“অনিবার্য কারণবশত রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান স্থগিত রাখা হচ্ছে এবছরের জন্য—প্রভাতী”|ফেসবুকে প্রজ্ঞার স্টেটাস আপডেটটা দেখে একটু অবাকই হলো সৌনক| এমনিতে কলকাতা ছাড়ার পর থেকে প্রজ্ঞার সঙ্গে সেরকম যোগাযোগ হয়নি সৌনকের| এই মাসখানেক আগে ঋদ্ধির মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড হিসেবে সাজেশন আসায় অ্যাড করেছে প্রজ্ঞাকে|প্রভাতীর সঙ্গে কত যে ভালোলাগা জড়িয়ে আছে|স্যর কাকিমা প্রজ্ঞা স্বরলিপি রাই ঋদ্ধি আর সর্বোপরি সমস্ত মানুষগুলোকে যিনি ভালোবাসার সুতোয় বেঁধে রেখেছেন সেই প্রানের ঠাকুর বিশ্বকবি| যদিও ঋদ্ধি রাই লিপিদের মতে ওসব বাজে কথা, সৌনকের প্রানভোমরা প্রজ্ঞার কাছেই বাঁধা|হ্যাঁ সেটা তো অস্বীকারও করেনা সৌনক|প্রজ্ঞার পর আর অমন তুলির টানে আঁকা চোখ,কোমরছাড়ানো এলোমেলো কোঁকড়া চুলের বিনুনী আর চোখের কোনে একটু ধেবড়ে যাওয়া কাজল তো সত্যিই খুঁজে পেলোনা সৌনক| ওকে দেখেই বোধহয় কবি লিখেছিলেন,
“একদা এলোচুলে কোন্ ভুলে ভুলিয়া
আসিল সে আমার ভাঙা দ্বার খুলিয়া|
জ্যোৎস্না অনিমিখ, চারিদিক সুবিজন—–
চাহিল একবার আঁখিতার তুলিয়া|
দখিন-বায়ু ভরছ থরথরে কাঁপে বন,
উঠিল প্রাণ মম তারি সম দুলিয়া||”
সৌনকের সঙ্গে প্রভাতীর সম্পর্কটা তো আর আজকের নয়|তবে সম্পর্কটার শুরু কবে তা ঠিকমত মনে পড়েনা সৌনকের|ছোটবেলা থেকেই সৌনকদের বাড়িতে গান বাজনার চর্চা ছিলো|আরো সমৃদ্ধ হতে সদ্যকৈশোরে পা দেওয়া সৌনককে পূর্নেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘প্রভাতী’তে রবীন্দ্রসঙ্গীত ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছিলো বাবা| কিন্তু পরিধিটা শুধু গানের মধ্যেই আটকে ছিলোনা| আজও স্পষ্ট মনে পড়ে স্যার থাকাকালীন একেকটা রবিবারের সকাল কেটে যেতো ওদের ওই হলঘরটায় বসেই| কাকীমা কোন কোন দিন আবদার করে লুচি ভেজে দিতো ওদের| কি অগাধ জ্ঞান ছিলো স্যরের|সাদা ধবধবে ধুতি আর সাদা পাঞ্জাবী পড়া মানুষটি ছিলো অতল গভীর সাগরের মতো|স্যারের কাছে শুনতে শুনতে কখন যে কবিগুরুকেই একমাত্র ভগবানের আসনে বসিয়ে ফেলেছিলো সৌনক|মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্যরের ছাত্রজীবনের কথা শুনতে শুনতে সৌনকের ঘোর লেগে যেতো|চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতো খোয়াই নদী ছাতিমতলা শান্তিনিকেতনের রাস্তাঘাট অলিগলি সবটা| একটু বড় হওয়ার পর স্যারের সঙ্গে বেশ কয়েকবার ওরা গিয়েওছিলো শান্তিনিকেতন| সবকিছুর মধ্যে স্যারের মেয়ে প্রজ্ঞার প্রতি অনুভূতিগুলোও বাসা বাঁধছিলো সদ্য যৌবনের কোঠায় পা দেওয়া মনটার প্রতিটা হৃদস্পন্দনে| প্রজ্ঞা জানতো হয়তো বা জানতো না|তবু প্রিয় মানুষটার মুখে ‘না’ শোনার সাহস ছিলোনা তাই বলাও হয়ে উঠলোনা| তারপরের গল্পটা খুব চেনা ঐ যা হয় একসময়ে নিজেদের উচ্চশিক্ষা জীবিকার সন্ধানে বেড়িয়ে পড়তে হয় চেনা গন্ডীটা ছেড়ে|সম্পর্কের সুতোগুলোও একটু একটু করে ক্ষীণ হয়ে আসে| ব্যস্ততা দায়িত্বের আড়ালে হারিয়ে যায় দায়বিহীন ভালোলাগার চেনা ছকগুলো|এই বছরখানেক আগে ঋদ্ধির কাছে শুনেছিলো কোন এক ধনী ব্যবসায়ীর সঙ্গে প্রজ্ঞার বিবাহের কথা| মন খারাপ হয় ঠিকই তবে এই তিরিশের শেষ কোটায় পৌঁছে আর আফশোস হয়না সৌনকের| প্রজ্ঞা তো আছে সবসময়ে তার সঙ্গে|প্রানের ঠাকুর ই ওদের মধ্যে একমাত্র যোগসূত্র| যে প্রজ্ঞার প্রথম প্রেমিক,মনের মাধুরী সবটুকু ভালোলাগা| আর সৌনকের অভিভাবক, পথ প্রদর্শক জীবনদর্শনের দিশারী| এসব ভাবতেই ভাবতেই ঋদ্ধিকে ফোন করলো সৌনক|
_________________
শূন্য হলঘরটায় বসে মনটা যেন বিমর্ষ হয়ে উঠলো পূরবীদেবীর|কতো শখ করে বাড়ির এই অংশটা বানিয়েছিলেন পূর্নেন্দু| লম্বা হলঘর|তিনদিকের দেওয়াল জুড়ে শুধুই বই|ঘরের ঠিক উত্তর পূর্ব কোনে জ্বলজ্বল করছে রবিঠাকুরের বিশাল বড় পোট্রেট| দুধসাদা মার্বেলের মেঝেটায় এখনো যেন লাইন করে বসে আছে ছাত্র ছাত্রীরা| ভাগ্যিস পূর্নেন্দু বেঁচে নেই| তাঁর সাধের প্রভাতীতে রবীন্দ্রজয়ন্তীর সন্ধ্যেবেলায় আলো জ্বলবেনা শুধু উদ্যোগের অভাবে তা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারতেননা| তখন অবশ্য শুধু পূর্নেন্দু কেন ওর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একটা আলাদা উন্মাদনা ছিলো|ওরা শুধু সঙ্গীত শিখতোনা, আত্মস্থ করতো| পূর্নেন্দু চলে যাওয়ার বছর চারেক পর থেকে প্রভাত ফেরীটা বন্ধ হয়ে গেছিলো| তাও প্রজ্ঞা সন্ধ্যেবেলার অনুষ্ঠানটা ধরে রেখেছিলো কিন্তু এবার তাও আর হয়ে উঠলোনা|ওর চাকরিতেও প্রতিনিয়ত ব্যস্ততা বাড়ছে|সব দিকটা সামলে আর হয়ে উঠছেনা| প্রজ্ঞার ছাত্র ছাত্রীরাও এখন থেকেই অনেক হিসেবী|ওরা প্রভাতীর ক্ষুদ্র পরিসরে আটকে না থেকে যে যার মতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহনে ব্যস্ত| এবার মন মেজাজও ভালো নেই মেয়েটার| ভালো থাকবেই বা কি নিয়ে|দশবছর ধরে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে দেবতুল্য বাবাকে অমান্য করে বিয়ে করার পর যদি পাশের মানুষটার লোলুপ ঘৃন্যরূপটা হঠাৎ সামনে এসে পড়ে তখন বেঁচে থাকাটাই যে বড় দায় হয়ে যায়|কবে যে মেয়েটাকে শেষবারের মতো হাসতে দেখেছিলেন মনে নেই পূরবীদেবীর|বাইরে মেলামেশাও সম্পূর্ণ বন্ধ|সপ্তাহে কোনরকমে একদিন গানের ক্লাসটা করায়|আজকাল মেয়েটার জন্য বড় চিন্তা হয় পূরবীদেবীর|তিনি নিজে নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হলেও মা তো| তিনি আর কদিনই বা তারপর!!ওর সঙ্গে পথ চলার জন্যও তো কাউকে প্রয়োজন| কলিংবেলের আওয়াজে সম্বিৎ ফিরলো তাঁর|এই অসময়ে আবার কে এলো..এমন ভর সন্ধ্যেবেলা|
__________________
এখনো নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছেননা পূরবীদেবী|পূর্নেন্দু চলে যাওয়ার পর কেটে গেছে দশ বছর|এতদিন পর আবার রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রভাতফেরী বেরোচ্ছে প্রভাতী থেকে| সেদিন সৌনক ঋদ্ধি রাই আর স্বরলিপি যেভাবে ভর সন্ধ্যেবেলা এসে চমকে দিয়ে বলেছিলো “কি গো কাকিমা !!একবার আমাদের জানালেনা|আমাদের প্রভাতীতে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবেনা তা হয়|” ওরাই স্যারের ডায়েরি খুঁজে পুরোন ছাত্র ছাত্রীদের ফোন করে ডাকা থেকে কানু ময়রার রসগোল্লা এমনকি ক্যাটারার দিয়ে খাওয়াদাওয়া সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে|ঠিক যমন পুর্নেন্দু করতেন|সকাল থেকেই রজনীগন্ধা ধূপের গন্ধের সঙ্গে অপটু ভাবে পড়া শাড়ির খসখস আওয়াজ সবকিছু যেন পুরোন স্মৃতিগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে||প্রজ্ঞাও আজ অনেকদিন পর বেশ হাসিখুশি|ওর যে কজন ছাত্রী আজ উপস্থিত তাদের শেষ মুহুর্তের তালিম দিতে ব্যস্ত|প্রভাত ফেরীতে লিপির হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে পূর্নেন্দুর বলা কথাটা বড্ড মনে পড়ছে “জানো পূরবী এক জায়গায় বসে থেকে নয় ঠাকুরকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে|রবীন্দ্রনাথের গানে বড্ড জোর|২৫শে বৈশাখের প্রভাতে ঘরবন্দী বাঙালিকে টেনে বের করতেই হবে”|সত্যিই আজ সার্থক পূর্নেন্দুর স্বপ্ন, পুরোন ছাত্র ছাত্রী তাদের পরিবার থেকে শুরু করে পাড়া প্রতিবেশী এমনকি পাশেরবাড়ির ঐ নাক উঁচু প্রোমোটারের বৌ সবাই হাতে হাত রেখেছে প্রানের ঠাকুরের গানে তাল মেলাতে মেলাতে|
______________________
কাকিমার মুখে প্রজ্ঞার ফেলে আসা জীবনের কথা শুনে
বড্ড অসহায় লাগছিলো সৌনকের|এতো কষ্ট পেয়েছে প্রজ্ঞার মতো একটা ভালো মানুষ|
সন্ধ্যেবেলার অনুষ্ঠানে প্রজ্ঞাকে দেখে আর চোখ ফেরাতে পারছিলোনা সৌনক|লাল পেড়ে সাদা কাঞ্জীভরম খোঁপায় জুঁইফুল সব মিলিয়ে যেন বড্ড ভালো লাগছে প্রজ্ঞাকে| কাকিমার আজ দুপুরে বলা কথাটা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিলো|হাতদুটো ধরে কাকীমা বলেছিলো “তোকে যে কিকরে ধন্যবাদ দিই বাবা|তুই আজ নতুন করে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে ফিরিয়ে আনলি|প্রভাতীকে বাঁধলি নতুন সুতোয়|আর আমার মেয়েটার মুখের হাসিটা ফিরিয়ে দিলি| “
সঞ্চালকের মুখে সঙ্গীত পরিবেশনায় নিজেদের নাম শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো প্রজ্ঞা আর সৌনক|অথচ একটা সময় ছিলো স্যারের যাবতীয় অনুষ্ঠানে ওদের দ্বৈতসঙ্গীত অপরিহার্য|পাড়ার যে কোন অনুষ্ঠান অপূর্ণ থেকে যেতো ওদের গান ছাড়া| যে গানটা বরাবর গাইতো ওরা নিজেকে সামলে সেইগানটাই ধরলো সৌনক|
“আমি তোমারও সঙ্গে বেঁধেছি আমারও প্রান|”
দর্শকাসনে তখন বাকি তিনবন্ধুর মুখে বিজয়ীর হাসি|
______________
অনেকদিন পর আজ বড্ড ভালো লাগছিলো সৌনকের|স্বরলিপির গানটা শুরু হওয়ার পর ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো সৌনক|এই জায়গাটা স্যারের বড় প্রিয় ছিলো|সময়ে অসময়ে বেশীরভাগ সময়ে এখানেই কাটাতেন স্যার| হঠাৎ চুরির রিনরিনে আওয়াজে পিছনে ঘুরে দেখলো প্রজ্ঞা দাঁড়িয়ে| মিষ্টি করে হেসে শুরু করলো প্রজ্ঞাই|
—“তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবোনা সৌনক|তবু যা করলে আজ|আমি জানি রাই বলেছে পুরো উদ্যোগটাই তোমার|”
—-“প্রভাতী শুধু তোমাদের নয় প্রজ্ঞা| প্রভাতী আমারও বড় ভালোবাসার জায়গা|যে ঠাকুর আমাদের বাঁচতে শেখালো স্বপ্ন দেখতে শেখালো উদ্যোগের অভাবে সেই ঠাকুর আজকের দিনে প্রভাতীতে একলাঘরে কেন থাকবেন |”
—-সৌনক…খুব ভালো থেকো তুমি|
চোখের জলটা মুছে চলে যাচ্ছিলো প্রজ্ঞা|
তবু হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো |তারপর খুব মন দিয়ে সৌনকের চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করলো|এ ভাষা যে তার বড্ড চেনা|খুব ধীরে ধীরে বললো–“বাবার ঋন শোধ করছো!!”
—ছিঃ!!প্রজ্ঞা…তোমার মুখে এতো ছোট কথা মানায়না”|
—-তুমি তো সবই জানো সৌনক|আমি শেষ…ভেঙে গেছি…বিশ্বাস ভালোবাসা এসব যে ধরা দেয়না ভাঙা মনে!!!
—-রবিঠাকুরের মানসীরা কোনদিন নিঃশেষ হয়না প্রজ্ঞা|তারা যুগে যুগে কালে কালে ফিরে আসে নতুন ভোরের স্বপ্ন নিয়ে…তারা যে এই শুকিয়ে যাওয়া সমাজের সঞ্জীবনী সুধা|
—-পারবোনা সৌনক…হয়না…গভীর ক্ষত নিয়ে|
—-মনের ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকে সংকীর্ন মন| কালো মেঘ সরিয়ে সূর্য উঠলে তার ছটায় পৃথিবীর সব কোনের অন্ধকার ঘুঁচে যায় প্রজ্ঞা|সেই মেঘ সরে যাওয়ার অপেক্ষা আমি করবো প্রজ্ঞা,কথা দিলাম|জানি একদিন সূর্য উঠবেই| সময় দিলাম তোমায়|”
কথাটা বলে হলঘরে ঢুকে যায় সৌনক|দুচোখ ভরা জল নিয়ে প্রজ্ঞা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে| ভিতরের হলঘর থেকে ভেসে আসা স্বরলিপির গলায় গাওয়া গানটা যেন খুব বেশী স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রজ্ঞার মননে–
“বিশ্বধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা–
জীবন যেন দিই আহুতি মুক্তি-আশে।”
কে জানে হয়তো প্রজ্ঞাও খুঁজছে কোন এক মুক্তির আস্বাদ| মনটা প্রশ্ন করে সত্যিকারের ভালোবাসা কি বন্ধন না মুক্তি নাকি বন্ধনের মাঝে মুক্তিকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া|