Kazi Nazrul Islam Kobita (কাজী নজরুলের কবিতা)
বাংলা সাহিত্যের কবিতা প্রেমী মানুষদের জন্য নিয়ে এসেছি বিদ্রোহী কবি Kazi Nazrul Islam Kobita (কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা)।
আপনি কি ইন্টারনেট এ কাজী নজরুলের কবিতা খুঁজছেন ? তাহলে আপনার খোঁজা এখানেই শেষ । কারণ, শুধুমাত্র আমাদের এই ওয়েবসাইটেই রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের সকল কবিতা….
Kazi Nazrul Islam Kobita Bangla
হিন্দু – মুসলিম সম্পর্ক
হিন্দু-মুসলিম দুটি ভাই
ভারতের দুই আঁখি তারা
এক বাগানে দুটি তরু দেবদারু আর কদম চারা।।
যেন গঙ্গা সিন্ধু নদী
যায় গো বয়ে নিরবধি
এক হিমালয় হতে আসে, এক সাগরে হয় গো হারা।।
বুলবুল আর কোকিল পাখী
এক কাননে যায় গো ডাকি,
ভাগীরথী যমুনা বয় মায়ের চোখের যুগল ধারা।।
ঝগড়া করে ভায়ে ভায়ে
এক জননীর কোল লয়ে
মধুর যে এ কলহ ভাই পিঠোপিঠী ভায়ের পারা।।
পেটে ধরা ছেলের চেয়ে চোখে ধরারা মায়া বেশী,
অতিথী ছিল অতীতে, আজ সে সখা প্রতিবেশী।
ফুল পাতিয়ে গোলাপ বেলী
একই মায়ের বুকে খেলি,
পাগলা তা’রা আল্লা ভগবানে ভাবে ভিন্ন যারা।।
মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্যম
মোরা ঝঞ্ঝার মত উদ্দ্যম
মোরা ঝর্ণার মত চঞ্চল,
মোরা বিধাতার মত নির্ভয়
মোরা প্রকৃতির মত স্বচ্ছল।।
মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন,
বন্ধনহীন জন্ম স্বাধীন
চিত্তমুক্ত শতদল।।
মোরা সিন্ধু জোঁয়ার কলকল
মোরা পাগলা জোঁয়ার ঝরঝর।
কল-কল-কল, ছল-ছল-ছল
মোরা দিল খোলা খোলা প্রান্তর,
মোরা শক্তি অটল মহীধর।
হাসি গান শ্যাম উচ্ছল
বৃষ্টির জল বনফল খাই-
শয্যা শ্যামল বনতল।।
কান্ডারী হুঁশিয়ার
দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!
দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?
কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।
এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।
তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!
যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।
ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,
ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।
অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন
কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।
হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার
গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,
পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!
কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?
করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!
কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,
বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!
ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!
উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।
ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?
দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!
আরো পড়ুন, Bidrohi Poem
আনন্দময়ীর আগমনে
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেব–শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?
মাদীগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি-নাকি
খাঁড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি।
ঢাল তরবার, আন মা সমর, অমর হবার মন্ত্র শেখা,
মাদীগুলোয় কর মা পুরুষ, রক্ত দে মা রক্ত দেখা।
তুই একা আয় পাগলী বেটী তাথৈ তাথৈ নৃত্য করে
রক্ত-তৃষার ‘ময়-ভুখা-হু’র কাঁদন-কেতন কণ্বে ধরে।-
অনেক পাঁঠা-মোষ খেয়েছিস, রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা,
আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত-সুধা।
দুর্বলেরে বলি দিয়ে ভীরুর এ হীন শক্তি-পূজা
দূর করে দে, বল মা, ছেলের রক্ত মাগে দশভুজা।..
‘ময় ভুখা হুঁ মায়ি’ বলে আয় এবার আনন্দময়ী
কৈলাশ হতে গিরি-রাণীর মা দুলালী কন্যা অয়ি!
আপন পিয়াসী
আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন
খুঁজি তারে আমি আপনার,
আমি শুনি যেন তার চরণের ধ্বনি
আমারি তিয়াসী বাসনায়।।
আমারই মনের তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুল পিয়াসে,
কভু সে চকোর সুধা-চোর আসে
নিশীথে স্বপনে জোছনায়।।
আমার মনের পিয়াল তমালে হেরি তারে স্নেহ-মেঘ-শ্যাম,
অশনি-আলোকে হেরি তারে থির-বিজুলি-উজল অভিরাম।।
আমারই রচিত কাননে বসিয়া
পরানু পিয়ারে মালিকা রচিয়া,
সে মালা সহসা দেখিনু জাগিয়া,
আপনারি গলে দোলে হায়।।
Kazi Nazrul Islam Kobita Bengali
করার ঐ লৌহ কপাট
১
কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।
২
গাজনের বাজনা বাজা!
কে মালিক? কে সে রাজা?
কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?
হা হা হা পায় যে হাসি,
ভগবান পরবে ফাঁসি!
সর্বনাশী
শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!
৩
ওরে ও পাগলা ভোলা!
দে রে দে প্রলয় দোলা
গারদগুলা
জোরসে ধরে হেচ্কা টানে!
মার হাঁক হায়দারী হাঁক,
কাধে নে দুন্দুভি ঢাক
ডাক ওরে ডাক,
মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে!
৪
নাচে ওই কালবোশাখী,
কাটাবী কাল বসে কি?
দে রে দেখি
ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি!
লাথি মার, ভাঙ্গরে তালা!
যত সব বন্দী শালায়-
আগুন-জ্বালা,
-জ্বালা, ফেল উপাড়ি।।
পূর্ণ অভিনন্দন
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র! এস পূর্ণিমা-পূর্ণচাঁদ!
ভেদ করি পুন বন্ধ কারার অন্ধকারের পাষাণ-ফাঁদ!
এস অনাগত নব-প্রলয়ের মহা সেনাপতি মহামহিম!
এস অক্ষত মোহান্ধ-ধৃতরাষ্ট্র-মুক্ত লৌহ-ভীম!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
ছয়বার জয় করি কারা-ব্যুহ, রাজ-রাহু-গ্রাস-মুক্ত চাঁদ!
আসিলে চরণে দুলায়ে সাগর নয়-বছরের মুক্ত-বাঁধ!
নবগ্রহ ছিঁড়ি ফণি-মনসার মুকুটে তোমার গাঁথিলে হার,
উদিলে দশম মহাজ্যোতিষ্ক ভেদিয়া গভীর অন্ধকার!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
স্বাগত শুদ্ধ রুদ্ধ-প্রতাপ, প্রবুদ্ধ নব মহাবলী!
দনুজ-দমন দধীচি-অস্থি, বহ্নিগর্ভ দম্ভোলি!
স্বাগত সিংহ-বাহিনী-কুমার! স্বাগত হে দেব-সেনাপতি!
অনাগত রণ-কুরুক্ষেত্রে সারথি-পার্থ-মহারথী!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
নৃশংস রাজ-কংস-বংশে হানিতে তোমরা ধ্বংস-মার
এস অষ্টমী-পূর্ণচন্দ্র, ভাঙিয়া পাষাণ-দৈত্যাগার!
এস অশান্তি-অগ্নিকাণ্ডে শান্তিসেনার কাণ্ডারি!
নারায়ণী-সেনা-সেনাধিপ, এস প্রতাপের হারা- তরবারি!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর!
ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!
না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।
জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
স্বর্গ হইতে জননী তোমার পেতেছেন নামি মাটিতে কোল,
শ্যামল শস্যে হরিৎ ধান্যে বিছানো তাঁহারই শ্যাম আঁচল।
তাঁহারি স্নেহের করুণ গন্ধ নবান্নে ভরি উঠিছে ঐ,
নদীস্রোত-স্বরে কাঁদিছেন মাতা, ‘কই রে আমার দুলাল কই?’
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
মোছো আঁখি-জল, এস বীর! আজ খুঁজে নিতে হবে আপন মায়,
হারানো মায়ের স্মৃতি-ছাই আছে এই মাটিতেই মিশিয়া,হায়!
তেত্রিশ কোটি ছেলের রক্তে মিশেছে মায়ের ভস্ম-শেষ,
ইহাদেরি মাঝে কাঁদিছেন মাতা, তাই আমাদের মা স্বদেশ।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন-পদ্মা-ভাগীরথীর!
এস বীর! এস যুগ-সেনাপতি! সেনাদল তব চায় হুকুম,
হাঁকিছে প্রলয়, কাঁপিছে ধরণী, উদ্গারে গিরি অগ্নি-ধূম।
পরাধীন এই তেত্রিশ কোটি বন্দির আঁখি-জলে হে বীর,
বন্দিনী মাতা যাচিছে শক্তি তোমার অভয় তরবারির।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
গল-শৃঙ্খল টুটেনি আজিও, করিতে পারি না প্রণাম পা’য়,
রুদ্ধ কণ্ঠে ফরিয়াদ শুধু গুমরিয়া মরে গুরু ব্যথায়।
জননীর যবে মিলিবে আদেশ, মুক্ত সেনানী দিবে হুকুম,
শত্রু-খড়্গ-ছিন্ন-মুণ্ড দানিবে ও-পায়ে প্রণাম-চুম।
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, পাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
আরো পড়ুন, Mora Eki Brinte Duti Kusum
দুঃশাসনের রক্ত পান
বল রে বন্য হিংস্র বীর,
দুঃশাসনের চাই রুধির।
চাই রুধির রক্ত চাই,
ঘোষো দিকে দিকে এই কথাই
দুঃশাসনের রক্ত চাই!
দুঃশাসনের রক্ত চাই!!
অত্যাচারী সে দুঃশাসন
চাই খুন তার চাই শাসন,
হাঁটু গেড়ে তার বুকে বসি
ঘাড় ভেঙে তার খুন শোষি।
আয় ভীম আয় হিংস্র বীর,
কর অ-কণ্ঠ পান রুধির।
ওরে এ যে সেই দুঃশাসন
দিল শত বীরে নির্বাসন,
কচি শিশু বেঁধে বেত্রাঘাত
করেছে রে এই ক্রূর স্যাঙাত।
মা-বোনেদের হরেছে লাজ
দিনের আলোকে এই পিশাচ।
বুক ফেটে চোখে জল আসে,
তারে ক্ষমা করা? ভীরুতা সে!
হিংসাশী মোরা মাংসাশী,
ভণ্ডামি ভালবাসাবাসি!
শত্রুরে পেলে নিকটে ভাই
কাঁচা কলিজাটা চিবিয়ে খাই!
মারি লাথি তার মড়া মুখে,
তাতা-থৈ নাচি ভীম সুখে।
নহি মোরা ভীরু সংসারী,
বাঁধি না আমরা ঘরবাড়ি।
দিয়াছি তোদের ঘরের সুখ,
আঘাতের তরে মোদের বুক।
যাহাদের তরে মোরা চাঁড়াল
তাহারাই আজি পাড়িছে গা’ল!
তাহাদের তরে সন্ধ্যা-দীপ.
আমাদের আন্দামান-দ্বীপ!
তাহাদের তরে প্রিয়ার বুক
আমাদের তরে ভীম চাবুক।
তাহাদের ভালবাসাবাসি,
আমাদের তরে নীল ফাঁসি।
বরিছে তাদের বাজিয়া শাঁখ,
মোদের মরণে নিনাদে ঢাক।
জীবনের ভোগ শুধু ওদের,
তরুণ বয়সে মরা মোদের।
কার তরে ওরে কার তরে
সৈনিক মোরা পচি মরে?
কার তরে পশু সেজেছি আজ,
অকাতরে বুক পেতে নি বাজ।
ধর্মাধর্ম কেন যে নাই
আমাদের, তাহা কে বোঝে ভাই?
কেন বিদ্রোহী সব-কিছুর?
সব মায়া কেন করেছি দূর?
কারে ক’স মন সে-ব্যথা তোর?
যার তরে চুরি বলে চোর।
যার তরে মাখি গায়ে কাদা,
সেই হয় এসে পথে বাধা।
ভয় নাই গৃহী! কোরো না ভয়,
সুখ আমাদের লক্ষ্য নয়।
বিরূপাক্ষ যে মোরা ধাতার,
আমাদের তরে ক্লেশ-পাথার।
কাড়ি না তোদের অন্ন-গ্রাস,
তোমাদের ঘরে হানি না ত্রাস;
জালিমের মোরা ফেলাই লাশ,
রাজ-রাজড়ার সর্বনাশ!
ধর্ম-চিন্তা মোদের নয়,
আমাদের নাই মৃত্যু-ভয়!
মৃত্যুকে ভয় করে যারা,
ধর্মধ্বজ হোক তারা।
শুধু মানবের শুভ লাগি
সৈনিক যত দুখভাগী।
ধার্মিক! দোষ নিয়ো না তার,
কোরবানির১ সে, নয় রোজার২ !
তোমাদের তরে মুক্ত দেশ,
মোদের প্রাপ্য তোদের শ্লেষ।
জানি জানি ঐ রণাঙ্গন
হবে যবে মোর মৃৎ-কাফন৩
ফেলিবে কি ছোট একটি শ্বাস?
তিক্ত হবে কি মুখের গ্রাস?
কিছুকাল পরে হাড্ডি মোর
পিষে যাবি ভাই জুতিতে তোর!
এই যারা আজ ধর্মহীন
চিনে শুধু খুন আর সঙিন;
তাহাদের মনে পড়িবে কার
ঘরে পড়ে যারা খেয়েছে মার?
ঘরে বসে নিস স্বর্গ-লোক,
মেরে মরে তারে দিস দোজখ৪!
ভয়ে-ভীরু ওরে ধর্মবীর!
আমরা হিংস্র চাই রুধির!
শহতান মোরা? আচ্ছা, তাই।
আমাদের পথে এসো না ভাই।
মোদের রক্ত-রুধির-রথ,
মোদের জাহান্নামের পথ,
ছেড়ে দেও ভাই জ্ঞান-প্রবীণ,
আমরা কাফের ধর্মহীন!
এর চেয়ে বেশি কি দেবে গা’ল?
আমরা পিশাচ খুন-মাতাল।
চালাও তোমার ধর্ম-রথ,
মোদের কাঁটার রক্ত-পথ।
আমরা বলিব সর্বদাই
দুঃশাসনের রক্ত চাই!!
চাই না ধর্ম, চাই না কাম,
চাই না মোক্ষ, সব হারাম
আমাদের কাছে: শুধু হালাল৫
দুশমন-খুন লাল-সে-লাল॥
———————————
১ কোরবানি– বলি।
২. রোজা– উপবাস
৩. মৃৎ-কাফন –লাশ যেখানে থাকে।
৪. দোজখ –নরক
৫. হালাল –পবিত্র
ঝোড়ো গান
[কীর্তন]
(আমি) চাইনে হতে ভ্যাবাগঙ্গারাম
ও দাদা শ্যাম!
তাই গান গাই আর যাই নেচে যাই
ঝম্ঝমা্ঝম্ অবিশ্রাম ॥
আমি সাইক্লোন আর তুফান
আমি দামোদরের বান
খোশখেয়ালে উড়াই ঢাকা, ডুবাই বর্ধমান।
আর শিবঠাকুরকে কাঠি করে বাজাই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-ড্রাম॥
জাগরণী
কোরাস্:—
ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও!
ফিরে চাও ওগো পুরবাসী,
সন্তান দ্বারে উপবাসী,
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!
জাগো গো,জাগো গো,
তন্দ্রা-অলস জাগো গো,
জাগো রে! জাগো রে!
১
মুক্ত করিতে বন্দিনী মা’য়
কোটি বীরসুত ঐ হেরো ধায়
মৃত্যু-তোরণ-দ্বার-পানে—
কার টানে?
দ্বার খোলো দ্বার খোলো!
একবার ভুলে ফিরিয়া চাও।
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
২
জননী আমার ফিরিয়া চাও!
ভাইরা আমার ফিরিয়া চাও!
চাই মানবতা, তাই দ্বারে
কর হানি মা গো বারেবারে—
দাও মানবতা ভিক্ষা দাও!
পুরুষ-সিংহ জাগো রে!
সত্যমানব জাগো রে।
বাধা-বন্ধন-ভয়-হারা হও
সত্য-মুক্তি-মন্ত্র গাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৩
লক্ষ্য যাদের উৎপীড়ন আর অত্যাচার,
নর-নারায়ণে হানে পদাঘাত
জেনেছে সত্য-হত্যা সার।
অত্যাচার! অত্যাচার!!
ত্রিশ কোটি নর-আত্মার যারা অপমান হেলা
করেছে রে
শৃঙ্খল গলে দিয়েছে মা’র—
সেই আজ ভগবান তোমার!
অত্যাচার! অত্যাচার!!
ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-ছি-নাই কি লাজ—
নাই কি আত্মসম্মান ওরে নাই জাগ্রত
ভগবান কি রে
আমাদেরো এই বক্ষোমাঝ?
অপমান বড় অপমান ভাই
মিথ্যার যদি মহিমা গাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৪
আল্লায় ওরে হকতা’লায়
পায়ে ঠেলে যারা অবহেলায়,
আজাদ-মুক্ত আত্মারে যারা শিখায়ে ভীরুতা
করেছে দাস—
সেই আজ ভগবান তোমার!
সেই আজ ভগবান তোমার!
সর্বনাশ! সর্বনাশ!
ছি-ছি নির্জীব পুরবাসী আর খুলো না দ্বার!
জননী গো! জননী গো!
কার তরে জ্বালো উৎসব-দীপ?
দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!!
মঙ্গল-ঘট ভেঙে ফেলো,
সব গেল মা গো সব গেল!
অন্ধকার! অন্ধকার!
ঢাকুক এ মুখ অন্ধকার!
দীপ নেবাও! দীপ নেবাও।
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৫
ছি ছি ছি ছি
এ কি দেখি
গাহিস তাদেরি বন্দনা-গান,
দাস সম নিস হাত পেতে দান!
ছি-ছি-ছি ছি-ছি-ছি
ওরে তরুণ ওরে অরুণ!
নরসুত তুমি দাসত্বের এ ঘৃণ্য চিহ্ন
মুছিয়া দাও!
ভাঙিয়া দাও,
এ-কারা এ-বেড়ি ভাঙিয়া দাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৬
পরাধীন বলে নাই তোমাদের
সত্য-তেজের নিষ্ঠা কি!
অপমান সয়ে মুখ পেতে নেবে বিষ্ঠা ছি?
মরি লাজে, লাজে মরি!
এক হাতে তোরে ‘পয়জার’ মারে
আর হাতে ক্ষীর সর ধরি!
অপমান সে যে অপমান!
জাগো জাগো ওরে হতমান!
কেটে ফেলো লোভী লুব্ধ রসনা,
আঁধারে এ হীন মুখ লুকাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৭
ঘরের বাহির হয়ো না আর,
ঝেড়ে ফেলো হীন বোঝার ভার,
কাপুরুষ হীন মানবের মুখ
ঢাকুক লজ্জা অন্ধকার।
পরিহাস ভাই পরিহাস সে যে,
পরাজিতে দিতে মনোব্যথা—যদি
জয়ী আসে রাজ-রাজ সেজে।
পরিহাস এ যে নির্দয় পরিহাস!
ওরে কোথা যাস
বল কোথা যাস ছি ছি
পরিয়া ভীরুর দীন বাস?
অপমান এত সহিবার আগে
হে ক্লীব, হে জড়, মরিয়া যাও!
কোরাস্:— ভিক্ষা দাও…
৮
পুরুষসিংহ জাগো রে!
নির্ভীক বীর জাগো রে!
দীপ জ্বালি কেন আপনারি হীন কালো অন্তর
কালামুখ হেন হেসে দেখাও!
নির্লজ্জ রে ফিরিয়া চাও!
আপনার পানে ফিরিয়া চাও!
অন্ধকার! অন্ধকার!
নিশ্বাস আজি বন্ধ মা’র
অপমানে নির্মম লাজে,
তাই দিকে দিকে ক্রন্দন বাজে—
দীপ নেবাও! দীপ নেবাও!
আপনার পানে ফিরিয়া চাও!
আশু প্রয়ান গীতি
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
বাংলার ঋষি বাংলার জ্ঞান বঙ্গবাণীর শ্বেতকমল,
শ্যাম বাংলার বিদ্যা-গঙ্গা অবিদ্যা-নাশী তীর্থ-জল!
মহামহিমার বিরাট পুরুষ শক্তি-ইন্দ্র তেজ-তপন—
রক্ত-উদয় হেরিতে সহসা হেরিনু সে-রবি মেঘ-মগন।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
মদ-গর্বীর গর্ব-খর্ব বল-দর্পীর দর্প-নাশ
শ্বেত-ভিতুদের শ্যাম বরাভয় রক্তাসুরের কৃষ্ণ ত্রাস।
নব ভারতের নব আশা-রবি প্রাচী’র উদার অভ্যুদয়
হেরিতে হেরিতে হেরিনু সহসা বিদায়-গোধূলি গগনময়।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
পড়িল ধসিয়া গৌরীশঙ্কর হিমালয়-শির স্বর্গচূড়,
গিরি কাঞ্চন-জঙ্ঘা গিরিল—বাংলার যবে দিন-দুপুর।
শিশুক-হাঙর শোষিছে রক্ত, মৃত্যু শোষিছে সাগর-প্রাণ—
পরাধীনা মা’র স্বাধীন সুতের মেদ-ধূমে কালো দেশ-শ্মশান।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
অরাজক মারি মড়া-কান্নায় দেশ-জননীর বদ্ধ শ্বাস,
হে দেব-আত্মা! স্বর্গ হইতে দাও কল্যাণ, দাও আভাস,
কেমন করিয়া মৃত্যু মথিয়া মৃত্যুঞ্জয় হয় মানব;
শব হয়ে গেছ, শিব হয়ে এস দেবকী-কারার নীল কেশব।
কোরাস্: বাংলার ‘শের’, বাংলার শির,
বাংলার বাণী, বাংলার বীর
সহসা ও-পারে অস্তমান।
এপারে দাঁড়ায়ে দেখিল ভারত মহা-ভারতের মহাপ্রয়াণ॥
সর্বহারা
ব্যথার সাতার-পানি-ঘেরা
চোরাবালির চর,
ওরে পাগল! কে বেঁধেছিস
সেই চরে তোর ঘর?
শূন্যে তড়িৎ দেয় ইশারা,
হাট তুলে দে সর্বহারা,
মেঘ-জননীর অশ্র”ধারা
ঝ’রছে মাথার’ পর,
দাঁড়িয়ে দূরে ডাকছে মাটি
দুলিয়ে তর”-কর।।
কন্যারা তোর বন্যাধারায়
কাঁদছে উতরোল,
ডাক দিয়েছে তাদের আজি
সাগর-মায়ের কোল।
নায়ের মাঝি! নায়ের মাঝি!
পাল তু’লে তুই দে রে আজি
তুরঙ্গ ঐ তুফান-তাজী
তরঙ্গে খায় দোল।
নায়ের মাঝি! আর কেন ভাই?
মায়ার নোঙর তোল্।
ভাঙন-ভরা ভাঙনে তোর
যায় রে বেলা যায়।
মাঝি রে! দেখ্ কুরঙ্গী তোর
কূলের পানে চায়।
যায় চ’লে ঐ সাথের সাথী
ঘনায় গহন শাঙন-রাতি
মাদুর-ভরা কাঁদন পাতি’
ঘুমুস্ নে আর, হায়!
ঐ কাঁদনের বাঁধন ছেঁড়া
এতই কি রে দায়?
হীরা-মানিক চাসনি ক’ তুই,
চাস্নি ত সাত ক্রোর,
একটি ক্ষুদ্র মৃৎপাত্র-
ভরা অভাব তোর,
চাইলি রে ঘুম শ্রানি–হরা
একটি ছিন্ন মাদুর-ভরা,
একটি প্রদীপ-আলো-করা
একটু-কুটীর-দোর।
আস্ল মৃত্যু আস্ল জরা,
আস্ল সিঁদেল-চোর।
মাঝি রে তোর নাও ভাসিয়ে
মাটির বুকে চল্!
শক্তমাটির ঘায়ে হউক
রক্ত পদতল।
প্রলয়-পথিক চ’ল্বি ফিরি
দ’লবি পাহাড়-কানন-গিরি!
হাঁকছে বাদল, ঘিরি’ ঘিরি’
নাচছে সিন্ধুজল।
চল্ রে জলের যাত্রী এবার
মাটির বুকে চল্ ।।
মা বিরজাসুন্দরী দেবী
সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।
তুমি কোনদিন কারো করনি বিচার,
কারেও দাওনি দোষ। ব্যথা-বারিধির
কূলে ব’সে কাঁদ’ মৌনা কন্যা ধরণীর
একাকিনী! যেন কোন্ পথ-ভুলে-আসা
ভিন্-গাঁ’র ভীর” মেয়ে! কেবলি জিজ্ঞাসা
করিতেছে আপনারে, ‘ এ আমি কোথায়?’
দূর হ’তে তারাকারা ডাকে, আয় আয়!
তুমি যেন তাহাদের পলাতকা মেয়ে
ভুলিয়া এসেছ হেথা ছায়া-পথ বেয়ে!
বিধি ও অবিধি মিলে মেরেছে তোমায়
মা আমার-কত যেন! চোখে-মুখে, হায়
তবু যেন শুধু এক ব্যথিত জিজ্ঞাসা-
‘ কেন মানে? এরা কা’রা! কোথা হ’তে আসে
এই দুঃখ ব্যথা শোক?’ এরা তো তোমার
নহে পরিচিত মাগো, কন্যা অলকার!
তাই সব স’য়ে যাও নির্বাক নিশ্চুপ,
ধূপেরে পোড়ায় অগ্নি-জানে না তা ধূপ!…
দূর-দূরান-র হ’তে আসে ছেলে-মেয়ে,
ভুলে যায় খেলা তা’রা তব মুখ চেয়ে!
বলে, ‘তুমি মা হবে আমার?’ ভেবে কী যে!
তুমি বুকে চেপে ধর, চক্ষু ওঠে ভিজে
জননীর কর”ণায়! মনে হয় যেন
সকলের চেনা তুমি, সকলেরে চেন!
তোমারি দেশের যেন ওরা ঘরছাড়া
বেড়াতে এসেছে এই ধরণীর পাড়া
প্রবাসী শিশুর দল। যাবে ওরা চ’লে
গলা ধ’রে দুটি কথা ‘মা আমার’ ব’লে!
হয়ত আসিয়াছিল, যদি পড়ে মনে,
অথবা সে আসে নাই-না এলে স্মরণে!
যে-দুরন- গেছে চ’লে আসিবে না আর,
হয়ত তোমার বুকে গোরস’ান তার
জাগিতেছে আজো মৌন, অথবা সে নাই!
মন ত কত পাই-কত সে হারাই..
সর্বসহা কন্যা মোর! সর্বহারা মাতা!
শূন্য নাহি রহে কভু মাতা ও বিধাতা।
হারা-বুকে আজ তব ফিরিয়াছে যারা-
হয়ত তাদেরি স্মৃতি এই ‘সর্বহারা’!
ফরিয়াদ
এই ধরণীর ধূলি-মাখা তব অসহায় সন্তান
মাগে প্রতিকার, উত্তর দাও, আদি-পিতা ভগবান!-
আমার আঁখির দুখ-দীপ নিয়া
বেড়াই তোমার সৃষ্টি ব্যাপিয়া,
যতটুকু হেরি বিস্ময়ে মরি, ভ’রে ওঠে সারা প্রাণ!
এত ভালো তুমি? এত ভালোবাসা? এত তুমি মহীয়ান্?
ভগবান! ভগবান!
তোমার সৃষ্টি কত সুন্দর, কত সে মহৎ, পিতা!
সৃষ্টি-শিয়রে ব’সে কাঁদ তবু জননীর মতো ভীতা!
নাহি সোয়াসি-, নাহি যেন সুখ,
ভেঙে গড়ো, গড়ে ভাঙো, উৎসুক!
আকাশ মুড়েছ মরকতে-পাছে আঁখি হয় রোদে ম্লান।
তোমার পবন করিছে বীজন জুড়াতে দগ্ধ প্রাণ!
ভগবান! ভগবান!
রবি শশী তারা প্রভাত-সন্ধ্যা তোমার আদেশ কহে-
‘এই দিবা রাতি আকাশ বাতাস নহে একা কারো নহে।
এই ধরণীর যাহা সম্বল,-
বাসে-ভরা ফুল, রসে-ভরা ফল,
সু-স্নিগ্ধ মাটি, সুধাসম জল, পাখীর কন্ঠে গান,-
সকলের এতে সম অধিকার, এই তাঁর ফরমান!’
ভগবান! ভগবান!
শ্বেত পীত কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ।
আমরা যে কালো, তুমি ভালো জান, নহে তাহা অপরাধ!
তুমি বল নাই, শুধু শ্বেতদ্বীপে
জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,
সাদা র’বে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান।
সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!
ভগবান! ভগবান!
তব কনিষ্ঠ মেয়ে ধরণীরে দিলে দান ধুলা-মাটি,
তাই দিয়ে তার ছেলেদের মুখে ধরে সে দুধের বাটি!
ময়ূরের মতো কলাপ মেলিয়া
তার আনন্দ বেড়ায় খেলিয়া-
সন্তান তার সুখী নয়, তারা লোভী, তারা শয়তান!
ঈর্ষায় মাতি’ করে কাটাকাটি, রচে নিতি ব্যবধান!
ভগবান! ভগবান!
তোমারে ঠেলিয়া তোমার আসনে বসিয়াছে আজ লোভী,
রসনা তাহার শ্যামল ধরায় করিছে সাহারা গোবী!
মাটির ঢিবিতে দু’দিন বসিয়া
রাজা সেজে করে পেষণ কষিয়া!
সে পেষণে তারি আসন ধসিয়া রচিছে গোরস’ান!
ভাই-এর মুখের গ্রাস কেড়ে খেয়ে বীরের আখ্যা পান!
ভগবান! ভগবান!
জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,
মাটির মালিক তাঁহারাই হন-
যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।
নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান।
ভগবান! ভগবান!
অন্যায় রণে যারা যত দড় তারা তত বড় জাতি,
সাত মহারথী শিশুরে বধিয়া ফুলায় বেহায়া ছাতি!
তোমার চক্র রুধিয়াছে আজ
বেনের রৌপ্য-চাকায়, কি লাজ!
এত অনাচার স’য়ে যাও তুমি, তুমি মহা মহীয়ান্ ।
পীড়িত মানব পারে না ক’ আর, সবে না এ অপমান-
ভগবান! ভগবান!
ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহি ক’ আর!
‘ মরিয়া’র মুখে মারণের বাণী উঠিতেছে ‘মার মার!’
রক্ত যা ছিল ক’রেছে শোষণ,
নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ!
শত শতাব্দী ভাঙেনি যে হাড়, সেই হাড়ে ওঠে গান-
‘ জয় নিপীড়িত জনগণ জয়! জয় নব উত্থান!
জয় জয় ভগবান!’
তোমার দেওয়া এ বিপুল পৃথ্বী সকলে কবির ভোগ,
এই পৃথিবীর নাড়ী সাথে আছে সৃজন-দিনের যোগ।
তাজা ফুল ফলে অঞ্চলি পুরে
বেড়ায় ধরণী প্রতি ঘরে ঘুরে,
কে আছে এমন ডাকু যে হরিবে আমার গোলার ধান?
আমার ক্ষুধার অন্নে পেয়েছি আমার প্রাণের ঘ্রাণ-
এতদিনে ভগবান!
যে-আকাশে হ’তে ঝরে তব দান আলো ও বৃষ্টি-ধারা,
সে-আকাশ হ’তে বেলুন উড়ায়ে গোলাগুলি হানে কা’রা?
উদার আকাশ বাতাস কাহারা
করিয়া তুলিছে ভীতির সাহারা?
তোমার অসীম ঘিরিয়া পাহারা দিতেছে কা’র কামান?
হবে না সত্য দৈত্য-মুক্ত? হবে না প্রতিবিধান?
ভগবান! ভগবান!
তোমার দত্ত হসে-রে বাঁধে কোন্ নিপীড়ন-চেড়ী?
আমার স্বাধীন বিচরণ রোধে কার আইনের বেড়ী?
ক্ষুধা তৃষা আছে, আছে মোর প্রাণ,
আমিও মানুষ, আমিও মহান্ !
আমার অধীনে এ মোর রসনা, এই খাড়া গর্দান!
মনের শিকল ছিঁড়েছি, পড়েছে হাতের শিকলে টান-
এতদিনে ভগবান!
চির-অবনত তুলিয়াছে আজ গগনে উ”চ শির।
বান্দা আজিকে বন্ধন ছেদি’ ভেঙেছে কারা-প্রাচীর।
এতদিনে তার লাগিয়াছে ভালো-
আকাশ বাতাস বাহিরেতে আলো,
এবার বন্দী বুঝেছে, মধুর প্রাণের চাইতে ত্রাণ।
মুক্ত-কন্ঠে স্বাধীন বিশ্বে উঠিতেছে একতান-
জয় নিপীড়িত প্রাণ!
জয় নব অভিযান!
জয় নব উত্থান
ছাত্রদলের গান
আমরা শক্তি আমরা বল
আমরা ছাত্রদল।
মোদের পায়ের তলায় মুর্সে তুফান
উর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
বিষম চলার ঘায়!
যুগে-যুগে রক্তে মোদের
সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদরে কক্ষচ্যুত ধুমকেতু-প্রায়
লক্ষহারা প্রাণ,
আমরা ভাগ্যদেবীর যজ্ঞবেদীর
নিত্য বলিদান।
যখন লক্ষ্মীদেবী স্বর্গে ওঠেন,
আমরা পশি নীল অতল,
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা ধরি মৃত্যু-রাজার
যজ্ঞ-ঘোড়ার রাশ,
মোদের মৃত্যু লেখে মোদের
জীবন-ইতিহাস!
হাসির দেশে আমরা আনি
সর্বনাশী চোখের জল।
আমরা ছাত্রদল।।
সবাই যখন বুদ্ধি যোগায়,
আমরা করি ভুল।
সাবধানীরা বাঁধ বাঁধে সব,
আমরা ভাঙি কূল।
দার”ণ-রাতে আমরা তর”ণ
রক্তে করি পথ পিছল!
আমরা ছাত্রদল।।
মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
বক্ষে ভরা বাক্,
কন্ঠে মোদের কুন্ঠ বিহীন
নিত্য কালের ডাক।
আমরা তাজা খুনে লাল ক’রেছি
সরস্বতীর শ্বেত কমল।
আমরা ছাত্রদল।।
ঐ দারুণ উপপ্লাবের দিনে
আমরা দানি শির,
মোদের মাঝে মুক্তি কাঁদে
বিংশ শতাব্দীর!
মোরা গৌরবেরি কান্না দিয়ে
ভ’রেছি মা’র শ্যাম আঁচল।
আমরা ছাত্রদল।।
আমরা রচি ভালোবাসার
আশার ভবিষ্যৎ
মোদের স্বর্গ-পথের আভাস দেখায়
আকাশ-ছায়াপথ!
মোদের চোখে বিশ্ববাসীর
স্বপ্ন দেখা হোক সফল।
আমরা ছাত্রদল।।
গোকুল নাগ
না ফুরাতে শরতের বিদায়-শেফালি,
না নিবিতে আশ্বিনের কমল-দীপালি,
তুমি শুনেছিলে বন্ধু পাতা-ঝরা গান
ফুলে ফুলে হেমনে-র বিদায়-আহবান!
অতন্দ্র নয়নে তব লেগেছিল চুম
ঝর-ঝর কামিনীর, এল চোখে ঘুম
রাত্রিময়ী রহস্যের; ছিন্ন শতদল
হ’ল তব পথ-সাথী; হিমানী-সজল
ছায়াপথ-বিথী দিয়া শেফালি দলিয়া
এল তব মায়া বধূ ব্যথা-জাগানিয়া!
এল অশ্রু হেমনে-র,এল ফুল-খসা
শিশির-তিমির-রাত্রি; শ্রান- দীর্ঘশ্বাসা
ঝাউ-শাখে সিক্ত বায়ু ছায়া-কুহেলির
অশ্রু-ঘন মায়া-আঁখি, বিরহ-অথির
বুকে তব ব্যথা-কীট পশিল সেদিন!
যে-কান্না এল না চোখে, মর্মে হ’ল লীন,
বক্ষে তাহা নিল বাসা, হ’ল রক্তে রাঙা
আশাহীন ভালবাসা, ভাষা অশ্রু-ভাঙা!
বন্ধু, তব জীবনের কুমারী আশ্বিন
পরিল বিধবা বেশ করে কোন্ দিন,
কোন্ দিন সেঁউতির মালা হ’তে তার
ঝ’রে গেল বৃন-গুলি রাঙা কামনার-
জানি নাই; জানি নাই, তোমার জীবনে
হাসিছে বি”েছদ-রাত্রি, অজানা গহনে
এবে যাত্রা শুরু তব, হে পথ-উদাসী!
কোন্ বনান-র হ’তে ঘর-ছাড়া বাঁশী
ডাক দিল, তুমি জান। মোরা শুধু জানি
তব পায়ে কেঁদেছিল সারা পথখানি!
সেধেছিল, এঁকেছিল ধূলি-তুলি দিয়া
তোমার পদাঙ্ক-স্মৃতি।
রহিয়া রহিয়া
কত কথা মনে পড়ে! আজ তুমি নাই,
মোরা তব পায়ে-চলা পথে শুধু তাই
এসেছি খুঁজিতে সেই তপ্ত পদ-রেখা,
এইখানে আছে তব ইতিহাস লেখা।
জানি না ক’ আজ তুমি কোন্ লোকে রহি’
শুনিছ আমার গান হে কবি বিরহী!
কোথা কোন্ জিজ্ঞাসার অসীম সাহারা,
প্রতীক্ষার চির-রাত্রি, চন্দ্র, সুর্য, তারা,
পারায়ে চলেছ একা অসীম বিরহে?
তব পথ-সাথী যারা-পিছু ডাকি’ কহে,
‘ওগো বন্ধু শেফালির, শিশিরের প্রিয়!
তব যাত্রা-পথে আজ নিও বন্ধু নিও
আমাদের অশ্রু-আর্দ্র এ স্মরণখানি!’
শুনিতে পাও কি তুমি, এ-পারে ও-পারে?
এ কাহার শব্দ শুনি মনের বেতারে?
কতদূরে আছ তুমি কোথা কোন্ বেশে?
লোকান-রে, না সে এই হৃদয়েরি দেশে
পারায়ে নয়ন-সীমা বাঁধিয়াছ বাসা?
হৃদয়ে বসিয়া শোন হৃদয়ের ভাষা?
হারায়নি এত সূর্য এত চন্দ্র তারা,
যেথা হোক আছ বন্ধু, হওনি ক’ হারা!
সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,
সব আছে! নাই শুধু সেই নিতি নিতি
নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,
আরো প্রিয় ক’রে পাওয়া চির প্রিয়জনে-
আদি নাই, অন- নাই, ক্লানি- তৃপ্তি নাই-
যত পাই তত চাই-আরো আরো চাই,-
সেই নেশা, সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান
সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান,-
সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল,
সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল!
আজ সেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে
শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে!….
হে নবীন, অফুরন- তব প্রাণ-ধারা।
হয়ত এ মরু-পথে হয়নি ক’ হারা,
হয়ত আবার তুমি নব পরিচয়ে
দেবে ধরা; হবে ধন্য তব দান ল’য়ে
কথা-সরস্বতী! তাহা ল’য়ে ব্যথা নয়,
কত বাণী এল, গেল, কত হ’ল লয়,
আবার আসিবে কত। শুধু মনে হয়
তোমারে আমরা চাই, রক্তমাংসময়!
আপনারে ক্ষয় করি’ যে অক্ষয় বাণী
আনিলে আনন্দ-বীর, নিজে বীণাপাণি
পাতি’ কর লবে তাহা, তবু যেন হায়,
হৃদয়ের কোথা কোন্ ব্যথা থেকে যায়!
কোথা যেন শূন্যতার নিঃশব্দ ক্রন্দন
গুমরি’ গুমরি’ ফেরে, হু-হু করে মন!
বাণী তব- তব দান- সে তা সকলের,
ব্যথা সেথা নয় বন্ধু! যে ক্ষতি একের
সেথায় সান-্বনা কোথা? সেথা শানি- নাই,
মোরা হারায়েছি,- বন্ধু, সখা, প্রিয়, ভাই।…
কবির আনন্দ-লোকে নাই দুঃখ-শোক,
সে-লোকে বিরহে যারা তারা সুখী হোক!
তুমি শিল্পী তুমি কবি দেখিয়াছে তারা,
তারা পান করে নাই তব প্রাণ-ধারা!
‘ পথিকে’ দেখেছে তা’রা, দেখেনি ‘গোকুলে’,
ডুবেনি ক’-সুখী তা রা-আজো তা’রা কূলে!
আজো মোরা প্রাণা”ছন্ন, আমরা জানি না
গোকুল সে শিল্পী গল্পী কবি ছিল কি-না!
আত্মীয়ে স্মরিয়া কাঁদি, কাঁদি প্রিয় তরে
গোকুলে পড়েছে মনে-তাই অশ্রু ঝরে!
না ফুরাতে আশা ভাষা, না মিটিতে ক্ষুধা,
না ফুরাতে ধরণীর মৃৎ-পাত্র-সুধা,
না পূরিতে জীবনের সকল আস্বাদ-
মধ্যাহ্নে আসিল দূত! যত তৃষ্ণা সাধ
কাঁদিল আঁকড়ি’ ধরা, যেতে নাহি চায়!
ছেড়ে যেতে যেন সব স্নায়ু ছিঁড়ে যায়!
ধরার নাড়ীতে পড়ে টান! তরুলতা
জল বায়ু মাটি সব কয় যেন কথা!
যেয়ো না ক’ যেয়ো না ক’ যেন সব বলে-
তাই এত আকর্ষণ এই জলে স’লে
অনুভব করেছিলে প্রকৃতি-দুলাল!
ছেড়ে যেতে ছিঁড়ে গেল বক্ষ, লালে লাল
হ’ল ছিন্ন প্রাণ! বন্ধু, সেই রক্ত ব্যথা
র’য়ে গেল আমাদের বুকে চেপে হেথা!
হে তরুণ, হে অরুণ, হে শিল্পী সুন্দর,
মধ্যাহ্ন আসিয়াছিলে সুমেরু-শিখর
কৈলাসের কাছাকাছি দারুণ তৃষ্ণায়,
পেলে দেখা সুন্দরের, স্বরগ-গঙ্গায়
হয়ত মিটেছে তৃষ্ণা, হয়ত আবার
ক্ষুধাতুর!-স্রোতে ভেসে এসেছে এ-পার
অথবা হয়ত আজ হে ব্যথা-সাধক,
অশ্রু-সরস্বতী কর্ণে তুমি কুরুবক!
হে পথিক-বন্ধু মোর, হে প্রিয় আমার,
যেখানে যে লোকে থাক/ করিও স্বীকার
অশ্রু-রেবা-কূলে মোর স্মৃতি-তর্পণ,
তোমারে অঞ্জলি করি’ করিনু অর্পণ!
সুন্দরের তপস্যায় ধ্যানে আত্মহারা
দারিদ্র্যে দর্প তেজ নিয়া এল যারা,
যারা চির-সর্বহারা করি’ আত্মদান,
যাহারা সৃজন করে, করে না নির্মাণ,
সেই বাণীপুত্রদের আড়ম্বরহীন
এ-সহজ আয়োজন এ-স্মরণ-দিন
স্বীকার করিও কবি, যেমন স্বীকার
ক’রেছিলে তাহাদের জীবনে তোমার!
নহে এরা অভিনেতা, দেশ-নেতা নহে,
এদের সৃজন-কুঞ্জ অভাবে, বিরহে,
ইহাদের বিত্ত নাই, পুঁজি চিত্তদল,
নাই বড় আয়োজন,নাই কোলাহল;
আছে অশ্রু, আছে প্রীতি, আছে বক্ষ-ক্ষত,
তাই নিয়ে সুখী হও, বন্ধু স্বর্গগত!
গড়ে যারা, যারা করে প্রাসাদ নির্মাণ
শিরোপা তাদের তরে, তাদের সম্মান।
দু’দিনে ওদের গড়া প’ড়ে ভেঙে যায়
কিন’ স্রষ্টা সম যারা গোপনে কোথায়
সৃজন করিছে জাতি, সৃজিছে মানুষ
অচেনা রহিল তা’রা। কথার ফানুস
ফাঁপাইয়া যারা যত করে বাহাদুরী,
তারা তত পাবে মালা যমের কস’রী!
‘আজ’টাই সত্য নয়, ক’টা দিন তাহা?
ইতিহাস আছে, আছে অবিষ্যৎ, যাহা
অনন- কালের তরে রচে সিংহাসন,
সেখানে বসাবে তোমা বিশ্বজনগণ।
আজ তারা নয় বন্ধু, হবে সে তখন,-
পূজা নয়-আজ শুধু করিনু স্মরণ।
আমার কৈফিয়ৎ
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’,
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে তাই সই সবি!
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে!
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে-বাণী কই কবি?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী!
কবি-বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে!
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাশ ঠেলে’।
পড়ে না ক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হয়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে!
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো ফের যেন তুই যাস জেলে!
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছা!
প্রতি শনিবারী চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা!’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি!’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা!’
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা!
মৌ-লোভী যত মৌলবী আর ‘ মোল্-লা’রা ক’ন হাত নেড়ে’,
‘দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে!
ফতোয়া দিলাম- কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও!
‘আমপারা’-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে!
হিন্দুরা ভাবে,‘ পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা’ত-নেড়ে!’
আনকোরা যত নন্ভায়োলেন্ট নন্-কো’র দলও নন্ খুশী।
‘ভায়োরেন্সের ভায়োলিন্’ নাকি আমি, বিপ্লবী-মন তুষি!
‘এটা অহিংস’, বিপ্লবী ভাবে,
‘নয় চর্কার গান কেন গা’বে?’
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কন্ফুসি!
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের আঙ্কুশি!
নর ভাবে, আমি বড় নারী-ঘেঁষা! নারী ভাবে, নারী-বিদ্বেষী!
‘বিলেত ফেরনি?’ প্রবাসী-বন্ধু ক’ন, ‘ এই তব বিদ্যে, ছি!’
ভক্তরা বলে, ‘নবযুগ-রবি!’-
যুগের না হই, হজুগের কবি
বটি ত রে দাদা, আমি মনে ভাবি, আর ক’ষে কষি হৃদ্-পেশী,
দু’কানে চশ্মা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ’তেছে নিদ্ বেশী!
কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুণ্ডু আমিই কি বুঝি তার কিছু?
হাত উঁচু আর হ’ল না ত ভাই, তাই লিখি ক’রে ঘাড় নীচু!
বন্ধু! তোমরা দিলে না ক’ দাম,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান!
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব’লে অ-মূল্যে নেন! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু?
বন্ধু! তুমি ত দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হ’ল শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে!
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তা’রে করিনু বিকল,
তবু যদি কথা শোনে সে পাগল! মানিল না ররি-গান্ধীরে।
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে’!
আমি বলি, ওরে কথা শোন্ ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস্ খোশ্-হালে!
প্রায় ‘হাফ’-নেতা হ’য়ে উঠেছিস্, এবার এ দাঁও ফস্কালে
‘ফুল’-নেতা আর হবিনে যে হায়!
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে।
বোঝে না ক’ যে সে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে,
গান শুন সবে ভাবে, ভাবনা কি! দিন যাবে এবে পান খেয়ে!
রবে না ক’ ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ’ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে।
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে!
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত, একটু নুন,
বেলা ব’য়ে যায়, খায়নি ক’ বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায়!
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছে কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন?
আমরা ত জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস!
কত শত কোটি ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটি টাকা, এল না স্বরাজ!
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ।
মা’র বুক হ’তে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস!
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ!
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে!
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসে না ক’ মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে!
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে!
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথায় উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে।
প্রার্থনা ক’রো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ!
ভালো লাগলে আপনার কবিতা প্রেমী বন্ধু ও প্রিয়জনদের সাথে শেয়ার করুন।..
ভালো থাকুন, কবিতায় থাকুন।..
Thank You, Visit Again…
Tags – Bangla Kobita, Bengali Poem, Nazrul Islam