প্রতিমা রায় একজন মধ্যবিত্ত গৃহিণী | অন্য সংসারের গৃহিণীর মতই সকলের ফাইফরমাশ খাটতে হয় বিয়ের পর থেকে | হাসিমুখে সকলের মন জয় করে চলে প্রতিমা | সবার চিন্তা করতে করতে কখন যেন নিজের কথা ভাবতেও ভুলে গেছে | শ্বশুরের প্রেশারের ঔষধ মনে করে দেওয়া,শাশুড়ির সুগারের ঔষধ সময়মত দেওয়া,ছেলের স্কুলের টিফিন,বরের টাই,মোজা এগিয়ে দেওয়া,দেবরকে ঘুম থেকে তুলে কলেজের জন্যে তৈরি হতে বলে জলখাবার দেওয়া সবেতেই প্রতিমা সমান দক্ষ | সবার খেয়াল প্রতিমা রাখলেও প্রতিমার খেয়াল রাখার কেউ নেই | কপালে হাত দিয়ে কেউ দেখেনা প্রতিমার জ্বর এলো কিনা,রাতে কেউ জিজ্ঞেস করেনা প্রতিমা খেয়েছে কিনা,সকালে উঠে কেউ বলেনা আজ ওর ছুটি,দুপুরে কেউ ওকে বলেনা তানপুরা নিয়ে বসতে | সকলে নিজেদের লক্ষ্যে ছুটতে ছুটতে প্রতিমার নিজের লক্ষ্যের মর্যাদা দিতেও যেন ভুলে গেছে |
প্রতিমা খুব সুন্দর গান করে তবে তানপুরা নিয়ে বসলেই প্রতিমার ছেলে দীপ্ত বলে “ওই শুরু হল মায়ের প্যানপ্যানানি”…..ওর বর সৌম্যও তাল মেলাতে থাকে ছেলের সাথে “ভর সন্ধ্যে বেলা তোমার কি লোক না হাসালেই নয়?”…..খুব খারাপ লাগে প্রতিমার….একটাই তো নেশা ছোটবেলা থেকে | প্রথাগত তালিম না নিয়েও প্রতিমার গানের গলা খুব মিষ্টি | ছোটবেলায় বাবার সাথে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে শিউলি ফুল তুলতে তুলতে গান গাইতো প্রতিমা | বাবা মুগ্ধ হয়ে শুনতেন | বিয়ের পর ও প্রথম বুঝতে পারে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে আজও শিল্পের কোনও কদর নেই | শুধু পুঁথিগত বিদ্যার অহঙ্কারের কদর সর্বত্র | গান,নাচ,লেখালেখির প্রতি ঝোঁক থাকলে তুমি হবে হাসির পাত্র | এই শখগুলো অনেকের হাসির কারণ বলেই হয়তো অনেকে নিজের বায়োডাটাতে এগুলো সরিয়ে নেট সার্ফিং লিখে নিষ্কৃতি চাই | আধুনিকতার তৃষ্ণাতে পিপাসু সকলে গানবাজনা,নাচ,লেখালেখিকে বিতৃষ্ণার চোখে দেখে | ঠোঁট উল্টে শাশুড়ি বলেছিলেন একবার “যাই করো বৌমা,মেয়েদের জায়গা কিন্তু সেই হেঁসেলেই”….নিজের ঘরে এসে সেদিন খুব কেঁদেছিল প্রতিমা |
অনেক প্রতিভা প্রতিদিন হারিয়ে যায় অনুপ্রেরণার অভাবে | প্রতিমা যে রক্তমাংসের মানুষ এটাই বাড়ির মানুষগুলো ভুলে গেছে | যেন ওর কোনও অনুভূতি থাকতে নেই | কখন যে সেই ছোট্ট বাপসোহাগী মেয়েটা রায় পরিবারে এসে মাটির প্রতিমা হয়ে গেছে তা কেউ জানে না | মাতৃত্বের স্বাদ আস্বাদনের পরেই নাকি একজন নারী মেয়ে থেকে মা হয়ে উঠে পরিপূর্ণতা পায় | তবে প্রতিমা যেন বয়সের আগেই পরিপূর্ণতা পেয়েছে | সকাল থেকে উঠে “বৌমা,তোমার শ্বশুরের জলখাবার হলো?”…..”বৌমা,দীপ্তের টিফিন তৈরি হলো?”…..”কই গো আমার মোজা পাচ্ছিনা কেন?”…..”বৌদি,কলেজের দেরি হচ্ছে,খেতে দাও তাড়াতাড়ি”…..এইসব শুনতে শুনতে প্রতিমার দশ বছরের বৈবাহিক জীবন কেটে গেছে | সংসারের সকলের কথা ভেবে মুখ না খুলে মূক হয়ে সবকিছু সহ্য করেছে প্রতিমা | একটা ক্ষীণ আশা মনের মাঝে ছিল ছেলে বড় হয়ে অন্তত মায়ের স্বপ্নপূরণ করবে |
*********************************************
দীপ্ত বড় হয়েছে এখন | ক্লাস টেনে পড়ে এখন | স্কুলে সব অভিভাবকদের ডাকা হয়েছে | সবার সন্তানের ব্যাপারে আলোচনা করবেন হেড স্যার | কোনও বিষয়ে কেউ পিছিয়ে থাকলে সুপরামর্শ দেবেন | সৌম্যের কাজের খুব চাপ | তাই অগত্যা প্রতিমাকে যেতে হয়েছে | খুব সঙ্কোচ করছিল প্রতিমা | ও কি ভালো করে কথা বলতে পারবে? দীপ্ত খুব একটা খুশি হয়নি মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে | হেড স্যার প্রতিমাকে দেখে হাত জোর করে নমষ্কার করে বললেন “মিসেস রয়,আই উড ডেফিনিটলি সে দীপ্ত ইস আ ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট,হি সুড ফোকাসড মোর অন সাইন্স গ্রুপ”….প্রতিমা আমতা আমতা করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো | বাইরে এসে দীপ্ত খুব রেগে গেল “আমার একটা প্রেস্টিজ আছে মা,তুমি তখন কিছু বললে না কেন শুনি? তোমাকে স্কুলে আনা ভুল হয়েছে আমার | সৈকতের মাকে দেখলে কি সুন্দর করে কথা বলছিল? ইউ আর জাস্ট টু ব্যাকডেটেড মা”….প্রতিমার খুব খারাপ লাগলো….শেষে ওর জন্যে দীপ্তকে ছোট হতে হলো সকলের সামনে | সন্তানের থেকে পাওয়া যন্ত্রণা ভীষণ কষ্টদায়ক | স্লো পয়জনের মত মনের গভীরে ক্ষত সৃষ্টি করে | সেদিন ভালো করে প্রতিমার সাথে কথা বলেনি দীপ্ত | রাতে খেতে বসে কষ্টগুলো যেন দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে বিঁধেছিল |
সৌম্যের সাথে মনোমালিন্য হয়েছে প্রতিমার | মনটা ভালো নেই আজ | সকালে গ্যাসে দুধ গরম বসিয়ে খেয়াল ছিল না প্রতিমার | অনেকটা দুধ উপচে পড়ে গেছে | “মনটা আজকাল কোথায় থাকে বৌমা?” – অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্যেও শাশুড়ির গালমন্দ শুনতে হয়েছে | এখন দুপুরে কয়েকদিন ধরে কাজ শেষ করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে প্রতিমা | তানপুরাটা যেন ইশারায় ডাকে প্রতিমাকে,চুপি চুপি বলে “মন এত অশান্ত হলে চলবে কেন?সুরের সাধনা যারা করে তাদের এত চঞ্চল হলে চলে?তুই যে মায়ের জাত,সহ্য শক্তির দৃষ্টান্ত তুই,মন শান্ত করে নিজের কথা শোন” |
আজকাল ব্যস্ততার কারণে সৌম্যের আর দীপ্তের সময় নেই মোটেও | দীপ্ত টিউশনের পরে বাড়ি এসে নিজেও পড়তে বসে | সামনে যে আইসিএসসি,জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা | পরীক্ষার আগে এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ | মানসিক চাপ কাটিয়ে ভালো পরীক্ষা দেওয়ার জন্যেই এই উদ্যোগ | অনেক নামী শিল্পী আসবেন | দীপ্ত যাবে আজ স্কুলে | তবে আগেই বাবাকে বলে রেখেছে “তুমি আর আমি যাবো বাবা,মাকে নিতে পারবো না” | স্বামী স্ত্রী একে অপরের পরিপূরক তবে সন্তান জন্মানোর পরে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটা যেন তিক্ত হয়ে যায় | আজ দীপ্ত বড় আপন সৌম্যের কাছে | তাই তো এত বছরের জীবনসঙ্গীকেও আজ বড় বেমানান লাগে নিজের জীবনে |
যথাসময়ে দীপ্ত এবং সৌম্য গিয়ে উপস্থিত হয় স্কুলে | প্রথমে অরুন্ধতী হোম চৌধুরীর গান দিয়ে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সূচনা হলো | সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গান শুনছে | হঠাৎ একটা নাম শুনে চমকে গেল দীপ্ত এবং সৌম্য – এবার আপনাদের সামনে সঙ্গীত পরিবেশন করতে আসছেন ‘গুরুদক্ষিণা’ এর পক্ষ থেকে সঙ্গীতশিল্পী প্রতিমা রায় |
“শুনে সাঁজবেলার সে গান
মন বায় একা উজান
শুনে সাঁজবেলার সে গান
মন বায় একা উজান
সরে সরে যায় তটভূমি
সরে সরে যায় তটভূমি
হবে স্বপ্নেরই উপাদান” – তানপুরার যোগ্য সঙ্গতে এত সুন্দর গায়কীতে তখন চারিদিকে নিস্তব্ধতা | ভ্রম ভাঙলো প্রতিমার কথায় “নমস্কার,আমি প্রতিমা রায় | অতি সাধারণ একজন গৃহবধূ | পুঁথিগত বিদ্যা অর্জন করতে গিয়ে আমরা বাকি শিল্পগুলোর কদর করতেই ভুলে গেছি | অথচ দেখুন পরীক্ষার আগে মানসিক চাপ কমাতে আমরা গান শুনি | এক্ষেত্রে গান শোনাটা দোষের নয়,তবে কেউ গাইতে চাইলে সেটা কিন্তু দোষের | আমাদের প্রতিভাগুলো শুধু পুঁথিগত বিদ্যার কিছু সংখ্যার ওপর নির্ভরশীল | কেউ কাউকে ছাপিয়ে কিছু বেশি সংখ্যা তুলতে পারলে আমরা মাথায় করে রাখি | আর সমাজ যতই আধুনিকমনষ্ক হোক,নারীদের প্রতি এখনও পুরোনো মনোভাব রেখে চলেন অনেকে | আসলে আমরা পুজোর জন্যে মাটির প্রতিমা খুঁজি যার কোনও অনুভূতি নেই | কত প্রতিমার স্বপ্ন এভাবেই চাপা পড়ে যায় তার হিসেব আমরা রাখি না | এবার সবাই এগিয়ে এসে নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গিটা একটু বদলে দেখুন – আসুন মাটির প্রতিমাদের অনুভূতিগুলো খুঁজে দেখি | হারিয়ে যাওয়া প্রতিভাগুলোর উন্মোচন হোক | আপনাদের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এসে বাংলাতে কথা বললাম | তার জন্যে আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী | আসলে আমি ইংলিশটা ভালো পারি না | অনেক কথা বলে ফেললাম | আর একটা কথা, ইংলিশ সুড বি জাস্ট অ্যা মোড অফ কমিউনিকেশন নট অ্যা স্ট্যাটাস সিম্বল | বি প্রাউড টু স্পিক ইন ইওর মাদার টাং | উইশ ইউ অল দা বেস্ট ফর ইওর এক্সাম”
দীপ্ত আর সৌম্য তখনও একে অপরের মুখের দিকে চেয়ে আছে | সত্যিই মাটির প্রতিমাদেরও প্রাণ আছে | শুধু ওদের অনুভূতি বোঝার জন্যে মৃতপ্রায় বিবেকের জাগ্রত হওয়াটা বড্ড জরুরি | আচার্য জগদীশচন্দ্র বোস যদি গাছেদের প্রাণ আছে এটা উপলব্ধি করতে পারেন,তবে আমাদের চারপাশের মাটির প্রতিমাদের অস্তিত্ব কেন বুঝতে পারবো না আমরা?