“এসো তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরে শুই।”,আবীর রিচার পাশে শুয়ে ওকে নিজের দিকে ফেরানোর চেষ্টা করল।
“আজ না প্লিজ “,রিচা এক ঝটকায় আবীরের হাতটা নামিয়ে দিল।এমনিতেই কত রাত হয়ে গেছে।বাইরে আকাশ কালো হয়ে আছে।চাঁদটাও মেঘের আড়ালে ঝুপ করে ডুব দিয়েছে।হাওয়ারাও অশান্ত।
“রোজ ই তো এক কথা বলো।আমি সারাদিন খাটাখাটনি করে এসেও তোমাকে একটুও কাছে পাইনা।”,আবীরের গলায় বিরক্তি ঝরে পড়ল। আজ সে ভেবেই রেখেছিল রিচাকে একটু কাছে পাবে।অনেকদিন ওকে আদর করতে পারেনি।কারণ ছিল তবে,আজ আর সে বারণ শুনতে চায়নি।
“ওমনি কেন করছো তুমি? শ্রেয়ান ঘুমোচ্ছে তো।ওর যদি ঘুম ভেঙে যায়।”
আবীর নিজেকে শান্ত করল।রিচার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”শ্রেয়ান ঘুমিয়ে গেছে দেখো।তুমি আমার সাথে ওঘরে চলো।”
“ছেলেকে ফেলে ওঘরে যাবো! তারপর ওর ঘুম ভেঙে গেলে?”,রিচার চিন্তা, এই কিছুক্ষণ আগেই সে তার ছেলেকে ঘুম পাড়িয়েছে।অনেক কষ্টে।আবার যদি ওর ঘুম ভেঙে যায়।
“ওর ঘুম ভাঙবেনা। আমি বলছি তুমি চলো।”,আবীর রিচার দুহাত ধরে আসতে করে টেনে ওকে বসালো।তারপর গালে নাক ঘষে বলল,”এসো আমার সঙ্গে।”
রিচার মনে একটা দ্বন্দ্ব দেখা দিল।সে কি করবে? এখন যদি ও উঠে না যায় তাহলে আবীরের মান হবে।ওই বেচারিকে সত্যিই সে কাল কাল করে অনেকদিন ধরে নিজের থেকে সরিয়ে রেখেছে।ওর অভিমান হওয়া স্বাভাবিক। শ্রেয়ান তো ঘুমোচ্ছে। ও যদি আবীরের সাথে পাশের ঘরে যায়,নিশ্চয় শ্রেয়ান উঠে পড়বেনা।অগত্যা মনের প্রশ্নগুলোর জট না ছাড়িয়েই রিচা বিছানা থেকে ধীরেধীরে উঠল।আবীর একটা সবুজ সংকেত পেতেই রিচাকে কোলের মধ্যে তুলে নিল।
“এই কি করছো?”,রিচা প্রায় চমকে উঠল।
“চুপ।একটাও কথা না। শ্রেয়ান ঘুমোচ্ছে না!”,আবীর রিচাকে নিয়ে পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।তারপর কোল থেকে আসতে করে ওকে বিছানার উপর শুইয়ে দিল।নিজেও ঠিক পাশটাতে শুয়ে রিচার বুকের উপর মাথাটা আলতো করে নামিয়ে রাখল।রিচার সারা শরীরে একটা তিরতিরানি শিহরণ খেলে গেল।দুহাত দিয়ে আবীরের পিঠে দশটা নখের দাগ বসিয়ে কোনোরকমে শেষ সংবরণ করার চেষ্টা করল,”করোনা।শ্রেয়ান..!”
কথাটা শেষ করার আগেই আবীর ওর ঠোঁটের উপর নিজের একটা আঙুল রাখল।তারপর ওর কানের লতিতে একটা হালকা কামড় বসিয়ে বলল,”শ্রেয়ানের একটা ভাই বা বোন হলে কেমন হয়! আমি তোমাকে অনেকদিন ধরেই বলবো ভাবছিলাম।বলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না।”
“কিন্তু..”,কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল রিচা।শরীর প্রতিবাদ করলো। শরীরের সঙ্গে মনের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, একটার ভালোলাগা খারাপ লাগার সাথে অন্যটা ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে।ওর চোখের সামনে বিয়ের পরের রাত গুলো ভেসে উঠল।আবীরের যত্ন নিয়ে ওকে টেনে ধরা।চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দেওয়া।তারপর কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেওয়া।আবীর ভালোবাসতে জানে।এতগুলো বছর ধরে ওকে আগলে রেখেছে একটা নিশ্ছিদ্র প্রহরীর মতো। রিচা মাঝেমাঝে অবহেলা করলেও করেছে,কিন্তু আবীর কখনওই ওকে অবহেলা করেনি।ওর প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনেছে।ওর পাশে থেকেছে সবসময়।
রিচার নাইটগাউন টা অল্প একটু নামিয়ে ঘাড়ের কাছে ঠোঁট নিয়ে গেল আবীর। রিচা থরথর করে কেঁপে উঠল।আবীরের চুল ধরে টেনে ধরলো আরও।আদরে আদর গুলে নিতে নিতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল খানিক টা।চোখের কোণটা যখন ভালোলাগার বৃষ্টিতে অল্প ভিজে উঠেছে ঠিক তখনই বাইরে ঝড় এলো। বুক কাঁপিয়ে দেওয়া কড়কড় আওয়াজে একটা বাজ রিচার অবচেতন ভাবটা কাটিয়ে, মনের মধ্যে সেই ভয় টা ফিরিয়ে আনল। রিচার চোখে ভেসে উঠল সেই রাত টা।এরকমই ঝড়জল মাথায় নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স টা ছুটে গিয়েছিল নার্সিংহোমে। রিচার লেবার পেইন তখন সীমাহীন। আবীর ওর হাত ধরে ক্রমাগত সাহস দিয়ে চলেছে,”কিচ্ছু হবেনা তোমার।সব ঠিক হয়ে যাবে।” কয়েকটা ছবি টুকরোটুকরো হয়ে ধরা পড়ল রিচার মনে।রিচাকে স্ট্রেচারে করে ও.টির ভিতরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।একটা চোখ ধাঁধানো আলো ভেসে উঠল।অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছিল রিচার।তারপর আসতে আসতে সবটা অবশ হতে শুরু করল।ঘুম নেমে এলো রিচার চোখে।
আবীর কে ঠেলে দিয়ে উঠে বসল রিচা।ওর সারা শরীর ঘেমে স্নান করে গেছে তখন। “শ্রেয়ান”,একটা মৃদু আর্তনাদ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পাশের ঘরে দৌড়ে গেল ও। আবীরের মাথার শিরাগুলো দপদপ করতে লাগলো।অসম্ভব রাগে – দুঃখে ও উঠে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ঘরে এলো।রিচা তখন বিছানায় শুয়ে পুতুল টার মাথায় হাত বোলাচ্ছে আর কান্নাভেজা গলায় বলছে,”কেঁদোনা সোনা। মা কোথাও যায়নি তোমাকে ছেড়ে।” দৃশ্য টা দেখে আবীরের মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল।ও বিছানায় উঠে একটান দিয়ে রিচার কাছ থেকে পুতুলটা কেড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল ঘরের এক দিকে। রিচা কঁকিয়ে উঠল,”কি করছো তুমি? শ্রেয়ানের লাগবে তো।” পুতুলটাকে কুড়োবার জন্য রিচা উঠতে গেলে আবীর ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল,”রিচা ওটা শ্রেয়ান নয়। শ্রেয়ান নেই। এটা তুমি অ্যাক্সেপ্ট করে নাও এবার। ওই পুতুল টা তোমার ছেলে হবেনা কোনোদিনও।”
রিচা আবীরের বন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল।চিৎকার করে কেঁদে উঠল,”তুমি কিচ্ছু জানো না।ওটা আমার ছেলে।আমি একটাও কথা শুনতে চাইনা তোমার কাছ থেকে।আমাকে ছেড়ে দাও তুমি। আমাকে ছেড়ে দাও প্লীজ।” বাইরের ঝড়বৃষ্টির আওয়াজে রিচার গলার আওয়াজ চাপা পড়ে গেল।আবীর ওকে শক্ত করে ধরে রেখেছে।কেউ বুঝতে পারছেনা ওকে।আবীর ও না।শ্রেয়ান ওকে ডাকছে।ও শুনতে পাচ্ছে ছেলেটা মেঝেই পরে কেঁদে চলেছে তখন থেকে,”মা, মা… মা..”
আবীরের চোখেও জল চলে এলো।ও রিচাকে আরও শক্ত করে টেনে ধরল বুকের কাছে।এই দৃশ্য ও দেখতে পারছেনা আর।দিনের পর দিন একটা পুতুল কে নিজের ছেলে ভেবে… রিচা পাগল হয়ে উঠেছে। সেদিনের পর থেকেই সব এলোমেলো হয়ে গিয়েছি । ওর রিচা। সেই দামাল মেয়েটা,যাকে পেয়ে আবীর মনে করেছিল সে নতুন একটা জীবন পেয়েছে। পুরোনো না পাওয়া গুলো ভুলে এবার অন্তত একটা স্বচ্ছ জীবন কাটাতে পারবে। সব কিন্তু ঠিক ই চলছিল।ওদের মধ্যে বন্ডিং টাও খুব সুন্দর ভাবে গড়ে উঠছিল।রিচাকে কাছে পেয়ে ও নিরুপমার মুখের আদলটাও ভুলে যেতে বসেছিল। কিন্তু সুখের নিবাস কোত্থাও দীর্ঘস্থায়ী নয়।যেই মুহূর্তে মনে হচ্ছে জীবন উপুড় করে দিচ্ছে সবটা ঠিক তখনি কোনো একটা অভিশাপে সব তছনছ হয়ে যায় বারবার।তাদের সন্তান যে জন্মানোর পর চোখ ই খুলবেনা সেটা রিচা মেনে নিতে পারেনি।নার্সিংহোম বা ডাক্তার কেউ গাফিলতি মেনে নেয়নি।তাদের তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল রিচা মৃত বাচ্চার জন্ম দিয়েছে।
হে ঈশ্বর মায়ের যন্ত্রণা ভাগ করে নেওয়ার ক্ষমতা তুমি কাউকে দাওনি কিন্তু বাবার বুকে উদ্বেগ তীব্রতাও কেউ কোনোদিন টের পায়নি।
নাম টা আবীর ই ঠিক করেছিল।ছেলে হলে শ্রেয়ান,মেয়ে হলে অনুজা।উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে অফিস ফিরতি পথে একদিন এই পুতুলটাও কিনে এনেছিল সে…রিচা আঘাত টা নিতে পারেনি। দশ মাসের স্বপ্ন যন্ত্রণা কে ছাপকে একটা ছোট্ট জীবনের রূপে ওর সমস্ত শিরা-উপশিরা দিয়ে বেড়ে উঠছিল ওর ভিতরে।সে একদিন হঠাৎ করেই মরে গেল।এরকম হয় নাকি!রিচা পেটে হাত দিলেই অনুভব করতো শ্রেয়ান ওর প্রত্যেকটা কথা শুনছে।তার জবাব দিচ্ছে নিজের ভাষায়।সবাই ওর সাথে ষড়যন্ত্র করেছে।ওই নার্সিংহোমের ডাক্তার গুলো।নার্সগুলো।আবীর।সবাই… ওরা লুকিয়ে রেখেছে ওর ছেলেকে।লুকিয়ে রেখেছে ওর শ্রেয়ান কে।
আবীর অনেক চেষ্টা করেছে।অনেক ভাবে বুঝিয়েছে।নতুন সন্তান নেওয়ার জন্য সাহস জোগানোর চেষ্টা করেছে।মাথায় হাত বুলিয়ে,কাছে টেনে।কিন্তু সেও তো একটা মানুষ। একটা রক্ত মাংসের মানুষ। চোখের সামনে দিনের পর দিন নিজের স্ত্রী কে পাগলের মতো একটা পুতুল কে ছেলে ভেবে আদর করতে, খাওয়াতে, ঘুম পাড়াতে দেখা যায়না।ওর ও বুকের ভেতর টা হাহাকার করে ওঠে।বাবা ডাক শোনার জন্য ওর মধ্যেও কি একটা যেন মোচড় দিয়ে ওঠে।কিন্তু এই মুহূর্তে ওর কাছে রিচার কান্নাটা বর্শার মতো গলায় এসে বিঁধছে। ও শক্ত করে ধরে থাকল রিচাকে।হাত দিয়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল,”কিচ্ছু হবেনা তোমার।আমি তো আছি। আবার নতুন করে শুরু করবো আমরা।তুমি ভেঙে পড়োনা। প্লীজ ভেঙে পড়োনা।”
কে জানে ঝড় পেরিয়ে শহর নতুন বৃষ্টি তে ভিজে উঠবে কিনা! নতুন করে স্বপ্নগুলো ছোট্ট দুটো পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াবে কিনা!বুকের আগল পেরিয়ে কেউ সত্যিগুলোকে মেনে নেবে কিনা!
শহর যেন প্রত্যুত্তর দেয়,ফিনিক্স হয়ে ওঠো।ভস্ম হয়ে যাওয়া শরীর থেকেই একটা পুনরুত্থানের গল্প লেখো।কারণ সময় চলে গেলে,আর ফিরবেনা।