রাগ-অভিমান-ষড়যন্ত্র বুকে রিচা চলে গেল।দেবোপম একদৃষ্টে রক্তশূন্য শরীরটার দিকে তাকিয়েছিলেন।মেয়েটার বয়েস বেশি নয়।ব্যক্তিগত জায়গায় তিনিও একজন মেয়ের বাবা।তার মেয়ের সাথে রিচার বয়েসের পার্থক্য বিশেষ বেশি নয়।পরিতোষ পাশে এসে দাঁড়ালো,”স্যার আপনি যা ভেবেছিলেন। কেসটা এতটা প্যাঁচালো জানতাম না।কিন্তু সতীশ ই যে এর পিছনে আছে,কি করে বুঝলেন!”
দেবোপম রিচার উপর থেকে নজর না সরিয়েই বললেন,”বলছি পরিতোষ। যা ভেবেছিলাম,তাই হয়েছে। কিন্তু আপসোস কি বলোতো! একটু তাড়াতাড়ি করলে মেয়েটাকে বাঁচাতে পারতাম।আমার জন্যই মনে হচ্ছে মেয়েটা.. “
পরিতোষ সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,” কি যে বলেন স্যার।আপনি কি আর জানতেন আজকেই এই ঘটনা ঘটে যাবে।”
“সেটাই”,দেবোপম দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন,”মার্ডার ওয়েপনটা পেয়েছো?”
“হ্যাঁ স্যার ওই তো পাশের ড্রেনে।মার্ডার ওয়েপন।গ্লাভস।কোট। সব। জুতোর আওয়াজ পেয়েই ওগুলো জানলা দিয়ে পিছনে ফেলে দিয়েছে মনে হয়।কিন্তু এরকম বোকা বোকা কাজ করার কি মানে!”
“কি জানো পরিতোষ, মানুষ ক্রুশিয়াল সিচুয়েশনে এসেই বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলে।বোকার মতো ভুল করে। কি বলছে কি সতীশ!”
“আমাদের আসার পর থেকে সেই এক ক্যাসেট বাজিয়ে যাচ্ছে….আমি কিছু জানিনা।আমার কাছে একটা ফোন এসেছিল।আমি সেই ফোনটা পেয়ে এই এখানে ছুটে এসেছি।আমি এসেই দেখি বৌদি এভাবে রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে।আমি পুলিশকে ফোন করতে যাবার আগেই, পুলিশ এসে পড়ে…. কি বলবেন বলুন স্যার।”
“কিছু বলার তো নেই,পরিতোষ। ওকে থানায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো। আর এই বডিটাও পোস্টমর্টেম এর জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
“ঠিক আছে স্যার।”,পরিতোষ এগিয়ে যেতে ক্যাপটা নামিয়ে একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নিলেন দেবোপম। গরম হয়ে আছে।ঘেমে আছেন।অনেক ঝড় গেল।পুরো সেট আপ টা সাজাতে হয়েছে।নাহলে সতীশকে ধরা যেতোনা।কখনও কখনও রাজাকে হাত করার জন্য ঘোড়াকে টার্গেট করতে হয় এমনকি রানীকেও বাজী রাখতে হয়।দেবোপম মনে মনে বললেন,”চেক”..
(২)
দেবোপম চেয়ারে বসেছিলেন।পরিতোষ এসে উত্তেজিত গলায় বলল,”স্যার আমাকে কিন্তু এখনও ভাবাচ্ছে আপনি কি করে ধরলেন সতীশ ই আছে এর পিছনে আর সে রিচাকে খুন করতে পারে।”
দেবোপম একটু হাসলেন,তারপর বললেন,”বসো।তোমাকে বলছি সব।জানো পরিতোষ আমার প্রথমে মনে হয়েছিল এই ঘটনাটা পুরোটা অরূপ আর রিচাদেবীর সাজানো। সন্দেহের তির পুরোটাই ওর দিকে যাচ্ছিল। তারপর দুটো অদ্ভুত তথ্য পেলাম,যেটা আমার চিন্তাভাবনা পুরোপুরি পাল্টে দিলো।”
“কি স্যার”,পরিতোষ আগ্রহী চোখে তাকিয়ে আছে তার রোলমডেলের দিকে।
“প্রথমত একটা অদ্ভুত খবর জানতে পারি।এই সতীশের চোখ রিচার উপর বহুদিন ধরেই পড়েছিল।নীলাঞ্জনের অনুপস্থিতিতে ও বহুবার রিচার কাছে যায়।নানারকম প্রস্তাব নিয়ে।যেহেতু নীলাঞ্জন মাঝেমাঝেই ট্যুরে যেতো,সতীশ চেয়েছিল রিচাকে ভুলিয়ে ওর সাথে ইন্টিমেট হতে। বলাবাহুল্য রিচা প্রতিবার ই ফিরিয়ে দিয়েছে।শেষবার সেটা রীতিমত ঝগড়ার পর্যায়ে পৌঁছে যায়।তখন ওদের কনভারসেশনটা একজন শুনে ফেলে,যে সেই মুহূর্তে নীলাঞ্জনের খোঁজ নিতে সে বাড়িতে ঢুকছিল। গেস করো সেই ব্যক্তিটি কে!”
“রজত বাবু কি!”,পরিতোষ দ্বিধাপূর্ণ গলায় উত্তর দিল।
“নট ব্যাড পরিতোষ। এগজ্যাক্টলি। আমি ওই লোকটির সাথে প্রথমবার কথা বলার পরই বুঝতে পেরেছিলাম এ অনেক কিছু জানে।কিছু একটা ভেবে বা কোনোকিছুর ভয়ে বলছেনা।আমি গিয়ে ভদ্রলোককে একদিন চেপে ধরলাম।একটু আইনী ভয় দেখাতেই সুড়সুড় করে সব বলে দিলেন। এর মধ্যে রিচা একদিন আমার সাথে দেখা করে জানায় ওকে কেউ একটা মাঝেমাঝেই ফোন করে বলছে এখন তো নীলাঞ্জন নেই।একা হয়ে গেছো।কত করে লাগবে! এসব উল্টোপাল্টা কিছু। আমি সতীশের কথা জিজ্ঞেস করতে ও বলল সতীশ নাকি নীলাঞ্জনের মৃত্যুর পরে মাঝে মাঝেই রিচাকে গিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে আসতো।কোনো দরকার পড়বে কিনা খোঁজ নিতো। মানে চিন্তা করো একবার। কত সাহস।লোকটা ধুরন্ধর। আমার তখনই ওকে সন্দেহ হয়।আমি রিচাকে সান্ত্বনা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিই। আর পরামর্শ দিই এখন কদিন কারোর সাথে দেখা করবেন না।”,দেবোপম একটু দম নিলেন।
“তারপর স্যার!”,পরিতোষ আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে।
“তারপর আমি একটা টোপ ফেলি। আমি একটা চিঠি পাঠাই সতীশকে। বিশেষ কিছু লিখিনা। লিখি, আপনি যে আমায় বহুবার কু প্রস্তাব দিয়েছেন, শোওয়ার জন্য বলেছেন,আমি বারণ করে দিয়েছি নীলাঞ্জনের জন্য আর এ জন্য নীলাঞ্জনের উপর আপনার যে প্রচ্ছন্ন রাগ ছিল সেটা আমি পুলিশ কে বলবো ভেবেছি। আপনার এই পাশে থাকার নাটক। আমি আপনার অভিসন্ধি বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় নীলাঞ্জনের মৃত্যুর পিছনে আপনার কোথাও হাত আছে। ~ রিচা… “
“বাপরে স্যার! কি মারাত্মক স্ক্রিপ্ট লিখেছেন।এরকম টোপ না গেলার ক্ষমতা সতীশের নেই।”,পরিতোষ এর চোখেমুখে উত্তেজনা।
“তারপর ছিল ফাইনাল টাচ। আমি তোমাদের সরিয়ে আনলাম না ওখান থেকে তার কারণ ছিল।আমি তারপর একদিন সতীশের কাছে গেলাম। খোশগল্প করার ভান করে।সে তো চা বিস্কুট মিষ্টি সব ব্যবস্থা করল।।আমি এটাওটা বলার পর বললাম নীলাঞ্জন বাবুর কেস টা আর কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছেনা। রবার দের ধরা গেল না।এখানে তো আর কোনো ক্লু পেলাম না।দেখা যাক।অন্যকোথাও পাওয়া যায় কিনা। এত কেস তার উপরে।আপাতত বন্ধ করতেই হচ্ছে এটা…. তারপর আরও অনেক কথার মাঝে এটাও বললাম তোমাদেরকেও ডেকে নিতে বাধ্য হলাম।অন্য কেসের এত চাপ বলে। ব্যাস ওকে মোটামুটি বুঝিয়ে দিলাম ওর উপর বা রিচার উপর বা কারোর উপর ই আর নজর রাখা হচ্ছেনা।”,দেবোপম টেবিলে একবার করাঘাত করলেন।
“আপনি জিনিয়াস স্যার।”,পরিতোষ প্রায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।
দেবোপম একটু হেসে আবার সিরিয়াস হয়ে গেলেন,”কিন্তু পরিতোষ আমাকে দুটো ব্যাপার খুব ভাবাচ্ছে।”
“কি ব্যাপার স্যার?”
“রিচার খুন টা সব ঘেঁটে দিল।প্রথমত ল্যাক অফ স্ট্রং মোটিভ।মানে সতীশের একটা মোটিভ আছে ঠিকই।কিন্তু সেটা একটা খুন করার মতো না।মানে অতটাও স্ট্রং নয়। আর সেকেন্ডলি এই সতীশ।এই লোকটা ধুরন্ধর হতে পারে।কিন্তু বড্ড ভীতু গোছের।ভেবেচিন্তে খুন করার যথেষ্ট সাহসের দরকার। এই লোকটার সেটা আছে বলে মনে হয়না।”
“মানে কি বলতে চাইছেন আপনি! সতীশ খুন করেনি।কিন্তু ওকে তো আমরা ক্রাইম সিন থেকেই .. “,পরিতোষ অবাক।
“হ্যাঁ জানি।কিন্তু ওকে তো আমরা অনস্পট ক্রাইম করতেও দেখিনি।মার্ডার ওয়েপন হাতেও দেখিনি।যদি ওর কথাটা সত্যিই হয়,যদি সত্যিই কেউ ওকে ফোন করে আসতে বলে,কোনো কিছু বলে আর সেই ফাঁদে ও পা দেয়। মানে হাইপোথেটিক্যালি হতে পারেনা এমন নয়।ডি.এন.এ টেস্টের রেজাল্ট হাতে না পেলে বলা যাবেনা।”
“আপনার বলার পর আমারও মনে হচ্ছে সতীশের মোটিভ টা স্ট্রং নয় তবুও।ওরকম কিছু হওয়াটাও আনকমন কিছু। দেখা যাক রিপোর্টে কি আসে।”,পরিতোষ সমর্থন করে।
(৩)
দেবোপম কে অতিরিক্ত চিন্তিত দেখাচ্ছে দেখে পরিতোষ আর ঘাঁটাবে কিনা বুঝে উঠতে পারলোনা।
রিচার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কিছুটা চমকে যাওয়ার মতোই।রিচা মৃত্যুকালীন সময়ে অন্তঃসত্ত্বা ছিল।সেটুকু অনেক আগেই জানতে পেরেছিলেন দেবোপম। কিন্তু যে রিপোর্ট টা তার হাতে এসেছে, সেটা তাকেও অবাক করে দিয়েছে। রিচার গর্ভের সন্তানের বাবা মৃত নীলাঞ্জন না।অন্য কেউ। আর সবথেকে আশ্চর্যর ব্যাপার হচ্ছে।মার্ডার ওয়েপনে রিচার ছাড়া আর কারোর ডিএনএ পাওয়া যায়নি,কিন্তু গ্লাভস আর কোট থেকে রিচাকে বাদ দিলে অন্য আর একজন যার ডি.এন.এ পাওয়া গেছে সেটা সতীশের নয়। আর সবথেকে আশ্চর্যের কেসটা হল যে অপরিচিত মানুষ বা সম্ভাব্য খুনীর ডি.এন.এ পাওয়া গেছে রিচার গর্ভস্থ সন্তানের বাবাও সে। রিপোর্ট গুলো পাওয়ার পর প্রথমে বেশকিছুক্ষন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলেন দেবোপম।চোখ দুটো রাগে লাল হয়ে গেছে । প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উনি কয়েকজন কনস্টেবল কে পাঠালেন অরূপের খোঁজে। তখন থেকেই গজগজ করছেন।পরিতোষ দ্বিধাভরে প্রশ্ন করল,”স্যার আপনার সন্দেহ টাই সত্যি হল।মানে আমি এখনও ভাবতে পারছিনা।অরূপ ই শেষমেশ। “
দেবোপম রাগে ফেটে পড়লেন,”ওই স্কাউন্ড্রেলটা নিজের সন্তানকে পর্যন্ত হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করলনা।রিচা ওকে জানায়নি এমন তো হতে পারেনা।কিন্তু পরিতোষ কি পেল এসব করে!মানুষ সত্যিই বিচিত্র জীব বুঝলে।সত্যিই বিচিত্র জীব।
পরিতোষ কি বলবে ভেবে পেলোনা,শেষমেশ সেও বলল,”সত্যি স্যার নিজের সন্তান কে।আমার তো এক ছেলে।ওর জন্যই সবকিছু করি।এই এখানে খাটাখাটনি করার পর যখন বাড়ি ফিরি, ওর মুখ টা দেখেই শান্তি পাই।জানেন স্যার এরা না বাবা হওয়ার যোগ্য ই না।”
“সত্যি পরিতোষ। মানুষ নিজের সন্তানের জন্য অনেকদূর যেতে পারে। আর এতো নিজের সন্তান কেই..”
কথা শেষ হবার আগেই কয়েকজন কনস্টেবল একজন কে ধরে নিয়ে এলো।নীল টিশার্ট, কালো প্যান্ট, কোঁকড়ানো চুল,মোটের উপর মাঝারি মুখশ্রীর ছেলেটা কাঁদোকাঁদো মুখ।হাত জোর করে আসার পর থেকে একটাই কথা বলে যাচ্ছে, আমি কিছু করিনি স্যার। কনস্টেবল দের মধ্যে একজন যার নাম সমরেশ সে এগিয়ে এলো দেবোপমের কাছে,তারপর স্যালুট ঠুকে বলল,”স্যার পালাতে যাচ্ছিল।আমাদের দেখেই।ঘরে গিয়ে দেখলাম ব্যাগপত্র গোছানো। পার্স থেকে একটা রাজধানীর টিকিট ও পাওয়া গেছে।”
দেবোপম অরূপের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন,”একি না বলেই পালিয়ে যাচ্ছো ভায়া।”
“আমি কিছু করিনি স্যার। বিশ্বাস করুন। “,অরূপ বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলল।
“তাহলে পালাচ্ছিলে কেন বাবা!”, দেবোপম রসিয়ে রসিয়ে বললেন।
“আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম!”
“ভয় পেয়ে গেছিলে।এমা কেন?”
“আমাকে একজন ফোন করে বলল আমার কোট,গ্লাভস পরে একজন রিচাকে খুন করেছে।পুলিশ আমাকে ধরতে আসছে।আমি তাই..”
“আরে বাপরে। তুমি তো ভয়ংকর স্ক্রিপ্ট লিখতে পারো। মানে সত্যি। এককাজ করো তুমি ভেবে নাও আর কে কি বলেছে…ততক্ষণ “,দেবোপম সমরেশের দিকে মুখ করে বললেন,”ওর একটু খাতির করো। আপ্যায়নে যেন ত্রুটি না থাকে দেখো।”
সমরেশ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল,”আচ্ছা স্যার।আপনি একদম চিন্তা করবেন না।”
দুজন কনস্টেবল অরূপ কে ধরে নিয়ে গেল। অরূপ পাগলের মতো চেঁচাতে লাগল,”বিশ্বাস করুন স্যার।আমি সত্যি কিছু করিনি। আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।”
দেবোপম সেদিকে কান না দিয়ে সমরেশ কে বলল,”ওর ঘর এবং ঘরের চারপাশ ভালো করে সার্চ করো।”
সমরেশ উত্তর দিল,”স্যার জয়ন্ত,শশাঙ্ক, আক্রম ওখানেই আছে।ওরা সার্চ করছে।”
“বেশ।তুমিও যাও। আর কিছু পেলে খবর দিও।”
“ইয়েস স্যার।”,সমরেশ স্যালুট ঠুকে বেরিয়ে গেলে পরিতোষ দেবোপমের কাছে এসে দাঁড়ায়।
দেবোপম ওর দিকে ঘুরে সহাস্য দৃষ্টিতে বললেন,”কি বুঝলে পরিতোষ! “
“কি সাংঘাতিক লোক স্যার এই অরূপ।কিন্তু ওর আর বেরোনোর রাস্তা দেখছিনা।কেসটা আমার কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেছে।”
“কিরকম শুনি”,দেবোপম একটা সিগারেট ধরালেন।
পরিতোষ গড়গড় করে বলতে লাগল,”নীলাঞ্জন কে সরানোর প্ল্যান টা রিচা আর অরূপ দুজনে মিলেই করেছিল।নীলাঞ্জন কে খুন করে কেসটাকে রবারির কেস বলে চালিয়ে দেওয়া।আর সত্যি বলতে সেরকমই মনে হয়েছিল। রিচা হয়ত প্ল্যান করেছিল সবকিছু মিটে গেলে দুজনে সরে যাবে। তারপর হয়ত রিচা আর অরূপের কোনো কারনে ঝামেলা হয়।কোনোকিছু নিয়ে।রিচা হয়ত এমনি বলেছে আমি ফেঁসে গেলে তুমিও ফেঁসে যাবে এরকম কিছু। হয়ত অরূপ ভয় পেয়ে যায়। তাই রিচাকেও সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান করে। যেহেতু অরূপ জানেনা আমরা ওর উপরে নজর রাখছি,আর রিচাও ওর সম্বন্ধে কিছু বলবেনা তাই ওকে কেউ কোনোদিন ধরতে পারবেনা।এর মাঝে হয়ত সতীশের কথাটা ওর মাথায় আসে।রিচাকে ও যে বিরক্ত করতো বা কুপ্রস্তাব দিত এটা নিশ্চয় রিচা ওকে বলেছে। ও তাই সতীশ কে ফাঁসানোর জন্যই হয়ত ফোন করে ওখানে ডেকেছিল।”,পরিতোষ একটু থামল।
“মোস্ট প্রিসাইজলি”, দেবোপমের চোখটা জ্বলজ্বল করে উঠল।হয়ত অধঃস্তনের স্বতঃস্ফূর্ততা তাকে প্রভাবিত করেছে।পরিতোষকে দেবোপম পছন্দ করেন।মনটা খুব পরিষ্কার। পুলিশের চাকরিতে এসেও সে নিজেকে সরল রাখতে পেরেছে। আর তাছাড়া সে সবসময় দেবোপমের প্রশংসা করে।দেবোপম এটাও জানে যে পরিতোষ তাকে রোলমডেল মনে করে। তাই কোনো কেসের কোনো চিন্তাভাবনা কিছু বলার থাকলে তিনি পরিতোষ কে বলেন। এরকম একজন সাগরেদ কার ই না ভালো লাগে!
একটু থেমে পরিতোষ বলল,”কিন্তু একটা জিনিস আমাকে ভাবাচ্ছে স্যার। অরূপ যদি খুন টা করেই থাকে তাহলে ওর কোট, গ্লাভস গুলো পাশের ড্রেনে কেন ফেলে দিলো?”
দেবোপম গাল চুলকে প্রশ্ন করলেন,”আচ্ছা তুমি বলো, সতীশ কে যদি তোমার ফাঁসানোর হতো তুমি কি করতে! ওকে ধরো ফোন করে ওখানে ডাকলে।পুলিশও দেখতে পেলো।কিন্তু মার্ডার ওয়েপন,কোট, গ্লাভস মনে করো অন্যকোথাও পেলে।ওর হাতে মনে করো রক্তের ছিটেফোঁটাও লেগে নেই,চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।ফাঁসাতে পারতে কি?”
“সেটাও ঠিক। অরূপ হয়ত ভেবেছে কোট, গ্লাভস এগুলো পেলে আর সিনে সতীশকে দেখলেই হয়ত কাজ টা মিটে যাবে।কিন্তু আর একটা ব্যাপার স্যার! অরূপ কি করে মেনেজ করলো কেসটা! না মানে এটা তো বুঝলাম কোট গ্লাভস কেন রেখে এসেছিল।সতীশ কে ফোন ও করেছিল।কিন্তু আমরা যে ওই সময়েই ঢুকবো! মানে আমরা গিয়েই যে সতীশকে ক্রাইম সিনে পাবো,ওর পালিয়ে যাওয়ার আগেই সেটা কি করে! “
দেবোপম মৃদু হেসে বললেন,”এতটা যখন তুমি বললে।বাকিটা তুমিই ভেবে বলো।”
পরিতোষের হঠাৎ চোখদুটো জ্বলে উঠল,”দাঁড়ান।দাঁড়ান।বুঝেছি স্যার। সতীশের ঘর থেকে বেরোনোর কল টা যে করে যে জানিয়েছিল আপনাকে সেটা…. “
ওর কথা শেষ করার আগেই দেবোপম বলে উঠল,”ওটা সমরেশ ছিলনা। আমার প্রথমে তাই মনে হয়েছিল। কারণ আমি সমরেশ কে বলেছিলাম জানাতে। ফোনটা যখন পেয়েছিলাম তোমাদেরও তাই বলেছিলাম। কিন্তু দুটো জিনিস খটকা লাগে আমার। সেটা বলার আগে বলি।সমরেশকে কিভাবে খবর দিতে বলেছিলাম… আমি মাঝে সমরেশের সাথে গিয়ে সতীশের স্ত্রীর সাথে দেখা করি।সতীশ কাজে বেরিয়েছিল তখন। আমি ওর স্ত্রীকে বোঝায় যে আমরা খবর পেয়েছি সতীশ বাবুকে একজন ব্ল্যাকমেইল করছে।কি নিয়ে সেটা এখনো জানা যাচ্ছেনা। কিন্তু ভয়ংকর কিছুই।আপনার হাজবেন্ডের লাইফ রিস্ক থাকতে পারে। উনি পুলিশেও খবর দেননি,এমনকি আপনাকেও জানিয়েছেন বলে মনে হয়না।আমরা ওনার উপর নজর রাখছি অনেকদিন,তখনই জানতে পারি…ভদ্রমহিলার তো হাত পা শুকিয়ে যাওয়া মতো অবস্থা।তো ওনাকে তারপর বললাম।এর মধ্যে সন্ধ্যে রাতের দিকে সতীশ বাবু যদি কোথাও আপনাকে না জানিয়ে বেরোন আপনি অবশ্যই খবর দেবেন।ভদ্রমহিলা একপায়ে রাজী হয়ে যান। সেখান থেকেই।কিন্তু..প্রথম যে ফোনটা আসে সেটা আসে একটা ল্যান্ডফোন থেকে। তখন তাড়াহুড়োর জন্য খেয়াল করিনি। আমি বেরিয়ে পড়েছি ততক্ষণে তোমাদের সাথে।তার কিছুক্ষণ পর আবার ফোন আসে। এবার সমরেশের। ও ফোন করে এককথা আমাকে জানায়।কিন্তু আমরা ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছিলাম।এটা আমাকে ভাবিয়েছিল। পরে সমরেশ কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। আর সেইজন্যই তোমাকে বলেছিলাম আমার মনে হয়না সতীশ খুন করতে পারে।”
পরিতোষের চোখ আবার জ্বলজ্বল করে উঠল।একরাশ মুগ্ধতা সেই দৃষ্টি তে। যেন একজন আইডল যে তার থেকে অনেক ক্রোশ এগিয়ে আছে,তাকে ছোঁওয়ার চেষ্টা করা।সেই চেষ্টার মধ্যেও একটা তৃপ্তি আছে।
#
দেবোপম আর অরূপ মুখোমুখি। দেবোপম একটা চেয়ারে বসে। অরূপ হাত পা বাঁধা অবস্থায় আর একটা চেয়ারে।তার সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদ এভাবেই চলে। বিশেষত অপরাধী দের সঙ্গে। অরূপ প্রায় ক্লান্ত।ওর কথা বলার ও ক্ষমতা নেই।একজন কনস্টেবল থুতনি ধরে ওর মুখটা তুলে ধরে আছে। দেবোপম কিছুক্ষণ তাকিয়ে মুখ খুললেন,” তোমার বাড়ির বাগান থেকে রিচার বাড়ি থেকে চুরি যাওয়া দশভরি সোনা পাওয়া গেছে।তুমি কিছু বলতে চাও!”
অরূপ মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,”আমি কিছু জানিনা স্যার। সোনার ব্যাপারে।সত্যি বলছি।অন্যকেউ হয়ত..”
দেবোপম রেগে গেলেন,”চুপ একদম চুপ। অনেক নাটক হয়েছে।তোর পালানোর আর কোনো রাস্তা নেই।এই ন্যাকাপোনা বন্ধ কর।”
দেবোপম বাবু একহাতে নাকে রুমাল চেপে ধরে কুঁজো হয়ে নীলাঞ্জনের অবচেতন শরীরের উপর ঝুঁকে কিছুক্ষণ দেখলেন।মাথায় পিছনে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে।ভোঁতা কিছু দিয়ে।ওখানেই ক্ষতটা স্পষ্ট। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পেলে বলা যাবেনা আঘাতটা ওইকারনেই হয়েছে কিনা, নাকি অন্যকোনোভাবে।যেটাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।দেবোপম বাবু ডাক দিলেন,”পরিতোষ! পরিতোষ! ” একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকে জিজ্ঞেস করল,”হ্যাঁ স্যার বলুন।”
“লাশটা পোস্টমর্টেম এ পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর হ্যাঁ শোনো ওই ভিড় সরাও।বিরক্তিকর লাগছে।”
“হ্যাঁ স্যার।”
“দাঁড়াও। কে প্রথম লাশ দেখেছে!”
“স্যার ওই ওনার স্ত্রী আর প্রতিবেশী তিনজন। যারা দরজা ভেঙে ঢুকেছিল।”
“আচ্ছা কেবল তাদের বাদ দিয়ে বাকি যেকটা দাঁড়িয়ে আছে,তাদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে আপাতত বিদায় করো।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর!”
“কি স্যার!”
“কিছু না বাদ দাও।আমি দেখছি।তুমি ওগুলোই করো আপাতত। ”
“ইয়েস স্যার”, আর একবার স্যালুট ঠুকে পরিতোষ বেরিয়ে গেলো।
দেবোপম চাইলেই সেকেন্ড অফিসার কে পাঠাতে পারতেন,কিন্তু কি একটা মনে হতেই নিজেই এলেন ক্রাইম সিনে।খুনের হার রিসেন্টলি এতই বেড়েছে যে খুনের খবর শুনলে খুব একটা বিচলিত হন না তিনি।বরং কোনোদিন কোথাও একটাও খুন না হলে অবাক হন ।উঠে ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।একপাশে রিচা জড়পদার্থর মতো বসে আছে।ওর মুখ থেকে রঙ উড়ে গেছে।চোখ দুটো ভয়ে মাখামাখি।সেই পাংশুটে মুখের দিকে তাকিয়ে দেবোপম মনে মনে বললেন,”শকড!আশ্চর্য নয়।তোমার কাছে পরে আসছি!”
পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘর তছনছ হয়ে আছে পুরো।ড্রেসিংরুমের ড্রয়ার গুলো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।আলমারির দরজা হাট করে খোলা।এদিকওদিক কাগজ, জামাকাপড় এবং টুকিটাকি জিনিসপত্র ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে।দুজন কনস্টেবল সেগুলোই গুছিয়ে তুলে তুলে দেখছে।দেবোপম কে দেখে তাদের ই একজন এগিয়ে এসে বলল,”স্যার লকার ভাঙা।ভিতরে কিছু নেই।রবারির কেস মনে হচ্ছে।” দেবোপম ভুরু কুঁচকে বললেন,”দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা ঠিক হবেনা।” ছড়ানোছেটানো কাগজপত্র গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা কাগজের উপর এসে থামলেন।এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন।বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে ‘নিউ লাইফ ফার্টিলিটি ক্লিনিক’। লেখাটা পড়ে একটু থমকে রইলেন দেবোপম। তারপর কাগজটাকে ভাঁজ করে পকেটে ভরে রাখলেন। আর একবার ঘরটার এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে পাশের ঘরে ফিরে এলেন। বডি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ততক্ষণে। রিচা বিছানার উপর উঠে বসেছে।মাথা নামানো।মুখে কোনো কথা নেই।দেবোপম সেদিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,”আপনি নীলাঞ্জন বাবুর স্ত্রী,রিচা!”
রিচা মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো।কথা বললনা।ঘাড় নাড়ল স্রেফ।
“হুম আপনি কোথায় গিয়েছিলেন!”
“বাবা মার কাছে!”
“কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিল না এমনি গেছিলেন?”
“এমনি। ও ই আমাকে যেতে বলেছিল।”,রিচা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল।
“আচ্ছা নীলাঞ্জন বাবুই আপনাকে যেতে বলেছিল।”
“হ্যাঁ।ও বলেছিল।আমি অনেক দিন যাইনি আর ও বলেছিল ওর ছুটি আছে।ও বাড়িটা সামলে নেবে।আমি যেন ঘুরে আসি।”
“আর আপনি চলে গেলেন।ভালো। ফিরলেন কখন?”
“আজ সকালে।নটার সময়।”
“ফেরার পর কি কি হল একটু বলুন।”
রিচা একটু নড়েচড়ে বসল,তারপর বলল,”আমি ফেরার আগেই ওকে ফোন করছিলাম।তুলছিলনা।প্রথমে ভাবলাম হয়ত সারারাত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।তাই সকালে ঘুমোচ্ছে।আমি তাই আর ফোন করিনি। এখানে আসার পর কলিং বেল বাজালাম।বেশ কয়েকবার।ফোন ও করলাম।কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে…”
রিচার কথা শেষ হবার আগেই দেবোপম তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন,”আপনাদের সদর দরজার স্পেয়ার কি নেই!”
“আছে।কিন্তু আমার কাছে ছিলনা সেসময়। ”
“কেন?”
” নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলনা।ও বলেছিল ও বাড়িতেই থাকবে।নিয়ে যেতে হবেনা।তাই আমি নিয়ে যাইনি।”
“আচ্ছা তারপর কন্টিনিউ করুন।”
“হ্যাঁ তো আমি অনেকবার ডাকার পর সাড়া না পেয়ে মুখার্জী দা আর দাস দা কে ডাকলাম।ওনারা এসে বার কয়েক ডাকলেন।তারপর সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙা হয়।আর তারপর..”,রিচা কথা শেষ করতে পারলোনা।ওর গলা জড়িয়ে এলো।দুহাত দিয়ে চোখদুটো ঢেকে নিলো।
দেবোপম মুখ গম্ভীর করে বললেন,”বুঝলাম।আচ্ছা এই দাস দা আর মুখার্জী দা কারা?”
ঘরে কনস্টেবল দের সাথে দুজন দাঁড়িয়েছিলেন।তারা এগিয়ে এলেন। দেবোপম তাদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন,”আপনারা!”
দাঁড়িয়ে থাকা ওই দুজন ব্যক্তির একজন বলল,”আমার নাম সতীশ মুখার্জী।বৌদি আমাকে প্রথম ডেকেছিলেন।”
“আচ্ছা আর আপনি!”,দেবোপম অন্য একজনের দিকে প্রশ্ন করলেন।
“আমার নাম রজত দাস।মুখার্জী দার সাথে আমাকেও ডেকেছিলেন বৌদি।”
“আচ্ছা কি হয়েছিল বলতে পারবেন?”
সতীশ মুখার্জী বললেন,”আমাদের ডাকার পর আমরা এসে কয়েকবার নীলাঞ্জন দাকে ডাকলাম। কোনো উত্তর পেলাম না। তারপর বৌদি বললেন দরজা ভেঙে ফেলতে।তো আমরা দরজা ভেঙে ফেললাম।”
“আচ্ছা বৌদি বললেন।আপনাদের মধ্যে কে থানায় খবর দিয়েছিল?”,দেবোপম জড়িপ করে নিলেন দুজনকে।
“আমি”,রজত দাস উত্তর দিলেন।
“আচ্ছা।আপনারা কাল সন্ধ্যে বা রাতে কোনো আওয়াজ পাননি কোনোকিছুর? চিৎকার বা অন্যকিছুর!”
সতীশ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল,”উঁহু তেমন কিছু তো মনে পড়ছেনা!স্বাভাবিক যেমন শুনি রোজ,তার বাইরে আলাদা কিছু কানে আসেনি।”
“আর আপনি?”,দেবোপম রজতের দিকে তাকালেন।লোকটার মধ্যে একটু জড়োসড়ো ভাব।রজত একটু ভেবে উত্তর দিলেন,”আমারও তেমন কিছু মনে পড়ছেনা।তবে কাল রাত নটার দিকে একটা ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েছিলাম।আমি ভাবলাম তেমন কিছু না হয়ত।”
“আপনি শুনতে পাননি তেমন কিছু!”,দেবোপম সতীশের দিকে ঘুরলেন।
একগাল বোকা বোকা হাসি মুখে সতীশ উত্তর দিল
অরূপ অনড়,”সত্যি বলছি স্যার?”
“তোর কোট গ্লাভস পাওয়া গেছে ক্রাইম সিনের পাশ থেকে।হয়ত জানিস না।যতই কাদাজলে ফেলে রেখে যা,ডি.এন.এ টেস্টের মাধ্যমে তোর ডি.এন.এ-র স্যাম্পলে পাওয়া যাবে!”,দেবোপম অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন।
“স্যার আমাকে একজন অচেনা লোক ফোন করে বলেছিল আমি গ্লাভস আর কোট পরে একজায়গায় গিয়ে দুটো খুলে রেখে চলে আসি।”
“বা বা বা… দারুন তো। আর তুই রেখেও এলি বাধ্য ছেলের মতো।”
“আসলে স্যার।আমি রিচাকে ভালোবাসতাম।কে কখন কিভাবে জানিনা আমার আর রিচার ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের ছবি তুলে নিয়েছিল।যেদিন ফোন টা আসে।সেদিন সকালে একটা চিঠি আসে।সেখানে সেই ছবি গুলো ছিলো।তারপর সেই ফোন টা আসে।সেই লোক টা বলে আমি যদি ওগুলো না করি তাহলে ওই ছবিগুলো ও পুলিশের কাছে পৌঁছে দেবে। ওগুলো আপনাদের হাতে এলে স্যার আপনারা আমাকেই সন্দেহ করতেন। তাই স্যার ভয়ে..”
অরূপের কথা শেষ হবার আগেই দেবোপম কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারলেন,”অনেক হয়েছে।গাঁজাখুরি গল্প।তোর মতো জানোয়ারের হয়ত যাই আসেনা,কিন্তু ওই রিচা মেয়েটির গর্ভে তোর মতো কুলাঙ্গারের সন্তান ছিল। তোকে ভালোবেসে নিজের স্বামীকে পর্যন্ত… আর তুই..”
দেবোপম উঠে বেরিয়ে এলেন।
(৪)
দেবোপম বাবু একহাতে নাকে রুমাল চেপে ধরে কুঁজো হয়ে নীলাঞ্জনের অবচেতন শরীরের উপর ঝুঁকে কিছুক্ষণ দেখলেন।মাথায় পিছনে কিছু একটা দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে।ভোঁতা কিছু দিয়ে।ওখানেই ক্ষতটা স্পষ্ট। তবে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পেলে বলা যাবেনা আঘাতটা ওইকারনেই হয়েছে কিনা, নাকি অন্যকোনোভাবে।যেটাকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে।দেবোপম বাবু ডাক দিলেন,”পরিতোষ! পরিতোষ! ” একজন কনস্টেবল এগিয়ে এসে স্যালুট ঠুকে জিজ্ঞেস করল,”হ্যাঁ স্যার বলুন।”
“লাশটা পোস্টমর্টেম এ পাঠানোর ব্যবস্থা করো।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর হ্যাঁ শোনো ওই ভিড় সরাও।বিরক্তিকর লাগছে।”
“হ্যাঁ স্যার।”
“দাঁড়াও। কে প্রথম লাশ দেখেছে!”
“স্যার ওই ওনার স্ত্রী আর প্রতিবেশী তিনজন। যারা দরজা ভেঙে ঢুকেছিল।”
“আচ্ছা কেবল তাদের বাদ দিয়ে বাকি যেকটা দাঁড়িয়ে আছে,তাদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে আপাতত বিদায় করো।”
“আচ্ছা স্যার।”
“আর!”
“কি স্যার!”
“কিছু না বাদ দাও।আমি দেখছি।তুমি ওগুলোই করো আপাতত। ”
“ইয়েস স্যার”, আর একবার স্যালুট ঠুকে পরিতোষ বেরিয়ে গেলো।
দেবোপম চাইলেই সেকেন্ড অফিসার কে পাঠাতে পারতেন,কিন্তু কি একটা মনে হতেই নিজেই এলেন ক্রাইম সিনে।খুনের হার রিসেন্টলি এতই বেড়েছে যে খুনের খবর শুনলে খুব একটা বিচলিত হন না তিনি।বরং কোনোদিন কোথাও একটাও খুন না হলে অবাক হন ।উঠে ঘরের চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন।একপাশে রিচা জড়পদার্থর মতো বসে আছে।ওর মুখ থেকে রঙ উড়ে গেছে।চোখ দুটো ভয়ে মাখামাখি।সেই পাংশুটে মুখের দিকে তাকিয়ে দেবোপম মনে মনে বললেন,”শকড!আশ্চর্য নয়।তোমার কাছে পরে আসছি!”
পাশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ঘর তছনছ হয়ে আছে পুরো।ড্রেসিংরুমের ড্রয়ার গুলো মাটিতে লুটোপুটি খাচ্ছে।আলমারির দরজা হাট করে খোলা।এদিকওদিক কাগজ, জামাকাপড় এবং টুকিটাকি জিনিসপত্র ছড়িয়েছিটিয়ে রয়েছে।দুজন কনস্টেবল সেগুলোই গুছিয়ে তুলে তুলে দেখছে।দেবোপম কে দেখে তাদের ই একজন এগিয়ে এসে বলল,”স্যার লকার ভাঙা।ভিতরে কিছু নেই।রবারির কেস মনে হচ্ছে।” দেবোপম ভুরু কুঁচকে বললেন,”দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কিছু বলা ঠিক হবেনা।” ছড়ানোছেটানো কাগজপত্র গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা কাগজের উপর এসে থামলেন।এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলেন।বড়ো বড়ো হরফে লেখা আছে ‘নিউ লাইফ ফার্টিলিটি ক্লিনিক’। লেখাটা পড়ে একটু থমকে রইলেন দেবোপম। তারপর কাগজটাকে ভাঁজ করে পকেটে ভরে রাখলেন। আর একবার ঘরটার এদিকওদিক চোখ বুলিয়ে পাশের ঘরে ফিরে এলেন। বডি সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ততক্ষণে। রিচা বিছানার উপর উঠে বসেছে।মাথা নামানো।মুখে কোনো কথা নেই।দেবোপম সেদিকে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করলেন,”আপনি নীলাঞ্জন বাবুর স্ত্রী,রিচা!”
রিচা মুখ তুলে ওর দিকে তাকালো।কথা বললনা।ঘাড় নাড়ল স্রেফ।
“হুম আপনি কোথায় গিয়েছিলেন!”
“বাবা মার কাছে!”
“কোনো বিষয়ে ঝগড়া হয়েছিল না এমনি গেছিলেন?”
“এমনি। ও ই আমাকে যেতে বলেছিল।”,রিচা দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিল।
“আচ্ছা নীলাঞ্জন বাবুই আপনাকে যেতে বলেছিল।”
“হ্যাঁ।ও বলেছিল।আমি অনেক দিন যাইনি আর ও বলেছিল ওর ছুটি আছে।ও বাড়িটা সামলে নেবে।আমি যেন ঘুরে আসি।”
“আর আপনি চলে গেলেন।ভালো। ফিরলেন কখন?”
“আজ সকালে।নটার সময়।”
“ফেরার পর কি কি হল একটু বলুন।”
রিচা একটু নড়েচড়ে বসল,তারপর বলল,”আমি ফেরার আগেই ওকে ফোন করছিলাম।তুলছিলনা।প্রথমে ভাবলাম হয়ত সারারাত কাজ করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।তাই সকালে ঘুমোচ্ছে।আমি তাই আর ফোন করিনি। এখানে আসার পর কলিং বেল বাজালাম।বেশ কয়েকবার।ফোন ও করলাম।কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে…”
রিচার কথা শেষ হবার আগেই দেবোপম তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেন,”আপনাদের সদর দরজার স্পেয়ার কি নেই!”
“আছে।কিন্তু আমার কাছে ছিলনা সেসময়। ”
“কেন?”
” নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলনা।ও বলেছিল ও বাড়িতেই থাকবে।নিয়ে যেতে হবেনা।তাই আমি নিয়ে যাইনি।”
“আচ্ছা তারপর কন্টিনিউ করুন।”
“হ্যাঁ তো আমি অনেকবার ডাকার পর সাড়া না পেয়ে মুখার্জী দা আর দাস দা কে ডাকলাম।ওনারা এসে বার কয়েক ডাকলেন।তারপর সাড়া না পেয়ে দরজা ভাঙা হয়।আর তারপর..”,রিচা কথা শেষ করতে পারলোনা।ওর গলা জড়িয়ে এলো।দুহাত দিয়ে চোখদুটো ঢেকে নিলো।
দেবোপম মুখ গম্ভীর করে বললেন,”বুঝলাম।আচ্ছা এই দাস দা আর মুখার্জী দা কারা?”
ঘরে কনস্টেবল দের সাথে দুজন দাঁড়িয়েছিলেন।তারা এগিয়ে এলেন। দেবোপম তাদের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন,”আপনারা!”
দাঁড়িয়ে থাকা ওই দুজন ব্যক্তির একজন বলল,”আমার নাম সতীশ মুখার্জী।বৌদি আমাকে প্রথম ডেকেছিলেন।”
“আচ্ছা আর আপনি!”,দেবোপম অন্য একজনের দিকে প্রশ্ন করলেন।
“আমার নাম রজত দাস।মুখার্জী দার সাথে আমাকেও ডেকেছিলেন বৌদি।”
“আচ্ছা কি হয়েছিল বলতে পারবেন?”
সতীশ মুখার্জী বললেন,”আমাদের ডাকার পর আমরা এসে কয়েকবার নীলাঞ্জন দাকে ডাকলাম। কোনো উত্তর পেলাম না। তারপর বৌদি বললেন দরজা ভেঙে ফেলতে।তো আমরা দরজা ভেঙে ফেললাম।”
“আচ্ছা বৌদি বললেন।আপনাদের মধ্যে কে থানায় খবর দিয়েছিল?”,দেবোপম জড়িপ করে নিলেন দুজনকে।
“আমি”,রজত দাস উত্তর দিলেন।
“আচ্ছা।আপনারা কাল সন্ধ্যে বা রাতে কোনো আওয়াজ পাননি কোনোকিছুর? চিৎকার বা অন্যকিছুর!”
সতীশ কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিল,”উঁহু তেমন কিছু তো মনে পড়ছেনা!স্বাভাবিক যেমন শুনি রোজ,তার বাইরে আলাদা কিছু কানে আসেনি।”
“আর আপনি?”,দেবোপম রজতের দিকে তাকালেন।লোকটার মধ্যে একটু জড়োসড়ো ভাব।রজত একটু ভেবে উত্তর দিলেন,”আমারও তেমন কিছু মনে পড়ছেনা।তবে কাল রাত নটার দিকে একটা ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেয়েছিলাম।আমি ভাবলাম তেমন কিছু না হয়ত।”
“আপনি শুনতে পাননি তেমন কিছু!”,দেবোপম সতীশের দিকে ঘুরলেন।
একগাল বোকা বোকা হাসি মুখে সতীশ উত্তর দিল
চারমাস পর..
লোকাল কোর্টের রায় বেরিয়েছে। যা প্রমাণ পাওয়া গেছিল তা অরূপ কে দোষী সাব্যস্ত করতে বেশি সময় লাগেনি। এখানে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।পরিতোষ কোর্ট থেকে বেরোনোর সময় বলছিল,”হাইকোর্টে যাবে হয়ত,কিন্তু সাজা কম হওয়ার সুযোগ দেখছিনা।আপনি না থাকলে স্যার..বেচারা সতীশ হয়ত জেলের হাওয়া খেতো।” দেবোপম দাঁড়ায়নি।আজ মেয়ে হোস্টেল থেকে ফিরেছে।তাই উনি দেরী করতে চাননি। বাড়ি তে ফিরে এলেন তাড়াতাড়ি। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে শেলি জড়িয়ে ধরল বাবাকে। নীলাঞ্জনের খবর সে পেয়েছিল।ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিল। বাবাকে তো জানাতেও পারেনি।কোনোদিনও জানাতেও পারবেনা। সময় লাগলেও এখন কিছুটা সুস্থ সে।নিজের মন কে বুঝিয়ে নিয়েছে।সবকিছু পাওয়া যায় না।সবকিছু পাওয়া সম্ভব নয়। এই পাওয়া না পাওয়ার নাম ই জীবন। দেবোপম এসে শেলি ওরফে শেফালির মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন “কেমন আছিস মা!”
“ভালো আছি বাবা।”,শেলি হাসল।
“বেশ।যা কিছু খেয়ে নে।অনেক দূর থেকে এসেছিস।”
“হুম বাবা।”
শেলি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলে দেবোপম ছাদে এলেন।একটা সিগারেট ধরালেন। তারপর হাসতে লাগলেন।নিজের মনেই।ক্রুর হাসি। শয়তানের হাসি। ওই আননোন নাম্বারের কেসটা কি সুন্দর সাজিয়েছেন।ওদিকে ওকে পেমেন্ট সব কমপ্লিট।লোকটা,এমনিতেও ভয়ংকর সুন্দর ভাবে সব মিটিয়ে দিয়েছে।বিশেষত রিচাকে সরানোর সময়।আইডিয়া অবশ্য ওর ই ছিল।একটা সম্পূর্ন নতুন কোট আর গ্লাভসের উপরে অরূপের কোট আর গ্লাভসটা চাপিয়ে নেওয়া,যাতে কেবল অরূপেরই ডি.এন.এ পাওয়া যায়।দ্যাট ওয়াজ আউটস্ট্যান্ডিং। নিজের প্রশংসা না করে নিজেই পারলেন না।যাইহোক সেই ছায়ামানুষ এখন আবার ছায়াতেই সরে যাবে। কেউ জানবে না তার কথা। কেউ জানবে না এই গেমটার মাস্টার মাইন্ড কে! আকাশের দিকে তাকিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে নিজেকেই বললেন,”এ পৃথিবীতে সন্তানের থেকে মায়ার আর কিছুই নেই।কিছুই থাকতে পারেনা।তার একমাত্র মেয়ের জীবন শেষ করে দিয়ে কেউ বেঁচে থাকতে পারেনা।কারোর ই সেই অধিকার নেই”
ব্যভিচারী – অন্তিম পর্ব