অনুভব
– অভিজিৎ বনিক
তুমি রান্নাঘর থেকে বাইরে যাবে, নাকি আমি রান্না বন্ধ করে চলে যাবো?
পেছন থেকে মালার চিৎকার শুনে অজয় থতমত খেয়ে রান্নাঘর থেকে দৌড়ে পালিয়ে
যায় অজয়।
মাছ ভাজাটা বসিয়ে রেখে মালা গিয়েছিল বিছানাটা তুলতে,ব্যস সেই সুযোগে অজয় এসে
রান্নাঘরে ঘুটুরঘুটুর করতে শুরু করে দিয়েছে।
আর তাই নিয়েই মালা অজয়ের উপর চিৎকার শুরু করে দেয়।
রান্না করতে করতে একা একাই বকবক করতে থাকে মালা।জীবনটা আমার অতিষ্ঠ করে দিলো
চব্বিশ বছর ধরে।
মালার পুরো নাম মালবিকা। এম, এ, ফাষ্ট ইয়ার পড়তে পড়তে একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনার
জন্য খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যায় এই প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক অজয়ের সঙ্গে।
বিয়ের পর থেকেই মালার ভেতরে একটা চাঁপা দুখ:,একটা রাগ সবসময় রয়েই গেছে।
মালা ছিলো অসামান্যা সুন্দরী। অত্যন্ত আধুনিক মনের মেয়ে।
সে সব সময় মনে মনে ভাবতো তার সঙ্গে বিয়ে হবে,একটা রোমান্টিক,আধুনিক, স্মার্ট
বয়ের সঙ্গে।
যার বাইকের পেছনে বসে পিঠে হাত রেখে সব সময় ঘুরে বেড়াবে মালবিকা। আর তার বর হবে
একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী।
রোমান্টিক লাভ স্টোরি গল্প
হা ভগবান, তার বদলে বিয়ে হল একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে।
একদম হাবাগোবা, অত্যন্ত সাধাসিধে। বোকাবোকা টাইপের।
জামাপ্যান্ট পর্যন্ত ইন করে পড়ে না।
তার থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতায় পর্যন্ত কম।
সে গ্রাজুয়েট, আর মালবিকা এম,এ,।
তাই সব সময় একটা,আক্ষেপ রয়ে গেলো মালবিকার মধ্যে।
সব কিছুতেই হাসি অজয়ের।
কোন সিরিয়াসনেস নেই ওর মধ্যে।
সব বিষয়েই অজয় মালার মতামত নেয়।
কোন কিছু করতে গেলেই, দেখতো মালা এটা ঠিক আছে নাকি, ওটা ঠিক আছে নাকি।
অসহ্য এই রকম পুরুষ মানুষ নিয়ে ঘর করা যায় নাকি?
তবু দাঁতে দাঁত চেঁপে চব্বিশ বছর ঘর করে এলো মালবিকা।
সব সময় ঘরে থাকতেই ভালোবাসে অজয়।আর মেয়েদের মত ঘরের কাজ করতে ভালোবাসে।
আর অদ্ভুত একটা জিনিস,মেয়েদের সব কাজ করতে পারে লোকটা।রান্না করা,বাসন মাজা,ঘর
মোছা,কাঁপড়কাচা,সব সব পারে, একদম গুছিয়ে করতে।
Bengali Romantic Love Story
বিয়ে হয়ে যখন এ বাড়ীতে প্রথম আসে তখন অজয় তাকে সংসারের কাজকর্মে অনেক হেল্প
করেছে।
ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছে,দাদা বিয়ে করে বউ নিয়ে বাইরে চলে গেছে।
এক দিদি ছিল।সেই রান্নাবান্না করতো, তার বিয়ের পর অজয়ই রান্নাবান্নার
দায়িত্ব তুলে নেয়।
বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে একার সংসার ছিল অজয়ের।
অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিলো না।তাই কাজের মানুষ বলে কেউ ছিল না।
সেই সংসারেই মালবিকা এসে এই জীবন যন্ত্রনার সম্মুখীন হয়।
অজয় বিয়ে করার এক বছর আগে চাকুরী পেয়েছিল।
তাই সংসারে খুব সচ্ছলতা ছিলো না।
তাই মালা খুব একটা শখ আলহাদ করতে পারেনি।
প্রথম প্রথম খুব কাঁদতো,এক এক সময় মনে হত সব ছেড়ে দিয়ে দূরে কোথাও চলে
যাই, কিন্তু কোথাও যেতে পারেনি।বিয়ের পর পরই মেয়ে হয়েছে, তার দু বছর পরেই আবার
ছেলে হয়েছে,ধীরেধীরে সংসারের গভীরে তলিয়ে গেছে মালা। কিন্তু কোনদিনও অজয়ের মনের
কাছাকাছি আসতে পারেনি মালা।
কিন্তু অজয় তার সীমিত ক্ষমতা দিয়ে আপ্রান চেষ্টা করেগেছে মালাকে সুখী করার।
নিজের জীবনটা অতি সাধারন ভাবেই কাটিয়ে দিয়েছে। নিজের জন্য একটা
সামান্য জিনিস পর্যন্ত করেনি।
ছেলেমেয়েকে অনেক কষ্ট করে মানুষ করেছে,
মেয়ের খুব ভালো ঘরে বিয়ে দিয়েছে।
আর ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিংএ ডিপ্লোমা করে আগামী সপ্তাহে ব্যঙ্গালুর চলে যাবে
বেসরকারি কোম্পানিতে জয়েন করে।
ব্যস এইতো মালবিকার জীবন।
জীবনের এইতো চাওয়া পাওয়া,কোথায় যেনো একটা শূন্যতা, কোথায় যেনো একটা না পাওয়ার
বেদনা,মালবিকার হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে আজও কাঁদে।
ছেলে চলে যাবে আগামী সপ্তাহে ব্যঙ্গালুর।মালবিকা আরো একা হয়ে যাবে।ভাবতেই
মালবিকার কান্না পেয়ে যায়। এই মানুষটার সঙ্গে একা কাটাতে হবে, ভাবতেই মালবিকার
খুব রাগ হয়।
ও ভাবছে ছেলে ব্যঙ্গালুর চলে গেলে কিছুদিন বাপের বাড়ী থেকে আসবে, একা একা।
একটি রোমান্টিক গল্প
ছেলের লাগেজ রেডি। আজই ব্যঙ্গালুর চলে যাবে।
অজয় এয়ারপোর্টএ যাচ্ছে ছেলের সঙ্গে, প্লেনে তুলে দিতে ছেলেকে। বিকেল ৭টায়
ফ্লাইট।
মালার শুখনো মুখের দিকে তাকিয়ে অজয় বুঝতে পারে, ছেলেকে ছেড়ে দিতে মালার খুব
কষ্ট হচ্ছে।
তাই অজয় মালাকে শান্তনা দিয়ে বলে, মন খারাপ কোরনা মালা,আমি
তাড়াতাড়ি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে আজ বাইরে খেতে যাবো।
বাইরে গাড়ীর হর্ন বাজতেই ব্যাগপত্রর নিয়ে অজয় আর ছেলে বেড়িয়ে গেলো ।
ছেলেকে সময়মত বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়ে ফেরার সময় তীব্র যানজটে আটকে পড়ে অজয়।
সে বাড়ীতে ফোন করে বলে,মালা আমি রাস্তায় যানজটে আটকে গেছি,মনে হয় না আমি রাত
১১টার আগে ফিরতে পারবো।
মালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে আচ্ছা, আর কি করা যাবে।
মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে।
বিয়ের পর খুব একটা বাপের বাড়ী যেতো না মালা।
যে হেতু এই বিয়েটা পছন্দ ছিলো না।
তবু যাইহোক অজয়ের থেকে কিছুদিন একা সে স্বাধীন ভাবে জীবনটা কাটাবে।
ছেলের টানে এতদিন সংসারে ছিল,ছেলেও চলে গেলো এখন সে স্বাধীন।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মালা ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয়।
অজয়কে বলে আমি কদিনের জন্য বাপের বাড়ী থেকে আসি।
মালা দেখলো কথাটা শোনার পরেই অজয়ের মনটা খারাপ হয়ে গেলো।খুব করুন মুখে ও উত্তর
দিলো যাও।
যদিও অজয় কোনদিন মালার কোন কাজে বাধা দেয়নি।
মালা সকাল সকাল রান্নাবান্না করে,সব কিছু গুছিয়ে পরিপাটি করে স্নান
সেরে, অজয়ের সঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়ে,বিকেল বিকেল বাপের বাড়ীর উদ্দেশ্যে
বেড়িয়ে পড়লো।
এতদিন পর মালাকে দেখে মালার মা বাবা ভায়ের বউ সব অবাক হয়ে গেলো।
সবাই খুব উচ্ছসিত হয়ে মালাকে আপ্যায়ন করলো।
নানা রকম গল্পগুজব শুরু করলো।
মালা ঘরে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ড্রইং রুমে এসে সোফার উপর বসলো।
বলল মা গতকালই বাবাই ব্যঙ্গালুর চলে গেছে।
মনটা খুব খারাপ।তাই তোমাদের এখানেই চলে এলাম।
ভাবছি কটাদিন এখানে নিশ্চন্তে কাটিয়ে যাবো।
মা বলল থাক না, তোর যে কদিন ইচ্ছে।
কিন্ত অজয়কেতো নিয়ে আসতে পারতি।
ও কটা দিন কাটিয়ে যেতো। মা বলল।
তুমি আর লোক পাওনি যে ও এসে আমার সঙ্গে কিছুদিন শ্বশুরবাড়ি কাটিয়ে যাবে।
সেদিন গল্প করতে করতে বেশ রাত হয়ে গেলো।
রাতে সবাই মিলে বসে এক সঙ্গে হইহই করে খাওয়াদাওয়া হল।
তারপর যে যার মত ঘুমাতে চলে গেলো।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মালা দেখলো রাত ১২টা।
ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় বিছানায় এলিয়ে দিলো মালা।
কিন্তু ঘুম আসছে না তো।
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ১৮+
ওতো বাড়ীতে বিছানায় গা দিলেই ঘুমিয়ে পড়তো, কিন্তু এখানে কেনো ঘুম আসছে না।
মাথাটা আবার অনেকদিন পর অসহ্য ব্যথা করছে।
কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে মালা শুয়ে রইলো,
যেই একটু তন্দ্রা এলো,অমনি দেখলো অজয় তার কপালটা টিপে দিচ্ছে।
বাড়িতে থাকার সময় মালার যখন অসহ্য মাথা যন্ত্রনা করতো তখন অজয় বুঝতে
পারতো, মালা কোন সময় অজয়কে বলতো না,অজয় নিজেই,মালার পাশে বসে ওর কপালটা টিপে
দিতো।
মালা চোখ মেলে দেখলো সে শুধু ভাবছে,কোথায় অজয়।
তার মানে যে লোকটাকে মনে হোত সে সহ্য করতে পারছেনা, সেই লোকটাই গোপনে মালার
হৃদয়ের এতটা জায়গা দখল করে আছে।
মালা বাড়ীতে থাকলে যে মানুষটা সংসারের সবার জন্য পরিপাটি, সেই মানুষটা কিন্তু
নিজের জন্য খুব খুব উদাসীন।
রান্না করে হয়তো নিজের জন্য রাখলেন, কিন্তু কখন খাবেন তার ঠিক নেই,পেনটা
কোথায়,মানিব্যাগটা কোথায়,তাকে খুঁজে দিতে হবে।
আর জামাপ্যান্ট পড়ার আগে পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতো,মালা কোন জামাপ্যান্টটা পরবো।
কিন্তু পাশাপাশি থাকার সময় এর মূল্যতো কোনদিন
বোঝেনি মালা।
তবে আজ কেন জীবন সায়াহ্নে এত আকুতি।
খালি মনে হচ্ছে লোক টা একা একা কি করছে?
ছেলেটা নেই,মেয়েটা নেই,তার সঙ্গে দুদন্ড কথা বলারও কেউ কেই।
এখানে তার সঙ্গে কথা বলার অনেকে আছে, মা আছে বাবা, ভাই আছে, ভাইএর বৌ
আছে,কিন্তু ওখানে মানুষটা সম্পূর্ণ একা।
ভাবতেই মালার বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রনা মোচড় দিয়ে ওঠে।
ঐ হাবাগোবা,গোবেচারা লোকটার মধ্যে এতটা যাদু থাকেত পারে,এটা এতদিনে মালা
রন্ধ্রে রন্ধ্রে উপলব্ধি করতে পারছে।শিরায় শিরায় “অনুভব ” করতে পারছে
যে জীবনের এই অবেলায় এসে তার পাওয়ার আর কিছু নেই। এভাবে ঐ নিঃস্বার্থ মানুষটাকে
একা রেখে পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক নয়।
সারারাত দুচোখের পাতা সে এক করতে পারেনি।
খুব ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে মালা আবার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নেয় নিজের
একটুকরো সুখের সংসারে ফিরে যাবার জন্য।
রোমান্টিক ভালোবাসার ছোট গল্প
বাড়ীর সবাই অবাক, এই গতকালই আসলি, আবার আজকেই ভোরবেলা বাড়ী চলে যাচ্ছিস, কি
ব্যাপার তোর?মা জিজ্ঞাসা করতেই মালা উত্তর দিলো,
ও তুমি বুঝবেনা মা, একটা কথা আছেনা, ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভাঙে, আমার
অবস্থাও হয়েছে তাই।
তড়িঘড়ি মালা বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
সকাল নটার মধ্যে বাড়ী পৌঁছে গেলো।
বাড়ীতে ঢুকে মালা শুনতে পেলো অজয় এফ,এম রেডিও চালিয়ে গান শুনছে।
দরজায় নক করতেই অজয় দরজা খুলেই ভুত দেখার মত চমকে ওঠে।এ কিকরে হয়? কালকে
গেলো আজকেই ফিরে এলো।
অজয়ের চোখেমুখে এক অনাবিল আনন্দের হাসি ফুটে ওঠে।
আর এই হাসিটা মালবিকার দুচোখ এড়ায় না।
হঠাৎ অজয় একটা অভিমানের সুরে বলে ওঠে, কি ব্যাপার মালা, তুমি বললে কদিন বাপের
বাড়ী থাকবে,
আর আজকেই চলে এলে?
মালা একটা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে ওঠে একটা বাচ্চা কে বাড়ীতে একা রেখে আমার কি আর
যো আছে বাপের বাড়ীতে গিয়ে দুদণ্ড সুখে কাটাবো।
অজয় হোহো করে হেসে ওঠে।
আর তখনই এফ,এম, রেডিওতে বেজে ওঠে শচিন কত্তার গান,” শূন্য এ বুকে
পাখী মোর ফিরে আয় ফিরে আয়…..”
আরো পড়ুন,
মন তুই আমার হবি – Premer Golpo 2021