ঠান্ডা লেগে যাবে তো , গায়ে কিছু জড়াওনি কেন?” একটু চমকে গেলাম। পেছনে তাকিয়ে
দেখি বারান্দায় মহুয়া দাঁড়িয়ে।
– “তুমি উঠে পড়েছ? কখন এলে? বসবে এখানে?”
আমি সবুজ মখমলের মত লনে ছড়িয়ে রাখা একটা বেতের চেয়ারের দিকে আঙুল তুলে বললাম।
– “হ্যাঁ। বসবো। তার আগে একটু চা দিতে বলি? খাবে?”
আমি ঘাড় হেলাতেই ধীর পায়ে ভেতরে চলে গেল মহুয়া। একটা জংলাছাপ কুর্তি পড়ে।
মুহূর্তের জন্য আমার মনে হলো ওর পায়ে একটা নূপুর যেন বড্ড মানাতো এখন। এই ধীর
স্থির চলাফেরায় একটা আলাদা ছন্দ এনে দিত। ভাবনা আমার স্বভাব। ভাবতে ভাবতেই দূরের
পাহাড়ে সূর্যাস্তের মুহূর্তের বিষণ্ন ছায়া দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। একটু অন্যমনস্ক
হয়ে পড়েছিলাম। কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে ঘুরে দেখে বুঝলাম মোটা জ্যাকেটটা এনে
দিয়েছে মহুয়া। নিজে একটা গরম চাদর জড়িয়ে একটু গুটিসুটি মেরে বসলো চেয়ারে।
– “বিকেলের ওষুধটা খেয়েছো?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
– “হ্যাঁ। আজকে মনে ছিল।” একটা খুব মিষ্টি হাসি আমাকে উপহার দিয়ে বললো ও।
তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়লো টি-পট থেকে চা ঢালতে।
সিকিমের একটা পাহাড়ের ওপরের বাগান ঘেরা বাংলোয় আছি আমরা, গত আড়াই মাস ধরে।
জায়গাটার নামটা এত অদ্ভুত, মনে থাকেনা কিছুতেই। একটা গাড়ি নেওয়া আছে এখানে। মাঝে
মধ্যে বাজারে বেরিয়ে যাই সপ্তাহের কোনো এক দিন। একটু আধটু দরকারি চাল তেল নুন
আনতে, বাকি সবজিপাতি বাগানেই হয়। সেই দিয়েই চালিয়ে নেওয়া হয়। একটা চৌকিদার আছে,
সে-ই মালির কাজ করে। আর তার বউ রান্নাবান্নার দিকটা সামলায়। মহুয়া খুব একটা
ঘেঁষেনা ওদিকে। যা দেয়, তাই চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে। আর আমার অখন্ড অবসর। মাঝে মধ্যে
একটু আধটু বোতল খুলে বসি। একা একাই ঢুকুঢুকু করি, মহুয়া হাসে শুধু পাশে বসে। আমি
অপেক্ষা করি ওর উচ্ছল হয়ে ওঠার, কিন্তু ও আবার চুপ হয়ে যায়। দূরের দিকে তাকিয়ে
থাকে। আর কি যেন ভাবে শুধু বসে।
* * * * * * * * * * * * *
– “কিরে রুদ্রদা, চল চল খেলতে যাবো, চল না।”
– “আরে ধুর, জানিস তো আমার ভালো লাগেনা, কেন ঝামেলা করছিস?”
– “তোর ভালো না লাগলেই বা কি, বয়েই গেছে আমার। আমি বলছি বলে যাবি, ব্যাস।”
– “দাঁড়া কাকিমা কে বলে দিচ্ছি, মজা বুঝবি।”
– “ইশঃ আমিও বলবো তুই স্কুলে লুকিয়ে বই পড়ছিলি ক্লাসে বসে।”
– “কি বদমাস মেয়ে রে তুই। মিথ্যে বলবি?”
– “তাহলে চল খেলতে।”
– “উফ, শান্তিতে একটু গল্পের বইটাও শেষ করতে দেবেনা।
* * * * * * * * * * * * * *
– “কিগো, ঘরে চলো।”
মহুয়ার গলা শুনে চোখ তুলে তাকালাম। ওর বড় বড় চোখের পাতাগুলো আর নিষ্পাপ মুখটা
দেখে ইচ্ছে করছিল জড়িয়ে ধরি। পরক্ষনেই নিজেকে সামলালাম। কারোর অসহায়তার সুযোগ
নেব, এটা ভাবলাম কি করে? হোক না সে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।
একটু ফাঁসফেসে গলায় বললাম, – “আজকে একটু খাই? ঠান্ডা লাগছে তো। বোতলটা আনতে বলবে
ভেতর থেকে? আর সাথে কিছু?”
একটু চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে আবার সেই ছন্দ মিলিয়ে ভেতরে চলে গেল
মহুয়া। আবারও আমি তাকিয়ে রইলাম ওর যাওয়ার দিকে। ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, ওর কি
সত্যি কোন উন্নতি হয়েছে এখানে এসে? দমচাপা ভাবটা কি কম মনে হচ্ছে একটু?
নাহ্, আপনারা যা ভাবছেন তা নয় একদমই। আমি মোটেই বদ্ধ মাতাল নই, বা নিজের স্ত্রীকে
নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য এই নির্জন পাহাড়ে বাংলো ভাড়া করে দিন কাটাচ্ছি
না। আমি একজন প্রথিতযশা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। আর মহুয়া আমার একজন রোগিনী মাত্র।
নাহ্, মাত্র কথাটা বোধহয় খাটেনা এই ক্ষেত্রে। মাঝে মাঝেই আমাদের রঙিন কৈশোরে চলে
যাই আমি আজও, মহুয়াকে সামনে দেখলে।
বিহার, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের এক শহরে আমাদের দুই পরিবার থাকতো পাশাপাশি। আর আমাদের
দুজনের বন্ধুত্বের সেই শুরু, হয়তো বা শেষও। কোন অজ্ঞাত কারনে সেই ছোট থেকেই মহুয়া
ধারণা করিয়ে দিয়েছিল ও একান্তই আমার। আর সেটা আমার মনের ভেতরে বদ্ধমূল হয়ে বসেছিল
চিরকাল। কিন্তু শহর বদলের সাথে সাথে আমাদের যোগাযোগেও ইতি ঘটে গেছিল তখনকার
মত।
মহুয়াকে খুঁজে পেলাম হঠাৎ মাসছয়েক আগে। কয়েকটা বেসরকারি উন্মাদআশ্রমে আমি নিজের
তাগিদেই শ্রমদান করি। কিছুটা কম সময়ের জন্য হলেও। একটি নতুন রোগিণীর আবির্ভাব
সেখানে রোজকার ঘটনা, তবে অদ্ভুত লেগেছিলো তখন, যখন সেই রোগিনীদের মধ্যে একজন হঠাৎ
আমার ছেলেবেলার নাম ধরে ডেকে ওঠে আমায়। চমকে উঠেছিলাম সেদিন। মারাত্মক রকমের।
নোংরা, উলঝুলো চুল, অর্ধনগ্ন একজন উন্মাদ রোগিনী আমাকে ডাকছে দেখে আশ্রমের ভেতরেও
কর্মীরা অবাক হয়েছিল সেদিন। বারবার আসার চেষ্টা করেছিল আমার কাছে। কিন্তু ঘোলাটে
দৃষ্টি আমাকে আটকে দিচ্ছিল বারবার।
আমি অফিসে ফিরে এসে ফাইল দেখে সেই রোগিণীর নাম বের করেই খেলাম দ্বিতীয় চমক। জানা
গেল, বাড়ির লোকেরাই ধরে বেঁধে দিয়ে গেছে এখানে ভর্তি করে। সপ্তাহ খানেক হলো। কোনো
যোগাযোগের দূরভাষ না থাকায় ঠিকানাটি পকেটে করে নিয়ে বেরোলাম সত্যসন্ধানের আশায়।
ততক্ষণে আমার নির্দেশে ওকে ধরে বেঁধে পরিষ্কার করে জামাকাপড় পড়িয়ে আনা হয়েছে।
বিড়বিড় করতে থাকা মুখ আর ঘোলাটে চোখের ভেতরে থেকেও মহুয়াকে খুঁজে পেতে আমার কোন
অসুবিধাই হলোনা এবার। আর আমার দিকে তাকিয়ে হাসিটা সেই ছোটবেলার মতই লাগলো।
ওর ফাইল ঘেঁটে বেশি কিছু পেলামনা চিকিৎসা সংক্রান্ত, কিন্তু ওর অবস্থা দেখে আমার
ডাক্তারি জ্ঞান বলছিল, অন্তত বছরখানেক বিনা চিকিৎসায় ছিল। পেছনের কারন না জানা
গেলে শুধু ওষুধে মনোরোগ সারেনা সবসময়ম। সহমর্মী কাছের মানুষের খুব প্রয়োজন হয়।
আমি পরের দিন ঠিকানায় গিয়ে তাজ্জব হয়ে গেছিলাম। বাড়ি বন্ধ ছিল, আর একজন প্রতিবেশী
উপযাচক হয়ে আমাকে জানিয়েছিল যে, বাড়ির পাগল বউকে নিয়ে নাকি ওঁনারা কাশী গেছেন
কিছুদিন আগে। যেই বউয়ের পরপর দুবার সদ্যজাত কন্যাসন্তান জীবিত থাকেনা, আর তার পরে
বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়, সেই বউকে কি আর শ্বশুরবাড়ি রাখতে পারে?
বাড়ি তালাবন্ধ হওয়ায় আমি কারোর সাথে যোগাযোগ আর করতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু কোন
কারণে মহুয়া যে শ্বশুরবাড়িতে চক্ষুশূল, আর তাঁদেরই কোন করা ব্যবহার যে ধীরে ধীরে
মহুয়াকে এই পথে ঠেলে দিয়েছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম তখনই। ওর মা বাবার খবরও না
কিছু জানে, না জানতে বুঝতে পারে। যোগাযোগ করারও কোন উপায় খোলা ছিলনা আমার
সামনে।
তখনই সিদ্ধান্তটা নিয়ে নি। পুলিশের কাছে একটা FIR করি। আমার নিজের কাজের জগতের
সূত্রে চেনা এবং জানা আরো কিছু ভালো এবং বড় মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে কমিটি করে
যতটা সম্ভব সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করি। সবার শেষে, শুধু মহুয়ার জন্যই আমার
তৈরি হওয়া পসার, রোগীদের সারি, আর অসংখ্য আমার দিকে চেয়ে থাকা মানুষদের ছেড়ে আমি
এই নির্বান্ধব অবস্থায় এক অসহ্য সুন্দর পাহাড়ে এসে থাকছি গত কয়েকমাস ধরে। মহুয়ার
স্বামী হয়ে। অন্ততঃ মহুয়া তেমনই জানে।
যখন সম্পূর্ন উন্মাদ মহুয়াকে আমি আশ্রম থেকে আমার ফ্ল্যাটে নিয়ে আসি, তখনই ও হঠাৎ
অনেকটা বদলে যেতে থাকে। খুব হাই প্রোফাইল সমাজের উচ্চবিত্ত বাসস্থানে থাকা
সত্ত্বেও পড়শিদের চোখ এড়াতেই এভাবে তড়িঘড়ি পাহাড়ের প্ল্যান করে চলে আসা আমার। ওর
যে একটু ভালোবাসা আর অনেকটা মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন সেটা বুঝে আমি কলকাতায়
থাকার সময়েই অনেকটা সময় ওকে দেবার চেষ্টা করতাম, নিজের ব্যস্ততা কমিয়ে এনে এনে।
আর এখন, আমার সমস্ত সময় ওরই জন্য। যার ফল আমি দিনদিন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে,
গত আড়াই মাস ধরে।
সুস্থ হয়ে উঠছে আমার মহুয়া। কিন্তু সমস্যা একটাই। পুরোনো কথা কিছুতেই মনে করতে
পারছে না। যেন এটাই ওর সংসার, আমিই ওর আসল স্বামী, আমরা অনন্তকাল মধুচন্দ্রিমায়
এখানেই থাকছি। এটা একটা সাংঘাতিক এফেক্ট আমার মনে ফেলছে। মহুয়াকে ভীষণ ভাবে চাওয়া
সত্ত্বেও আমি ওর পুরোপুরি সুস্থতার অপেক্ষা করে যাচ্ছি, আর নিজেকে খুব ধীরে ধীরে
অবসাদের রাস্তায় ঠেলে দিচ্ছি। বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারছি না, ওর অমোঘ
আকর্ষণে।
রাতে খাবার পরে ঘরের ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে একটা বই পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম, মহুয়ার ধাক্কা ঘুম ভাঙ্গালো আমার। উঠে গিয়ে বিছানায় শুতেই পাশে মহুয়াকে
অনুভব করলাম আমি, ধরে ধরে শুইয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। আর আমার এতদিনের সমস্ত
প্রতিজ্ঞা খড়কুটোর মত উড়ে গিয়ে আমি দখল নিলাম ওর। মহুয়ার কোন অবরোধই সফল হলোনা আর
সে রাতে।
সকালে উঠে বিছানায় শুয়ে ছিলাম, হঠাৎ বিদ্যুৎচমকের মত মনে পড়ে গেল আগের রাতের
ঘটনা। নিজের ভেতরের অবসাদ, না নেশার ঘোর কি আমাকে এতটা নিচে নামাতে পারলো, সেটা
ভেবে আমি মহুয়ার মানসিক অবস্থা নিয়ে চিন্তিত হয়ে উঠলাম আবার। ধড়ফড় করে উঠতে যেতেই
চৌকিদারের বউ চা নিয়ে এলো আমার জন্য, বিছানায় চা খাবার অভ্যেস আমার একার জীবনে
কোনোদিনই ছিলনা, এখানে এসে ধরিয়েছে মহুয়া।
চা শেষ করতে করতে আমি অবশ্যকর্তব্য ভাবতে লাগলাম। কিভাবে মুখোমুখি হবো মহুয়ার?
এখানে সবাই আমাদের স্বামী-স্ত্রী বলেই জানে, সেই জন্য আমাদের আলাদা শয্যা। প্রথম
দিকে একটু ঘড়িতে দেখলাম বেশ অনেকটাই বেলা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। বাথরুমে গিয়ে দেখলাম
পরিষ্কার জামাকাপড় গুছিয়ে রাখা অন্যান্য দিনের মতোই। কিছু বুঝতে না পেরে
হতবুদ্ধির মত স্নান সেরে বাইরে বেরোলাম। একটু অন্য ঘরগুলোতে উঁকি মেরে মহুয়ার কোন
হদিস না পেয়ে গুটি গুটি পায়ে বাইরের লনের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। প্রতিদিনের মতোই
শিশির মোছা পরিষ্কার হয়ে থাকা চেয়ার আমার অপেক্ষায়। সাথে সেই বইটা, যেটা আগের
রাতে পড়ছিলাম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেছনে একটা নূপুরের আওয়াজে চমকে তাকিয়ে দেখলাম
মহুয়া, হাতে ব্রেকফাস্টের ট্রে। মহুয়ার সহজ ব্যবহার আমাকে একটু অবাক করছিল তখন।
হঠাৎ ও বলে উঠলো,
– “আমরা ফিরব কবে?”
– “কোথায়?”
– “কেন কলকাতায়?”
– “তুমি যেদিন বলবে”
– “তাহলে চলো, কালকেই ফিরি। আর ভালো লাগছে না আমার এখানে।”
– “মহুয়া ?”
একটু ভারী স্বরে ডাকলাম আমি।
ও বললো, – “হ্যাঁ বলো, কি বলছো ?”
– “কাল রাতের জন্য সরি। আমি আসলে, কি যে হয়ে গেল।”
– “কিন্তু যা হয়েছে সেটাকে কি তুমি বদলাতে পারবে?”
– “না পারবো না জানি, কিন্তু তুমি, মানে আমি জানি খুব বাজে হয়ে গেছে, তুমি কি সেই
জন্যই যেতে চাইছো? আমি সত্যি বলছি আমি দুঃখিত, তুমি যা শাস্তি দেবে আমাকে, আমি
মাথা পেতে তা নেব, কিন্তু রাগ করে থেকোনা, প্লিজ।”
– “সেই জন্যই ফিরতে চাইছি রুদ্রদা। কিছু কথা আমারও আছে তোমাকে জানানোর। আমি ভয়ানক
চমকে উঠলাম মহুয়ার কথা শুনে। ওর কি তাহলে সব মনে পড়ে গেছে? ওকে আমার এখানে নিয়ে
আসা সার্থক তাহলে? পরমুহূর্তেই আমার ডাক্তারি স্বত্বা জেগে উঠলো আত্মপ্রসাদের
সাথে।”
– “কি জানাবে বলোতো?”
– “যেটুকু তুমি জানোনা, সেই ঘটনাগুলো রয়েছে তোমাকে আমার জানানোর।”
– “ঘটনা? আমি জেনে কি করবো বলো? তোমাকে সুস্থ করবার জন্য শুধু এখানে.. এখন তো আর
আমার কিছু..”
– “তুমি কি জানো, আমরা তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাবার পথেই বাবা মারা গেছিলেন
দুর্ঘটনায়? মা কোনোরকমে একটা স্কুলের চাকরি জুটিয়ে আমাকে আর ভাইকে বড় করেছিলেন
মামার বাড়িতে থেকে? আমি নিজেও টুকটাক টিউশনি করতাম জানো তো, কিন্তু মা-ও হঠাৎ চলে
গেলেন হার্ট অ্যাট্যাকে, আর ভাই পুরো বখে গেল বদসঙ্গে পড়ে।
এদিকে মামার বাড়িতেও এত বাজে অবস্থা ছিল, ওরাও আর আমাদের একসাথে থাকা মেনে নিতে
পারছিল না। তার মধ্যেই আমার বিয়ে হয়ে যায় প্রদীপের সাথে। ওর বাবার কাছে কিছু টাকা
পেতেন আমার মামা, সেই টাকার বিনিময়ে বিয়েটা হয়। তবে খুব একটা খারাপ ছিলাম না
জানো, যতদিন না আমার ছেলেটা ওরকম পঙ্গু হয়ে জন্মেছিল। তারপর এমন অত্যাচার শুরু
করলো সবাই, আমিও কেমন ভুলে যেতে শুরু করলাম।
এদিকে একদিন ছেলেটা সিঁড়ি থেকে পড়ে মারা গেল। আর ওরা বললো আমিই নাকি করেছি ওটা,
তারপর থেকে আমিও কেমন হয়ে গেলাম। জেলে নিয়ে গেছিল, বাড়িতে এমনিও মারধর করতো,
তারপর আমার আর কিছুই মনে নেই। শুধু হঠাৎ কোথায় যেন তোমাকে দেখলাম, শুধু ওইটুকুই
জানি। কদিন ধরেই মনে পড়ছিল সব, ভাবছিলাম তোমাকে বলবো, কিন্তু তোমাকে আমি কখনো
ভুলিনি জানো। খুব মনে হতো কোনোদিন তোমার সাথে দেখা হবেই আমার। কোনো এক দিন।
তোমার এগুলো কিছুই জানবার ছিলোনা বলো?”
আমি একেবারে হতচকিত হয়ে রইলাম। তারপর জিজ্ঞেস করলাম, – “তুমি কি নতুন করে তোমার
ছেলের মারা যাওয়া নিয়ে পুলিশ কেস করতে চাও? বা শ্বশুরবাড়ির সাথে যোগাযোগ?”
এতক্ষণ কথা বলে একটু হাঁফিয়ে গেছিল মহুয়া। আমার কথার উত্তর না দিয়ে আবার
অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে থাকলো দূরে। তারপর বললো, – “কি করবো জানিনা, কিন্তু তুমি
অন্তত গিয়ে নিজের জীবনটা আবার শুরু করো, আগের মত করে। আমি পরে ভাববো। আমার জন্য
অনেকটা সময় তোমার এমনি চলে গেল রুদ্রদা।”
– “আমি তো জেনে বুঝেই নিয়ে এসেছি তোমাকে এখানে, সব ছেড়ে। যদি তুমি সুস্থ হয়ে যাও।
অন্য কিছুই নয় বিশ্বাস করো। কাল রাতে যে কিভাবে, আমি সত্যি সরি মহুয়া। কালই যাবার
ব্যবস্থা করবো, তবে দুদিন সময় হয়তো লাগবে আমার।”
চুপচাপ খাবার শেষ করে ঘরে উঠে এলাম আমি। বুকটা হঠাৎ খুব ফাঁকা লাগছিল। একটা
অনির্দিষ্টকালের বাসস্থান হঠাৎ শেষ হয়ে গেলে এমনই হয় বুঝি? নিজেকে বারবার
সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, আমি তো ওকে সুস্থ করতেই এনেছিলাম এখানে। সেটা যখন ভালোভাবে
হয়ে গেছে, এখন তো ফিরে যাওয়াই উচিত। কিন্তু কোথাও যেন একটা চিনচিনে কষ্ট ছড়িয়ে
যাচ্ছিল বুকের ভেতর। ঘরের দরজা বন্ধ হবার আওয়াজে তাকিয়ে দেখলাম মহুয়া।
– “রুদ্রদা? তুমি এত ভীতু কেন?”
আমি আবার হাঁ হয়ে গেলাম, কিছুই বুঝছি না যে।
– “তোমার ডাইরি পড়েছি আমি কালকেই। আমি বরাবরই জানতাম তুমি আমারই ছিলে, কিন্তু
এতবছর ধরে? তারপর এতদিন একসাথে থাকলাম, একবারও আমাকে বলতে পারলেনা? কেন এত কিছু
করছো আমার জন্য তুমি? কেন কেন? মহুয়ার চোখে জল দেখে আমিও কেমন যেন হয়ে গেলাম। সব
ভুলে আবার জড়িয়ে ধরলাম ওকে, আর আমার ঠোঁট ছুলো ওর ঠোঁট। সেই যেমন আদিঅন্তকালের
ভালোবাসার সেই একমেবদ্বিতীয়ম প্রকাশ। মহুয়ার নিজেকে আমার কাছে সমর্পণ, সেই এক
শান্তির প্রলেপ ছড়িয়ে দিল বুকে। এবার গোটা দুনিয়ার সাথে লড়াই করার শক্তি আমার
কাছে।