রাজার হাসির গল্প – Rajar Hasir Golpo
অন্যজনের নাম নীল। গায়ক দুজনের প্রতি সম্রাট খুবই খুশি ছিলেন, এবং তাদের
দুজনের গান শোনার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে প্রায়ই লোকজন আসত। আরও গায়ক ছিল,
কিন্তু ওদের দু’জনের প্রতি সম্রাটের পক্ষপাতিত্ব ছিল একটু বেশি। এইভাবে দিন
যায়। নিজেদের খ্যাতি, প্রতিপত্তি এবং সম্রাটের পক্ষপাতিত্ব দেখে লাল ও নীল
দু’জনেই গর্ব বোধ করত। ক্রমশ আর সকলের চেয়ে তারা দুজনে নিজেদের অনেকটা যেন
আলাদা মনে করতে লাগল। তারা মনে করল সম্রাট আকবরের রাজত্বে তাদের কোনও
ভুল-ত্রুটি কিংবা অন্যায় অপরাধ ঘটলেও সাধারণ লোকের মতো তাদের বিচার হবে না।
এ-কথা ও-কথা বলতে বলতে রসিকতা করা হচ্ছে মনে করে সম্রাটকে হঠাৎ এমন একটা
অপমানজনক কথা বোকার মতো বলে বসল যে, দেখতে দেখতে সম্রাটের মুখখানা গম্ভীর হয়ে
গেল। সম্রাট বললেন, “তোমাদের এই প্রকার অসংযমের কী কারণ ঘটল। তোমাদের এই আচরণের
মানেই বা কী ?’
বাচ্চাদের হাসির গল্প
সম্রাটের গাম্ভীর্য দেখেও তারা ভাবল, তারা তো সম্রাটের খুব প্রিয়পাত্র, তাদের
কি আর কোনও শাস্তি হবে ? এই ভেবে তারা ক্ষমা চাওয়া দূরে থাক, সেই কথাটাই আবার
দাঁত বের করে কচলাতে লাগল—যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাবে।
স্পর্ধা দেখে সম্রাট এবার ভীষণ রাগতস্বরে বললেন, ‘এখনই এই মুহুর্তে তোমরা আমার
রাজ্য ছেড়ে যেখানে খুশি দূর হয়ে যাও। তোমাদের মুখ দেখাও আমার পাপ। আমার
রাজত্বে যেন আর কোনওদিন তোমাদের দেখতে না পাই, দেখতে পেলেই তোমাদের ফাঁসিকাঠে
চড়ানো হবে।’
সম্রাটকে শান্ত করবার আর কোনও পথ না পেয়ে অবশেষে তারা সভা ত্যাগ করে চলে যেতে
বাধ্য হল। না গেলে উপায় যখন নেই—কিন্তু এখন কোথায় থাকবে? এমন নিশ্চিন্ত
অন্নবস্ত্র আর বিশাল-বৈভব ছেড়ে তারা যাবে কোথায়? সুতরাং দিল্লির বাইরে না
গিয়ে তারা এক জঙ্গলে গিয়ে ভয়ে ভয়ে আশ্রয় নিল। দিনের বেলায় থাকত জঙ্গলে
গা-ঢাকা দিয়ে, আর রাত্রে বেরিয়ে শহরে এসে খাদ্যদ্রব্য কিনে নিয়ে যেত মাঝে
মাঝে। বড় কষ্টে কাটছিল তাদের দিন। কিন্তু ছ’মাস ধরে তারা এইভাবেই কাটাতে বাধ্য
হল এমনি করে। নিজেদের বোকামির জন্যই তাদের এই অবস্থা। অনেক দুঃখকষ্টের পর একদিন
রাত্রে আর কোনও উপায় না পেয়ে তারা এসে বীরবলের পায়ে কেঁদে পড়ল। ‘হুজুর আপনি
আমাদের মা-বাপ, আপনি আমাদের রক্ষা করুন।’ তাদের কান্না আর দুরবস্থা দেখে
বীরবলের মনে করুণার উদয় হল।
তাদের চিনত বহু লোক, এবং তাদের গানের ভক্তও ছিল অনেক। সুতরাং হঠাৎ দেখতে পেয়ে
লোকজনের ভিড় জমে গেল তাদের আশেপাশে। সম্রাটের শোভাযাত্রা আসছিল সেই পথ দিয়ে।
তিনি কাছাকাছি এসেই গায়ক দু’জনকে দেখতে পেলেন। বলা বাহুল্য, লোকলশকর তাড়া করে
গেল লাল আর নীলের পেছনে তাদের ধরবার জন্য। সম্রাটের আদেশ অমান্য! এবার
মৃত্যুদণ্ড । ভগবানেরও হাত নেই সম্রাটের আদেশ অমান্য করার। সকলে ওদের গান শুনে
ভালবাসত। দুর্জনরা বলল, ওদের শূলে দিলেই উপযুক্ত শান্তি আর যারা ওদেরকে ভালবাসত
তারা মনে মনে হায় হায় করতে লাগল। অবশেষে ওদের দু’জনের
উঠে বসল। সম্রাট প্রশ্ন করলেন, ‘কেন দূর হওনি আমার রাজ্য থেকে এখনও ? তোমাদের
কি মরণের ভয় নেই? নেমে এসো, ফাঁসিকাঠে অথবা শূলে চড়তে হবে।’ দুজন বলল,
জাঁহাপনা, আপনার হুকুম না মানা কারও কি ক্ষমতা আছে? আপনার হুকুম তামিল করব বলে
ছ’মাস ধরে দেশ-দেশান্তরে কত ঘুরে বেড়ালুম। কিন্তু যেখানেই যাই আপনার রাজ্যের
সীমানা আর শেষ হয় না—এমন বিরাট বিশাল এবং সীমাহীন আপনার সাম্রাজ্য।
হাসির ছোট গল্প
চড়েছি, সম্রাট। নইলে পৃথিবীময় আপনার রাজরাজত্ব। আমরা যাই কোথা? যেখানেই যাব
সেখানেই আপনার সাম্রাজ্য। এ সাম্রাজ্যের যেন শেষ নেই সম্রাট।’ সম্রাট খুশি হয়ে
তাদের ক্ষমা করলেন, এবং আবার তাদের নিয়ে গিয়ে সভাগায়কের আসনে বসিয়ে দিলেন এবং
মনে মনে খানিকটা হেসে চিন্তা করলেন, এই বুদ্ধিটা নিশ্চয়ই বীরবলের। বীরবলের
বুদ্ধি ছাড়া এমন কথা ওরা বলতেই পারে না! তবে এই ভেবে মনে শাস্তি পেলেন যে,
বীরবলের জন্য আজ এই দু’জন লোক ফাঁসি থেকে রেহাই পেল।
শক্তি—কেউ কারও চেয়ে কম যায় না। একদিন দুজনে পণ রেখে কুস্তি শুরু করল। পণের
শর্ত, যে জিতবে সে পরাজিতের শরীর থেকে এক সের মাংস কেটে নেবে।
আমার পিঠ থেকে এক সের মাংস কেটে নাও।’
যাবে, আমি তোমার বুক থেকে মাংস কেটে নেব ।
বুকের মাংস কেটে নিলে আমার তো মৃত্যু হতে পারে।’
বীরবলের ওপর দিলেন।
খুশি মাংস কেটে নিতে পারো। তবে একটা কথা, তোমাকে ঠিক এক সের মাংসই কেটে নিতে
হবে, এক রতি কম বা বেশি নিলেও চলবে না। আর তোমাদের পণের শর্ত ছিল এক সের মাংস,
তাই শুধু মাংসই নিতে পারবে, এক ফোঁটা রক্ত বের হলে তোমায় উপযুক্ত শাস্তি
দেওয়া হবে। এবার তুমি মাংস কাটতে পারো।’
পরাজিত পালোয়ান এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে গেল।
পাঠালেন, ‘জনশ্রুতি, আপনার প্রধান পারিষদ বীরবল খুবই বিদ্বান ও বুদ্ধিমান। আমি
একবার তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি অনুগ্রহপূর্বক যদি তাকে আমার এখানে
পাঠিয়ে দেন তাহলে বাধিত হব।’
পাঠিয়ে দিলেন।
মতো একই পোশাকে সবার সঙ্গে মিশে বসলেন। তাপর বীরবল সভাগৃহে প্রবেশ করলেন।
কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি সোজা সুলতাননের সামনে গিয়ে তাঁকে নমস্কার
করলেন।
নাকি?’
তাকাচ্ছেন কিন্তু বাকি সবাই আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাতেই তো আপনাকে আমি
চিনতে পারলাম।
বীরবলের প্রতি ঈর্ষান্তিব, বাদশা এ কথা জানতেন। বীরবলকে অপদস্থ করার অনেক
চেষ্টা করেও তাঁরা তা পারতেন না, এসব জেনেও বাদশা চুপ করে থাকতেন। একদিন হঠাৎ
বীরবলের অনুপস্থিতিতে একদল মন্ত্রী এসে বাদশাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বললেন ‘হুজুর
আমরা এমন কী অপরাধ করেছি যে জাঁহাপনা, আপনার সেবা করবার কোনও সুযোগ পাই না। যা
কিছু জ্ঞানবুদ্ধির কাজ, বিচারের কাজ, সেবার কাজ, সবই আপনি বীরবলকে দেন। দয়া
করে আমাদের ওপরেও কিছু ভাল কাজের দায়িত্ব দিন। দেখুন না বীরবলের চেয়ে আমরা
ভাল পারি কি না?
বা ভালবাসি, তোমাদেরকে তা করি না। কারণ বীরবলের অসাধারণ গুণ, সততা,
ধৈর্যবিচক্ষণতা ও সাধুতা যেন আমাকেও দিন দিন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাকে একদণ্ডও না
হলে আমার একদম চলে না, এটা তোমরা মিথ্যা বলোনি। কাজ অবশ্য তোমাদের আমি দিই না
আজকাল, কারণ জানি তোমরা বীরবলের মতো পারবে না বলে। বীরবলকে হিংসা কোরো না, সে
কিন্তু সত্যিই ভাল।’ ‘
জাঁহাপনা। কীসে আমরা অপারগ তা পরীক্ষা করে দেখুন। আমরা যদি বীরবলের মতো না পারি
তবে আপনি আর কোনওদিন আমাদের কাজ দেবেন না।”
আমাদের বিদ্যেবৃদ্ধি প্রকাশ পায়, এমন কাজ দিন, সম্রাট। আমরাও আপনার সেবা করতে
চাই। আমরাও প্রমাণ করে দেব, আপনার প্রিয় মন্ত্রী বীরবলের চেয়ে আমরা কোনও অংশে
কম নই।’ এমনি সব তোষামোদের কথা বলতে লাগলেন তাঁরা।
‘হাত দুই লম্বা এক টুকরো কাপড় নিয়ে এসো। ঠিক দুহাত লম্বা হওয়া চাই, কমও নয়
বেশিও নয়।”
সম্রাটের সামনে। অন্য মন্ত্রীরা হঠাৎ যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। এ আবার
কেমনধারা প্রহসন। সম্রাটের এই আচরণ তাঁদের কাছে ঠিক যেন বোধগম্য হচ্ছিল না।
তাঁরা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন সবাই। ভাবলেন, ‘দেখি সম্রাট এই কাপড়
দিয়ে কী করেন? সম্রাট ওঁদের সকলকে এবার পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর
একটি খাটের বিছানার ওপর সটান শুয়ে পড়ে বললেন, “ওই কাপড়ের টুকরোটা দিয়ে আমার
আপাদমস্তক ঢেকে দাও। যেন কোনওদিক বাদ না পড়ে। যদি পারো তবেই জানব তোমাদের
বুদ্ধির দৌড় কতদূর।
শিক্ষনীয় মজার গল্প
হুকুম। যেটি অসম্ভব সেইটিই যেন সম্রাট তাঁদের দিয়ে করাতে চান। দুহাত মাত্র
কাপড়ের টুকরো দিয়ে কি অত বড় দেহটা ঢাকা যায়? এ কোন দেশি কথা? আমরা কোনওদিনও
এমন অসম্ভব কথা শুনিনি।’ বললেন কেউ কেউ।
সম্রাটকে ঢাকবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু যা হওয়ার তাই হল। কেউই এই সামান্য
কাপড়ের টুকরোতে সম্রাটের দেহ ঢাকতে পারলেন না। যে যার মাথা থেকে যত রকমের
বুদ্ধি বের করলেন তাতে কিছুতেই কিছু হল না। মনে মনে সকলে সম্রাটের ওপর রাগ
করলেন। এ তো অসম্ভব ব্যাপার। এদিকে টানতে গেলে ওদিকে কুলোয় না ; গলা পর্যন্ত
ঢাকতে গেলে হাঁটু পর্যন্ত খোলা থাকে। মন্ত্রীরা একেবারে নাস্তানাবুদ। তাঁদের
কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ল। ওঁরা মনে করলেন, সম্রাট অপমান করার জন্যই এই
পন্থা বেছে নিয়েছেন।
বললেন, ‘মহারাজ এরকম অসম্ভব কাজ কেউ কোনওদিন করতে পারবে না। একমাত্র পরীরা পারে
হুজুর।
বীরবলকে বুঝিয়ে দেওয়া হল। বীরবল খাটের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, এ আর এমন কী, এ
তো খুব সোজা কথা! যে কেউই এ কাজ অনায়াসেই করতে পারবে। আমি মনে করেছিলাম বোধহয়
কিছু এমন কঠিন সমস্যা উপস্থিত হয়েছে। এখনই না গেলেই নয়, আমি বিরাট একটা কাজ
করছিলাম হুজুরের সাম্রাজ্যের জন্য, এমন সময়…।’
বিদ্যা-বুদ্ধি। বীরবল নিশ্চয়ই পরী নয়,মানুষ। মানুষ কখনও দুই হাত কাপড় দিয়ে ওই
বিরাট শরীরকে কোনওমতেই ঢাকতে পারবে না। অপমান হবেই হবে। দেখি কী করে ঢাকে সে
সম্রাটকে।’
ঝুঁকিয়ে দিলেন। তারপর সেই কাপড়ের টুকরোটা ছড়িয়ে সম্রাটের সর্বাঙ্গ ঢেকে
দিয়ে বললেন, ‘এখন ঠিক হয়েছে। দেখে নাও তোমরা সকলে ঠিকঠাক
কিন্তু আমরা যদি ওই বুদ্ধিটা করতাম তবে সফল হতাম। সম্রাট তাহলে আমাদের বুদ্ধির
দৌড় বুঝতে পারতেন। আমরা একেবারে হেরে ভূত হয়ে গেলাম। সত্যিই বীরবলকে বুদ্ধিমান
বলতেই হবে।
দিতে কে বললে? তোমাকে আমি এ-কথা তো আগে বলিনি বীরবল।’
বীরবল বললেন, ‘বুঝতে পাচ্ছি সম্রাট, এটা আপনারও আগে মনে হয়নি, ও বেচারিদের আর
দোষ কী? কিন্তু একটা প্রবাদ চলতি আছে জানেন তো হুজুর? যতটুকু লম্বা চাদর, ঠিক
ততটুকু পা সকলের ছড়ানো উচিত! আর এতটুকুও বেশি বা কম যেন না হয় হুজুর।
হলেন যে, বীরবলকে আর কোনওদিন ঘাঁটাতে সাহস হয়নি তাদের।
প্রিয় গল্প পড়তে নিয়মিত ভিজিট করুন আমাদের ওয়েবসাইটে।
ভালো থাকুন।..
Thank You, Visit Again…
Tags – Mojar Golpo, Hasir Golpo, Comedy Story