায়’৪৭-এর দেশত্যাগ, ‘৫০ ও’৫৪-র দাঙ্গার পর যারা তাদের সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা তদারকি এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তাদের পরিবারের সদস্য, সহঅংশীদার, বা অন্য আত্মীয়স্বজনদের বা অন্য নাগরিকের সঙ্গে শাসন সংরক্ষণ বা ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারত চলে গেছে কেবল তাদের বাড়িঘর, পুকুর বাগান, পারিবারিক শ্মশান, মঠ, মন্দির, কৃষিজাত অকৃষিজাত সম্পত্তি শত্ৰু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। এ ছাড়াও যে হিন্দুরা ভারতে যায়নি, ভারতের বাইরে যারা বিদেশে থাকেন অস্থায়ীভাবে ভারতে থাকে, তাদের সম্পত্তিও শক্ৰ সম্পত্তির আওতায় আনা হয়। অথচ যে মুসলমানরা ভারত বা ভারতের বাইরে চলে গেছে তাদের সম্পত্তি কিন্তু শত্ৰু সম্পত্তির আওতায় আনা হয়নি। এ জন্য কোনও জরিপ ও চালানো হয়নি। হিন্দু যৌথ পরিবারের আইনের বিধান অনুযায়ী পরিবারের অনুপস্থিত সদস্যের সম্পত্তির মালিকানা যৌথ পরিবারের সারভাইভিং সদস্যদের ওপর ন্যস্ত হবে এবং তারা ভোগদখল করবে। অথচ এইসব সম্পত্তি সরকারের ওপর ন্যস্ত হচ্ছে।
সুধাময় ভাবেন, নিয়াজ হোসেন, ফজলুর আলম, আনোয়ার আহমেদরা ফ্যামিলিসহ তো তাঁর চোখের সামনেই লন্ডন আমেরিকায় চলে গেলেন, তাঁদের দেশের বাড়িতে দুল্পসম্পর্কের আত্মীয়রা বাস করছে, কেয়ারটেকার রেখে গেছেন, কেউ আবার ভাড়া দিয়ে গেছেন বাড়ি, কারও মাধ্যমে ভাড়া তুলে নেন। তাঁদের সম্পত্তিকে তো শত্ৰু সম্পত্তি বলা হয় না। সুধাময় উঠে দাঁড়াতে চান, তাঁর গা ঘামছে। কেউ নেই ঘরে, মায়া, কিরণময়ী সব গেল কোথায়?
পর্ব – ১৩
৬গ.
সুরঞ্জন পুরনো ঢাকার রাস্তায় হাঁটে আর ভাবে এই শহরে এত হেঁটে বেড়িয়েও ময়মনসিংহকে সে ভুলতে পারেনি। ওই শহরে তার জন্ম, শুই ছোট্ট শহরে কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর। বুড়িগঙ্গায় পা ডুবিয়ে রেখে ব্ৰহ্মপুত্রের কথাই সে ভাবে বেশি। মানুষ যদি তার জন্মকে অস্বীকার করতে চায়। তবেই বোধহয় ভুলতে পারে জন্মের মাটিকে, জন্মপাড়ের নদীকে। গৌতমরা চলে যাচ্ছে দেশ ছেড়ে। তারা ভাবছে। এই দেশ তাদের জন্য আর নিরাপদ নয়। কিন্তু যাবার আগে হু হু করে কাঁদছে কোন! পাঁচ বছর আগে তার মামা এসেছিলেন। কলকাতা থেকে, ব্ৰাহ্মণবাড়িয়ায় গিয়ে কী যে শিশুর মত কাঁদলেন। তিনি। কিরণময়ী বলেছিলেন–সুরঞ্জন, যাবি নাকি তোর মামার সঙ্গে কলকাতায়? শুনে ছিঃ ছিঃ করে উঠেছিল সুরঞ্জন।
চার-ছয় বছর আগে পার্টির কাজে তাকে যেতে হয়েছিল ময়মনসিংহ। জানালায় বসে বুজ ধানক্ষেত, দিগন্ত অবধি বৃক্ষরাজি, কুড়েঘর, খড়ের গাদা, বিলে দৌড়ঝাপ করে উলঙ্গ শিশুদের গামছা পেতে মাছ ধরা, ট্রেন দেখে ফিরে চাওয়া সরল কৃষকের মুখ, দেখতে দেখতে তার মনে হয়েছে সে বাংলার মুখ দেখছে। জীবনানন্দ এই মুখ দেখেছিলেন বলে পৃথিবীর আর কোনও রূপ দেখতে চাননি। সুরঞ্জনের মুগ্ধতা হঠাৎ হোঁচটি খেল রামলক্ষ্মণপুর নামের স্টেশনটি আহমদ বাড়ি হয়ে গেছে দেখে, এক এক করে সে দেখল বালীর বাজারের নাম ফাতেমা নগর, কৃষ্ণনগরের নাম আওলিয়া নগর। ইসলামাইজেশন চলছে। সারাদেশ জুড়ে, ময়মনসিংহের ছোট্ট স্টেশনগুলোও বাদ গেল না। ব্ৰাহ্মণবাড়িয়াকে লোকে বলে বি বাড়িয়া, বরিশালের ব্ৰজমোহন কলেজকে বলে বি এম কলেজ, মুরারি চাঁদ কলেজকে ডাকা হয় এম সি কলেজ, হিন্দু নামগুলো বেরিয়ে আসে বলেই বুঝি সংক্ষেপের আশ্রয়? সুরঞ্জন আশঙ্কা করে। অচিরে এই সংক্ষেপগুলোও বিদেয় হয়ে মোহাম্মদ আলি কলেজ, সিরাজউদ্দৌলা কলেজ হয়ে যাবে ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিন্নাহ হলের নাম গল্টে সূর্য সেন হল করায় স্বাধীনতার একুশ বছর পর স্বাধীনতা বিরোধী লোকেরা বলছে সূর্য সেন ডাকাত ছিল, ডাকাতের নামে কী করে হলের নাম হয়? এর মানে নাম পল্টানোর আবদার। সরকার যে কখনও এই আবদার রাখবেন না, তা মনে হয় না। কারণ মৌলবাদী শক্তির সহায়তায় বি এন পি ক্ষমতায় বসেছে, তারাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মীেলাবাদীদের স্বার্থরক্ষা করছে।
পুরনো ঢাকার অলিগিলিতে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন দেখে অক্ষত হিন্দু দোকানগুলো বন্ধ, ওরা যে কপাট খুলবে, কী ভরসায় খুলবে। তবু নব্বই-এর পর খুলেছিল, বিরানব্বইয়ের পরও হয়ত খুলবে। হিন্দুর গায়ের চামড়া বোধহয় গণ্ডারের। তা না হলে ওরা ভাঙা ঘর আবার বাঁধে। কী করে। ভাঙা দোকান আবার জোড়া লাগায় কী করে!! ঘরবাড়ি দোকানপাট না হয় চুন সুরকি দিয়ে জোড়া লাগে। ওদের ভাঙা মন কি জোড়া লাগে?
নব্বই-এ পাটুয়াটুলির ব্ৰাহ্ম সমাজ, শাঁখারি বাজারের শ্ৰীধর বিগ্ৰহ মন্দির, নয়াবাজারের প্রাচীন মঠ, কায়েতটুলির সাপ মন্দিরে লুটপাট, ভাঙচুর আগুন লাগানো হয়েছে। পটুয়াটুলির বিখ্যাত এম ভট্টাচার্য এন্ড কোং, হোটেল রাজ, ঢাকেশ্বরী জুয়েলার্স এভারগ্রীন জুয়েলার্স, নিউ ঘোষ জুয়েলার্স, আল্পনা জুয়েলার্স, কাশ্মীরি বিরিয়ানি হাউজ, রূপশ্রী জুয়েলার্স, মানসী জুয়েলার্স, মিতালি জুয়েলার্স, শাঁখারি বাজারের সোমা স্টোর, অনন্যা লন্ড্রী, কৃষ্ণা হেয়ার ড্রেসার, টায়ার টিউব রিপেয়ারিং, সাহা কেন্টিন, সদরঘাটে ভাসমান হোৱাটল উজালা, পান্থনিবাস লুট করে ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। নয়াবাজারের মিউনিসিপ্যালিটি সুইপার কলোনি লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকা জেলা আদালতের সুইপার ব্যক্তিটা পুরো জ্বলিয়ে দেওয়া হয়। কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া পূর্বপাড়ার হরিসভা মন্দির, কালী মন্দির, মীর বাগ-এর মন্দির, গোশম বাজার আখড়া, শুভাঢ়া গোসাইর বাগের দুর্গ মন্দির, চন্দ্রাণিকারার মন্দির, পশ্চিম পাড়ার কালী মন্দির, শ্মশানঘাট, তেঘরিয়া পূকনদীর রামকানাই মন্দির, কালিন্দী বাড়ীশুর বাজারে দুর্গ মন্দির, কালী মন্দির, মনসা মন্দিরে হামলা, লুটপাট মুর্তি ভাঙা সবই ঘটেছে। শুভাঢ্যার খেজুর বাগ-এর প্যারীমােহন মিশ্রের ছেলে রবি মিশ্রেীর বাড়ি সহ পঞ্চাশটি ভাড়া বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তেঘরিয়ার ভাবতোষ ঘোষ, পরিতোষ ঘোষ, কালিন্দীর মান্দাইল হিন্দু পাড়ায়, আর বনগাঁও ঋষিপাড়ায় তিনশ বাড়ি ভেঙে লুট করে পুড়িয়ে ফেলেছে। সুরঞ্জন এসব কিছু দেখেছে, কিছু শুনেছে।
সূরঞ্জন কোথায় যাবে ঠিক বুঝে পায় না। এই ঢাকা শহরে তার আপনি কে আছে? কার কাছে গিয়ে দুদণ্ড বসবে, কথা বলবে? আজি মায়া তাকে দেবে না দেবে না বলেও একশ টাকা দিয়েছে। বুক পকেটে নোটটি রাখা, খরচ করতে ইচ্ছে করছে না। দু-একবার ভেবেছে এক প্যাকেট বাংলা ফাইভ কিনবে, কিন্তু কিনলেই তো ফুরিয়ে যাবে। টাকার মায় সে কখনই করে না। সুধাময় তাকে শর্ট-প্যান্ট বানাবার টাকা দিতেন, সেই টাকা সে বন্ধুবান্ধবের পেছনে খরচ করত, কেউ হয়ত পালিয়ে বিয়ে করবে, টাকা পয়সা পাচ্ছে না, সুরঞ্জন বিয়ে করবার খরচ দিয়ে দিল, একবার পরীক্ষার ফিস দিয়ে দিল রহমত নামের এক ছেলেকে। ছেলেটির মা ছিল হাসপাতালে, ওষুধ কিনবার টাকা ছিল না হাতে, ব্যস সুরঞ্জন ফিসের টাকাটি তাকে দিয়ে দিতে সামান্যও দেরি করেনি। একবার কি রত্নার কাছে যাবে। সে স্ট্র রত্না মিত্ৰ? এরকম হয় না বিয়ের পর সে রত্নার পদবী আর বদলালো না? মেয়েরা কেন বিয়ে হলেই পদবী বদলায়? বিয়ের আগে বাবার লেজ ধরে বেঁচে থাকে, বিয়ের পর ধরে স্বামীর লেজ। যত্তসব। সুরঞ্জনেরও ইচ্ছে করে নিজের নাম থেকে দত্ত পদবী তুলে দিতে। মানুষের এই ধর্ম বর্ণ ভেদাই মানুষকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। বাঙালি সে হিন্দু হোক, মুসলমান হোক, বাংলা নাম রাখবে। মায়ার নাম সে অনেকদিন ভেবেছে নীলাঞ্জনা মায়া হলে বেশ হত। আর তার নাম হতে পারত, কী হতে পারত, ‘নিবিড় সুরঞ্জন? সুরঞ্জন সুধা’? ‘নিখিল সুরঞ্জন? এরকম কিছু হলেই ধর্মের কালি আর গায়ে মাখতে হয় না। বাঙালি মুসলমানের মধ্যেও সে আরবি নাম রাখবার প্রবণতা লক্ষ করেছে। অতি প্রগতিবাদী ছেলেও যে কি না বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে সেও তার বাচ্চার নাম রাখতে গেলে রাখে ফয়সল রহমান, তৌহিদুল ইসলাম, ফাইয়জ চৌধুরি। কেন গো? বাঙালি মানুষের আরবি নাম থাকবে কেন? সুরঞ্জন তার মেয়ের নাম রাখবে স্রোতস্বিনী ভালবাসা, অথবা অর্থই নীলিমা; অর্থই নীলিমা বরং মায়ার নীলাঞ্জনা নামের সঙ্গে মেলে। এই নামটি মায়ার মেয়ের জন্য না হয় দিয়ে দেওয়া যাবে।
সুরঞ্জন হাঁটতে থাকে। এলোমেলো হাঁটা, অথচ বাড়ি থেকে বেরোবার সময় মনে হয়েছে কত তার কাজ। বাইরে বেরোলেই আর সে যাবার জায়গা পায় না খুঁজে। যেন সবাই ব্যস্ত, যে যার কাজে ছুটছে সবাই, কেবল তারই কাজ নেই, তারই কোনও ব্যস্ততা নেই। সে এই সন্ত্রাসের শহরে কারও সঙ্গে বসে দুটো কথা বলতে চায়। বংশালে দুলালের বাড়ি যাবে নাকি? নাকি আজিমপুরের মহাদেবদার বাড়ি? ইস্পাহানি কলোনিতে কাজল দেবনাথের বাড়িও যাওয়া যায়। যাবার কথা উঠতেই তার কেবল হিন্দু নাম মনে পড়ছে কেন? কাল বেলাল এসেছিল, সে তো বেলালের বাড়ি একবার যেতে পারে। হায়দার ফিরে গেল সেদিন, হায়দারের বাড়িতেও আডিডা দেওয়া যায়। এদের বাড়িতে গেলে সেই একই কথার ফুলকি উঠবে, বাবরি মসজিদ। ভারতে কী হচ্ছে ক’জন মরল, বি জে পি নেতারা কী বলল, সেনা নামিল কোন কোন শহরে, কারা গ্রেফতার হল, কোন দল নিষিদ্ধ হল—ভবিষ্যৎ কী হবে, এইসব। এগুলো শুনতে আর ভাল লাগে না তার। ওখানে বি জে পি যা, এখানে জামাতি তা। উদ্দেশ্য দু দলের একই। মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠিত করা। দুটো দেশ থেকে যদি ধর্মের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা যেত! ধৰ্ম এমন জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছে, এ থেকে তৃতীয় বিশ্বের নিরন্ন, নিরীহ, নির্যাতিত মানুষের বোধহয় মুক্তি নেই। কার্ল মার্ক্স-এর এই কথাটি বড় প্রিয় তার, ভিড়ের মধ্যে বিড়বিড় করে বলে—’ধমীয় ক্লেশ হল একই বাস্তব ক্লেশের অভিব্যক্তি এবং বাস্তব ক্লেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও। ধর্ম হল নিপীড়িত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, ঠিক যেমন সেটা হল আত্মাহীন পরিবেশের আত্মা। ধর্ম হল জনগণের জন্য আফিম। ‘
হেঁটে হেঁটে ওয়ারি, নবাবপুর, নয়াবাজার, তাঁতিবাজার, কোর্ট এরিয়া, রজনী বসাক লেন, গেণ্ডারিয়া, বেগম বাজার ঘুরে ঘুরে দুপুর পার করে সুরঞ্জন শেষ পর্যন্ত কাজলের বাড়িই যায়। তাকে বাড়িতেই পাওয়া যায়, আজকাল সব হিন্দুকে বাড়িতে পাওয়া যায়। হয়। বাড়ির বাইরে কোথাও লুকিয়ে থাকে, নয় ঘাপটি মেরে বাড়িতে বসে থাকে। আড্ডা দিয়ে বেড়ানোর জন্য বেকার সুরঞ্জনের জন্য ভালই হল, কাজলকে পেয়ে সে মনে মনে বলে। কাজলের ঘরে আরও ক’জনকে পাওয়া যায়। সুভাষ সিংহ, তাপস পাল, দিলীপ দে, নির্মল চ্যাটার্জি, অঞ্জন মজুমদার, যতীন চক্রবর্তী, সাইদুর রহমান, কবীর চৌধুরি।
—কি খবর বেশ হিন্দু সমাগম দেখছি।
সুরঞ্জনের কথায় কেউ হাসে না। সে নিজেই বরং হেসে ওঠে।
—কি খবর সবার এত মন খারাপ কেন? হিন্দুদের মারা হচ্ছে বলে? সুরঞ্জনই প্রশ্ন করে।
—মন ভাল থাকবার কোনও কারণ আছে? সুভাষ বলে।
কাজল দেবনাথ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ করে। সুরঞ্জন এই পরিষদকে কখনও সমর্থন করেনি। তার মনে হয়েছে এটিও একটি সাম্প্রদায়িক দল। এই দল সমর্থন করলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করবার দাবিটিতে তেমন জোর থাকে না। এ প্রসঙ্গে কাজল অবশ্য বলেন, চল্লিশ বছর প্রত্যাশায়, প্রতীক্ষায় থেকে নিরাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মরক্ষার, স্বনির্ভরতার তাগিদে এই পরিষদ গঠন করেছি।
—খালেদা কি একবারও স্বীকার করেছে দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হচ্ছে? একবারও তো বিধবন্ত এলাকা দেখতে গেলেন না। তিনি। আসরের একজন এই কথা বলতেই কাজল বলেন-আওয়ামি লিগই বা কি করেছে। বিবৃতি দিয়েছে। এরকম বিবৃতি জামাতে ইসলামি দিয়েছে আগে। গত নিবাচনে আওয়ামি লিগ ক্ষমতায় এলে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ রাখবে না বলে এক ধরনের অপবাদ প্রচার হয়েছে। তারা এখন ক্ষমতায় না। যেতে পেরে ভাবছে। এইটথ এমেন্ডমেন্টের বিরুদ্ধে কথা বললে জনপ্রিয়তা কমে যাবে।
আওয়ামি লিগ কি ভোটে জিততে চায় নাকি নীতিতে অটল থাকতে চায়? অটল থাকলে এই বিলের বিরুদ্ধে কোনও কথা বলছে না কেন?
—ভেবেছে ক্ষমতায় আগে তো যাই, তারপর যা রদবদল করা দরকার, করা যাবে। সাইদুর রহমান আওয়ামি লিগের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করান।
–কাউকে বিশ্বাস নেই। সবাই ক্ষমতায় গিয়ে ইসলামের গান গাইবে আর ভারতের বিরোধিতা করবে। এ দেশে ভারত বিরোধিতা এবং ইসলাম লোকে খায় ভাল। কাজল মাথা নেড়ে বলেন।
হঠাৎ সুরঞ্জন আলোচনার প্রসঙ্গে না গিয়ে তার পুরনো প্রশ্নটিই করে—কিন্তু কাজলদা, আপনাদের এই সাম্প্রদায়িক পরিষদটি না করে অসাম্প্রদায়িক মানুষের একটি দল করলে ভাল হত না? আর এই পরিষদে সাইদুর রহমান নেই কেন, জানতে পারি?
যতীন চক্রবর্তী ভারী কণ্ঠে বলেন–সাইদুর রহমানকে না নিতে পারা আমাদের ব্যর্থতা নয়। ব্যৰ্থতা রাষ্ট্রধর্ম যারা তৈরি করেছে, তাদের। এতকাল তো আমাদের এরকম পরিষদ করতে হয়নি, এখন করতে হয় কেন? বাংলাদেশটি এমনি এমনি গড়ে ওঠেনি। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান সকলেরই অবদান ছিল, কিন্তু একটি বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা মানে অন্য ধর্মের মানুষদের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেওয়া। স্বদেশের প্রতি ‘ভালবাসা কারও চেয়ে কারও কম নয়। কিন্তু যারা দেখে ইসলাম তাদের ধর্ম না। হওয়ায় রাষ্ট্রের চোখে তাদের পৈত্রিক ধর্ম দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর ধর্ম বলে বিবেচিত হয়, এবং ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কারণেই তারা দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত হয়ে গেছে, তখন তাদের অভিমান মারাত্মক হয়। এ কারণে যদি তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের বদলে সাম্প্রদায়িকতার চেতনাই প্রবল হয়ে ওঠে, তবে তাদের দোষ দেওয়া যায় কি?
উত্তরটি যেহেতু সুরঞ্জনের দিকে ছুড়ে দেওয়া, সুরঞ্জন আই নীচু কণ্ঠে বলে-কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে এরকম একটি সম্প্রদোয়ভিত্তিক সংগঠন থাকার যুক্তি কি?
যতীন চক্রবর্তী মুহূর্ত দেরি না করে বলেন—কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ রকম সম্প্রদায়ভিত্তিক সংগঠন করতে বাধ্য করেছে। কারা? যারা রাষ্ট্ৰীয় ধর্মের প্রবক্তা, তারা নয়? একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের রিলিজিয়নকে রাষ্ট্রধর্ম বানালে সেই রাষ্ট্রটি তো আর জাতীয় রাষ্ট্র থাকে না। যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রধর্ম আছে, সে রাষ্ট্র ধর্মীয় রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত হতে পারে যে কোনও মুহুর্তে। এই রাষ্ট্র দ্রুত সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হচ্ছে, এখানে জাতীয় সংহতির কথা বলা হাস্যকর। এইটথ এমেন্ডমেন্ট যে আসলে বাঙালিকে কলা দেখানো তা সংখ্যালঘুরা বুঝতে পারছে কারণ তারা ভুক্তভোগী।
–আপনি কি ভাবছেন মুসলমানদের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হওয়া, বা ধর্মীয় রাষ্ট্র হওয়া কল্যাণকর? আমি কিন্তু তা মনে করি না।
—-নিশ্চয়ই না। এটা তারা আজ না বুঝলেও একদিন বুঝবে।
—আওয়ামি লিগ কিন্তু এ সময় ভাল একটি ভূমিকা রাখতে পারত। অঞ্জন বলে।
সুরঞ্জন বলে—হ্যাঁ আওয়ামি লিগের বিলেও অষ্টম সংশোধনী বাতিলের প্রস্তাব নেই। যে কোনও আধুনিক গণতন্ত্রী মানুষ জানে গণতন্ত্রের অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি বুঝি না যে দেশের শতকরা ছিয়াশি জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামকে রাষ্ট্ৰীয় ধর্ম করার দরকার কী। বাংলাদেশের মুসলমানেরা এমনিতেই ধর্ম পালন করে, তাদের জন্য রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার কোনও দরকার পড়ে না।
যতীনবাবু নড়েচড়ে বসে বলেন–নীতির প্রশ্নে কোনও আপিস হয় না। আওয়ামি লিগ তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার হচ্ছে বলে এক ধরনের আপিস করছে।
সুভাষ চুপচাপ কথা শুনছিল। এবার বলে—আসলে জামাতি আর বি এন পি-র সমালোচনা না করে আমরা খামোক আওয়ামি লিগকে নিয়ে পড়েছি। ওরা কি আওয়ামি লিগের চেয়ে ভাল কাজ করছে। কাজল তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন–আসলে যারা চিহ্নিত শত্ৰু, তাদের সম্পর্কে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু যাদের ওপর আশা করি, তাদের স্খলন দেখলেই মনে লাগে বেশি।
কবীর চৌধুরি হঠাৎ মাঝখান থেকে বলেন—এত যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছে সবাই, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু সকল ধর্মের প্রতি একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা, এখানে পক্ষপাতিত্ব বলে কিছু নেই। আর সেকুলারিজম শব্দটির মানে হচ্ছে ইহজাগতিকতা, সোজা ভাষায়, রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক থাকবে না।
কাজল দেবনাথ উত্তেজিত হয়ে ওঠেন, বলেন–দেশ বিভাগের সময় মুসলিম মৌলবাদ জিতে পাকিস্তানের জন্ম দেয়। ভারতে হিন্দু মৌলবাদ। কিন্তু হেরে যায়। হেরে যায় বলেই ভারত একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হতে পেরেছে। ভারতীয় মুসলমানদের জন্য এ দেশের হিন্দুদের জিম্মি বলে ঘোষণা হয়েছিল। কেবল হিন্দু বিতাড়নের অজুহাত হিসেবে, মূল উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু সম্পত্তি দখল। পাকিস্তান আমলের কায়দায় আবার যখন ইসলামি ব্যবস্থার জিগির শোনা যায়। তখন হিন্দুল্লা ভয় পাবে না কেন? এ দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র না করলে হিন্দুদের বাঁচা অসম্ভব। আমাদের আরও দাবি শত্ৰু সম্পত্তি আইন বাতিল করতে হবে। এডমিনিষ্ট্রেশনে কোনও হিন্দু নেই। পাকিস্তান আমল থেকে কোনও সেক্রেটারি পদে হিন্দুদের নেওয়া হচ্ছে না। আমিতে হিন্দু সংখ্যা খুবই কম। যারা আছে কারোরই প্রমোশন হয় না। নেভি বা এয়ারফোর্সে হিন্দু কেউ আছে বলে তো মনে হয় না।
নির্মল বলে–কাজলদা, হিন্দুদের মধ্যে কোনও ব্রিগেডিয়ার বা মেজর জেনারেল নেই। কর্নেল সত্তরজনে একজন, লেফটেনেন্ট কর্নেল চারশ পঞ্চাশজনে আটজন, মেজর এক হাজার জনে চল্লিশজন, ক্যাপ্টেন তেরশজনে আটজন, সেকেন্ড লেফটেনেন্ট নয়শীজনে তিনজন, সিপাহি আশি হাজারে মাত্র পাঁচশজন। চল্লিশ হাজার বি ডি আর-এর মধ্যে হিন্দু মাত্র তিনশজন। সেক্রেটারি কেবল হিন্দু নেই বলছেন কেন, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানও তো নেই। এডিশনাল সেক্রেটারিও তো নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি আছেন একশ চৌতিরিশজনে মাত্র একজন।
কাজল আবার শুরু করেন—ফরেন সার্ভিসে সংখ্যালঘু কি আছে। একজনও? আমার তো মনে হয় নেই।
সুভাষ মোড়ায় বসেছিল, হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। বলে—না কাজলদা নেই।
ঘরে কার্পেট পাতা। সুরঞ্জন কর্পেটে বসেই একটি কুশনে হেলান দেয়। তার বেশ ভাল লাগছে আলোচনা শুনতে।
কবীর চৌধুরি বলেন–পাকিস্তান আমল থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আওয়ামি লিগের আমলে একমাত্ৰ মনোরঞ্জন ধরকে কিছুদিনের জন্য জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করা হয়েছিল।
—হায়ার স্টাডিজের জন্য, বিদেশে ট্রেনিং এসব ব্যাপারে হিন্দুদের এভিয়েড করা হয়। কোন লাভজনক ব্যবসাই এখন হিন্দুদের হাতে নেই। ব্যবসা বাণিজ্য করতে গেলে মুসলমান অংশীদার না থাকলে কেবল হিন্দু প্রতিষ্ঠানের নামে সব সময় লাইসেন্স পাওয়া যায় না। তা ছাড়া শিল্পঋণ সংস্থা থেকে ইন্ডাস্ট্রি করার জন্য ঋণ দেওয়া হয় না।
অঞ্জন বলে–হ্যাঁ, আমিই তো গামেন্টস করার জন্য জুতোর সুকতলি খরচ করে ফেললাম। ব্যাঙ্ক-এর কোনও হেলপ পেলাম না। তারপর আফসারকে পার্টনার করে লোন নিতে হল।
সুভাষ বলে–একটা ব্যাপার লক্ষ করেছেন, রেডিও টেলিভিশনে কোরানের বাণী দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করা হয়। কোরানকে পবিত্র গ্রন্থ বলা হচ্ছে। কিন্তু গীতা বা ত্রিপিটক থেকে পাঠ করার সময় কিন্তু পবিত্র বলা হচ্ছে না।
সুল্লঞ্জন বলে—আসলে কোনও ধর্মগ্ৰন্থই তো পবিত্র নয়। যতসব বদমায়েসি এসব। সব বাদ দিলেই তো হয়। দাবি করা যেতে পারে রেডিও টিভিতে ধর্মপ্রচার বন্ধ করতে হবে।
আসর খানিকটা চুপ হয়ে যায়। সুরঞ্জনের চা খেতে ইচ্ছে করে। সম্ভবত চায়ের কোনও ব্যবস্থা এ বাড়িতে হচ্ছে না। তার শুয়ে পড়তে টুচ্ছে করে কার্পেটটিতে। শুয়ে শুয়ে সবার ভেতরকার কষ্টগুলোর যে উদগীরণ হচ্ছে, তা সে উপভোগ করবে।
কাজল দেবনাথ তার না শেষ হওয়া কথা বলতে থাকেন–সরকারি যে কোনও অনুষ্ঠানে, প্রতিটি সভা-সমিতিতে কোরানের সূরা পাঠ করা হয়। কই, গীতা থেকে তো করা হয় না? সারা বছরে সরকারি হিন্দু কর্মচারীদের জন্য মাত্র দুদিন ছুটির ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের ঐচ্ছিক ছুটির অধিকারও তেমন নেই। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে মসজিদ নিমণি করান্ধি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু মন্দির নিমণ করার কথা তো বলা হয় না। প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুন মসজিদ করা হচ্ছে, অথবা পুরনো মসজিদের সংস্কার চলছে, কিজ মন্দির গিজা প্যাগোড়ার জন্য কিছু কি খরচ করা হয়?
সুরঞ্জন শোয়া থেকে মাথা উঠিয়ে বলে—রেডিও টিভিতে গীতা থেকে পাঠ হলে খুশি হন? মন্দির নিমণি হলে খুব মঙ্গল হবে? একবিংশ শতাব্দী এসে যাচ্ছে, আমরা আজও ধমের প্রবেশ চাচ্ছি সমাজে, রাষ্ট্রে। তার চেয়ে বলুন রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ধর্মীয় অনুপ্রবেশ থেকে মুক্ত থাকবে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষত চাই মানে তো এই নয় যে এখন কোরান পড়লে গীতাও পড়তে হবে। আমাদের চাইতে হবে রাষ্ট্ৰীয় সমস্ত কাহকিলাপে ধমীয় অনুপ্রবেশ বন্ধ করতে হবে। স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধমীয় প্রার্থনা, পাঠ্য বইয়ে কোনও ধর্মীয় নেতার জীবনী দেওয়াও নিষিদ্ধ করতে হবে। ধমীয় কার্যকলাপে পলিটিক্যাল লিডারদের সহযোগিতা নিষিদ্ধ করতে হবে। যদি কোনও নেতা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নেয়, অথবা পৃষ্ঠপোষকতা করে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে হবে। সরকারি প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচার নিষিদ্ধ করতে হবে। কোনও আবেদন পত্রে আবেদনকারীর ধর্ম জানতে চাওয়া হবে না।
সূরঞ্জনের কথায় কাজল দেবনাথ হেসে ওঠেন, বলেন–তুমি বেশি এগিয়ে যাচ্ছ ভাবনায়। একটি সেকুলার দেশে তোমার প্রস্তাবগুলো চলে, এই দেশে চলে না।
সুভাষ উসখুস করছিল, ফাঁক পেয়ে বলে–আজ বাংলাদেশ ছাত্র-যুব ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে মিটিং করেছি। হোম মিনিস্টারের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্ত মন্দির পুনর্নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘরের ক্ষতিপূরণ দান, সহায় সম্বলহীনদের ত্রাণ ও পুনর্বাসন, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি ছিল ওতে।
সুরঞ্জন কুশনে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল, উঠে বলে—তোমার একটি দাবিও এই সরকার মানবে না।
কবীর চৌধুরি বলেন—তা মানবে কেন? হোম মিনিস্টার তো আস্ত একটা রাজাকার। শুনেছি এই লোক একাত্তরে কাঁচপুর ব্রিজে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প পাহারা দিত।
সাইদুর রহমান বলেন–রাজাকারগুলোই তো এখন ক্ষমতায়। শেখ মুজিব এদের ক্ষমা করেছে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসিয়েছে। এরশাদ এদের আরও শক্তিশালী করেছে। আর খালেদা জিয়া সরাসরি রাজাকারদের সহযোগিতায় ক্ষমতায় বসেছে।
—কক্সবাজারের খবর পেলাম, সেবাখোলার মন্দিরটি ভেঙে ফেলেছে। চিন্তামন্দির ছিল একটি, সেটিও। জালালাবাদের ঈদগাঁও বাজারের কেন্দ্রীয় কালী মন্দির, হিন্দুপাড়ার আগুনে পুড়ে ছাই করে দিয়েছে। ইসলামাবাদের হিন্দুপাড়ায় সার্বজনীন দুর্গ মন্দির, বোয়ালখালির দুর্গ মন্দির, অদ্বৈত চিন্তাহরি মঠ, মঠাধ্যক্ষের বাড়ি, সঙ্গে আরও পাঁচটি পারিবারিক মন্দির সম্পূর্ণ ছাই করে দিয়েছে। বোয়ালখালির হরি মন্দির লুট করেছে। চৌফলদভীর আটটি মন্দির, ছটি বাড়ি, দুটো দোকান পুরো ছাই করে দিয়েছে। হিন্দু পাড়ায় মোট একশ পয়ষট্রিটি পরিবারের সব কিছু লুট হয়ে গেছে। বাজারের পাঁচটি হিন্দু দোকান লুট, হিন্দুদের যেখানে পাচ্ছে মারছে। হিন্দু বাড়িগুলোর ধানের গোলায় কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। উখিয়ার ভৈরববাড়ি পুরো ধ্বংস করে দিয়েছে। টেকনাফের কালীবাড়ি, পুরোহিতের বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছাই করেছে। সারাবাং-এর মন্দিরও ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে ৭ মহেশখালির তিনটি মন্দির এগারোটি ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। চারটি গীতা স্কুলও পুড়িয়ে দিয়েছে। কালারমার বাজারে কালী মন্দির আর হরি মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। কুতুবদিয়ার বড়ঘোপা বাজারের কালী মন্দির নাটমন্দির, সব মিলিয়ে ছটি মন্দিরে আগুন দিয়েছে। বাজারের চারটি কর্মকারের দোকান লুট করেছে। আলী আকবর ডেইল-এ একাল্পটি জেলে পরিবারের ঘরবাড়ির যাবতীয় জিনিস সম্পূর্ণ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কুতুবদিয়ার এইসব আগুন লাগানোয় তিনটি বাচ্চা মারা গেছে। রামুর ঈদগড়ে সার্বজনীন কালী মন্দির আর জেলে পাড়ায় হরি মন্দির ভেঙে পুড়িয়ে দিয়েছে। ফতেখাঁরকুলে অনেক বাড়িঘর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার…
Tags – Lojja, Bangla Golpo, lajja