##অকাল বিয়ে
লিখেছেন – মৌমিতা দত্ত
আজ সকাল থেকেই মলিদের বাড়িতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগার মতো অবস্থা। মলির বাবার হাইপ্রেসার থাকা সত্ত্বেও এতো বেশি হাইপার হয়ে উঠেছেন যে তাকে সামলানোর জন্য মলির মা – এর প্রায় পাগলের মতো অবস্থা।
এদিকে মলিও বাড়ির আবহাওয়া গরম দেখে এসবের ফাঁকেই সৃজনকে বিকেলে দেখা করার জন্য ম্যাসেজ করে দিয়েছে। অবশ্য সৃজনই এখন সব ওর কাছে। কারণ, আর মাস দুয়েক পর সে সৃজনের ঘরণী অর্থাৎ অর্ধাঙ্গিনী হতে চলেছে। তাই সব কথাই সৃজনের জানা উচিত। আর সত্যি বলতে আজকের ঘটনার পর ওর আর এ বাড়িতে থাকার বেশি ইচ্ছাও নেই। আসলে যে দাদা এতোদিন ওর আদর্শ ছিল সে আজ যা ঘটনা ঘটালো তাতে করে আর যাইহোক তাদের বাড়ির মান সম্মান বলতে আর কিছু রইলো না।
এদিকে মলির বাবার চিৎকার থামছে না। উনি বলেই চলেছেন, “কুলাঙ্গার ছেলে কোথাকার। বংশের নাম ডোবাচ্ছ। বাপ কাকাদের মান সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছো লজ্জা করে না। তোমার মতো ছেলে জন্মানোর সময় যে কেন মরে গেলোনা আজ ভাবছি।
আজ বাদে কাল যার বোনের বিয়ে সে কিনা এরকম একটা জঘন্য কাজ করলো। কাল যদি তোমার বোনের বিয়ে ভেঙে যায় তার জন্য দায়ী তুমি থাকবে বুঝেছো।”
মলির দাদা পার্থর অবশ্য সেই একই উত্তর, “আমি কোনো ভুল করিনি বাবা তুমি আমাকে ভুল বুঝছো আমাকে। শিল্পী খুব ভালো মেয়ে বাবা।”
“হ্যাঁরে বাবু ভালো মেয়ে তো বটেই , তাইতো বাচ্চা সমেত তোর ঘাড়েই ঝুলে পড়লো। এ রকম গুণধর মেয়ে যদি আমার হতো আমি কেটে রেখে দিতাম। নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার। প্রথম স্বামীকে খেয়েছে এখন তোমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছে। কোথায় ভেবেছিলাম মেয়ের বিয়ের পর ছেলের বিয়ে দিয়ে বৌমা আনবো ঘরে। সবই আমার কপাল।” এইবলে মলির মা নীতা দেবী হা হুতাশ করতে থাকেন।
“কিন্তু মা বিদ্যাসাগর মহাশয়ই তো বিধবা বিবাহ চালু করে গেছেন অনেক আগেই। আমি যে প্রথম এই বিয়ে করলাম তা তো নয়।”
“থাক বাবা ক্ষেমা দাও। আমার ঘাট হয়েছে বলা। তুমি তোমার এসব লেকচার স্কুলে দিও শুনতে ভালো লাগবে। আমাকে দিওনা আমি তো তোমার মা। তোমাকে বেশি লেখাপড়া শেখানোই আমাদের উচিত হয়নি। তাহলে আমাদের বুড়ো বুড়িকে এই দিন দেখতে হতো না, তার আগেই আমাদের গঙ্গা প্রাপ্তি ঘটতো।” কথাগুলো বলে চুপ করে যান নীতা দেবী।
“গিন্নী চুপ করে যাও আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এ হল অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী। সব জেনে বুঝে গেছে। নিজেকে নায়ক মনে করছে। ত্রাতার ভূমিকায় অন্যকে উদ্ধার করে বেরাচ্ছেন। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে তাকে ঘরে এনে তুলেছে।”কথাগুলো খাটে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে মলির বাবা।
যখন বড়োরা নিজেদের মধ্যে বাগবিতন্ডায় ব্যস্ত। তখন দরজার কাছে চুপ করে দু’বছরের বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিল্পী। কারো মনের সদস্যা হতে গিয়ে সে যে তার পরিবারের এই চরম অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে সেটা বুঝতে পেরে তার শুকনো চোখের কোণও টলটলে দিঘীর মতো জলে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
“শোনো মা আমার এই কাজের জন্য আমি যদি তোমাদের চোখে অপরাধী হয়ে থাকি তাহলে আমাকে ক্ষমা করো। আমি যদি বিদ্বান না হয়ে, মাস্টার না হয়ে মূর্খও হতাম তা হলেও আমি শিল্পীকেই বিয়ে করতাম।
আমি ওকে দয়াও করিনি, করুণাও করিনি।
আচ্ছা মা একটু ভেবে দেখোতো আজ যদি মলির বিয়ের পর কোনো দুর্ঘটনা ঘটে। তাহলেও কী তুমি একই কথা বলবে?”
“কী বললি! ওগো শুনছো আজ বাদে কাল আমার মেয়েটার বিয়ে আর ও এসব কী অলক্ষুণে কথা বলছে।”
মলির বাবা চুপ করে বসে থাকেন শুধু।
পার্থ আবারও বলে ওঠে,”মা , আমি উদাহরণ দিয়েছি মাত্র। আচ্ছা মা, তুমিও তো একজন শিক্ষিকা ছিলে। কতো মানুষের জীবনের ভীত তৈরিতে তোমার হাত আছে। তাদেরও তুমি যা যা শিক্ষা দিতে তা কী শুধুই তাদের শেখানোর জন্য নাকি নিজের জীবনের ক্ষেত্রে শিক্ষার পরিভাষাটা আলাদা ছিল।
আচ্ছা মা তুমি ভাবছো তুমি সমাজে মুখ দেখাবে কী করে? আর আমি ভাবি যে সমাজ একটা মেয়েকে শুধু তার নিয়ম শৃঙ্খলে পেঁচিয়ে যন্ত্রণা দেয় , আমি অন্তত নিজেকে সেই সমাজের একজন হিসাবে ভাবিনা।
বিয়ে সমাজের তৈরী নিয়ম, অন্যত্র বিয়ের পর একটা মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়াও সমাজের নিয়ম, বিধবাকে কোনো কারোর স্ত্রী হতে দেখলে তাকে দুশ্চরিত্রা আখ্যা দেওয়া সবই সমাজের নিয়ম।
আবার নারী অগ্রগতির ঝান্ডা নিয়ে মিছিলেও নামে এই সমাজেরই লোকজন।
তাই বলছি সমাজের সঠিক ভাবনা সমাজ এখনো ভেবেই উঠতে পারেনি। আর এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক সমাজের নিম্নগামী মানসিকতাকে আমি সমর্থন করিনা।
তোমার তো বৌমা প্রয়োজন ছিল তা কী তুমি পাওনি? চেয়ে দেখো একবার।
আর সম্মানের কথা বলছো। বড়ো আচ্ছাদনের তলায় সকলের চোখে বড় হয়ে বাঁচাটাই যদি সম্মান হয়ে থাকে তাহলে নিজের বিবেকের কাছে বড় হয়ে বাঁচাটাই আমার কাছে সম্মানের।
আজ যদি আমি বিয়ে না করতাম শিল্পী উদ্ধার হতো না বা সৃজন যদি বিয়ে না করে মলি উদ্ধার হবে না একথা সম্পূর্ণ ভুল। কারণ,আমি মনে করি আমরা জীবনে চলতে কারোর হাত ধরি তার সাথে জীবনের পথটা একসাথে চলার জন্য, তাকে দয়া করার জন্য নয়।
এইটুকুই বলার ছিল আমার । তবুও যদি তোমাদের মনে হয় আমি ভুল করেছি আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা।”
বাবার ডাক শুনে পার্থর পা জোড়া থেমে গেলে। পরিমল বাবু উঠে এসে পার্থকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠেন, “আমাদের হয়তো সঠিক শিক্ষার অভাব হয়ে থাকলেও আজ বলতে লজ্জা নেই ছেলে হিসাবে তোমার শিক্ষায় কোনো গলদ নেই বাবা। তুমি সঠিক কাজ করেছো। আমরা আবেগ প্রবণ হয়ে গোটা দুনিয়ার কথা ভাবতে বসেছিলাম। তুমি চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে জীবনের মানেটা। এখন বেশ বুঝতে পারছি আমাদের দুনিয়া একটাই আর সেটা হলে তোমরা।” স্নেহের আলিঙ্গণে বাবা ছেলে দুজনের চোখেই তখন জল।
এতোক্ষণে বরণ ডালা সাজিয়ে নীতা দেবীও হাজির। সেই মঙ্খল শঙ্খ ধ্বনি আর উলু ধ্বনিতে চারিদিকে তখন যুদ্ধ শেষে সন্ধির আভাস ছড়িয়ে পরছে।
————————-