১৯৮০ এর দশক ছিল । তখন পাড়াগাঁয়ে ইলেকট্রিসিটি এর আধিপত্য দেখা যায়নি । আধুনিকতার ছোঁয়ার কথা কল্পনা করা ওই সময়ে ছেলেমানুষি ছাড়া আর কিছু নয় । তখন মানুষের মনের ভেতরে চিন্তা কম ছিল, বেঁচে থাকার আনন্দ বেশি ছিল |
ওই সময়ের গল্প এটা ।
কাশ ফুলের বাগানে তখন ঝঞ্ঝার প্রকোপ আর নেই, মায়ের আনন্দ বার্তার সাথে সাথে ওরাও তাল মিলিয়ে খুশিতে মাথা দুলিয়ে আগমনীর গান গাইছিলো । ওই কাশ ফুলের বাগানের পাশেই মেঠো রাস্তা ধরে সাইকেলে চেপে আসছিলেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাস্টার মশায় অবনী বাবু ।
এক অদ্ভুত মানুষ এই অবনী বাবু । কেউ জানেন না উনার বাড়ি কোথায়, উনি কবে এই গ্রামে এসেছিলেন । তবে উনার মতো রাশভারী মানুষ এই গ্রামে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না । স্কুলের ছোট ছোট বাছা গুলো উনার ভয়ে এক্কেবারে জূজূ হয়ে থাকে । উনাকে কেউ কখনো হাসতে দেখেনি । পান থেকে চুন খসলেই উনি সবাইকে ভগবানের দর্শন করিয়ে ছাড়তেন । স্কুলে আসার সময় কোনো বাচ্চা দেরি করে আসলেই হলো, তারপরে উনি সবাইকে খুঁজে খুঁজে খালি মাঠের মধ্যে নীল ডাউন করিয়ে রাখতেন । দেরি করে আসার কারণ যাই হোক না কেন উনার শাস্তির হাত থেকে কেউ রেহাই পেতো না । কিন্তু এই গল্পে অবনী বাবুর সঙ্গেও আরো দুটি চরিত্র আছে, যাদের গুরুত্বও অনস্বীকার্য ।
ওদের নাম হলো, রমেশ আর পলটু । চরিত্রও যেমন দুটো, ঠিক তেমনি ওদের চরিত্রও দুই মেরুর । রমেশ হচ্ছে আদর্শ ছাত্রের এক জ্বলন্ত উদাহরণ । আর অপর পক্ষে পল্টু হচ্ছে ঠিক বিপরীত।
পড়াশোনা বাদে বাকি সবকিছুতেই ও মাস্টার, অবাধ্যতার শিক্ষায় ও খুব পান্ডিত্য লাভ করেছে ।
তাই ফলস্বরূপ ও অবনীবাবুর করুনা রূপ আশীর্বাদ ও একটু বেশি প্রাপ্তিলাভ করেছে । কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা ব্যাপারে খুব মিল, পড়াশোনাতে দুজনেই সমান টক্কর দেয়, সেখানে কেউ কাউকে একটুও জায়গা ছেড়ে দেয় না । কোনো পরীক্ষা তে রমেশ এগিয়ে গেছে তো পরের পরীক্ষা তে পল্টু এগিয়ে যায় ।
কিন্তু অবনীবাবু সব ক্লাসরুমে গিয়ে রমেশের তারিফ করতেন, আর সকল ছাত্র-ছাত্রীদের বলতেন রমেশের মতো পড়াশোনা আর জীবন তৈরী করতে । আর ওপর পক্ষে বাকিদের বলতেন, ” আর যাই করো না কেন, পল্টুদের মতো হয়ে যেয়ো না । শুধু পড়াশোনাটা করলেই হয়না, তার বাইরেও আরো অনেক গুন্ লাগে মানুষের মতো মানুষ হওয়ার জন্যে । ওরকম ছেলে বড়ো হলে মস্ত বড়ো ডাকাত হবে আমার কথাটা কিন্তু মিলিয়ে নিয়ো । “
বাইরে অনেককিছু বললেও অবনীবাবু কিন্তু দুজনকেই সমান ভাবে ভালোবাসতেন । রমেশকে তার গুণাবলীর জন্যে, আর পল্টু কে শত ঝামেলার মাঝেও এতো সুন্দর পড়াশোনা করার জন্যে । পল্টুর মা বাবা কেউ নেই, বছর কয়েক আগে দুর্ঘটনায় ওদের দুজনেই মারা গেছেন, এখন ও ওদের জেঠুর বাড়িতে থাকেন । যেহেতু একটু রাগী স্বভাবের হলেও ওকে ভালোবাসেন । আর জেঠিমা ওকে অতটাও পছন্দ করেন না, এমনিতেই ওদের তিন সন্তান, ওদের কে সামলাতেই উনাকে হিমশিম খেতে হয় তারপরে আবার এক । না উনি নিজে চাইলেও ওকে সেই স্নেহ দিতেন পারেন না । সংসারের সমস্ত ঝামেলা সামলে উনি আর ওকে ছেলের জায়গায় বসাতে পারেন না ।
তবে উনি ওকে অপছন্দ করেন না, নিজের ছেলেগুলো উনার কথা অতটাও শোনেন না, তবে পল্টু কে যাই বলেননা কেন ও কিন্তু সবটা শোনে আর ওর পক্ষে যতটা সম্ভব পালন করার চেষ্টা করেন । এই কারণের জন্যেই উনি সব হারানো ছেলেটাকে ভেতরে ভেতরে স্নেহ করেন, আর আশীর্বাদ করেন যেন ও সত্যি করে মানুষ হয় ।
কিন্তু সব কিছু তো সমান হয় না, আর মানুষের সব ইচ্ছেও পূরণ হয় না, তাই পল্টুর বাঁদরামি যেমন বাড়তে থাকে ঠিক তেমনি ভাবেই বাড়িতে সবার শাসন বাড়তে থাকে । স্কুল এর নালিশ আর বাড়ির শাসন তাই পল্টুর প্রতিদিনের সঙ্গী ।
এরকম চলতে চলতে ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো, দুজনেই সেবার রেকর্ড নম্বর করে স্কুল তথা গোটা এলাকার নাম উজ্জ্বল করলো । তবুও অবনীশবাবু সেই মুহূর্তেও রমেশেরই প্রসঙ্গ করলেন । পল্টু সব দেখে শুনে শুধু একটু মুচকি হাসি হেসে স্যার কে প্রণাম করে বেরিয়ে এলো ।
এর পরের দৃশ্যপট একটু বদলে গেছিলো, রমেশ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে বাইরে গেলো, আর পল্টুও মেডিকেল পরীক্ষা পাস করে জলপাইগুড়ি চলে গেলো ।
দিন বদলের সাথে সাথে মানুষও বদলে যায়, তাই অবিনাশবাবুও কালের নিয়মে বদলে গেছেন। আগের সেই রাশভারী মানুষটা কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকেন। যে মানুষটা কে দেখে অনেকে ঘড়ির সময় ঠিক করতো, আজ উনি নিজেই দেরি করে ক্লাসে আসেন । যে মানুষটির জীবন আদর্শ স্বরূপ ছিল আজ যেন তা খেই হারিয়ে ফেলেছে । কথায় আছে একজন ভগবান তখনই স্বীকৃতি পায় যখন সে প্রকৃত ভক্তের সন্ধান পায়, ঠিক তেমনভাবেই আদর্শ শিক্ষাগুরুর পরিচয়ও তার উজ্জ্বল ছাত্রদের মাধ্যমে । আজ শিক্ষক আছে, ছাত্রদলও আছে, কিন্তু সেই ভালোবাসা সেই আবেগভরা ক্লাসরুমগুলো কি একটু হলেও হারিয়ে যাচ্ছে । না হলে কি স্বপ্নপ্রিয় অবনীশবাবুর শাসন গুলো আজ নিয়মকানুন আর আইনের বেড়াজালে হারিয়ে যেত ।
আমাদের সময়ে শাসন হলে ভাবতুম, ” আমাকে কেন এই শাসন করা হলো, তারপর আমরা বুঝতে পারতাম ওটা ওই মুহূর্তে দরকার ছিল, তা না হলে হয়তো এই ভাবে আমরা ভাবতে পারতাম না । “
অবশ্য আমরা মার্ খাবার পরের দিন এটাও শুনতে পেতাম,” ওরকম বদমায়েশি করলে হয়, স্কুলে এসে পড়াশোনা করবি,হাসি ঠাট্টা করবি, তা নয় শুধু মারপিট আর শয়তানি । খুব লাগেনি তো তোর, এখন বুঝবি না বুঝলি, যখন বা বড়ো হবি তখন বুঝবি এই শাসনের মধ্যে ছিলিস বলেই হয়তো পরে ওই জায়গাটায় যেতে পারলি । যা আর কখনও এরকম করবি না, এখন মন দিয়ে পড়া করবি যা । “
কিন্তু এখন অল্প শাসনেই শুরুতে কি এই প্রতিক্রিয়াটাই আসে,” কি, আমার গায়ে হাত তোলা, এতো সাহস ওই মাস্টারের, জানেনা আমি কি করতে পারি । এক্ষুনি মান হানির মামলা করে দেবো । তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল । “
না আমি অন্য কথায় চলে গেলাম, আসলে খেয়াল থাকে কথায় শুরু করি আর কথায় শেষ করবো, তবে লক্ষ্য তো স্থির রাখতেই হবে ।
তো তখন অবিনাশবাবু চাকরি জীবন শেষ করে শহর থেকে দূরে এক জায়গায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন । খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন, কখনোই সঞ্চয়ের কথা ভাবেন নি, তাই এই রকম হলেই উনাকে থাকতে হতো ।
এরকম কোনো এক সময়ে উনি রাস্তাতে হাঁট ছিলেন, একটু অন্যমনস্ক ছিলেন এমন সময় পেছন থেকে প্রচন্ড জোরে গাড়ি দাঁড় করানোর শব্দ । একটু হলেই উনি গাড়ির চাকার নিচেই চলে যাচ্ছিলেন ।
বিদেশী গাড়ির নীল কাঁচের জানলা তখন একটু নিচের দিকে নামলো । ভেতর থেকে কিছু এলোমেলো শব্দ ভেসে এলো, ” স্কাউন্ড্রেল, ভিখিরির বাচ্চা, মরার আর জায়গা পায় না । গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াবে আর কিছু হলেই মোটা ক্ষতিপূরণ । শালা দেশের এই হালের জন্যে এরাই দায়ী । ” তারপর মিষ্টি কিছু গালি উপহারস্বরূপ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি খানা পাস্ দিয়ে বেরিয়ে গেলো । অবিনাশবাবু গাড়ির কাঁচে কিছু লেখা দেখতে পেলেন, Ramesh Gupta, Sr Divisional Engineer, Eastern Railway ।
কিছু পুরানো স্মৃতি সঙ্গে সঙ্গে উনার স্মৃতির দৃষ্টিপটে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, পুরানো স্কুল আর বিনয়ী ছাত্র । এরকমও হয়, যে আদর্শ ছাত্র ছিল সে কি করে এমন ভাবে এক বয়স্ক মানুষের সাথে কথা বলতে পারে । ভুলটা হয়তো উনারই তবু, এত্তগুলো কথা বলতে রমেশের বুকে বাঁধলো না ।
পায়ে অল্প একটু ছোট লেগেছিলো, কাছেই গভর্মেন্টের স্পেশাল হাসপাতাল ছিল । উনার ঐখানে খুব বেশি যাতায়াত হয়নি তবে ভেতরে ঢুকে নিজের সমস্যার কথা বলতে রিসেপশন থেকে উনাকে নির্দিষ্ট জায়গায় চিকিৎসার জন্যে পাঠিয়ে দিলো ।
উনি কি ঠিক দেখছেন, ভেতরে এক বৃদ্ধার সাথে খোশ মেজাজে গল্প করছে সেই শয়তান পল্টু ।
বৃদ্ধার মনে হয় আর চিকিৎসা লাগবে না, উনার আনন্দ দেখে কে বলবেন উনি শারীরিক সমস্যা তে ভুগছেন । এবারে অল্প হলেও অবিনাশবাবুর অনুশোচনা হতে লাগলো ।
এমন সময় সহকারী এসে উনাকে ভেতরে নিয়ে গেলো ।
উনার মুখে দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বাবুর ভোরের কুঁচকে গেছে, উনি কিছুক্ষন পলক না ফেলে তাকিয়ে রইলেন । তারপর সটান ছুটে এসে স্যারকে প্রণাম করে বললেন, ” আপনি কোথায় হারিয়ে গেছিলেন, আমি জয়েনিং করার পর সোজা আপনার বাড়ি গেছিলাম, আপনি তখন অন্য জায়গায় চলে গেছিলেন, কেউ জানে না কোথায় । প্রচুর চেষ্টা করেছি আপনাকে খোঁজার, পাইনি স্যার । জেঠু জেঠিমাও হটাৎ করেই চলে গেলেন, আপনাকেও খুঁজে পাইনি । দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম স্যার, পরে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেলো । আপনি এক্ষুনি আমার সঙ্গে চলুন,আজ থেকে আপনি আমার সঙ্গেই থাকবেন, আপনার বারণ আমি শুনবো না । আগেও কোনোদিন আমি আপনার কথা শুনিনি, আজও শুনবো । আমি এখনো সেই বদমাস পল্টু আছি স্যার । “
অবনীবাবু হটাৎ করে কেঁদে ফেললেন, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পল্টুকে বুকে জড়িয়ে বললেন,” আজ আমার পড়ানো সার্থক, এতদিন ধরে তোর বাইরেটাই দেখছি, কখনো ভেতরটা দেখিনি । আজ পেলাম,আজ মনে হলো অন্তত একজনকে মানুষের মতো মানুষ করতে পেরেছি । আজ আমি খুশি রে, খুব খুশি । তুই এই বাবা, এক বার এই দজ্জাল শিক্ষক কে বুকে জড়িয়ে ক্ষমা করে দে । “
আজকাল পল্টুর মতো ছাত্রদের অভাব সঙ্গে অবনীশবাবুর মতো শিক্ষকদেরও সত্যি বড়ো অভাব । যদি কখন দুজনকে একসাথে খুঁজে পান, তাহলে ওদের কাছে গিয়ে বলবেন, আপনার দুজনেই গুণী, আপনার দুজনেই একে ওপরের পরিপূরক ।
এবার পুরোটাই আপনার রমেশ হয়ে নিজের জীবনের মজা নেবেন, নাকি পল্টু হয়ে আরো একটু বেশি শয়তানি করবেন । সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার ।