“ওই দেখ রিয়া,ক্যাবলামার্কা ছেলেটা আগের সপ্তাহে তোকে দেখতে গিয়েছিল মনে আছে? আজ বাইকের ব্যাক সিটে ললনা নিয়ে ঘুরছে | সব ছেলেগুলো এক,পাত্রী দেখতে গেলে যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না” – তনিমা কথাগুলো এক নি:শ্বাসে বলে গেল |
“আজ মালটাকে কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে,কি বলিস? আগেরদিন ওই ১৯৭০ এর হিরো মার্কা ঢোলা শার্ট আর ফর্মাল প্যান্ট পড়ে চলে এসেছিল | মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল | আমার জন্যে গোটা সেন্ট জেভিয়ার্স পাগল ছিল তুই তো জানিস আর সেই রিয়াকে দেখতে একটা ক্যাবলাকান্ত এসে হাজির | জাস্ট ইমাজিন তনিমা’ – রিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে প্রদীপ্তের দিকে |
ইশশশ! একটু সেজেগুজে এলেই তো সেদিন ল্যাটা চুকে যেত | একবার গিয়ে কি কথা বলবো | না থাক,সেন্ট জেভিয়ার্সের হার্টথ্রোব আজ পর্যন্ত যেচে কারোর সাথে কথা বলেনি | স্কুল কলেজে বরাবর বিউটি কুইনের শিরোপা জিতেছে রিয়া | ডানা কাটা সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা হল রিয়া |
—————————————————————
“বোন,একটা কথা বলবো,সেদিন প্রদীপ্তকে ওইভাবে ফিরিয়ে না দিলেই ভালো করতিস | ছেলেটা ভালো ছিল | এখনকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায় না রে” – রিয়ার দিদি প্রিয়া নিজের বোনকে বোঝানোর জন্যে ব্যর্থ প্রয়াস জারি রেখেছে |
“রোজ তোর ওই এক ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না দিদি | নিজে তো জীবনে সাজলি না কখনও | সারাজীবন খালি মোটা ফ্রেমের চশমা পড়ে স্কুল কলেজের মোটা মোটা বইগুলো গিলে গেলি | তোর চোখে ওই অমলকান্তি আদর্শ প্রেমিক হতে পারে,আমার চোখে নয় বস | আমার তো টল,ডার্ক,ড্যাশিং হ্যান্ডসাম ছেলে চাই | সো নিজের চয়েজ নিজের কাছে রাখ | বাই দা ওয়ে তুই চাইলে বাবাকে বলে প্রদীপ্তকে তোর জন্যে রাজি করাতে পারি | এমনিও তো ২৮ বছর হয়ে গেল তোর কিন্তু আজও একটা ছেলে পটাতে পারলিনা” – কর্কশ কথাগুলো বলে ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল রিয়া |
সত্যি কথা বলতে প্রিয়ার সেদিন দরজার আড়াল থেকে প্রদীপ্তকে বেশ লেগেছিল | ছেলেটার সারল্য মাখা চোখ এখনও ভুলতে পারেনি প্রিয়া | এই প্রথম কাউকে দেখে প্রিয়ার মনে বসন্তের সমাগম হয়েছিল |
প্রিয়ার বাবা মেয়ের জেদের কাছে নত হয়ে শেষে ছোট মেয়ের জন্যে পাত্র খোঁজা শুরু করেছিলেন | প্রিয়ার একটা নিজস্ব জগত আছে | পড়াশোনা আর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতচর্চা ছাড়া প্রিয়া আর কিছু বোঝেনা |
————————————————————
সুদীপ্ত বেশ বিন্দাস থাকে | বাপের টাকায় বন্ধুদের সাথে মস্তি করে বেশ ভালোই দিন কেটে যায় | সুদীপ্ত থেকে কখন যে সিড হয়ে অনেক মেয়ের মনে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে তা নিজেও জানে না সুদীপ্ত | কোনও রিলেশন তিন মাসের বেশি টেকে না সুদীপ্তের | সুদীপ্তের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে কী অমোঘ আকর্ষণ লুকিয়ে আছে কে জানে,মেয়েরা ওর সাথে প্রেম টিকবে না জেনেও ওর প্রেমে পড়ে |
দাদাকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় সুদীপ্তের | এই একটা ভীষণ দুর্বল জায়গা সুদীপ্তের | ছোটবেলা থেকে প্রদীপ্তকে খুব ভালোবাসে ও | আগের সপ্তাহে যখন প্রদীপ্তকে মেয়েটা প্রত্যাখ্যান করেছিল তখন থেকে সুদীপ্ত ঠিক করছিল কি ভাবে শায়েস্তা করা যায় মেয়েটাকে | না হয় ওর দাদাটা ফ্যাশন সচেতন নয় কিন্তু এত ভালো মনের মানুষ আজকাল কটা দেখা যায় শুনি? ওর দাদার কষ্ট হলে ওর খুব খারাপ লাগে | বাহ্যিক রূপটাই কি সব? ওর দাদার মত খাঁটি মানুষ কোটিতে একটা মেলে এমন বিশ্বাস সুদীপ্তের |
————————————————————-
প্রদীপ্ত ছোটবেলা থেকে খুব শান্ত নিরীহ প্রকৃতির ছেলে | ক্রিকেট আর কার্টুন ছাড়া আর কোনও নেশা নেই ওর | গল্পের বই পড়তে ভালোবাসে তাই পুজোর সময় আত্মীয়েরা টাকা দিলে তা দিয়ে পোশাক না কিনে তা দিয়ে গল্পের বই কিনতো প্রদীপ্ত | অন্তর্মূখী স্বভাবের কারণে খুব একটা বন্ধু বান্ধব নেই ওর | তবে রিয়ার মুখে ওইদিন অতগুলো কড়া কথা শুনে খুব মন খারাপ হয়েছিল |
—————————————————————
প্রিয়ার বাবা নাকি ফোন করেছিল প্রদীপ্তের বাবাকে | সেদিন মেয়ের ব্যবহারের জন্যে তারা নাকি আন্তরিক ক্ষমাপ্রার্থী | তবে প্রিয়ার বাবা চাই প্রদীপ্ত অন্তত একবার ওনার বড় মেয়ের সাথে দেখা করুক | প্রদীপ্ত প্রথমে রাজি না হলেও মায়ের পীড়াপীড়িতে অবশেষে রাজি হয়েছে | সেদিন রিয়ার ব্যবহারে প্রদীপ্ত এতটাই ক্রুদ্ধ ছিল যে ভালো করে শোনেনি যে ও প্রিয়াকে দেখতে যাচ্ছে | ১০ মিনিটের বেশি ও থাকবে না ওই অসভ্য মেয়েটার সাথে | গোলপার্কের ক্যাফে কফি ডেতে পৌঁছে প্রদীপ্ত দেখলো মেয়েটা এসে বসে আছে | আজ যেন ওকে আরও অপরূপ সুন্দরী মনে হচ্ছে | কিন্তু মনকে দুর্বল হতে দিলে চলবেনা | আজ প্রদীপ্ত ওর অপমানের যোগ্য জবাব দেবে | মেয়েটার সামনে গিয়ে একটা চেয়ারে বসে চোখে চোখ রেখে প্রদীপ্ত বললো “দেখুন আমাকে আপনার অপছন্দ হতেই পারে,সবার সবাইকে পছন্দ হয় না | কিন্তু সেদিন অমন করে আমাকে অপমান না করলেই পারতেন | আমি জানি আপনার মত আধুনিকার জন্যে আমার মত সাদামাটা পাত্র বড়ই বেমানান তবে আমার একটা আত্মসম্মান আছে | ওভাবে সকলের সামনে আমাকে কড়া কথা শুনিয়ে কি মজা পেলেন জানতে পারি? আর একটা কথা আমি আমার মতই,কারোর ইচ্ছেমত নিজেকে বদলাতে পারবো না | ভালো থাকবেন, চললাম”
প্রিয়া তো ঠিক এমন একজনকেই নিজের স্বামী হিসেবে চাই,যার আত্মসম্মানবোধ থাকবে | যে আর কারোর মত নয়,একদম নিজের মত | মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকার ভ্রম ভাঙলো প্রদীপ্তের স্বরে “কি হল?কি ভাবছেন এত?অপ্রিয় সত্যি কথা বললে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক | আমি চললাম” | এবার প্রথম মুখ খুললো প্রিয়া “সেদিন আমার বোন রিয়ার ব্যবহারের জন্যে আমরা সবাই ভীষণ লজ্জিত | হাত জোর করে আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রথমে | আসলে ওর ওভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি মোটেও | তবে আপনি একটা সুযোগ দিলে ওর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে রাজি আমি | বলুন একটা সুযোগ দেবেন আমাকে?” প্রদীপ্ত বেশ অবাক হয়েছে “আপনি মানে…..আপনি রিয়া নন?” মিষ্টি হেসে ভুলটা শুধরে দিলো প্রিয়া “না,আমি ওর যমজ বোন প্রিয়া,রিয়া আমার ছোট বোন” এতক্ষণে পরিষ্কার হল পুরো ব্যাপারটা প্রদীপ্তের কাছে “আচ্ছা,তো কিভাবে প্রায়শ্চিত্ত করতে চান শুনি?” লজ্জায় রাঙা হয়ে প্রিয়া বললো “আপনার সহধর্মিনী হয়ে আপনার পাশে থেকে আমার বোনের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই” প্রদীপ্তের ও বেশ ভালো লেগেছে প্রিয়াকে | দুটো ক্যাপুচিনো অর্ডার দিয়ে প্রিয়ার সাথে আড্ডা মারতে বসতেই ক্যাফে কফি ডেতে বেজে উঠলো পার্ফেক্ট ডেটের আবহসঙ্গীত “দো দিল মিল রাহে হ্যা,মাগার চুপকে চুপকে” |
—————————————————————
ভ্রান্তি বিলাসের চমৎকার পরিসমাপ্তি হল | প্রিয়া খুঁজে পেলো ওর অমলকান্তিকে আর প্রদীপ্ত খুঁজে পেলো ওর বনলতা সেনকে | দুই বাড়িতে ওদের দুজনকে পছন্দ হয়েছে | প্রজাপতির আশীর্বাদে আজ ২৫শে বৈশাখ ওদের আজ শুভ পরিনয় | রিয়ার ব্যস্ততা আজ তুঙ্গে | মেহেন্দি,সঙ্গীতে কত দায়িত্ব ছিল ওর | সেদিন তত্ত্ব নিয়ে প্রদীপ্তের বাড়ি গিয়ে ভুল করে সুদীপ্তকে বলেছিল “জামাইবাবুর তো দেখছি দিদিকে দেখার জন্যে তর সইছে না,সারাদিন ফোন করছে খালি” | সুদীপ্ত মুচকি হেসে রিয়ার কানে কানে বলেছিল “আমি আপনার জামাইবাবু নই,তবে আপনি সুযোগ দিলে আপনার বাবা মানে আমার হবু শ্বশুরমশাই এর জামাই বাবাজি হতে রাজি” লজ্জা পেয়ে একছুটে চলে গিয়েছিল রিয়া আর পিছন থেকে শুনেছিল ওই পাজি ছেলেটার দীর্ঘশ্বাস “মৌনং সম্মতিম লক্ষণম” |
(সমাপ্তি)