“হ্যাঁ অ্যাফেয়ার্স চলছে।শুনতে চাও আর কিছু!”
“মানে?”
“মানে, মানে কি? অ্যাফেয়ার্স চলছে।সুমনার সাথে। আমরা একসাথে কাজ করি!”
“তুমি এতো সহজে কি করে বলছো কথাটা!”
“ব্যাপার টা সহজ বলেই বলছি।হয়ে গেছে,হয়ে গেছে কি করার থাকতে পারে।অত ভাবিনি প্রথমে, ক্যাজুয়াল বন্ধুত্ব ছিল, তারপর কখন ওর প্রতি অ্যাট্রাক্টেড হয়ে পড়েছি,বুঝতেও পারিনি।”
“এই কথাটা তোমার নিজের স্ত্রীর সামনে বলতে লজ্জা করছেনা?”
“না করছেনা। লজ্জা করার কি আছে! ইটস ন্যাচারাল।কত মানুষ ই বিয়ের পরে আবার প্রেমে পড়ে।”
“অ্যান্ড ইউ সেইড দ্যাট। এতোই সহজ! আমার কি হবে অর্ণব? “
“তোমার কি হবে! বিয়ে যখন করেছি দেখবো তোমাকেও!”
“আর ওই মেয়েটার! ওর সাথে কি করবে?”
“ওর সাথে এখন ব্রেক-আপ করা পসিবল নয়।আমরা অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছি।”
“জীবন টা তোমার কাছে খেলা মনে হচ্ছেনা?”
“সেটা কখন বললাম!”
“তোমার জীবনে বিশ্বাস, লয়্যালটি এসব কোনো কিছুর মূল্য নেই? আমি যে আমার সবকিছু ছেড়ে তোমার কাছে এসেছি এটা তোমার কাছে কোনো ভ্যালু রাখেনা?”
“তুমি ফালতু সিন ক্রিয়েট করছো!”
“ফালতু সিন ক্রিয়েট করছি! হাউ ডেয়ার ইউ অর্ণব। আমি তোমাকে ভালোবেসে আমার সবকিছু দিয়েছি।আর তুমি আমার বিশ্বাস, আমার ভালোবাসা সবকিছু কে মজা ভেবে নিলে! হাউ কুড ইউ!”
“দেখো আমার এখন তর্ক করতে ভালো লাগছেনা।পরিষ্কার তোমাকে জানিয়ে দিলাম।এবার তুমি যা মন চায় করো।”
অর্ণব বেরিয়ে গেলে মহুল বিছানার উপর মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে।গা গুলিয়ে উঠছে ওর। হে ঈশ্বর এরকম কেন হল! তার কি অপরাধ ছিল! সেতো বিশ্বাসের ইঁট গুলো দিয়ে এই ভালোবাসার দালানটাকে গড়ে তুলেছিল। আবেগ,অনুভূতি স্মৃতি মিশিয়ে একটা জীবন বেঁধে তুলতে চেয়েছিল।তার সাথে এটা কেন হল!
এর কি উত্তর হতে পারে জানা নেই। ওর মনে হল কোনো ঝড় এসে ওর সবকিছু তছনছ করে দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুচোখে বৃষ্টি নামল মহুলের। সব ভালোর ই হয়ত একটা শেষ থাকে।
(২)
অর্ণব মহুলের বুকের কাছে সরে এসে বলেছিল,”যেমন ভাবে চাইছো! তেমন ভাবেই ধরা দেবো তোমার কাছে, ঠিক জলের মতো।তুমি আমার আধার হবে।আমি তোমার আকার নেবো।” কথাগুলো শুনতে ভীষণ ভালোই লেগেছিল।একটা ছেলে তাকে এতো ভালোবাসে,এত সহজ ভাবে সামনে এসে ধরা দেয়,নির্দ্বিধায় চোখের ভাষা পড়ে নেয়,বাবার মতো আগলে রাখে,আর কি চায়? মহুল পাপড়ি গুলো সযত্নে সরিয়ে পরাগ মেলে ধরেছিল অর্ণবের সামনে। অর্ণব বিচলিত মৌমাছির মতো মধু আহরণ করেছিল সেই ফুল থেকে। কদিন ই বা হল? চার বছর.. তাদের বিয়েই তো তিন বছর হতে চলল। ছাদে এসে একটা চেয়ার টেনে বসল মহুল। বিশ্ব সংসারের যাবতীয় নিম্নচাপ তার উপর ঘনিয়ে এসেছে। বেশ কিছুমাস হল অর্ণবের ব্যবহারে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছিল সে।প্রথমে গা করেনি।কিন্তু দু-সপ্তাহ আগে যেটা হল,তারপর সত্যি বলতে আর কিছু বলার ই থাকেনা। মহুল এমনিতে ওই টিপিক্যাল সন্দেহবাতিক স্ত্রীদের মতো নয়, যারা তাদের স্বামীকে প্রতি পদক্ষেপে সন্দেহ করে, সে খুব শান্ত এবং গভীর প্রকৃতির; নিজের স্বামীর উপর তার অগাধ বিশ্বাস। সত্যি বলতে না করার তো কোনো কারণ ও ছিলনা। ছয় বছর ধরে প্রেম করার পর তাদের বিয়ে হয়। মহুলের বাবা মা প্রথম দিকে একটু আপত্তি করেছিল, কিন্তু অর্ণবের চাকরি পেয়ে যাবার পর তারা আর বাধা দেননি। কারণ ও ছিল না। ছেলে চাকরি করে,মেয়েকে ভালোবাসে,মেয়েও তাকে ভালোবাসে, বিয়ে না দেওয়ার কোনো কারণ ই ছিলনা। সবকিছু এত মসৃণ গতিতে এগিয়ে যাবে সেটা মহুল কল্পনাও করতে পারেনি। বিয়ের পরের একটা বছর ছিল হেমন্তের একটা সুন্দর দুপুরের মতো,উজ্জ্বল,সোনার রাংতায় মোড়া। যাকে ইংরেজিতে বলে গোল্ডেন ডে’স।উটিতে হানিমুন।সল্টলেকে নতুন ফ্ল্যাটে শিফট করা। প্রতিদিন সন্ধ্যেই বাজার থেকে কিছু না কিছু কিনে এনে নতুন সংসারটাকে ভরিয়ে তোলা।নিজের হাতে যত্ন করে সাজানো। খুব সাদামাটা অথচ যেরকম জীবনের প্রত্যাশী ছিল ও। বিয়ের এক বছরের মাথায় তার গর্ভে তার ভালোবাসার ভ্রূণ ও এসে ধরা দিল। যত্ন আত্তি তে অর্ণব ফাঁকি মেরেছে এমন কথা সে কখনও বলতে পারবেনা।বিয়ের প্রায় দু বছরের মাথায় সে একটি সুস্থ সবল কন্যা সন্তানের মা ও হয়ে যায়।তাদের সংসারে একটা নতুন দীপ্তি নিয়ে আসবে এই আশায় মহুল ওদের মেয়ের নাম রেখেছিল দীপ্তি। এ পর্যন্ত গল্পটার মধ্যে বৈচিত্র্য কিছুই ছিলনা।চারিদিকে তাকালে আর পাঁচটা স্বাভাবিক সুন্দর সংসার যে আবর্তে পাক খায় তাদেরটাও তার ব্যতিক্রম ছিলনা।
কিন্তু তার কয়েকমাস যেতে না যেতেই একটা ব্যাপার মহুলের বুকে এসে বিঁধতে লাগলো। কোনো একটা কারণে অর্ণবের মানসিক অবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন ঘটে যায়… সেই কারণ আন্দাজ করার বহু আগেই মহুল বুঝতে পারে তার আর অর্ণবের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে।সে দূরত্ব কোনো স্কেল দিয়ে মাপা যায়না,কিন্তু অনুভব করা যায়। আগে অর্ণব তার ছোট থেকে ছোট থেকে ব্যাপারেও খেয়াল রাখতো,সে ঠিকমতো খেলো কিনা,তার কিছু লাগবে কিনা! দীপ্তি কি করল সারাদিন!
একটু একটু করে অর্ণব উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলে।কেমন যেন উদাসীন হয়ে পড়ে।কথা বলার সময় অনেকক্ষণ ভাবে।কিসের না কিসের চিন্তায় সারাক্ষণ মশগুল থাকে।অফিস থেকে কোনো কোনোদিন অনেক রাত্রি করে বাড়ি ফেরে,সেই মানুষ টাই যে একসময় অফিস থেকে সবার আগে বেরিয়ে আসতো কেবল মহুলের সাথে সময় কাটাবে বলে।কোনো এক জাদুমন্ত্র বলে কেউ যেন তাদের মধ্যেকার ম্যাজিকটাকে সরিয়ে নিল ।প্রথম দিকে মহুলের মনে হতো,হয়ত কাজের চাপ,বিয়ের পর একটু আধটু পরিবর্তন তো সবার মধ্যেই হয়।এগুলো কে তেমন আমল দিলে হবেনা। কিন্তু বিন্দু বিন্দু জমতে জমতে কখন সিন্ধু তৈরি হয়ে যায় সেটা আর মানুষের খেয়াল থাকেনা। ট্রেন টা যখন স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায় তখন তারা বুঝতে পারে,বড্ড দেরি হয়ে গেছে।
সন্দেহের মেঘটা সেদিন ই মহুলের সারা আকাশ ছেয়ে গেল যেদিন প্রথম অর্ণব অফিস থেকে ফোন করে বলে দিল আজ সে বাড়ি ফিরবেনা।একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে,তাই কয়েকজন কো-ওয়ার্কের সাথে সেই কাজ শেষ করতে হবে। অজুহাত টা তেমন জুতসই লাগেনি মহুলের।এরকমও হয় নাকি! সেরাত দুচোখে ঘুম আসেনি তার।অনেক চিন্তা এসে ভিড় করে মনে। ভোর পর্যন্ত পৌঁছোতে পৌঁছোতে সেসব চিন্তা হাওয়াতে মিলিয়ে যায়।উল্টে প্রশ্ন গুলো করার জন্য সে নিজেকে প্রচুর ধমকায়।অর্ণবকে সন্দেহ করার কোনো কারণ থাকতে পারেনা।
সেই মহুলের মনেও দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে যখন অর্ণবের রাতে না ফেরার সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। একদিন থাকতে না পেরে ও শ্রেয়সী কে সবটা জানায়।শ্রেয়সী ওর আর অর্ণবের কলেজের বন্ধু।বিয়ের পরও অল্পবিস্তর যোগাযোগ আছে ওর সঙ্গে। সবটা শুনে শ্রেয়সী ই প্রথম বলে অর্ণবের হয়তো অ্যাফেয়ার্স চলছে। এই খেয়াল যে তার মনে একবারের জন্যও আসেনি এটা মহুল বলতে পারবেনা। কিন্তু তবু ও শ্রেয়সীকে অনেক কথা শোনায় সেদিন।কিন্তু মহুল জানে কথাগুলো সেদিন সে নিজেকেই শোনাচ্ছিল।
তারপর সেই কল্পনাতীত খেয়ালটাই একদিন সত্যি হয়ে গেল… মুহূর্তের মধ্যে মহুলের সবকিছু পাল্টে গেল।কোনোদিন যে এরকম কদর্য সত্যের মুখোমুখি হতে হবে সে ভাবতেও পারেনি। পারতো কি করে,সে যে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল…
(৩)
বাড়ি চলে আসার সিদ্ধান্ত মহুল ঠিকই নিয়েছিল।এখন ভীষণ ভাবে সেটা মনে হচ্ছে তার।আবহাওয়া গুমোট হয়ে উঠেছিল,ওই পরিবেশে সে কোনো মতেই তার মেয়েকে রাখতে পারতোনা। অন্যের প্রাসাদের থেকে নিজের কুঁড়েঘর অনেক শ্রেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে মহুল নিজেকেই বলল,এ পৃথিবীতে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। যে বাড়িটাকে নিজের বাড়ি ভাবছিল সেটা কখন অন্য একজনের হয়ে উঠল। বছর খানেক আগেও কি ও এখানে বসে এই এক প্রশ্ন রাখতে পারতো! অথচ এখন ওর এটা মেনে নিতে এতটুকু অসুবিধা হচ্ছেনা। জীবনে কোনো কিছুই প্রেডিক্টেবল নয়। কেউ ভালোবাসার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে দুবার ভাবেনা,আর কেউ দুহাতে ভালোবাসা পেয়েও তাকে অবহেলা ভরে দূরে সরিয়ে দেয়। কত মানুষ তো নিজের ভালোবাসার মানুষ টার সাথে ঘর বাঁধতেও পারেনা। বুকে পাথর রেখেও কতজন অন্য জায়গায় ঘর বাঁধে। তাকে তো ওসব কোনো ঝঞ্ঝাটের মধ্যেই যেতে হয়নি।সেতো তার ভালোবাসার মানুষ টাকেই বেছে ছিল।তবুও কি সে সুখী হল! হয়ত সুখী হওয়াটা অনেকটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে।
“সবাই তো সুখী হতে চায়,তবু কেউ সুখী হয়,কেউ হয়না।”
সেপারেশন চেয়ে নিয়েছে সে অর্ণবের কাছ থেকে।দু-একটা কথা বলে ও আটকানোর চেষ্টাও করে,কিন্তু মুখ ফুটে বিশেষ প্রতিবাদ জানাতে পারেনি। জানানোর মুখ ও ছিলনা। ফিরে যেতে চায়না আর মহুল। একটা চাকরির চেষ্টা করবে। মেয়েকে নিজের হাতেই মানুষ করবে।সিঙ্গেল মাদার হবে। কতজন সিঙ্গেল মাদার ই তো শহরের বুকে আছে। সেও নাহয় তাদের একজন হবে। ডিভোর্স চায়নি সে।কেন সেটা সে নিজেও জানেনা। হয়ত এতগুলো বছরের স্মৃতি। সেই স্কুল জীবনের ভালোবাসা। কলেজ পেরিয়ে, বিয়ের পিঁড়ি তে উঠেছিল।কম স্মৃতি তো নেই। স্কুল থেকে একসাথে বাড়ি ফেরা।বাবা মাকে লুকিয়ে ফোন করা। ছাদে বসে বসে চ্যাট করা। একই কলেজে ভর্তি হওয়া। কতবার ভেঙে পড়েছে অর্ণব। মায়ের মতো আগলেছে ও। নিজের ছেলের মতোই মনে হত ওকে। সেভাবে তো ধরা দিয়েছিল। চোখ বন্ধ করলেই এখনও কলেজের দিন গুলো ভেসে ওঠে। একসাথে ঘুরতে যাওয়া। অর্ণবের মায়ের কাছ আবদার করা। ওদের বাড়িতে কতদিন কাটিয়েছে ও। মেয়ের মতো ভালোবাসাও পেয়েছে। ওদের বাড়িতেই প্রথম নিজের সবটুকু নির্দ্বিধায় সে তুলে দিয়েছিল অর্ণব কে। “জল – আধার – আকার “,ভাবলেই কেমন করে ওঠে ভিতর টা।এতকিছু একবারে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।জীবনের কিপ্যাডে ব্যাকস্পেস তো হয়না,তাই সব কিছু মুছে ফেলে ঠিক করা যায় না।করা গেলে হয়ত ভালো হত।কিন্তু বাস্তব এরকমই নিষ্ঠুর। একলা মনে বাউন্ডুলের কবিতা আওড়ায় মহুল,
“তোমার আমার গল্পখানা নাইবা হল শেষ/এতদূর তো মিথ্যে নয় সত্যি ছিল বেশ।”