হরিদার চায়ের দোকানে আমাদের আড্ডার ঠেক ভালোই জমতো | লোকটা সত্যিই দশভূজা | একা হাতে কারোর ডিম অমলেট,কারোর লেবু চা,কারোর টোস্ট করে দিতো | অনির্বান তখনও এসএসসি ক্লিয়ার করতে পারেনি | বাবার গালমন্দ শুনে রাতে অনশন করে ভোরে এসে হাজির হরিদার দোকানে | হরিদা পুরো ঘটনা শুনে তাড়াতাড়ি ডিম অমলেট দিয়ে ভাত বেড়ে দিলো | হরিদা থাকতে কাউকেই ধর্নামঞ্চে বসতে হবেনা | অনির্বানের পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের আড়ালে দুশ্চিন্তার ভাজ | হরিদার দোকানে ১৫০০ টাকা দেনা | বাপের গালি শুনে অভিমান করে কতদিন হরিদার দোকানে এসে পড়ে থাকতো | হরিদাকে দেখতে তেমন কিছু ছিল না | অঞ্জন দত্তের মতে হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটখাটো লোক | আমি যখন পঞ্চম শ্রেনীতে পড়ি তখন থেকে বাবার মুখে হরিদার কথা শুনতাম | সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামের একটা সাধারণ লোক নিজের অমায়িক ব্যবহারে আমাদের পাড়ার সবার মন জয় করে নিয়েছে | ছোট বড় সবার কাছে হরিপদ হল হরিদা |
বাবার থেকেই শোনা হরিদার জন্যে পাত্রী যখন ঠিক হল তখন হরিদা চা বিক্রি করতো | আমাদের পাড়ার সবাই টাকার ব্যবস্থা করে হরিদার বিয়ে দিয়েছিল | হরিদা সবসময় বলতো আপনাদের ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না | একটা অজানা অচেনা ছেলের জন্যে আপনারা যা করেছেন তা সত্যিই ভাষাতে প্রকাশ করা যায় না | এখন বৌদিও হরিদার সাথে খাবার বানায় | ছোটখাটো মানুষটার মন অনেক বড় ছিল | আমরা মজা করেই বলেছিলাম হরিদার বিবাহবার্ষিকীতে কিছু খাওয়ানোর কথা | ব্যাস রাখে হরি মারে কে | সবাইকে এগরোল বানিয়ে খাইয়ে দিলো | কিছুতেই টাকা নিতে রাজি হল না | নিজের জন্যে সঞ্চয় করতে শেখেনি হরিদা |
মৃন্ময়ের ঠাকুমা একবার খুব অসুস্থ হল | মৃন্ময়ের বাবা তখন বিজনেজ ট্রিপে বাইরে | হরিদা অ্যাম্বুলেন্স ডেকে ঠাকুমাকে সঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে না গেলে বুড়ি হয়তো সেদিনই পটল তুলতো | আবার টুবাই এর বোনকে কিছু বেপাড়ার ছেলে বিরক্ত করছিল | হরিদা এগিয়ে গিয়ে প্রতিবাদ করেছিল সেদিন | রাজনীতি থেকে খেলাধুলোর বিষয় নিয়ে হরিদার চায়ের ঠেক যখন সরগরম তখন হরিদাও যোগ দিতো আলোচনায় | হরিদা পয়সার অভাবে বেশিদূর পড়তে পারেনি | কিন্তু সব বিষয়ে হরিদার অগাধ জ্ঞান ছিল | রাতে বাড়ি ফিরে বৌদি পড়াতো হরিদাকে | আবার আবিরের যখন রেলের পরীক্ষা,ব্যাঙ্কের ক্লার্কের পরীক্ষা ক্লিয়ার হচ্ছিল না একজন অভিভাবকের মত পাশে ছিল হরিদা | আবিরের মাথায় হাত বুলিয়ে হরিদা বলতো ‘একটুতেই তোরা হার মেনে যাস বাবারা,আমার তো সকাল সকাল ইয়ে কিলিয়ার হয় না,তোর বৌদি ইসবগুল খাইয়ে কিলিয়ার করায়,চেষ্টা করে যা,রেলের চাকরি ঠিক হয়ে যাবে,এটা হরিদার কথা না তোদের পাড়ার চপশিল্পের প্রবর্তকের বাণী’ |
এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি | হরিদার আবার বিরহের কবিতা লিখতো | প্রেমের গান গাইতো | এত কষ্টের মধ্যেও মুখের হাসি কখনও অমলিন হতো না হরিদার | কিছুদিন ধরে বৌদির শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না | হরিদা মজা করে বলতো ‘আমার এখন ব্যবসা ডাউন আর তোর বৌদির প্রেশার,আর ডাউন হওয়ার সময় পেল না’ | বিকাশ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকের চাকরিটা পাওয়ার পরে আর হরিদার দোকানে আসে না | মনে সংশয় যদি হরিদা নিজের অভাবের ঝাঁপি খুলে বসে | একবছর আগেও বিকাশকে হরিদা টাকা দিতো চাকরির ফর্ম পূরণ করার জন্যে | কিছু মানুষের ফর্ম পূরণের দায়িত্ব নিতে গিয়ে হরিদাদের স্বপ্ন পূরণ হয় না | আমি এখনও বেকার তবুও টিউশনি করে যা পাই তা দিয়ে সাহায্য করি হরিদাকে |
মানুষের সময় বোধহয় একই থাকে না | যে আজকের রাজা কাল সে হয়তো ফকির | বিকাশের সেদিন স্কুল থেকে ফিরতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হলো | ও নেগেটিভ রক্তের প্রয়োজন | আবারও পরিত্রাতা হরিদা | যেই বিকাশ চাকরি পেয়ে হরিদার দোকানে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল,আজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে হরিদা | সবার সঙ্কট মোচনের গুরুদায়িত্ব যেন হরিদার কাঁধে | মানুষের বিপদে আপদে পাশে থাকা যেন লোকটার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে |
সুব্রত অনেকদিন পরে ইউএস থেকে ফিরেছে | আজ হরিদার দোকানে এসে যখন ডিম অমলেট আর লেবু চায়ের অর্ডার দিলো,তখন হরিদার চোখে জল | এতবছর পরে যখন বিদেশ থেকে ফিরে কেউ কেএফসি,ম্যাক ডি,ক্যাফে কফি ডে না গিয়ে হরিদার দোকানে আসে তখন সত্যিই শব্দেরা যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় | হরিদাকে জড়িয়ে ধরে সুব্রত বললো ‘যতই বিদেশ থাকি দাদা,আমার হৃদয় হরিদার দোকানে পড়ে থাকে আর তোমার দোকানের ডিম অমলেটের স্বাদ আমার জিভে আজীবন লেগে থাকবে’ |
কিছু কিছু সম্পর্ক হোক না নামগোত্রহীণ | আমাদের হৃদয় জুড়ে থাক হরিদাদের চায়ের ঠেক | ডিজিটাল দুনিয়ায় বেঁচে থাকুক হরিদাদের মত সাদামাটা মানুষ | আসলে হরিদারা অভিভাবকের মত মাথার ওপর না থাকলে হয়তো অনির্বান কিংবা বিকাশের মত অনেকেই অচিরে অনাথ হয়ে যেতো | প্রেমের ছ্যাঁকার প্রলেপ কিংবা বেকারত্বে আশার মলম লাগিয়ে আগামীদিনের জন্যে পরোক্ষভাবে আমাদের লড়াই করতে শেখায় সাদামাটা ছোটখাটো হরিদারা | চায়ের ধোঁয়া ওঠা ভাড়ে শেষ চুমুক পর্যন্ত লেগে থাকুক হরিদার স্নেহ |