ওরা কারা? যারা, কানে বড়ো বড়ো দুল পড়ে, চোখে কাজল, ডিপ্ লিপস্টিক আর কড়া পারফিউমে, চুমকি বসানো সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলটা ফেলে পাড়ি জমায় নিষিদ্ধ পল্লীতে। সোনাগাছি, কালীঘাট, হাড়কাটা গলি, খিদিরপুর অথবা লেবুতলায় যাদের হামেশাই দেখা যায়। কেউ তাদের আসল নাম জানেনা, কিংবা জানতেও চায়না। কেউ ডাকে চম্পা, প্রীতি, রানী ইত্যাদি নানান নামে। আর সভ্য সমাজ তাচ্ছিল্য মিশিয়ে বলে “বেশ্যা”। বেশ্যা তারাই, যারা সভ্য সমাজের মানুষের কাছে দিনের আলোয় দুচোখের বিষ, আবার বেশ্যা তারাই, যারা অন্ধকারে সভ্য সমাজের বহু নামকরা লোকের খিদে মেটায়। আসলে এদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটি গল্প আছে, আর সে গল্পটা অসহায়ত্বের। কিন্তু আমরা ভিতরটা দেখিনা, দেখি বাইরে দিকটা। আসলে ৫00 টাকায় কাপড় খুললে মেয়েরা হয় বেশ্যা, আর ৫0,000 টাকায় কাপড় খুললে হয় নায়িকা। আবেগে কাপড় খুললে হয় বান্ধবী, আর অভাবে কাপড় খুললে হয় মাগী।
এরকমই একটি গল্প………..
অখিলেশ বাবু পড়লেন বেকায়দায়, তাই শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ পল্লীতে যেতে বাধ্য হলেন।
খিদিরপুর এলাকাটা খুব ঘিঞ্জি, এ জায়গায় ভদ্র লোকরা খুব একটা আসেনা। তবু কালো কাঁচওয়ালা গাড়ি এখানে বেশ দেখা যায়। চ্যালারা এসে তুলে নিয়ে যায়।
চোখে সুরমা পরা, রং বাহারী লিপস্টিক আর সুগন্ধী পারফিউম, সালোয়ার কামিজ, শাড়ি পরা মেয়েরা তাঁর সামনে উপস্হিত হলো। আর এদের মধ্যেই অখিলেশ বাবু একজনকে চয়েশ করলেন ও নির্দিষ্ট রুমে নিয়ে গেলেন।
কথোপকথোন………
অখিলেশ বাবু: তোমার নাম কি? বয়স কত?
রানী: কেন নাম বয়স দিয়ে কি ধুয়ে খাবেন? না কি ৩00 টাকা এক্ট্রা দেবেন? আমার নাম রানী আর বয়স দেখে বুঝতে পারছেননা। না কি নেবা হয়ে গেছেন?
অখিলেশ বাবু: না শুনেছি মাসীরা তোমাদের নতুন নাম দিয়ে থাকে, তাই বললাম। যাক, তোমার নামটা খুব সুন্দর। সত্যি তুমি খুব সুন্দরী। আর এ নাম তো তোমাকেই মানায়।
রানী: যাক! সময় নষ্ট না করে, যেটা করার জন্য এসেছেন, সেটা করে তাড়াতাড়ি কেটে পড়ুন।
অখিলেশ বাবু: আচ্ছা! আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?
রানী: (হাসতে হাসতে বললো) বাব্বা, পারিনা গো, কত্ত ন্যাকামী। খাননা কে আপত্তি করেছে?
অখিলেশ বাবু: না, অনেকের আবার কিনা আপত্তি থাকে। ধোঁয়াটা সহ্য করতে পারেনা। তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
রানী: আসলে সমস্যা তো প্রাণীর থাকে। আর আমরা তো জড় পদার্থ। পয়সা তো শুধু শরীরের জন্য। আর আমরা তো শরীর বিক্রি করে খাই। কেনই বা সময় নষ্ট করছেন? শুরু করুন।
অখিলেশ বাবু: কেন তোমার কি সমস্যা, যার জন্য তুমি এখানে এলে?
রানী: সমস্যা তো অনেক গো সাহেব। যাক! আমি খুলবো, না আপনি নিজের খুলবেন?
অখিলেশ বাবু: না না এখন নয়।
রানী: ও বুঝেছি, এখানে এই প্রথমবার।
অখিলেশ বাবু: হ্যাঁ।
রানী: আপনি কি বিবাহিত?
অখিলেশ বাবু: হ্যাঁ।
রানী: ও বুঝেছি, বউ পর পুরুষের সাথে ফুর্তি করছে, তাই এখানে।
অখিলেশ বাবু: না না সেটা নয়। আসলে……
বলতে বলতে দরজায় টোকা দিয়ে মাসী বললো, রানী বেরো এক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে। আরো কাস্টোমার এসেছে।
রানী: হ্যাঁ হ্যাঁ বেরুচ্ছি।
অখিলেশ বাবু: না, আরো একঘন্টা থাকো। যা দিতে হয় দেবো।
রানী: সুলেখা মাসী, কাস্টোমার আরও এক ঘন্টা থাকবে বলছে।
মাসী: আচ্ছা ঠিক আছে।
অখিলেশ বাবু: তা তুমি কেন এখানে এলে?
রানী: (চোখ ছলছল করে) সখ করে কেউ এখানে আসেনা সাহেব। তখন আমি কলেজে পড়তাম। বাবা টাকার লোভে এক ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ের দিলেন, বলতে পারেন এক দালালের সঙ্গে। ভালোই চলছিল। কদিন পর হঠাৎ দেখি, আমার স্বামী বন্ধু বান্ধবদের সাথে ড্রিঙ্কের আয়োজন করেছে। তারপর আমাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বাধা দিয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। নরপিশাচ গুলো সেই রাতে আমাকে অনেক বার ধর্ষণ করে। তার পর আমার স্বামী আমাকে মোটা টাকার বিনিময়ে এখানে বিক্রি করে দেয়।
অখিলেশ বাবু: বুঝলাম।
রানী: আচ্ছা বলুনতো আপনি কেন এখানে এসেছেন?
অখিলেশ বাবু: বউকে খুঁজতে।
রানী: মানে?
অখিলেশ বাবু: জানো, দিল্লী থেকে ট্রেনে ফিরছিলাম হাওড়াতে। একটু ঘুম এসেগেছিলো। মুঘলসরাইয়ের দুটো স্টেশন আগে ট্রেনটা দাঁড়ালো। দেখলাম আমার বউ মানে সুপর্না নেই। ভাবলাম হয়তো বাথরুমে গেছে। তন্ন তন্ন খোঁজার পরও তাকে পেলাম না।
রানী: তা, বউ খুঁজতে শেষ পর্যন্ত এখানে এলেন?
অখিলেশ বাবু: হ্যাঁ, জান সেই রাতের ঘটনার ১0 দিনের মাথায়, মানে গতকাল স্ত্রীর ফোন আসে, শুধু বললো খিদিরপুরে এসে, এই নরক থেকে নিশা মানে তোমার সুপর্নাকে নিয়ে যাও। কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেলো। বুঝতে পেরেছিলাম হয়তো ৫ সেকেন্ডের সুযোগটাই পেয়েছিলো আমাকে জানানোর জন্য। তারপর যতবার ফোন করেছি ওই নম্বরে, ফোন লাগেনি আর। শুধু সুইচ্ অফ বলছিলো। আমি খুঁজতে এসেছি আমার স্ত্রী সুপর্নাকে, জানি এতো বড় খিদিরপুরে, আমার একার পক্ষে স্ত্রীকে খোঁজা সম্ভব নয়, শুধু চাই তোমার মতো একজন বন্ধু, যে আমার স্ত্রীকে খুঁজে বের করে দেবে এই নরক থেকে। প্লিজ তুমি খুঁজে দাও আমার সুপর্নাকে, যা লাগবে আমি তোমাকে দেবো ….
রানী: আমার দাবি না হয় আপনাকে পরেই বলবো, তবে পারবেন কি সব কিছু জেনেও নিজের স্ত্রীকে এখান থেকে ফিরিয়ে নিতে ?
অখিলেশ বাবু: কেনো পারবো না ? আমি তো বেশ্যা নিশাকে কিনতে আসিনি, আমি স্ত্রী সুপর্নাকে ফেরাতে এসেছি। তুমি তো কত দালাল, কত মাসীকে চেনো। ফিরিয়ে দাও, আমার সুপর্নাকে।
রানী: আচ্ছা, আপনার নম্বরটা দিয়ে যান, আমি আপনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানাবো কথা দিলাম।
(৩ দিন পর অখিলেশ বাবুকে ফোন করে রানী)
রানী : শুনছেন ? নিশা মানে সুপর্নার খবর পেয়েছি। আমার বিল্ডিঙের ডান দিকের ৪ নং বিল্ডিয়েই সুপর্না থাকে, নতুন তো তাই হাতে ফোন পায়না। আর হ্যাঁ, হয়তো কোনো সাহেবের ফোন থেকেই আপনাকে সেদিন ৫ সেকেন্ডের জন্য ফোন করতে পেরেছিলো। নিয়ে যান আপনার সুপর্নাকে।
(সাথে পুলিশ নিয়ে গিয়ে অখিলেশ বাবু উদ্ধার করলেন নিশা ওরফে তার স্ত্রী সুপর্নাকে। ফেরার পথে দেখা করতে যান ওই রানী নামক বেশ্যার সাথে )
অখিলেশ বাবু: কি বলে ধন্যবাদ দেবো তোমায়, নিজেও জানিনা, এবার বলো তোমার কত টাকা লাগবে ?
রানী : টাকা লাগবে না, টাকার থেকেও অনেক বেশি কিছু আপনি আমাকে দিয়ে গেলেন সাহেব…
অখিলেশ বাবু : মানে ? কি বলতে চাইছো ? কিছুই বুঝলাম না….
রানী: বিশ্বাস করুন সাহেব, আমি কোনো পুরুষকে মন থেকে সহ্য করতে পারি না, বিশ্বাস করতেও পারিনা। শুধু এটাই মনে হতো সব পুরুষ সমান। আর আপনি আমার সেই ভুল ভাঙলেন, নতুন করে বিশ্বাস করতে শিখলাম। একজন পুরুষ যেমন তার স্ত্রীকে বিক্রি করতে পারে, তেমনই কোনো পুরুষ তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেও পারে নিষিদ্ধ পল্লী থেকে। গতর খাটিয়ে পয়সা তো ৩ বছরে অনেক রোজগার করেছি, তবে ৩ বছরে যে ভুলটা রোজ ভেবে এসেছি, সেই ভুলটা আপনি ৫ মিনিটেই ভেঙে দিলেন। যেটা পয়সার থেকেও অনেক দামী। সাহেব, ভালো থাকবেন, আর আপনার সুপর্নাকে নিয়ে সুখে থাকুন। ধন্যবাদ এই সত্যিটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে যাবার জন্য “সব পুরুষ সমান নয়। হ্যাঁ, কেউ রেখে যায়, কেউ নিয়ে যায় …., কেউ রাখতে আসে, কেউ ফেরাতে আসে ….”।
অখিলেশ বাবুর জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। সব কিছু ফিরে আসে।
আর সব কিছু জানাজানির পর, রানীকে ওখান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সেই নামহীন নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়না।।