১)
ব্রিস্টলে আজ সন্ধ্যে থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা হয়েই যাচ্ছে। ক্লিফটন ব্রিজ টা এই মধ্য রাত্রে নিঝুম হয়ে আছে। বৃষ্টিভেজা এই রাতের অন্ধকারে জন মানবহীন এই ব্রিজটার প্রায় মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালো অলিভিয়া।
বৃষ্টির জল আর চোখের জল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে ওর ।নাকের ওপর আটকানো চশমাটা বৃষ্টির জলে ঝাপসা হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন আগেই।ব্রিজের ওপর থেকে শোনা যাচ্ছে অ্যাভন নদীর জলস্রোতের আওয়াজ। পিটারের চেহারাটা যেন চোখের সামনে থেকে সরতেই চাইছেনা।ব্রিজের ধার ঘেঁষে এগোতে এগোতে নিচের দিকে তাকালো অলিভিয়া। জীবন বড়োই কঠিন… বড়োই যন্ত্রণার।ছোটবেলা জন্মেই হারিয়েছে নিজের বাবা মা কে…তারপর ফস্টার কেয়ার…এরপর কেটেছে অনেকগুলো বছর …একটা ছোট খাটো কাজ ও পেয়েছিল অলিভিয়া… ..তারপর জীবনে এলো উইলিয়াম … মরুভূমির মতো রিক্ত শুস্ক জীবনে ভালোবাসার জোয়ার নিয়ে এসেছিল সে…কিন্তু টিকলো না সেই সম্পর্ক….এরপর দিন এগোলো ,মাস ঘুড়ে নতুন বছর এলো…বছর শেষের সেই বসন্তে অলিভিয়ার একদিন পরিচয় হলো পিটারের সাথে….পিটার ও ফস্টার কেয়ার এ মানুষ হয়েছে..অলিভিয়ার মনে হয়েছিল পিটার তাকে বুঝবে..ছোট্ট সুন্দর একটা সংসারের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল অলিভিয়া…কিন্তু বিয়ের কথা বলতেই পিটার বুঝিয়ে দিয়েছিল রূঢ় বাস্তব টা…যে সম্পর্কের ভিত শুধুমাত্র শরীর,সেখানে ভালোবাসার কোনো স্থান নেই…এর পর অলিভিয়া চেষ্টা করেছিল বেশ কিছুদিন কয়েক জায়গায় কাজ করে আবার জীবন টা শুরু করতে কিন্তু একটা কাজ অবধি কোথাও জোগাড় হলো না…একসময় গান গাইতে ভালোবাসত অলিভিয়া …কিন্তু এখন গলা দিয়ে আর গান বেরোয় না…শুধুই বেসুরো আর্তনাদ….কিছু জীবন,কিছু প্রাণ এই পৃথিবীতে আসে শুধুমাত্র অসময়ে শেষ হওয়ার জন্য।
ব্রিজটার রেলিং টা ধরে উঠে চোখটা বন্ধ করলো অলিভিয়া। মেঘলা আকাশে চমকে উঠলো বিদ্যুৎ। হাতদুটো ছেড়ে দিয়ে ঝাঁপাতে যাওয়ার সাথে সাথে মনে হল কে যেন নিজের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করে হ্যাচকা টান দিল অলিভিয়াকে… মুহূর্তের মধ্যে ব্রিজের ওপর আছড়ে পড়লো অলিভিয়া..চোখের চশমাটা খুলে গিয়ে পড়লো দুহাত আগে…ঝাপসা চোখ দুটো তুলে অলিভিয়া দেখলো এক লম্বা ছিপ ছিপে ভদ্রমহিলা ওর মুখের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। এই আলো আঁধারির ব্রিজের ওপর চশমা ছাড়া মুখটা বোঝা যাচ্ছে না মহিলাটির। মহিলাটি তখনও হাঁপাচ্ছেন… মুখ নিচু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো অলিভিয়া।
ভভ্রমহিলটি নিজের হাত দিয়ে অলিভিয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে প্রায় টানতে টানতে ওকে নিয়ে গেলেন নিজের দামি গাড়িটার কাছে। তারপর গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে অলিভিয়াকে নিয়ে চেপে বসলেন গাড়িতে। গাড়িতে বসতেই গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি বাড়ালো।
গাড়ির ভিতর এখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা।গাড়ির জানলার কাঁচটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে অলিভিয়া।মনের ভেতরের আর্তনাদ টা গলার কাছে দলা পাকিয়ে রয়েছে। চোখের জল বাঁধ মানতে চাইছেনা।হাত দিয়ে চোখদুটো থেকে জল মুছে ফেললোও চোখের কোনে বার বার জমে উঠছে জলকণা।
ড়ির ভেতরের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভভ্রমহিলাটি অলিভিয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন
“তোমার নাম কি?”
উত্তর দিলো না অলিভিয়া
ভভ্রমহিলাটি আবার প্রশ্ন করলেন
“কোথায় থাকো?”
চুপ করে রইলো অলিভিয়া
না থেমে ভভ্রমহিলাটি পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন
“কি হয়েছিল ? আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলে কেন?”
উত্তর না দিয়ে আবছা চোখে অলিভিয়া পাথরের মতো বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে তখন ও।
গলার আওয়াজটা একটু নামিয়ে ভদ্রমহিলা অলিভিয়ার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন
“জানি এখন কথা বলার মতো পরিস্থিতিতে তুমি নেই,হয়তো আমার কথা গুলো ও তোমার কানে ঢুকছে না….জানি খুব ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে তোমার জীবনে…আচ্ছা ঠিক আছে তোমায় একটা গল্প বলি শোনো..হয়তো কিছুটা মিল পাবে….আমার পরিচিত এক বন্ধুর গল্প…তার নাম রবার্ট”
বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অলিভিয়ার কানে ওই ভদ্রমহিলার গল্পটা ভাসতে লাগলো…
(২)
কলেজের নোটিশ বোর্ড টা তিন বার চেক করলো রবার্ট। নিজের নামটা কোথাও খুঁজে পেলো না…রবার্টের স্বপ্ন ছিল এই কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হওয়ার।সেই শুরু রবার্টের জীবনে স্বপ্ন ভঙ্গের ইতিহাসের। কিছুটা বাধ্য হয়েই অন্য একটা কলেজ থেকে ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে শেষ মেশ কমপ্লিট হলো গ্রাজুয়েশন টা।
মধ্যবিত্ত পরিবারের আর পাঁচটা মা এর মতো রবার্টের মা ও চাইতেন যেন খেয়ে পড়ে ঠিক ঠাক ভাবে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয় রবার্ট।কিন্তু রবার্টের স্বপ্নরা সব সময় আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতো।রবার্টের সবসময় মনে হতো সে নিশ্চই পারবে তার স্বপ্নগুলোকে বাস্তব করতে…কিন্তু ভাগ্য আর পরিস্থিতি বোধয় অন্য কিছু ভেবে রেখেছিল রবার্টের জন্য।
কলেজে থেকে পাশ করে একটা রিসার্চ ডেস্ক এ কাজ ও জুটে গেল রবার্টের।প্রথম প্রথম খুব মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করতো রবার্ট।কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারলো এই কাজ ওর জন্য নয়।আবার একটা নতুন জায়গায় কাজে ঢুকলো রবার্ট।কিন্তু ও বরাবরের আন অর্গানাইজড।
অন্যরা যখন মিটিং নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো রবার্ট তখন নিজের হিজিবিজি লেখা গুলো লিখেই যেত।
মনটা যেন সব সময় ভারাক্রান্ত থাকতো।বাড়িতে মা এর শরীর টা দিন দিন খারাপ হচ্ছে…মা কে বাঁচতেই হবে…বাঁচতে হবে রবার্টের জন্য।মা যে ওর সব অভাব,অভিযোগ,আশা ভরসা, ভালোবাসার আশ্রয় স্থল।
(৩)
এর পর এলো সেই দিনটা।সেদিনের সকালেও বাইরে বইছিল হওয়া,নিত্য দিনের মতো গাছে বসা পাখিগুলো ও ডাকছিল নিজেদের মতো।ইংল্যাণ্ডের ব্যাস্ত শহরের সকালটা অন্য আর পাঁচ দিনের মতোই ছিল।কিন্তু সেই সকালে সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে রইলো রবার্টের কাছে। সব কিছু অন্যদিনের মতো থাকলেও মা আর ছিল না….চোখে জল আর বুকে হাহাকার নিয়ে পাগলের মতো রবার্ট মা কে বার বার ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছিল…কিন্তু ততক্ষনে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে….এখনো তো সবকথা শেষ ই হয়নি তার ..এখনো তো মা কে পড়ে শোনানো হয়নি নিজের সব লেখা গল্প গুলো….মায়ের হাত টা জড়িয়ে ধরে পাথরের মতন রবার্ট তাকিয়ে ছিল মাএর দিকে…বার বার ডাকলেও মা আর চোখ খুললো না…
(৪)
মনটা আর টিকছিলোনা এই শহরে। মায়ের মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলোনা রবার্ট।এই শহর টার সাথে যেন মায়ের গন্ধ আষ্টে পৃষ্ঠে লেগে আছে।নিজের অজান্তেই চোখের জল যেন বাঁধ ভাঙা নদীর মতো গাল দুটো বেয়ে নেমে আসছে বার বার।
শেষ মেষ বাইরে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো। একটা স্কুলে ইংলিশ টিচার এর জব অফার টা নিয়ে রবার্ট পাড়ি দিল পর্তুগাল।
পর্তুগালে এলেও মা এর মুখটা সবসময় চোখের সামনে ভাসতো রবার্টের। ঠিক সেই সময়ে ওর মরুভূমির মতো শুকিয়ে যাওয়া প্রেম নদীতে বান নিয়ে এলো এক জার্নালিস্ট।খুব তাড়াতাড়ি দুজন ধরা দিলো দুজনের প্রেমে। দিশাহীন জীবন যেন আবার আশার আলোয় নতুন গতি পেলো।
ধীরে ধীরে সময় এগোল।
রোমান্টিসিজমের রঙ্গিন খোলস টা দিন দিন বিবর্ণ হতে থাকলো।বিয়ের কিছুমাস পর থেকেই রবার্ট বুঝতে পারছিল বিয়ে করাটা তার জীবনের অন্যতম ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।যে মানুষটাকে নিয়ে জীবনটাকে নতুন ছন্দে সাজিয়েছিল,স্বপ্ন দেখেছিল ,সেই মানুষটা এখন তাকে সহ্য অবধি করতে পারেনা।অশান্তি আর গৃহযুদ্ধে জেরবার হয়ে যাচ্ছিল রবার্ট।লেখাটা প্রায় একরকম ভুলেই গেছে।লিখতে বসলে হাত চলতো না…নাহ এভাবে আর চলতে পারেনা…কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে…ওদের জীবনে ভালোবাসার সাক্ষী হিসাবে ততদিনে এসেছে এক ফুটফুটে পরী…আদর করে রবার্ট তার নাম রেখেছিল জেসিকা…কিন্তু ছোট্ট জেসিকার ভুবন ভোলানো হাসি ও মন গলাতে পারেনি ওর মনের মানুষটির। বাচ্চা মেয়েটাও যেন মানুষটার অবহেলার পাত্রী হয়ে উঠছিল…কিকরে কেও নিজের সন্তানকে অবহেলা করতে পারে বোধ ক্ষমতার বাইরে ছিল রবার্টের। শেষ পর্যন্ত বিয়েটা আর টিকলো না…রবার্টের এক সময়ে ভালোবাসার মানুষটি তার নিজের বাচ্চা মেয়েটার দায়িত্ব অবধি নিলো না।
মায়ের মুখটা খুব মনে পড়ছিল রবার্টের…শেষ মেশ ওই দুধের শিশুকে নিয়ে পর্তুগাল ছেড়ে আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে এলো রবার্ট। আর সাথে নিয়ে এলো একটা রোগ …মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর সেই রোগের নাম ডিপ্রেশন…
(৫)
মাথা গোঁজার জায়গা টা ছিল ঠিক ই, কিন্তু সংসার চালানোর মতন সামর্থ্য ছিলোনা রবার্টের।ওই টুকু বাচ্চাটাকে কিভাবে মানুষ করবে ভেবে পাচ্ছিলনা রবার্ট।অনেক চেষ্টা করেও একটা চাকরি অবধি জুটলনা।কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতি এতটাই চরমে উঠলো যে বাধ্য হয়ে দেশের ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি তে নাম লেখাতে বাধ্য হলো।এই সংস্থাটি দেশের পিছিয়ে পড়া গরিব মানুষ গুলোকে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিত।নিজের উত্তরোত্তর এই নিম্নমুখী জীবনরেখা মেনে নিতে পারছিলোনা রবার্ট।চোখ দুটো থেকে ঘুম চলে গেছে অনেক দিন আগেই।জীবন শক্তির জলোচ্ছাস ক্রমাগত বাস্তবের পাথুরে জমিতে আছড়ে পড়তে পড়তে হারিয়ে ফেলেছে নিজের গতি।
বাচ্চাটার দিকে তাকালে নিজেকে অপরাধীর মতো মনে হতো রবার্টের।এভাবে কেটে গেল আরো কয়েকটা দিন। এরপর একদিন রাতের বেলা জেসিককে ঘুম পাড়িয়ে বেশ কয়েকটা ঘুমের বড়ি নিয়ে জানালাটার কাছে গিয়ে দাড়ালো রবার্ট।যখন সমস্ত শহর ঘুমিয়ে পড়েছে তখন নিজেকে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেবার জন্য মুখের কাছে ঘুমের ওষুধ গুলো তুললো। খুব ইচ্ছে করছে নিজেকে শেষ করার আগে ছোট্ট জেসিকা কে আরো একবার দেখতে।
আস্তে আস্তে জেসিকার মাথার কাছে এসে বসলো রবার্ট।
ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটা কত নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে ..ছোট্ট জেসিকার কপালে একটা কিস করে উঠতে যেতেই মনে হলো কে যেন পিছন থেকে জামাটা টেনে ধরে আছে…..ছোট্ট জেসিকার হাতের মুঠোয় তখন বন্দী হয়ে আছে ওর জামাটা….নিজেকে ধরে রাখতে পারলোনা রবার্ট…বুকের ভেতর টা মোচড় দিচ্ছে….বাইরে এখন ঝড় উঠেছে কিন্তু মনের ভিতরের ঝড়টার কাছে সেই বাহ্যিক ঝড় তুচ্ছ…
..নিজের অজান্তেই চোখের কোনটা ভিজে যাচ্ছে।
জেসিকাকে জড়িয়ে ধরল রবার্ট।মাথাটা আর কাজ করছে না….চোখ দুটো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে আসছে।
(৬)
নতুন সকালের রোদ টা জানলা দিয়ে মুখের ওপর পড়তেই চোখটা খুলে গেল রবার্টের।নতুন দিনের ঝলমলে আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা ঘরে।ছোট্ট জেসিকার সবেমাত্র ঘুম ভাঙ্গা মুখটার ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠছে আদুরে অনাবিল হাসি।এক অজানা কারণেই মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে রবার্টের।ঘরের ভেতর ঢোকা মিঠে কড়া রোদটা আলোকিত করে তুলেছে ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র। নিজের বিবর্ণ পুরোনো সত্ত্বার মাঝেও যেন আলোর রঙে গা ভাসিয়েছে পুরোনো টাইপ রাইটার টা। টাইপ রাইটার টার কাছে গিয়ে সস্নেহে তার ওপর হাত বোলালো রবার্ট।তারপর জেসিকাকে খাইয়ে দিয়ে বসে পড়লো ওই পুরোনো টাইপ রাইটার টা নিয়ে।লিখতে লাগলো তার সেই অসমাপ্ত গল্পটা ,যে গল্পটা জীবনের দ্বিতীয় চাকরির সময়ে ম্যানচেস্টার থেকে ফেরার সময় সে ভেবেছিল। ভেবেছিল এই বাস্তব জগৎ থেকে অনেক দূরের এক ফ্যান্টাসি জগতের কথা কল্পনার রঙে রাঙিয়ে। লিখেওছিলো বেশ কিছুটা ,কিন্তু সম্পূর্ণ করা হয়নি।হয়তো এই লেখা কেও পড়বে ও না ..কিন্তু স্বপ্ন রা যে বড় অবাধ্য… তারা সবসময় ভেসে চলে নিজের খেয়াল খুশিতে বাস্তবকে ছুঁতে চাওয়ার আশায়।
এরপরের কিছুদিন নিজের মন প্রাণ সম্পুর্ন ভাবে গল্পটাতে সোঁপে দিলো রবার্ট। গল্প লেখা শেষ হতেই শহরের প্রায় ১৫ টা পাবলিশিং হাউসে সাবমিট করল গল্পটা।কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস….১২ টা পাব্লিসিং হাউস গল্পটা পড়ে মুখের ওপর না করে দিল রবার্ট কে। ” না ” শব্দটা যেন আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে ওর লেখা গল্পটার সাথে।
অবশেষে একদিন সময়ের চাকা ঘুরল। কিছুদিন আগেই শুরু হওয়া ছোট এক পাবলিশিং হাউস হঠাৎ ডেকে পাঠালো রবার্ট কে। মিটিং এ ভদ্রলোক জানালেন তিনি রবার্টের গল্পটা ছাপতে চান যদিও ওনার খুব বেশি আশা নেই এই বই থেকে তবুও একটা চান্স নিয়ে দেখতে চান।খুব কম সংখ্যক বই বার করে দেখবেন প্রথমে ,যদি চলে, তাহলে পরে আরো ছাপাবার কথা ভাববেন।
হাসির রেখা ফুটে উঠলো রবার্টের ঠোঁটের কোনে।
বাড়ি গিয়ে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরলো রবার্ট।
হোক ই বা কয়েকটা কপি …তবু এ যেন নিজের স্বপ্ন কে সার্থক হতে দেখা…আর সেটাই বা কম কি?
৭)
গল্পটা শেষ হওয়ার সাথে সাথে অলিভিয়া ভদ্রমহিলার দিকে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল
“তারপর কি হলো রবার্টের?”
ভদ্রমহিলা জানলার বাইরে তাকাতে তাকাতে বললেন
“তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি রবার্টকে।বাকিটা ঠিক যেন স্বপ্নের মতো…আর জানোতো, স্বপ্নের একটা গুন আছে….স্বপ্নরা কখনও মরতে দেয়না…স্বপ্নরা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখে….তাই স্বপ্ন দেখো…নিজের জন্য বাঁচো …নিজেকে ভালোবেসে বাঁচো”
অলিভিয়ার দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা এবার বললেন
“চাকরি করো?”
অলিভিয়া মাথা নামিয়ে বললো
“চাকরি চলে গেছে”
জানলার দিকে তাকিয়ে ভভ্রমহিলাটি বললেন
“তোমার বাড়ি কোথায় বললে না যে ? …আর ফোন নম্বর টা যদি দিতে নিজের চেনা জানা কিছু বন্ধুকে ফোন করে চেষ্টা করতাম তোমার একটা চাকরির জন্য…”
বাইরের দিকে তাকিয়ে অলিভিয়া নিজের বাড়ির ঠিকানাটা বলে দিলো।
অলিভিয়ার বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই অলিভিয়া গাড়ি থেকে নেমে পড়ল।
ভদ্রমহিলা আবার জিজ্ঞাসা করলেন
“ফোন নম্বর টা?”
অলিভিয়া মাথা নামিয়ে নিজের ফোন নম্বরটা বললো।
ভভ্রমহিলাটি অলিভিয়ার দিকে ওর চশমা টা এগিয়ে দিয়ে বললেন
“একটা কথা মনে রেখো.. এভরি রিজেকশন ইস রিডাইরেকশন ইন লাইফ”
অলিভিয়া চশমাটা চোখে তুলে ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতেই দেখলো উনি গাড়ির কাঁচ তুলে ফেলেছেন ততক্ষনে…অন্ধকার গাড়ির ভেতর মুখটা বোঝা যাচ্ছে না ওনার।
মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা অনেকটা দূরে এগিয়ে গেলো।
(৮)
সকাল আটটা নাগাদ অলিভিয়ার ঘুম ভাঙলো একটা ফোনের আওয়াজে।
ফোন তুলতেই অন্যপ্রান্তে গম্ভীর গলায় এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন
“গুডমর্নিং… আপনার নম্বরটা এক বিশেষ বন্ধুর থেকে পেয়েছি।আজ বেলা এগারোটা নাগাদ আমার অফিসে একবার আসতে পারবেন ইন্টারভিউ এর জন্য?”
“অবশ্যই…থ্যাংক ইউ সো মাচ”
“ওকে , আর আসার সময় পাসপোর্ট সাইজের কিছু ছবি আর এডুকেশনাল সার্টিফিকেট গুলোর কপি নিয়ে আসবেন”
“নিশ্চই”
নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে হাজির হল অলিভিয়া।ইন্টারভিউ নিলেন কোম্পানির মালিক নিজে।এটা ব্রিস্টলের খুব বড় একটা পাবলিশিং হাউস। সেরকম কিছু জিজ্ঞেস ও করলেন না ভদ্রলোক ইন্টারভিউ তে। ওর এডুকেশনাল সার্টিফিকেট গুলো দেখে বললেন
“প্রুফ রিডিং এ দিচ্ছি আপনাকে আপাতত…কিছুদিন করে দেখুন যদি কাজ টা ভালো না লাগে অন্য ডিভিশন এ শিফট করে দেব..তবে ভালো লাগবে আশা করি”
তারপর নিজের সেক্রেটারি কে ডেকে বললেন
“ওনার জয়েনিং ফর্মালিটিস কমপ্লিট করে প্রুফ চেক ডিভিশনের মনিকা কে বলবেন ওনার বসার জায়গা টা দেখিয়ে দিয়ে কাজ টা বুঝিয়ে দিতে”
সবটা কেমন যেন স্বপ্নের মতো লাগছিলো অলিভিয়ার। জীবনে এতো বড় জায়গায় কাজ পাবে ভাবেনি কখনো।কালকের ভভ্রমহিলটির কথা খুব মনে পড়ছিল আর চোখে ভাসছিল রবার্টের গল্পটা।সত্যি হোক বা মিথ্যা রবার্টরা সত্যি বাঁচাতে শেখায়,স্বপ্ন দেখতে শেখায়।কাল ভালো করে মুখতুলে দেখা হলো না ওই ভদ্রমহিলাকে … একটা ধন্যবাদ ও বলা হল না যে…
(৯)
জয়েনিং ফর্মালিটিস শেষ হতেই মনিকা এসে নিয়ে গেল অলিভিয়াকে। ওকে ওর বসার জায়গা টা দেখিয়ে দিয়ে ,ওর পাশে বসে কাজ টা বুঝিয়ে দিয়ে বললো
” আজ একটা ছোট্ট কাজ দিচ্ছি …যদিও প্রুফ রিডিং করা আছে আর যে গুলো চেঞ্জ করা হয়েছে হাইলাইট করা আছে। চোখ বোলাও বুঝতে পারবে।”
মনোযোগ দিয়ে লাইন গুলো চেক করতে লাগলো অলিভিয়া।
খুব ইন্টারেষ্টিং একটা থ্রিলার গল্প মনে হচ্ছে…ভীষণ ভালো লাগছিলো পড়তে আর সাথে সাথে হাইলাইট করা জায়গা গুলো তেও নজর বোলাচ্ছিল অলিভিয়া।
প্রায় আধ ঘন্টা পড়ে নিজের কৌতূহল আর চেপে রাখতে পারলো না অলিভিয়া
“মনিকা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
“হুম নিশ্চই..বলো”
“আচ্ছা এই গল্পটা কার লেখা? ভীষণ ভালো লাগছিলো পড়তে..”
মনিকা হেসে বললো
“আমাদের কাজ কিন্তু গল্প পড়া নয়…আমাদের কাজ লেখার ভুল ভ্রান্তি গুলো ধরার…”
অলিভিয়া মুখ নামিয়ে নিলো..
মনিকা হেসে বলল
“আসলে এই গল্পের রাইটারের সব গল্পই দুর্দান্ত…বিশ্বের অন্যতম বেস্ট সেলার অথর ই শুধু নন বিশ্বের সবথেকে ধনী রাইটার,বিশ্বের প্রথম বিলিয়নেয়ার রাইটার….যদিও কিছুদিন আগে ওনার সেই বিলিয়নিয়ার তকমাটা চলে গেছে”
অলিভিয়া বললো
“কেন এখন আর বিক্রি হয়না বুঝি?”
মনিকা হো হো করে হেসে বললো
“কি যে বলো ! না সেটা না…ওনার বই সর্ব কালের সর্ব সেরা বেস্ট সেলার…ওনার লেখা বই নিয়ে তৈরী হয়েছে হলিউড মুভি ও…সেগুলো ও সমান ভাবে জনপ্রিয়..আসলে উনি নিজের সম্পত্তির এক বিশাল অংশ দান করেছেন চ্যারিটিতে …তাই এখন আর সেই বিলিয়নের তকমাটা নেই…এখন তো উনি নিজেই মুভি প্রোডুসার…এই তো কাল ই নাকি ব্রিস্টলে এসেছিলেন কিসব কাজে…উনি শুধু একজন অথর ই নন…প্রকৃত অর্থে একজন ভালো মানুষ…যিনি সবসময় দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে…যার জীবনটা সবার কাছে এক অনুপ্রেরণা।”
অলিভিয়া কৌতহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো
“কি নাম ওনার?”
মনিকা হেসে বললো
“ওনার নাম রবার্ট…রবার্ট গালব্রেইথ”
অলিভিয়া অজান্তেই বিড় বিড় করে বলে উঠলো
“আমি…আমি তো ভাবছিলাম রবার্ট এর গল্পটা শুধু একটা গল্পই…”
তারপর মনিকার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো
“এত বড় লেখক অথচ ভদ্রলোকের নাম এর আগে কখনোই শুনিনি কি ভাবে???”
মনিকা হাসতে হাসতে বললো
“ভদ্রলোক নন ….ভদ্রমহিলা ….রবার্ট হল ওনার নতুন ছদ্মনাম যে নামে উনি থ্রিলার গল্প লিখবেন..আর সেই লেখাটার ই প্রুফ রিডিং চলছে এখন…তবে এখন কিন্তু কোথাও মুখ খুলবে না…এখনো মিডিয়া জানে না….”
একরাশ কৌতূহল নিয়ে অলিভিয়া বললো
“ওনার আসল নাম টা কি?”
মনিকা নিজের কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো
“হ্যারি পটারের নাম শুনেছো? “
চমকে উঠল অলিভিয়া
“জে কে রোলিং????”
মনিকা উত্তর না দিয়ে শুধু একটু মুচকি হাসলো।
কালকের ওই ভদ্রমহিলার আবছা ছবিটা চোখের সামনে যেন ভেসে উঠছে অলিভিয়ার….নিজের অজান্তেই ভালোলাগার এক আনন্দাশ্রু চোখের কোনে ভিড় করেছে….
(১০)
ফিস থেকে বাড়ি ফিরে ভালো করে স্নান করলো অলিভিয়া। তারপর নিজের খুব পছন্দের কালো রঙের পোশাকটা পড়ে চোখে লাগলো আই লাইনার আর ঠোঁটে ওর খুব পছন্দের লিপস্টিক টা।
আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে একটা ফ্লাইং কিস করলো।
তারপর নিজের পুরোনো গিটারটা বের করে
এভিস লারকে র গাওয়া গানটা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠলো
“Rise up
Don’t fall down again…
Rise up
Long time I broke the chain
I try to fly…so high
Direction sky….
Rise up……”
এভাবেই বেঁচে থাকুক ফ্যান্টাসি রা….বেঁচে থাক স্বপ্ন …জীবনের স্বপ্ন,হার না মানার স্বপ্ন,আমার আমিকে আরো ভালোবাসার স্বপ্ন…অনুপ্রেরণা আর প্রকৃত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন…বেঁচে থাক হ্যারি পটার রা…বেঁচে থাক রোলিং আর তাঁর কলম….