অনিমেশের বাবা হঠাৎ মারা গেলো হার্ট ফেল করে l অবশ্য বয়স হয়েছিল …তা প্রায় পঁচাত্তর বছর l কিন্তু শরীর স্বাস্থ্য বেশ ভালোই ছিল l ভদ্রলোকের নেশা ছিল শুধু বই পড়া l এবং বই পড়ার কোন বাছ বিচার ছিল না l সে প্রেমের গল্প হোক বা ঠাকুর দেবতার বই হোক l কি পড়তো না ? রহস্য , ভৌতিক , কল্প বিজ্ঞান সব কিছু l লাইব্রেরী রুমে দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটিয়ে দিত l অনিমেশের মা অনেকদিন আগেই গত হয়েছিল l
সেদিন সন্ধ্যে বেলা ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছিলো l অনিমেশের স্ত্রী চা দিতে এসে দেখলো l শ্বশুরের চোখে পরা চশমাটা নাকের ডগায় নেমে গেছে l চোখ দুটো বন্ধ l প্রথমে ভেবেছিলো , ঘুমিয়ে পড়েছে ! কিন্তু কয়েকবার ডাকার পর সাড়া না পাওয়াতে , মনে খটকা লাগলো l স্ত্রীর গলা শুনে অনিমেশ ওপর থেকে নেমে এসে বাবার গায়ে হাত দিয়ে বুঝে যায় ….তিনি আর ইহ জগতে নেই l
সত্যি কি আশ্চর্য মৃত্যু l রাত্রে দোতলার ঘরে কাছা পরে বসে অনিমেশ ভাবছিলো l গত কালও মানুষটা জীবিত ছিল ! ছেলে সুরেশ কাল দিল্লী থেকে আসছে l দাদুকে খুব ভালোবাসতো l কতবার ওর কাজের জায়গা দিল্লীতে নিয়ে যাবার জন্যে কত সাধাসাধি করেছে l যাওয়া আর হলো না l একেবারেই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেল ..l
রাত এগারোটা বেজে গেছে l স্ত্রী ঘুমোচ্ছে l খাটে বসে সে বাবার কথাই ভাবছে l মনে হচ্ছে নিচে গিয়ে লাইব্রেরি রুমের দরজাটা খুললেই , সেই পরিচিত দৃশ্য দেখতে পাবে l কতদিন রাত্রে ও গিয়ে বলেছে l ” এবার ওঠো l শুতে যাও l” বাবার কোন বন্ধু ছিল না l কোন আত্মীয়র বাড়ি যেত না l মা মারা যাবার পর থেকেই , জীবন সঙ্গী ছিল শুধু বই l
এইসব চিন্তার মধ্যেই ওর কানে লাইব্রেরি ঘরের দরজা দেবার শব্দ ভেসে এলো l এক নিমেষে বাস্তবে ফিরে এলো… l সে কি ভুল শুনলো ? কান খাড়া করে রইলো l সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ l কেননা শীতের রাতে এমনিতেই শীতলতার ছোঁয়া l বেশির ভাগ লোক এখন লেপের নিচে , গভীর নিদ্রায় মগ্ন l ওকে সচকিত করে আবার দরজার আওয়াজটা পেলো l এবার ভুল শোনার প্রশ্নই নেই l তবে কি বাড়িতে চোর ঢুকেছে ? কিন্তু বই পড়ার ঘরে চোর কি চুরি করবে ?
আচমকা বাবার কথাটা মনে আসতেই …কিরকম যেন একটা শিরশিরানি অনুভব করলো দেহে l উঠে দাঁড়িয়ে কাপবোর্ডের ওপর থেকে চশমাটা পরে নিচে নেমে এলো l আলো জ্বালিয়ে দেখলো লাইব্রেরি রুমের দরজাটা বন্ধ l তবে ? এই সময় চোখে পড়লো বন্ধ কাঁচের জানালাটার দিকে ! ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে l তার মানে বউ আলো নেভাতে ভুলে গেছে l
দরজাটা খুলে ইজিচেয়ারটার দিকে চোখ পড়তেই সারা শরীরের রোম কূপগুলো খাড়া হয়ে গেলো l বাবা একমনে চোখ কুঁচকে বই পড়ছে ! সবিস্ময়ে দেখলো বাবার চোখে চশমাটা নেই ! যতই তার পরম আত্মীয় হোক , মন জানান দিচ্ছে….উনি এখন মৃত l কথাটা মনে হতেই হৃৎপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো l সেও কি বাবার মতো হার্ট ফেল করবে ?
এই সময় পিঠে ঠান্ডা হাতের একটা স্পর্শ পেলো l রক্ত শূন্য মুখে পিছন ফিরলো l দেখলো বউ দাঁড়িয়ে l অবাক চোখে বললো l
” এই ঘরে এতো রাতে দাঁড়িয়ে আছো কেন ? তার ওপর বাবার চশমাটা চোখে গলিয়ে ? ” ও তাড়াতাড়ি চোখ থেকে চশমাটা খুললোl — তাইতো , তাড়াহুড়োতে বাবার চশমাটা চোখে লাগিয়ে নেমে এসেছে l সেইজন্যে কি রকম ঝাপসা লাগছিলো l পরক্ষনেই মনে এলো , বাবার চশমা ছাড়া বই পড়তে অসুবিধে হচ্ছিলো বলেই কি ছেলেকে দিয়ে নিজের চশমাটা আনালো ? এগিয়ে গিয়ে চেয়ারের হাতলে চশমাটা রেখে , ছলছল চোখে লাইব্রেরি রুম থেকে বেরিয়ে এলো l
একটা চাপা কান্না গিলতে গিলতে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলো অনিমেশ l
Bengali Story – চশমা – Bangla Golpo
Leave a review
Leave a review