রথযাত্রার ইতিহাস 2024 – পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস, আচার ও রীতি – Rath Yatra History In Bengali

sudiproy877
8 Min Read

রথযাত্রার ইতিহাস

রথযাত্রার কথা শুনলে আমাদের সবার সামনে যে ছবিটা ভেসে উঠে সেটা হচ্ছে হাজার হাজার ভক্তেরা জগন্নাথ দেব, সুভদ্রা ও বলরাম কে রথে বসিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাদের মাসীর বাড়িতে। রথের সামনে ছড়িয়ে পরছে পুষ্পবৃষ্টি , হরি নাম কীর্তনে মুখরিত চারিদিক।এমন ছবি ই ভেসে আসে আমাদের চোখে।


 
সবার আগে কঠোপনিষদ থেকে দুটি লাইন উদ্ধৃত করব।
 
“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।
 
বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন: প্রগ্রহমেব চ।। (১/৩/৩)
 
এর অর্থ হচ্ছে –
 
“এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। তার মানে দাঁড়ায়
ঈশ্বর আমাদের অন্তরে থাকেন। তাঁর কোন রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত”
 

পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস

Loading...
জগন্নাথদেবের রথযাত্রা
 
ঠিক এই কথা পবিত্র বেদ এ বলা হয়েছে আবাঙমানসগোচর শব্দের মাধ্যমে। যার মানে হলো মানুষের বাক্য এবং মনের অতীত। আমরা মানুষ তাই তাকে মনের ভাবের সাথে মিলিয়ে সাজাই।
 

রথ বলতে স্বাভাবিক ভাবে আমরা বুঝি প্রাচিন কালে যুদ্ধে ব্যাবহৃত চাকা যুক্ত ঘোড়ায় টানা যান।

 
এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই জগন্নাথদেবের রথযাত্রা কিভাবে এলো আমাদের মাঝে। তা জানতে হলে আমাদের কে ফিরে যেতে হবে মালবদেশ  যা বর্তমানে উড়িষ্যা নামে পরিচিত সে রাজ্যের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। কেননা রথযাত্রার সূচনা হয়েছিলো এই রাজার হাত ধরেই।
 
রথযাত্রার ইতিহাস 2024 - পুরীর রথযাত্রার ইতিহাস, আচার ও রীতি - Rath Yatra History In Bengali
Loading...
 
পদ্মপুরাণ এর বর্ণনায় পাওয়া যায় এই রাজার হাত ধরে রথযাত্রার ইতিহাস। তখন সত্যযুগ, মালবদেশ এর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলে শ্রী হরি তথা বিষ্ণু ভক্ত। তিনি গড়ে তুলেছিলেন  জগন্নাথধাম তথা শ্রীক্ষেত্র নামের পবিত্র মন্দির। কিন্তু মন্দিরে ছিলো না কোনো বিগ্রহ।একদিন এক সন্যাসীর আগমন ঘটে রাজপ্রাসাদে। রাজার সেবা যত্নে তুষ্ট হয়ে তাকে বললেন নীলমাধব ( ভগবান বিষ্ণুর আরেক রুপ) এর গুপ্তভাবে শবরদের মাধ্যমে পূজিত হবার কথা। নীল পর্বতের ধারেই ছিলো শবরদের বসবাস। সন্যাসীর কথা শুনে নীলমাধবের দর্শণের জন্য ব্যাকূল হয়ে গেলেন রাজা। তখন
সে ডেকে পাঠালেন তার পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতি কে এবং শবরদের দেশে গিয়ে খুজে আনতে বললেন নীলমাধবের মূর্তী কে।

জগন্নাথ দেবের রথযাত্রার ইতিহাস 

রাজার আদেশ অনুযায়ী বিদ্যাপতি গেলেন শবররাজ বিশ্ববসুর নিকট। সেখানে একবার জঙ্গলের মাঝে বিদ্যাপতি পথ ভুলে যায় ।তখন তাকে উদ্ধার করেন বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। যা হবার তাই হলো , বিদ্যাপতি ললিতার প্রেমে পরে গেল । এরপর রাজা দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির মাথার মধ্যে নীলমাধবের দর্শনের চিন্তা সে প্রথম থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সে অনেক বলে কয়ে ললিতা কে রাজি করালো নীলমাধবের দর্শন করানোর জন্য ।কিন্তু ললিতার শর্ত ছিলো যে তিনি বিদ্যাপতিকে চোখ বেধে নিয়ে যাবেন। বিদ্যাপতি গেলেন চোখ বেধে কিন্তু সাথে করে নিয়ে গেলেন যব এর দানা ।
 
আরো পড়ুন,
 
যাবার পথে ললিতার অগোচরে তিনি সেই দানা পথে ফেলতে ফেলতে ফেলেন চিহ্ন হিসেবে। নীল পর্বতে গিয়ে নীলমাধবের দর্শন পেয়ে বিদ্যাপতি ধন্য হলেন। এর পরে তিনি খবর পাঠালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। রাজা তার রথ , সৈ্ন্য নিয়ে এলেন নীলমাধবকে নিয়ে যেতে।কিন্তু শ্রীহরির লীলা বোঝা বড় দায়। রাজা পৌছে গিয়ে দেখলেন যে মন্দিরে নীলমাধবের বিগ্রহ নেই। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে কোথায় বলা হয় নীল মাধবে নীজে থেকেই লীন হয়ে যান, আবার কেউ বলে থাকেন যে শবরেরা নীলমাধবের বিগ্রহ লুকিয়ে রেখে দেয়।এতদূরে এসেও নীলমাধবের দেখা না পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন হতাশ হয়ে পরেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এ জীবন সে রাখবে না। ঠিক এই সময় আকাশ থেকে দৈববাণী শোনা যায়-

রথযাত্রা ২০২৪

“সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে দারুব্রহ্ম কাষ্ঠ, সেই কাষ্ঠখণ্ড থেকেই তৈরি হবে
বিগ্রহ” (অর্থাৎ নীলমাধবের বিগ্রহ)।
 
এরপর রাজা চলে আসলেন তার নিজ রাজ্যে। হঠাৎ এক রাত্রে রাজা সপ্নে দেখলেন, ভগবান শ্রী হরি তাকে বলছেন –
 
 “ আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্ম রূপে পাবে।”
 
রাজা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই স্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন এক খন্ড কাঠের টুকরা। হাতি সৈণ্য এনেও সেই কাঠ নড়ানো গেলো না। তখন শ্রী হরির সপ্নাদেশে খবর পাঠানো হলো শবররাজ বিশ্ববসুকে। তিনি আসার পর বিদ্যাপতি , রাজা ও বিশ্ববসু এই তিনজনে মিলে সেই কাঠের টুকরা নিয়ে এলেন রাজার প্রাসাদে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই 
কাঠ খোদাই করার মত ক্ষমতা কারোর ই ছিলো না ওই রাজ্যে। হাতুরি বা খোদাই করতে গেলেও তা সম্ভব হলো না।ভেঙ্গে যাচ্ছে বারবার।রাজা আবার চিন্তায় পরে গেলেন। ঠিক তখনি তার কাছে এলেন অনন্ত মহারাণা নামের এক ছুতোর। অনেকের মতে শ্রীহরি নিজেই এসেছিলেন ছুতোর হয়ে আবার মতান্তরে অনেকে বলে থাকেন বিশ্বকর্মা এসেছিলেন ভগবান এর আদেশে। 

জগন্নাথ দেবের ইতিহাস

সে বলল সে এই কাঠ খোদাই করে গড়ে দিবেন নীল মাধবের বিগ্রহ। কিন্তু তার একটি শর্ত হলো ২১ দিনের মধ্যে কেউ এই মন্দিরে প্রবেশ করবে না যতক্ষন পর্যন্ত তার খোদাই এর কাজ শেষ হয়। রাজা রাজি হয়ে গেলেন।দরজায় পাহাড়া বসল। কিন্তু বিপত্তি বাধালো ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুণ্ডীচা। তার আর অপেক্ষা মানছিলো না , কাজ শেষ হবার আগেই ১৪ দিনের মাথায় তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরে ঢুকে তিনি দেখতে পেলেন এক অদ্ভূত দৃশ্য। সেখানে নেই কোন ছুতোর, অসম্পূর্ণ অবস্থায় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি দেখে রানী ভিরমি খেলেন। একি মূর্তি! নীল নবঘন শ্যামল শ্রীবিষ্ণুর এমন গোলাকৃতি নয়ন, হস্ত পদ হীন, কালো মেঘের মতো গাত্র বর্ণ দেখে রানীর মাথা ঘুরতে লাগলো।
 
রাজা শুনে ছুটে এলেন । রানীর উপরে ক্ষিপ্ত হলেন এবং এও বললেন শর্ত ভঙ্গের কারনে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ছুতোর চলে গেছেন।
 
বিমর্ষ হয়ে পরলেন রাজা। কিন্তু ভক্তের কষ্ট ভগবান সইবেন কেন। সে রাত্রেই রাজাকে আবার সপ্নে দেখা দিলেন। তাকে বললেন তিনি এই রুপেই পূজিত হবেন। তার নিজস্ব কোনো আকার বা আকৃ্তি নেই । ভক্তেরা যে রুপ কল্পনা করে তার আরাধনা করেন তিনি তার কাছে ঠিক তেমন ই। তিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কে বললেন এই অসম্পুর্ন অবস্থায় ই তিনি পূজো গ্রহণ করবেন এবং তাকে পুরুষোত্তম ধামে স্থাপণ করা হয় যেন এবং সেখানেই তিনি পূজো গ্রহন করবেন।
 
আর এভাবেই প্রতিষ্ঠা হয় জগন্নাথ দেব এর। জগণ্ণাথ দেব এর এই রুপ নিয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে-
 
‘‘অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা
 
পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ ।
 
স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা
 
তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্’’ ।।

Rath Yatra History In Bengali

অর্থাৎ, তার লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তার পদ নাই, অথচ সর্বত্রই চলেন। তার চোখ নাই, অথচ সবই দেখেন। কান নাই, কিন্তু সবই শোনেন। তাকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা, তার রূপ নেই, আকার নেই। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীক রূপই হলো পুরীর জগন্নাথদেব। তার পুরো বিগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কারণ তার রূপ তৈরিতে মানুষ অক্ষম। শুধু প্রতীককে দেখানো হয়েছে মাত্র।
 
জগন্নাথ মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। রথ যাত্রার ইতিহাস সম্পর্কে এইটাই গল্প।
 
জগন্নাথের প্রধান উত্‍‌সব হল রথযাত্রা। পুরাণ অনুসারে বলা হয়- আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি যেটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’ এবং সাত দিন পরে সেখান থেকে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। রথে চড়ে ওই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ ও (উল্টো)রথ বলা হয়।
 
‘রথযাত্রা’ আবার পতিতপাবনযাত্রা, নবযাত্রা, গুণ্ডিচাযাত্রা, মহাবেদীযাত্রা, নন্দীঘোষযাত্রা নামেও পরিচিত🚩
 
জয় জগন্নাথ ।🚩🙏
 
 
আরো পড়ুন,
 
Tags –
Rath Yatra,

Share This Article