“ওরকম সোমত্ত আর সুন্দরী মেয়ে আর একটাও পাবিনা! ভালো ঘরে বিয়ে হচ্ছে সোমু তোর।” দিদানের কথাটা কানে এখনও বাজছে সোমকের। দত্ত বাড়ি সেজে উঠেছে আলোর মখমলে। সাউন্ড সিস্টেমে একটানা সানাইয়ের সুর বেজে চলেছে। গেটের বাইরে কাপড় দিয়ে ঘেরা বাঁশের তোরণ দাঁড়িয়ে আছে একা। তার উপরের দিকে, প্লেটের উপরে থার্মোকলের কাজ করে বড়ো বড়ো করে লেখা “অনুব্রতা ওয়েডস্ সোমক”
আজ সোমকের বিয়ে.. অথচ ওর মনে একবিন্দু উচ্ছ্বাস নেই।থাকবে কি করে? কারণ তাদের এই দত্ত বাড়িতে একটা অদ্ভুত প্রথা চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে.. সেই প্রথাটা অনেকটা এরকম.. এই দত্তবাড়ির ছেলেরা বিয়ের পর বাড়ি ছেড়ে মেয়েদের বাড়িতে চলে যায় আর মেয়েরা জামাই বিয়ে করে বাড়িতে আনে। বিয়ের পর দত্তবাড়ির মেয়েদের পদবী অপরিবর্তিতই থাকে, ছেলেরা চাইলে পদবী পাল্টাতেও পারে আবার নাও পারে। বিয়ের পর সন্তান হলে সে জন্মসূত্রে মাতৃকূলের পদবী লাভ করে। শুধু তাই নয়,বিয়ের রীতিতেও সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী একটা প্রথার চল আছে তাদের পরিবারে। এখানে কনেপক্ষ বিয়ের জন্য বরের বাড়িতে আসে তারপর বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে বরকে সঙ্গে করে নিয়ে যায় তাদের বাড়িতে। সেখানে একদিন পর বৌভাতের আদলে একটা রিসেপশনের আয়োজন করা হয়।
এই বিষয়টির সাথে যারা পরিচিত নয় তাদের কাছে এই রীতি ভীষণ চমকপ্রদ। অনু অর্থাৎ অনুব্রতার কাছে যখন এরকম একটা সম্পর্ক এলো, ও সাদরে গ্রহণ করেছিল। ব্যাপারটি কেবল অভিনব বলে নয়, অনুব্রতা রাজী হয়েছিল তার অন্যতম বড়ো কারণ সে বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে রাজী ছিল না। তার বাবা তাকে এত কষ্ট করে বড়ো করেছে, পড়াশোনা করিয়েছে, তার ছোটখাটো আবদারের খোঁজ নিয়েছে সেই বাবাকে ছেড়ে অন্যকোথাও সে যাবে কেন? সে বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। সে যদি বিয়ে করে অন্যকোথাও চলে যায় তাহলে তার বাবা মা একা হয়ে যাবে। সেটা সে কেন চাইবে!
অন্যদিকে ঠিক এই কারণেই সোমকের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। সেও বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তার বাবা মা আর কোনো সন্তানও নেয়নি , তার জন্মানোর পরে। এখন সেও যদি বিয়ে করে চলে যায়, তাহলে তার বাবা মাকেও বাকি জীবনটা ভূতের মতো একা একাই কাটাতে হবে। বিয়ের পর বাপের বাড়িতে ছেলেদের আসা হয়না তেমন।প্রথম দিকে ঘন ঘন এলেও,পরের দিকে ঠিক ছেদ পড়ে যায়। সংসারের চাপ। ছেলেমেয়ে মানুষ করা। আর এই জন্যই বিয়ে করার তেমন ইচ্ছে ছিলনা সোমকের… কিন্তু বাবা মায়ের জোরাজুরিতে শেষমেশ রাজী হয় সে।
কনেপক্ষ এখনও আসেনি। ছাদের একধারে দাঁড়িয়ে উঠোনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল সোমক। এই উঠোনে মাসতুতো দাদা দিদিদের সাথে কত লুকোচুরি খেলেছে ও।আচারের বয়াম চুরি করে পালানোর জন্য দিদুনের কাছে বকাও খেয়েছে কত। তার প্রথম সাইকেল চালানো শেখাও তো বাবার হাত ধরে এই উঠোনেই।দীপাবলিতে একসাথে তুবড়ি জ্বালানো, ছোটখাটো পার্বণে চাতালে একসাথে বসে আড্ডা দেওয়া, এইসব… সবকিছু পিছনে রেখে চলে যেতে হবে? সোমক জানে মা সামনে হাসিমুখে তার সাথে বিয়ে নিয়ে হাসিঠাট্টা করলেও আড়ালে চোখের জল ফেলছে। বাবাও বুঝতে দিচ্ছে না ভিতরের কষ্টটা। কিন্তু সে সবটাই বুঝতে পারছে। একটা চারাগাছকে জল দিয়ে, সার দিয়ে বড়ো করার পর যখন তাতে সবেমাত্র ফুল ধরতে শুরু করেছে ঠিক তখনই যদি বাগান বদল করা হয়, মালি বদল করা হয় তাহলে যে মালী এতদিন ধরে তাকে বড়ো করল তার প্রতি সেটা অন্যায় করা হয়। সে তো তার বাবা মাকে সেভাবে পেলোই না।একটা চাকরি করে সে যদি সারাজীবন তার বাবা মার কাছে থাকতে পারতো, যদি এমনটা হতো, তাকে বিয়ে করে কেউ তার বাড়িতে এসে থাকতো, কতই না ভালো হত। সব জায়গায় তো তাই হয়। তাদের পরিবারে কেন যে এরকম একটা নিয়ম চলে আসছে? তার একবারেই পছন্দ নয়…কেমন যেন চাপিয়ে দেওয়া। বিয়ের পর সে কোথায় থাকবে, কাদের নিয়ে থাকবে এটা তো একান্তই তার নিজের ইচ্ছে মতো হওয়া উচিৎ, কোনো একটা বস্তাপচা নিয়ম কেন বলে দেবে তাকে কি করতে হবে! নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হল সোমকের।রাগে দুঃখে চোখে জল চলে এলো..
নীচে হঠাৎ হট্টগোল শোনা গেল,”এই বউ এসে গেছে। বউ এসে গেছে।”
উলুর একটা রোল পড়ে গেল।বাড়িটা যেন হেসে উঠল লোকের সমাগমে। ওই আলোর রোশনাই, ওই সানাইয়ের শব্দ, ওই আয়োজনের দিকে সোমক চেয়ে একবার হাসল। এখন তো কেবল সময়েরই অপেক্ষা।