খাবার শেষ করে বিল দেবার সময় পকেটে হাত দিতেই বুকটা ধাড়াস করে উঠলো। মানিব্যাগটা নেই। সম্ভবত তাড়াহুড়ো করে বেরুবার সময় আনতে ভুলে গেছি। আমার সামনে স্প্যানিশ একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। ওয়েটারের পোষাক পরা মেয়েটি কৌতুহলের সাথে তাকিয়ে আমাকে দেখছে। মেয়েটি মাঝারি আকৃতির, মুখে ছোট ছোট ব্রণের দাগ।ফ্যাকাশে গায়ের রং, মনে হয় কতদিন না জানি সূর্যের আলোতে সে যায়নি। ছোট করে ছাটা চুল। পায়ে খুব সাধারন একজোড়া স্যান্ডেল। সম্ভবত খুব বড় ধরনের ঝামেলায় ফেঁসে গেলাম।
— আমি খুবই দুঃখিত সেনোরিটা। আমি আমার মানিব্যাগটা আনতে ভুলে গেছি। আমার মোবাইলটা রেখে দাও। আমি টাকা দিয়ে ফোনটা নিয়ে যাবো।
মেয়েটি অপলকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর বাড়িয়ে দেয়া দামি ফোনটা দেখছে। হতাশ হয়ে সে মাথা নাড়লো। সম্ভবত ভাবছিল কটা টাকার জন্য দামি একটা ফোন রাখাটা ঠিক হবেনা। ফোনটা হারিয়ে ফেললে বড় কোন অঙ্কের জরিমানা দিতে হবে তাকে। মাথা নেড়ে সে আমাকে বললো টাকাটা যেন মনে করে দিয়ে যাই।
বাড়ি ফিরে সেই ঘটনাটা একপ্রকার ভুলে গেলাম। চারদিন পর সেই হোটেলটার সামনে দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ মনে পড়লো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ এখনো মেয়েটির টাকা আমি দেইনি। তাড়াতাড়ি হোটেলে প্রবেশ করে মেয়েটিকে খুঁজে বের করলাম। খাবারের মূল্যটা ওর হাতে দিতে দিতে খেয়াল করলাম মুখের বা পাশে কালো দাগ।
— “আমি ভেবেছিলাম তুমি আর আসবেনা। বেশিভাগ মানুষই এরকম করে।” মেয়েটি আমাকে বললো।
— “সত্যি আমার মনে ছিলনা সেনোরিটা। তুমি কি পড়ে গেছিলে কোথাও?” ওর গালের কালো দাগটা দেখিয়ে বললাম।
— “তুমি সেদিন চলে যাবার পর মালিক পয়সা চাইলো। বললাম তোমার কাছে পয়সা ছিলনা। মালিক ভাবলো আমাক বোকা বানিয়ে তুমি চলে গেছো। তাই একটু শাস্তি দিয়েছে”। ছোট করে হেসে বললো মেয়েটি।
লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিলো তখন। আমারি ভুলে বিদেশী একটি মেয়ে অপমানিত আর লাঞ্চিত হলো। ক্ষমা চাইলাম মেয়েটির কাছে। মেয়েটি অবাক হয়ে বললো , “আমি সামান্য একটি হোটেল ওয়েটার সিনর। আমার কাছে ক্ষমা চাইবার কিছু নেই। ভালো লাগছে বরং তুমি তোমার কথা রেখেছো সেটার জন্য”। বিদায় নেবার সময় মেয়েটির নাম জানতে পারলাম। ওর নাম ক্যাথরিন।
এরপর আমি প্রায়ই “লা সালভাডো” রেস্তোরায় যেতাম। অনেকটা অনুতপ্ত হয়ে। ক্যাথরিন আমাকে দেখলে মেনুকার্ড নিয়ে হাজির হতো তার চিরচেনা হাসি দিয়ে। তারপর স্প্যানিশে জিজ্ঞাস করতো “কোমো এসতাস্তাদ সিনর?”। আমি তাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করতাম, “আজ কোন আইটেমটা ভালো করে রান্না হয়েছে? সেটা আনো”। ক্যাথরিন কখনো টক দিয়ে মাংস, কখনো সামুদ্রিক মাছ আনতো। গরম সসেজ কিংবা ছোট্ট এক গ্লাস ক্যাভিয়ার। ব্যাস, আমার ওতেই চলতো। ছোট্ট হোটেলটাতে তেমন কাস্টমার কখনো থাকতো না। ফলে খেতে খেতে ক্যাথরিনের সাথে গল্প করার সুযোগ হতো। ক্যাথরিনের প্রথম জিজ্ঞাসা ছিল, “আচ্ছা তুমি কি ইন্ডিয়ান?”
— হ্যা ।
— তো স্পেনে কি করছো?
— পড়াশুনা করতে এসেছি। এখানের একটি ইউনিভার্সিটিতে পি এইচ ডি করছি । তোমার কথা বলো ক্যাথরিন। তোমার কে কে আছে?
— আমার কেউই নেই। বাবা মা ছোটবেলায়ই মারা যান। এই হোটেল মালিক আমার আঙ্কেল হোন। তার কাছেই মানুষ হয়েছি আমি। আঙ্কেল মানুষটা ততটা খারাপ নন। কিন্তু আমরা খুব দরিদ্র। কোনরকমে হোটেল চালিয়ে বেঁচে আছি”। ঠোঁটের কোণে একফালি হাসি ঝুলিয়ে ক্যাথরিন বললো।
ক্যাথরিনের জন্য খুব মায়া হতো আমার। বিদেশের এই জীবনে চেনাজানা মানুষ বলতে এক ক্যাথরিনই আছে। মেয়েটা কত সমস্যায় জীবনটা পার করছে। একা নিঃসঙ্গ আর চরম দোদুল্যমান একটা লাইফ। সামনের দিনগুলিতে কি আছে কে জানে। পড়াশুনা করতে পারেনি, হোটেলের ধোঁয়া আর কাস্টমারের দয়ার উপর নির্ভর করছে জীবন। তবু আমি চেষ্টা করি যতটা সম্ভব ক্যাথরিনকে সঙ্গ দেয়ার।
আমার নিজের কথা বলি। বাবা মা আর আমার ছোট বিড়াল “দুরন্ত’র” কথা শোনাই। শত শত মাইল দূরে ফেলে আসা আমার প্রিয় দেশটার কথা বলি। নিস্তব্ধ রাতের ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক, বর্ষার টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ কিংবা ভরা জোছনাকে আমি যে কতটা মিস করছি সেসব বলি ক্যাথরিনকে। কাজ না থাকলে মাঝে মাঝেই দেখা যায় সন্ধ্যায় কোন এক টেবিলে বসে ক্যাথরিনের সাথে আমি গল্পের ঝাঁপি খুলে বসেছি। বিদেশিনী মেয়েটা তন্ময় হয়ে শুনতো আমার সব ব্যাথা বেদনা।
একদিন ক্যাথরিনের সাথে ওদের কিচেনে যাই। ইচ্ছা ছিল ক্যাথরিনকে কিছু রান্না করে খাওয়াবো। ইন্ডিয়ান সুপারশপ থেকে কিনে আনা চাল, ডাল আর মসলা খুলে লেগে গেলাম রান্না করতে। গ্যাসের চুলোয় বসিয়ে দিলাম চাল ডালের মিশ্রন, সাথে তাজা অলিভ অয়েল দিয়ে সাধ্যমতন বানালাম বাঙ্গালী খিচুড়ি। খুব পছন্দ করেছিল ক্যাথরিন আমার বানানো খিচুড়ি। খেতে খেতে ঠাট্টা করে বলতে লাগলো, “পার্মানেন্ট আমাদের হোটেলে রাঁধুনির চাকরিটা নিয়ে নাও”। আমিও হাসলাম।
সেদিন শপিংমলে কেনাকাটা করার সময় দুটো ফ্রি টিকেট পাই ফুটবল খেলার। টিকেট দুটো হাতে নিয়ে ভাবছিলাম কি করবো। ক্যাথরিনকে বললে কেমন হয়? ওর কথা ভাবতে ভাবতে “লা সালভাডো” হোটেলে চলে গেলাম। ক্যাথরিনের বুড়ো আঙ্কেল আজ আমাকে দেখতে পেয়েই কেমন ক্ষেপে গেলেন। ছুটে এসে অশালীন সব গালাগালির তুবরি ছোটালেন। যার বেশিভাগই ক্যাথরিন আর আমাকে ঘিরে। ক্যাথরিন ছুটে এসে আমাকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে গেলো, “আঙ্কেলের কথায় তুমি কিছু মনে করোনা। তিনি এখন মাতাল হয়ে আছেন। তাই এরকম করছেন”। চলে যাচ্ছিলাম তখন, ক্যাথরিন আমাকে পেছন থেকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলো, “এখন কেন এসেছিলে সেটা তো বললে না”।
— “ফুটবল ম্যাচ দেখার দুটো টিকেট পেয়েছি। ভাবছিলাম আমার সাথে ম্যাচ দেখতে তুমি যাবে কিনা”। কিছুক্ষন ইতস্তত করে বলে ফেললাম।
জবাবে ক্যাথরিন কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসী গলায় বললো, “তুমি কি সত্যি আমাকে নিয়ে ম্যাচ দেখতে যাবার কথা ভেবেছো?”। আমাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ক্যাথরিন ভেতরে চলে গেলো তারপর কাপড় পাল্টে চলে এসে নীচু কন্ঠে বললো,”আমি কখনো ভাবিনি আমার মত সামান্য মানুষকে কেউ এরকম গুরুত্ব দেবে”। চোখমুখ উজ্জ্বল করে ক্যাথরিন ম্যাচটা দেখলো আমার পাশে বসে। সারাক্ষন আনন্দে ঝলমল করছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম , “আহা কি দূর্ভাগা মেয়ে। আজ পর্যন্ত কোথাও একটু সহানুভূতি পায়নি।”
হটাৎই একদিন দেশ থেকে ডাক আসলো আমার। বাবা ভীষন অসুস্থ। ব্যাগ গুছিয়ে এয়ারপোর্টে যাবার সময় “লা সালভাডো” হোটেলে গেলাম। ক্যাথরিনকে বললাম কিছুদিনের জন্য ইন্ডিয়া যেতে হবে। ব্যাথার একটা ছাপ দেখেছিলাম ওর চেহারায়। ব্যাগ্র কন্ঠে জানতে চাইলো, “ফিরে আসবে তো?”। মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সাথে আরো বললাম, “আসার সময় তোমার ব্যাঙের ডাক, বৃষ্টির শব্দ আর ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক রেকর্ড করে নিয়ে আসবো।
দুটো মাস ইন্ডিয়াতে কাটিয়ে আবার স্পেনে ফিরে আসলাম। বাবা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বেশ রাত হলো, এয়ারপোর্ট থেকে নিজের বাড়িতে ফেরার সময় মন কিছুতেই মানলো না। ক্যাথরিনের সাথে দেখা করে তবেই বাড়ি যাবো ঠিক করলাম। লা সালভাডো রেস্তোরার সামনে দাঁড়িয়ে বিভ্রান্তবোধ করলাম। রেস্তোরাটা ধ্বংসস্তুপের মতন। পুরনো হোটেলটা কেমন কালো হয়ে আছে। বুকের পাঁজড়টা কেমন অজানা আশংকায় কাঁপতে লাগলো। পাশের স্টোরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মাফ করবেন, বলতে পারেন এই হোটেলের মানুষগুলো কই?”
— “কেন জানেন না? হোটেলের মানুষ তো সব মারা গেছে। বুড়ো এডওয়ার্ড আর ওর ভাইজি ক্যাথরিন। মাসখানেক আগেই আগুন লেগে দুজনই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। গ্যাসের চুলো থেকে আগুন লেগেছিল। ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে দুজনই পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছিল।” নির্বিকার কন্ঠে বললো স্টোরের কর্মচারিটা।
ঘোর লাগা চোখে সেদিন আমি লা সালভাডোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আজও হঠাৎ হঠাৎ রাতে আমি ফ্রাঙ্কো রোডে একা হাঁটতে থাকি। শীতের কুয়াশায় স্পেনের বিলবাওয়ের রাস্তাটা যেন জমাট বাঁধা বরফে রূপান্তরিত হয়। আমি পুড়ে যাওয়া এল সালভাডো হোটেলটার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ফোনের হেডফোনে বাজতে থাকে রেকর্ড করে আনা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। পরম আগ্রহে হোটেলটার দিকে তাকাই। অনুভব করার চেষ্টা করি খুব সাধারন কাপড় পরা ছোট একটি স্প্যানিশ মেয়ের মুখটাকে। ভীতু আর লাজুক চোখদুটোকে খুঁজি ধ্বংসস্তুপের মাঝে। জানিনা আমি কিসের টানে সেখানে যাই। তবে স্পেনের রাস্তায় আমি হাঁটতে থাকি। ব্যাথার সুতীব্র যাতনা ছড়িয়ে পড়ে শিরায় শিরায়। কেন ব্যাথার বেদনা হয় তা জানিনা।