দেবোপম বাবু একহাতে নাকে রুমাল চেপে ধরে কুঁজো হয়ে নীলাঞ্জনের অবচেতন শরীরের উপর ঝুঁকে কিছুক্ষণ দেখলেন।মাথায় পিছনে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে।ভোঁতা কিছু দিয়ে।ওখানেই ক্ষতটা স্পষ্ট। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পেলে বলা যাবেনা আঘাতটা ওইকারনেই হয়েছে কিনা, নাকি অন্যকোনোভাবে।যেটাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।দেবোপম বাবু ডাক দিলেন,”পরিতোষ! পরিতোষ! ” একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকে জিজ্ঞেস করল,”হ্যাঁ স্যার বলুন।”
“লাশটা পোস্টমর্টেম এ পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর হ্যাঁ শোনো ওই ভিড় সরাও।বিরক্তিকর লাগছে।”
“হ্যাঁ স্যার।”
“দাঁড়াও। কে প্রথম লাশ দেখেছে!”
“স্যার ওই ওনার স্ত্রী আর প্রতিবেশী তিনজন। যারা দরজা ভেঙে ঢুকেছিল।”
“আচ্ছা কেবল তাদের বাদ দিয়ে বাকি যেকটা দাঁড়িয়ে আছে,তাদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে আপাতত বিদায় করো।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর!”
“কি স্যার!”
“কিছু না বাদ দাও।আমি দেখছি।তুমি ওগুলোই করো আপাতত। “
“ইয়েস স্যার”, আর একবার স্যালুট ঠুকে পরিতোষ বেরিয়ে গেলো।
দেবোপম চাইলেই সেকেন্ড অফিসার কে পাঠাতে পারতেন,কিন্তু কি একটা মনে হতেই নিজেই এলেন ক্রাইম সিনে।খুনের হার রিসেন্টলি এতই বেড়েছে যে খুনের খবর শুনলে খুব একটা বিচলিত হন না তিনি।বরং কোনোদিন কোথাও একটাও খুন না হলে অবাক হন ।উঠে ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।একপাশে রিচা জড়পদার্থর মতো বসে আছে।ওর মুখ থেকে রঙ উড়ে গেছে।চোখ দুটো ভয়ে মাখামাখি।সেই পাংশুটে মুখের দিকে তাকিয়ে দেবোপম মনে মনে বললেন,”শকড!আশ্চর্য নয়।তোমার কাছে পরে আসছি!”
পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘর তছনছ হয়ে আছে পুরো।ড্রেসিংরুমের ড্রয়ার গুলো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।আলমারির দরজা হাট করে খোলা।এদিকওদিক কাগজ, জামাকাপড় এবং টুকিটাকি জিনিসপত্র ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে।দুজন কনস্টেবল সেগুলোই গুছিয়ে তুলে তুলে দেখছে।দেবোপম কে দেখে তাদের ই একজন এগিয়ে এসে বলল,”স্যার লকার ভাঙা।ভিতরে কিছু নেই।রবারির কেস মনে হচ্ছে।” দেবোপম ভুরু কুঁচকে বললেন,”দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা ঠিক হবেনা।” ছড়ানোছেটানো কাগজপত্র গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা কাগজের উপর এসে থামলেন।এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন।বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে ‘নিউ লাইফ ফার্টিলিটি ক্লিনিক’। লেখাটা পড়ে একটু থমকে রইলেন দেবোপম। তারপর কাগজটাকে ভাঁজ করে পকেটে ভরে রাখলেন। আর একবার ঘরটার এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে পাশের ঘরে ফিরে এলেন। বডি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ততক্ষণে। রিচা বিছানার উপর উঠে বসেছে।মাথা নামানো।মুখে কোনো কথা নেই।দেবোপম সেদিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,”আপনি নীলাঞ্জন বাবুর স্ত্রী,রিচা!”
রিচা মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো।কথা বললনা।ঘাড় নাড়ল স্রেফ।
“হুম আপনি কোথায় গিয়েছিলেন!”
“বাবা মার কাছে!”
“কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিল না এমনি গেছিলেন?”
“এমনি। ও ই আমাকে যেতে বলেছিল।”,রিচা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল।
“আচ্ছা নীলাঞ্জন বাবুই আপনাকে যেতে বলেছিল।”
“হ্যাঁ।ও বলেছিল।আমি অনেক দিন যাইনি আর ও বলেছিল ওর ছুটি আছে।ও বাড়িটা সামলে নেবে।আমি যেন ঘুরে আসি।”
“আর আপনি চলে গেলেন।ভালো। ফিরলেন কখন?”
“আজ সকালে।নটার সময়।”
“ফেরার পর কি কি হল একটু বলুন।”
রিচা একটু নড়েচড়ে বসল,তারপর বলল,”আমি ফেরার আগেই ওকে ফোন করছিলাম।তুলছিলনা।প্রথমে ভাবলাম হয়ত সারারাত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।তাই সকালে ঘুমোচ্ছে।আমি তাই আর ফোন করিনি। এখানে আসার পর কলিং বেল বাজালাম।বেশ কয়েকবার।ফোন ও করলাম।কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে…”
রিচার কথা শেষ হবার আগেই দেবোপম তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন,”আপনাদের সদর দরজার স্পেয়ার কি নেই!”
“আছে।কিন্তু আমার কাছে ছিলনা সেসময়। “
“কেন?”
” নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলনা।ও বলেছিল ও বাড়িতেই থাকবে।নিয়ে যেতে হবেনা।তাই আমি নিয়ে যাইনি।”
“আচ্ছা তারপর কন্টিনিউ করুন।”
“হ্যাঁ তো আমি অনেকবার ডাকার পর সাড়া না পেয়ে মুখার্জী দা আর দাস দা কে ডাকলাম।ওনারা এসে বার কয়েক ডাকলেন।তারপর সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙা হয়।আর তারপর..”,রিচা কথা শেষ করতে পারলোনা।ওর গলা জড়িয়ে এলো।দুহাত দিয়ে চোখদুটো ঢেকে নিলো।
দেবোপম মুখ গম্ভীর করে বললেন,”বুঝলাম।আচ্ছা এই দাস দা আর মুখার্জী দা কারা?”
ঘরে কনস্টেবল দের সাথে দুজন দাঁড়িয়েছিলেন।তারা এগিয়ে এলেন। দেবোপম তাদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন,”আপনারা!”
দাঁড়িয়ে থাকা ওই দুজন ব্যক্তির একজন বলল,”আমার নাম সতীশ মুখার্জী।বৌদি আমাকে প্রথম ডেকেছিলেন।”
“আচ্ছা আর আপনি!”,দেবোপম অন্য একজনের দিকে প্রশ্ন করলেন।
“আমার নাম রজত দাস।মুখার্জী দার সাথে আমাকেও ডেকেছিলেন বৌদি।”
“আচ্ছা কি হয়েছিল বলতে পারবেন?”
সতীশ মুখার্জী বললেন,”আমাদের ডাকার পর আমরা এসে কয়েকবার নীলাঞ্জন দাকে ডাকলাম। কোনো উত্তর পেলাম না। তারপর বৌদি বললেন দরজা ভেঙে ফেলতে।তো আমরা দরজা ভেঙে ফেললাম।”
“আচ্ছা বৌদি বললেন।আপনাদের মধ্যে কে থানায় খবর দিয়েছিল?”,দেবোপম জড়িপ করে নিলেন দুজনকে।
“আমি”,রজত দাস উত্তর দিলেন।
“আচ্ছা।আপনারা কাল সন্ধ্যে বা রাতে কোনো আওয়াজ পাননি কোনোকিছুর? চিৎকার বা অন্যকিছুর!”
সতীশ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল,”উঁহু তেমন কিছু তো মনে পড়ছেনা!স্বাভাবিক যেমন শুনি রোজ,তার বাইরে আলাদা কিছু কানে আসেনি।”
“আর আপনি?”,দেবোপম রজতের দিকে তাকালেন।লোকটার মধ্যে একটু জড়োসড়ো ভাব।রজত একটু ভেবে উত্তর দিলেন,”আমারও তেমন কিছু মনে পড়ছেনা।তবে কাল রাত নটার দিকে একটা ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েছিলাম।আমি ভাবলাম তেমন কিছু না হয়ত।”
“আপনি শুনতে পাননি তেমন কিছু!”,দেবোপম সতীশের দিকে ঘুরলেন।
একগাল বোকা বোকা হাসি মুখে সতীশ উত্তর দিল,”কই! সেরকম তো কিছু শুনেছি বলে মনে পড়ছেনা।”
“স্ট্রেঞ্জ পাশের বাড়িতে মার্ডার রবারি হয়ে যাচ্ছে আর আপনারা কেউ কিছু টের ই পাচ্ছেন না।”,দেবোপম চোখ দুটো দিয়ে মেপে নিলেন দুজনকে।একটা অসংলগ্নতা যে আছে সেটা পরিষ্কার।কথা ঘোরালেন,” আচ্ছা দরজা তো বন্ধ ছিল বললেন। তাহলে লক করলো কে! মানে চাবি তো কেবল নীলাঞ্জন বাবুর কাছেই ছিল। রিচা এবার বিছানা থেকে জবাব দিল,”এই দরজাটা অটোলক।টেনে দিলেই আটকে যায়।”
“আই সি”,দেবোপম মুখ গম্ভীর করে বললেন,”বেশ আপনাদের এখন আর কিছু বলতে হবেনা।থানায় গিয়ে একবার স্টেটমেন্ট গুলো দিয়ে আসবেন।আর হ্যাঁ এখন আপনাদের কেউই আউট অফ স্টেশন যাবেন না।যদি দরকার পরে আপনাদের থানায় আসতে হবে।”
সতীশ ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন,”আমাদের আর কাজ কি! না মানে আমরা আর কি করবো!”
দেবোপম সতীশের কাঁধে হাত রেখে বললেন,”সে তো আমি বুঝবো।যা বললাম সেটুকু করুন। নাহলে ধরে নিতে হবে।এই ঘটনার জন্য আপনি দায়ী।”
বেরিয়ে যেতে যেতে দেবোপম একজন কনস্টেবল ডেকে কানে কানে বললেন,”এই তিনজনের উপর একটু নজর রাখো।এরা কোথায় যাচ্ছে।কার সাথে দেখা করছে!” কনস্টেবলটি “ইয়েস স্যার” বলে সম্ভাষণ জানালো।
“আচ্ছা নীলাঞ্জন বাবুর ফোন টা পেয়েছো!”
” না স্যার। দুটো ঘর তন্নতন্ন করে খোঁজা করা হয়েছে। কোথাও পাওয়া যাইনি।”
“ইন্টারেস্টিং।বাড়ির এদিকওদিক একবার খুঁজে দেখো তাও।”,দেবোপম বাইরে বেরিয়ে এলেন। উপরের দিকে মুখ তুলে নাক চোখ কুঁচকোলেন।বড্ড রোদ।
(২)
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট টা হাতে পাবার পর ভালো করে পড়লেন দেবোপম। যেমন সন্দেহ করেছিলেন।তেমন টাই। একটা ভোঁতা কোনো কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। কিন্তু মার্ডার ওয়েপন টা এখনও পাওয়া যায়নি।নীলাঞ্জন বাবুর ফোনটা ভাঙাচোরা অবস্থায় বাড়ি থেকে একটু দূরে রাস্তার পাশে পাওয়া গেছে।পরিতোষ এসে ডাকলো,”স্যার। যেমন বলেছিলেন ভিক্টিমের ওয়াইফ, আর ওই দুই প্রতিবেশীর উপর নজর রাখা হয়েছিল।”
“হুম কিছু জানতে পেলে!”,দেবোপম প্রশ্ন করলেন।
“সতীশ বাবু আর রজত বাবু অফিস আর বাড়ি ছাড়া আর কোথাও যাননি,কিন্তু রিচা একজনের সাথে দেখা করেছে এর মধ্যে!”
“কোনো রিলেটিভ! “, দেবোপম নড়েচড়ে বসলেন।
“না স্যার। ওনার এক বন্ধু। নাম অরূপ বিশ্বাস।”
“স্বামীর মৃত্যুর শোক কাটতে না কাটতেই বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাওয়ার মানে কি! সাসপিসিয়াস। রিচার ফোন কল ট্র্যাক করতে বলেছিলাম।করেছো!”
“হ্যাঁ স্যার। কিছু ফোন রিলেটিভস দের করা হয়েছে।নীলাঞ্জন বাবু এবং রিচার। খোঁজ নিয়ে দেখেছি। আর একটা নাম্বারে বহুবার ফোন করা হয়েছে। সেই নাম্বার টা এই অরূপ বিশ্বাসের।”
“বলো কি হে! এই বন্ধুটি ভরসার কাঁধ হয়ে দাঁড়িয়েছে নাকি! এই অরূপ বিশ্বাসের সমস্ত ডিটেইলস আমাকে এনে দিও।” দেবোপম টেবিলে হাত রেখে চিন্তা করতে লাগলেন। পরিতোষ জিজ্ঞেস করলো,”আপনি কি এটা প্ল্যানড মার্ডার ভাবছেন স্যার!”
দেবোপম চিন্তা করছিলেন,অবচেতন ভাবেই উত্তর দিলেন,”আমি কিছু ভাবছিনা পরিতোষ। কিন্তু আমাকে কয়েকটা ব্যাপার ভাবাচ্ছে।এই যেমন ধরো এই অরূপ বিশ্বাস। তারপর রিচা যে প্রেগন্যান্ট, ফার্টিলিটি ক্লিনিকে তার যাতায়াত এসব কথা উনি বেমালুম চেপে গিয়েছেন।কিন্তু কেন? তারপর বাড়ি থেকে চুরি গিয়েছে বলতে লকারে থাকা দশভরি সোনা আর কিছু টাকা। সবটা কেমন যেন নিখুঁত হয়েছে। রবারি অ্যান্ড মার্ডার। কিন্তু ব্যাপার টা সাজানো ও হতে পারে।তারপর ধরো রবারি করতে যে বা যারা এসেছিল তারা নীলাঞ্জন বাবুর ফোনটা ভেঙে কেন রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে গেলো।যদি কোনো ভাবে নীলাঞ্জনের মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান ই করে দেয়।ফোন টা ভাঙার কি দরকার ছিল! এটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। আর যদি অচেনা কেউ ই হয় নীলাঞ্জন বাবু দরজা খুলেই বা দিলেন কেন আর চেঁচালেন ই বা না কেন! একমাত্র হতে পারে চেনাজানা বা নীলাঞ্জন বাবুর প্রয়োজনে আসা কোনো ব্যক্তি যদি এর পিছনে থাকে। তাহলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।সিন গুলো মিলে যায়।যাইহোক তুমি এই অরূপের খোঁজ এনে দাও।”
পরিতোষ বলল,”আপনার বলার পর এখন আমারও মনে হচ্ছে স্যার। এই অরূপ টাকে আমারও সন্দেহ হচ্ছে। ওর সাথে রিচার কিছু একটা কেস আছে বুঝলেন।”
“এতো আগে থেকে বলা ঠিক হবেনা।হতেও পারে তেমন কিছু না।তুমি ওর ডিটেইলস টা এনে দাও তো।তারপর বলছি।আমি এর মাঝে কিছু কাজ সেরে রাখি।”
“আচ্ছা স্যার।আসছি “,বলে স্যালুট ঠুকে পরিতোষ বেরিয়ে গেল। দেবোপম আবার চিন্তা করতে বসলেন।মনে মনে বললেন,এক্সটা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স। বড্ড সহজ হয়ে যাচ্ছেনা! রিচাকে দেখে মনে হয়না সে এত কাঁচা কাজ করতে বা করাতে পারে। উঁহু আরও খবর আনতে হবে।দেবোপম উঠে পড়লেন।
.
.
নীলাঞ্জন দের পাড়ায় ঢুকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন দেবোপম। তারপর কি একটা ভেবে প্রথমে রজত দাসের বাড়িতে ঢুকলেন। ভদ্রলোক চেয়ারে বসেছিলেন।ওর স্ত্রী দরজা খুলে দিলো। দেবোপম কে দেখে উঠে এল, “আরে আপনি! বসুন বসুন।”
দেবোপম হাত দেখিয়ে তাকে বাধা দিয়ে সরাসরি বাণ নিক্ষেপ করলেন,”বসতে আসিনি।একটা কথা বলার ছিল। নীলাঞ্জন বাবুর প্রি প্ল্যানড মার্ডার হয়েছে।মুখার্জী বাবুর বাড়িতে গিয়েছিলাম।উনি বললেন আপনার সাথে নাকি নীলাঞ্জন বাবুর ঠিক বনতো না। কি একটা ঝামেলা হয়েছিল।”
রজতের চোখ দুটো জ্বলে উঠল।সে প্রতিবাদ করল,”একদম ই না।আমার সাথে নীলাঞ্জন দার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি মাঝেমাঝেই আমাদের বাড়িতে আসতেন।আমিও যেতাম।ঝামেলার তো কোনো প্রশ্নই ওঠেনা। কিন্তু আপনি বললেন বলেই একটা কথা বলছি ওই মুখার্জীর সাথে নীলাঞ্জন দার একটা ঘটকা আছে! “
মানুষ কত বোকা বোকা কথায় ধরা দিয়ে দেয়,দেবোপম মনে মনে হাসলেন।মুখে কিছু বুঝতে পারিনি এমন ভাব এনে বললেন,”কি বলুন তো!”
“কি তো ঠিক বলতে,পারবোনা। তবে ধার টার নিয়ে বোধহয়। নীলাঞ্জন দার সাথে মাঝে মাঝেই চোটপাট লেগে থাকতো। একবার তো প্রায় হাতাহাতি হয়ে গিয়েছিল কি একটা ব্যাপার নিয়ে।আমরা গিয়ে আটকেছিলাম।”
“এরকম ব্যাপার নাকি! তাহলে ওনাকে একবার ক্রশচেক করতে হয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।”,দেবোপম উঠে দাঁড়ালেন।
“চা খেয়ে যাবেন না!”,রজত জিজ্ঞেস করল। এখন তার মুখে একটা হাসি।
দেবোপম ও হেসে উত্তর দিলেন,”পরে কোনোদিন হবে। কেস টা মিটে যাক।”
দেবোপম বেরিয়ে যাচ্ছিলেন রজত ইতস্তত করছে দেখে প্রশ্ন করলেন,”আরও কিছু বলবেন!”
রজত দাড়ি চুলকে উত্তর দিল,”না তেমন কিছু না।তবে একটা কথা বলা দরকার মনে হয়।জানিনা কতটা হেল্প হবে আপনার কেস এ। কিন্তু চ্যাটার্জী বৌদি খুব একটা সুবিধের নয়।”
দেবোপম ভুরু কুঁচকালেন,”কেন বলুন তো!”
রজত আবার ইতস্তত ভাবে জবাব দিলো,”না মানে।নীলাঞ্জন দা যখন ট্যুরে যেতেন তখন বৌদির কাছে কে একজন মাঝে মাঝেই আসতো।”
দেবোপমের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল,তিনি বুঝতে না দিয়ে বললেন, “অনেক ধন্যবাদ রজত বাবু।আপনি অনেক হেল্প করলেন।”
ওখান থেকে বেরিয়ে আর সতীশ মুখার্জী বা রিচার কাছে গেলেন না।একটা তৃতীয় মানুষের গন্ধ এখন পাচ্ছেন দেবোপম।সেটা অরূপ কি! সে ও হতে পারে।আবার নাও।সতীশের সাথে ঝামেলাটা কি নিয়ে হয়েছিল! তারপর হাতাহাতি! নাহ এখানে থেকে আর কিছু হবেনা। থানায় ফিরে এলেন।ওনার মাথায় অনেক অঙ্ক ঘুরছে এখন। ঠান্ডা ভাবে বসে ভাবতে হবে।পরের পর্বটা কি হবে।
(৩)
রিচার কয়েকটা দিন খুব দিশেহারা ভাবে কেটেছে।সবকিছু সামলে উঠতে উঠতে।কাজ শ্রাদ্ধ। লোকজনের হাঙ্গামা।তারপর পুলিশ স্টেশনেও বেশ কয়েকবার ছুটতে হয়েছে।কোথা থেকে কি হয়ে গেল! কিন্তু যা হল সেটা ভালোর জন্যই হলো বোধহয়। এমনিতেও সে পালাতো। নীলাঞ্জন একটা ক্রুর শয়তান।শেয়ালের মতো। দেরীতে হলেও সে বুঝেছে। কিন্তু নীলাঞ্জনের জন্য না। যে মানুষটাকে সে স্কুল জীবন থেকে ভালোবেসে এসেছে তার জন্য। হয়ত বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে যদি সেদিন তাকেই বিয়ে করতো এই দিন দেখতে হতোনা।কিন্তু উপায় ছিলনা তখন। একজন বেরোজগারী ছেলের সাথে কোনো বাবা ই বিয়ে দেবেনা। যাইহোক। ওসব ভেবেও লাভ নেই আর। অনেক দূর এগিয়ে এসেছে সে। কিন্তু একটা ব্যাপার তাকে কদিন ধরে ভাবাচ্ছে।অরূপের ব্যবহারে কয়েকদিন ধরে বেশ পরিবর্তন এসেছে।কেন কে জানে!কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে।আপন মনে চিন্তা করে।অসংলগ্ন কথা বলে। একবার বলছে কাজ টা ও করেছে,একবার বলছে করেনি।একবার বলছে গয়না গুলো ওর কাছেই আছে,একবার বলছে নেই। অদ্ভুত তো।ওকে সন্দেহ করার কোনো কারন নেই ।ভালোবেসে যখন ওর জন্য সব ছাড়তে পেরেছে। তাকে অবিশ্বাস করার কোনো মানে হয়না।চোখ বন্ধ করেই ভরসা করা যায়।সবাই স্বেচ্ছাচারী,ব্যভিচারী নীলাঞ্জনের মতো হয়না।এই পৃথিবীতে অরূপের মতো ভালো মানুষ রা আজও আছে।যারা ভালোবাসার ভাষা জানে। যারা ঠকাতে জানেনা।সেই ভালোবাসার জন্য কাঙাল হয়ে যেতে পারে রিচা। এমনকি!
নিজের পেটের উপর হাত বুলিয়ে নিজের মনেই হাসল রিচা।সেই হাসি একসময় অট্টহাসিতে পরিণত হল। তুমি হেরে গিয়েছো নীলাঞ্জন। তোমার অতিরিক্ত অহংকার তোমাকে ডুবিয়ে দিয়েছে। তোমাকে তোমার ঠিকানায় পৌঁছে দিয়েছে।
চিন্তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল রিচা।রাত দশটা বাজছে।বেল বাজতে টনক নড়ল।উঠে দরজা খুলতে গেল।হয়ত অরূপ।ওর আসার কথা ছিলনা।কিন্তু ও বলছিল আসতে পারে।ও ই হবে হয়ত।উত্তেজনা মিশ্রিত ভয় নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল রিচা।শরতের রাতে, দরজাটা খুলে কিছু বোঝার আগেই অন্ধকার থেকে একটা হাত এসে ওর চোখ মুখ চেপে ধরল।মরিয়া হয়ে সেই হাত টা মুখ থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে রিচা অনুভব করল ওর পেটের চামড়া ভেদ করে একটা কিছু ঢুকে গেল শরীরের ভিতর। গলগল করে গরম রক্ত বেরোচ্ছে। কিছু বোঝার আগেই আরোও কয়েকবার সেটা পেটের এদিকওদিক ছুটে গেল। রিচার চোখ ভারী হয়ে এলো।সবকিছু কেমন অন্ধকার হয়ে এলো। সেই অন্ধকার থেকে একটা পিশাচের হাসি কানে এলো! রিচা মানসচক্ষে দেখতে পেলো নীলাঞ্জন হাসছে।বিকট শব্দে।
ব্যভিচারী – শেষ পর্ব