লিখেছেন – সায়নী ভট্টাচার্য্য
রাত সাড়ে নটার সময় সৈকত বাড়ি ফিরে এলো ।
এসে দেখে বাবা , মা দুজনেই বসে আছেন । কি বলে যে ওদের সান্ত্বনা দেবে তা ও নিজেই বুঝে উঠতে পারলো না । ছেলের শুকনো মুখ দেখে ওনাদেরও বুঝতে বাকী রইল না কি হয়েছে।অলক্ষ্যে দুজনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।সুধীরবাবু ছেলের অবস্থা দেখে থাকতে না পেরে স্ত্রীকে বলেই ফেললেন,
“বুঝলে রমা দোষটা আমারই।আমার ভুলের জন্যে ছেলেটা শাস্তি পাচ্ছে এতদিন ধরে।কিন্তু আর না,অনেক হয়েছে।এবার একটা চুড়ান্ত ফয়সালা দরকার। কাল সকালেই আমি তথাগতবাবুর সঙ্গে কথা বলব।”
“যা ভালো বোঝো করো,তবে ছেলেটা আমার সত্যি খুব কষ্টে আছে গো।” বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন সরমাদেবী।
সারাদিন খুব ধকল গেছে শারীরিকভাবে,মানসিকভাবেও,তবু কিছুতেই ঘুম আসছে না সৈকতের।চোখ বন্ধ করলেই ভেসে ওঠে আজ থেকে ঠিক একবছর আগের দিনটি। অব্যক্ত যন্ত্রণায় একটা কথাই ওর মন বলে, “কেন তৃণা কেন ? শুধু আমার গায়ের রঙটাই তোমার চোখে পড়লো,আমার ভালোবাসাটা দেখলে না!!এতটাই ঘৃণা করো তুমি আমায় !!” অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে একের পর এক ঘটনাগুলো জেগে ওঠে সৈকতের মনের আঙিনায়।
গতবছর এইদিনেই সৈকত আর তৃণা আবদ্ধ হয়েছিল বিবাহবন্ধনে। সৈকতের বাবা সুধীরবাবু ছিলেন তৃণার বাবা তথাগতবাবুর সহকর্মী। যদিও পরবর্তীতে তথাগতবাবুর পদোন্নতি হয়েছিল আর হার্টের অসুখের কারণে সুধীরবাবুকে অগ্রিম অবসর নিতে হয়েছিল। তবুও ওনাদের বন্ধুত্বে ঘাটতি হয়নি কোনোদিন। সৈকতকে তথাগতবাবু সবসময়ই অন্যচোখে দেখতেন।মিতভাষী,বুদ্ধিমান,দায়িত্বশীল এই ছেলেটি শুরু থেকেই ওনার নজর কেড়েছিল। ভেবেছিলেন ‘অতি আদরে বাঁদর’ মেয়েটিকে এই ছেলেটাই সামলাতে পারবে আর ওনাদের বন্ধুত্বও একটা নতুন নাম পাবে। কথাটা সুধীরবাবুকে বলতে তিনিও সানন্দে রাজি হয়ে যান। সৈকত যদিও একবার সামনাসামনি তৃণার মতামত জানতে চেয়েছিল, কিন্তু তথাগতবাবু নিজের মেয়ের স্বভাব ভালোভাবেই জানতেন, সুতরাং বিষয়টি তিনি সযত্নে এড়িয়ে যান। একরকম তড়িঘড়িভাবেই ওদের বিয়েটা হয়ে যায় দুমাসের মধ্যে।
ফুলসজ্জার রাতে যখন সৈকত তৃণার হাতে আঙটি পরাতে যায়, প্রায় ছিটকে তৃণা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়।রাগে ফুসতে ফুসতে সৈকতের দিকে আঙুল তুলে বলতে থাকে,” খবরদার, ভুলেও আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করবে না বলে দিলাম।ভাবলে কি করে তোমার মতো একটা কালো ভুতকে আমি পছন্দ করব ? শুধুমাত্র পুঁথিগত বিদ্যা থাকলেই হয় না, আজকালকার দিনে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়েও চলতে হয়,যা তোমার মতো একজন ব্যকডেটেড লোকের পক্ষে অসম্ভব।”
“তাহলে রাজি কেন হয়েছিলে এই বিয়েতে ?” আহত গলায় জিগ্যেস করেছিল সৈকত।
” বিয়েতে রাজি আমি কোনোদিনই ছিলাম না, বাধ্য হয়েছিলাম সবার জোরাজুরিতে।কিন্তু ভুল ভাঙলো শুভদৃষ্টির সময়।” বলে ক্ষোভে কেঁদে ফেলল তৃণা।
“তার মানে বিয়ের আগে তুমি আমার ছবিই দ্যাখনি ?” অবাক বিষ্ময়ে প্রশ্ন করে সৈকত।
“বাবার উপরে বিশ্বাস করেছিলাম।ভেবেছিলাম বাবা অন্তত আমার জন্য একটা সুশ্রী পাত্র ঠিক করেছে।কিন্তু এভাবে যে ঠকে যাব ভাবিনি।” কেঁদে কেঁদে বলল তৃণা।
সেদিনের পর থেকেই নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিল সৈকত।ঝগড়াবিবাদ কোনোদিনই সে পছন্দ করত না।তাই সেদিনও জিজ্ঞেস করতে পারলো না, “ঠকলোটা আসলে কে তৃণা ? তুমি না আমি !!”
বিয়ের পর তৃণার জীবনে খুব একটা পরিবর্তন হয়েছে বলে বোঝা যায় না। সে আগের মতোই বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয়, ক্লাবে যায়।সুধীরবাবু বা সরমাদেবীও বিশেষ কিছু বলতেন না।তৃণাকে ওনারা নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। একদিন এক বান্ধবীর জন্মদিনে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ড্রিংক করে বাড়ি ফেরে তৃণা।নেশার ঘোরে কাছে টেনে নেয় সৈকতকে।জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি সৈকতও।রাতের অন্ধকারে একাত্ম হয়ে যায় দুটি শরীর।কিন্তু তার পরিণতিটা যে কতটা ভয়াবহ, সৈকত তা টের পায় পরদিন সকালে, যখন তৃণা সরাসরি সৈকতকে দায়ী করে এই ঘটনার জন্য।কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই, রাগে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় তৃণা।সুধীরবাবু, সরমাদেবী যদিও কয়েকবার গেছিলেন তৃণাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য, সৈকত একবারও যায়নি।
…………………………….
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তৃণা বুঝতে পারে তার শরীরের পরিবর্তনগুলো। বুঝতে পারে যে এখন আর সে একা নয়, আরোও একজন আসতে চলেছে খুব শিগগির এবং এই সময়ে একটি মেয়ে যা চায় সেও তাই চাইছে।কিন্তু মুখ ফুটে কাউকে বলতেও পারছে না।কি বলবে, যাকে একসময় নিজে চুড়ান্ত অপমান করেছে, যার অকৃত্রিম ভালোবাসাকে নিষ্ঠুর ভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে তাকেই এখন একবার দেখার জন্য মন ছটফট করছে।কবে যে এই ব্যকডেটেড, কালো ভুতটা ওর মনে জায়গা করে নিয়েছে তা সে নিজেই টের পায়নি আর যখন পেল ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে। মানছে সে প্রচুর ভুল করেছে,অন্যায় করেছে তা বলে কি একবারও ওকে ক্ষমা করা যায় না…একবারও এসে বলা যায় না, “তৃণা ফিরে চলো।আমি তোমায় নিয়ে যেতে এসেছি।” কেন মা,বাবা এসে ওকে নিয়ে যাবে, “সে” এসে নিয়ে যেতে পারেনা !!স্বামী হিসেবে ওর কি কোনো অধিকার নেই স্ত্রীর উপর!! সেজন্যই তো আজ যখন সৈকত এসেছিল, তৃণা সামনে পর্যন্ত যায়নি। কেন যাবে সে !! সৈকত তো আর তার জন্য আসেনি, এসেছিল ওর সন্তানের জন্য।
ভাবতে ভাবতে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে তৃণা ,”কেন সৈকত কেন ? একবার অন্তত বলতে পারতে ‘চল তৃণা বাড়ি চলো’।জোর করে টেনে নিয়ে যেতে সঙ্গে।এখন এতটাই ঘৃনা করো তুমি আমায়!!!”
……………………………
“হ্যালো, সৈকতদা, আমি তৃণার বৌদি বলছি”।
”হ্যাঁ বৌদি বলুন… আপনার আওয়াজটা ওরকম শোনাচ্ছে কেন ? সব ঠিক আছে তো?” নিশ্বাস বন্ধ করে একটা আগাম দুঃসংবাদের অপেক্ষা করতে থাকে সৈকত।
“বলছিলাম, আপনি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন ?আসলে…..”
“কোন হস্পিটাল নাম বলুন, আমি এখনই যাচ্ছি”।বৌদির কথার মধ্যেই বলে উঠে সৈকত। হাসপাতালের নাম জেনে তখনই বেড়িয়ে পড়ে।
আধঘণ্টা পরে যখন সৈকত হাসপাতালে পৌঁছায়, তৃণার বাড়ির সকলেই প্রায় সেখানে উপস্থিত।কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় তথাগতবাবু বলেন যে, কিছুদিন ধরেই তৃণা খুব চুপচাপ ছিল,ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতো না,বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরেই কাটাতো।আজকে সকালে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়।
এমন সময় ডাক্তার ইমার্জেন্সি কেবিন থেকে বেরিয়ে আসেন।
“তৃণা কেমন আছে ডাক্তারবাবু ?” অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত রেখে প্রশ্ন করে সৈকত।
“এখন স্ট্যবল আছেন যদিও জ্ঞান ফিরতে কিছুটা সময় লাগবে,বাচ্চাও ঠিক আছে।আর প্লিজ, ওনার খাওয়াদাওয়ার প্রতি অল্প লক্ষ্য রাখবেন।দুর্বলতার কারণেই উনি অজ্ঞান হয়েছিলেন।”
…………………………………
মাথায় আলতো একটা হাতের স্পর্শে চোখ খুলে তাকায় তৃণা।দেখে সৈকত মাথায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায় সকালের ঘটনা।নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় গর্ভে।কান্নাভেজা গলায় জিজ্ঞেস করতে থাকে,
“আমার সন্তান ঠিক আছে তো সৈকত? ওর কোনো ক্ষতি হয়নি তো ? তুমি হয়তো ভাবছো আমি ইচ্ছে করেই এমনটা করেছি।কিন্তু বিশ্বাস করো, সত্যি আমি কিছু করিনি।খুব,খুব ভালোবাসি আমি ওকে।”
“আমার থেকেও বেশি ?”
সৈকতের প্রশ্নে কান্না থামিয়ে অবাক চোখে তাকায় তৃণা।
“কি হলো, ওমনভাবে তাকিয়ে আছ যে ? আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না ?”
“তুমি এসব……”
” প্রথমত, ‘আমাদের’ সন্তান একদম ঠিক আছে। দ্বিতীয়ত, তুমি এটাই ভাবছো তো, আমি কিভাবে তোমার মনের কথা জানলাম ? বৌদি বলেছে,কাল রাতে আমি তোমাদের বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসার পর তুমি খুব কাঁদছিলে।আর এটাও লক্ষ্য করেছে যে, তুমি ইদানিং প্রায় সময়ই আমাদের বিয়ের অ্যলবাম দেখো।আমি ফোন করলে আড়ি পেতে শোনো।”কথাগুলো বলতে বলতে সৈকত লক্ষ্য করে তৃণার গালদুটো হাল্কা আবির রঙে ছেয়ে গেছে।
“ওহ্.. তার মানে বৌদি না বললে সত্যিটা তুমি জানতে পারতে না বলো।”
“কিভাবে জানবো তৃণা, তুমি তো আমাকে সুযোগই দিলে না। রাগের মাথায় বাড়ি ছেড়ে চলে এলে।একবারও আমার কথা ভাবলে না।” বলতে বলতে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল সৈকতের চোখ থেকে।দুর্বল হাত দিয়ে সৈকতের চোখ মুছে তৃণা বলল,
“তুমিও তো আমাকে আটকালে না।একবারও এলে না আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি তোমার জানো। আমার সেইদিনের বলা কথাগুলো, বাড়ি ছেড়ে চলে আসা, সব তোমার মনে আছে সৈকত, কিন্তু আমার স্বভাবের পরিবর্তনগুলো তোমার চোখে পড়ল না !!! তুমি অফিস থেকে ফিরতে দেরি করলে বারবার তোমাকে ফোন করতাম।তোমার সঙ্গে খাওয়ার জন্য মিথ্যে বাহানা করতাম।অফিসে যাওয়ার আগে তোমার ঘড়ি, রুমাল চুপচাপ টেবিলে রেখে দিতাম।” কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলে তৃণা।
“ভুল তো আমরা দুজনেই করেছি আর তার শাস্তিও পেয়েছি।জানো তৃণা, ‘অভিমান’ জিনিসটা খুব মারাত্মক,কত সম্পর্ক যে এইজন্য নষ্ট হয়ে যায়!! অনেক তো হলো,এবার চলো আমরা দুজন …এইরে….সরি, তিনজন মিলে নতুনভাবে সংসার শুরু করি যেখানে শুধু ভালোবাসা, বিশ্বাস আর আনন্দ থাকবে।” বলে তৃণার হাতটা শক্ত করে ধরে সৈকত।
দিনের শেষে অস্তগামী সূর্যও যেন এখন ক্লান্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে চায়।পাখিরাও সব ব্যস্ত নিজেদের নীড়ের টানে।সেইসঙ্গে মান- অভিমান দূরে সরিয়ে দুটি মনও নতুন আশায় ফিরে যেতে চায় নিজেদের পুরনো গন্তব্যে।।।
অভিমান – Oviman (বাংলা গল্প )
Leave a review
Leave a review